শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সূর্পণখা নিজের নাক কেটে যাওয়ার অপমানের বিচার চাইতে দাদা রাবণের কাছে গিয়েছিলেন। রাবণ ছিলেন সেই সময় একজন রাজা, যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। মানুষ কোনও কারণে যদি বুঝতে পারে বা মনে করে তাঁর কোনও ক্ষতি হয়েছে, তখন সেই ক্ষতির উপশম হিসেবে বিচার চায়। মানুষ বিচার চাওয়াকে নিজের অধিকার মনে করে। মানুষ নিজের তৈরি সমাজের মধ্যে স্বেচ্ছায় যেমন থাকতে চায়, তেমনই ভাবে এই স্বেচ্ছায় থাকার কিছু শর্ত বজায় রাখতে চায় নিজেদের মধ্যে।

এই স্বেচ্ছা আরোপিত শর্ত মেনে নেওয়া এবং মেনে চলার মধ্যে যে বিষয়টি প্রাধান্য পায়, সেটি হল সামাজিক চুক্তি। যুথবদ্ধ হওয়া যেমন একটি বেঁচে থাকার কৌশল, তেমন ভাবেই নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে নেওয়াটাও একটি কাঠামো নির্মাণ। এই কাঠামো কখনওই একমুখী নয়। বহুমুখী তো বটেই, আবার বহু ভাগে বিভক্তও। আর মানুষ মনে করেছেন, এই কাঠামো সমাজে মানুষের বেঁচে থাকাকে সহজ করবে।

মানুষ একদিনে এ ধরনের চুক্তি বা কাঠামো কোনওটাই নির্মাণ করে উঠতে পারেনি। দীর্ঘদিনের আলাপ-আলোচনা, পর্যালোচনা করে বাস্তব পরিস্থিতি লক্ষ্য করে নির্মাণ করেছেন। ভারতের আইন তৈরির ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ছয়টি দর্শনশাস্ত্রের ধারা কীভাবে সচেষ্ট থেকেছে মানুষের মধ্যে শর্ত বা নিয়মের উপস্থিতি এবং নতুন কিছু নিয়মের মেনে নেওয়ার কারণ বুঝিয়ে দিতে। মানুষের যুক্তিবোধ থেকে শুরু করে, জীবনের বা যৌথ জীবনের না না পরিস্থিতিতে কীভাবে শারীরিক, মানসিকভাবে মানিয়ে নিতে পারবে এবং নিজেকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আটকে না রেখে ক্রমেই বৃহৎ হতে থাকা জগতের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারবে এই বিষয়গুলি পরবর্তীকালে আমাদের ধর্মের আলোচনাতে আনা হয়েছে। ধর্মীয় আলোচনার মোড়কে পুনরায় বিষয়গুলি আমাদের প্রতি দিনের আলোচনায় বা চর্চায় এনে আমাদের শেখান হয়েছে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল আর নীতি নৈতিকতার বিষয়ের গুরুত্ব কতটা।
এখানে আমার মনে যে প্রশ্নটি উঁকি দেয় সেটি হল, এই নীতি নৈতিকতার পাঠে নারীর প্রতি বঞ্চনার বিষয়টি কি কখনও জায়গা পায়নি? আসলে আমরা বর্ণ বিভাজনের বা জাত পাতের মতো বিষয়কে নীতি নৈতিকতার মধ্যে স্থান দিয়ে নীতি নৈতিকতাকেই কিংবা জায়গা দিতে গিয়ে বিদেশি শাসকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে নারীদের আইনি সাহায্য করা আমাদের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে, আমাদের দার্শনিক চেতনার মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক দর্শনের প্রাবল্যকেই আসলে নির্দেশ করে?

ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকার সময় আমরা দেখতে পেলাম বিচার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন নজিরগুলির নথি রাখা থাকত। সেই নথিগুলি বিচার প্রক্রিয়াতে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থার মধ্যে এক আমূল পরিবর্তন এল এবং সেই ব্যবস্থায় বিচারক এবং উকিলের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এতটাই তাঁদের ভূমিকার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে তাদের বিচার প্রক্রিয়া জন জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যখন আমরা সংবিধান তৈরি করলাম তখন আমাদের অধিকার পাওয়া এবং রক্ষা করার বিষয়টি শুধু প্রথাগত, ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে সীমিত না থেকে একটি সংবিধানের সাহায্যে, সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে শক্ত কাঠামো তৈরি করলাম। এই কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হল আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতি এবং বিভিন্ন সময়ের আইনি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন নথি।

এর পরে প্রশ্ন আসে আমরা কি লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে পেরেছি আমাদের সমাজ থেকে? নারীরা কিংবা যারাই সমাজের প্রান্তিকতার শিকার তা যৌন প্রান্তিকতা (যারা এলজিবিটিআইএ+) হোক কিংবা পুরুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তারাও যখন বলছেন যে, তারা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং ন্যায় বিচার চাইছেন। আমাদের সমাজে সবাই কি লিঙ্গ সাম্য চাইছেন? সবাই কি সাম্যের স্বাধীনতা পেয়েছেন? এই দুটি প্রশ্নের দুটি দিক আছে। একটা দিক হল সমাজে আমরা সচেতন এই বিষয়ে জে কারা কারা বৈষম্যের শিকার হয়ে চলেছেন। অন্যদিকে এই বিষয় নিয়ে সচেতন জে আইনি রক্ষা কবচ পেলে কাদের কী কী অসুবিধে হবে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩৩: স্বাধীনতার চেতনা (লড়াই)— দমন করার চেতনা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

একদম যে কেউ সাম্যের স্বাধীনতা পাননি তা বলা অনুচিত হবে। আমরা অনেক সময় জানতে পারি না বা আমাদের জানতে দেওয়া হয় না যে আমাদের জন্য কী কী আইনি রক্ষাকবচ আছে। আমরা শুধুই ৪৯৮এ ধারা নিয়ে কথা বলতে থাকি। আমাদের এই আইনের ধারা নিয়ে জোর গলায় কথা বলার প্রয়োজন আছে। কথা না বললে নিজেদের প্রয়োজন বা অসুবিধের কথা বলে উঠতে পারব না। আর এই আসুবিধের কথা আলোচনা না হলে আমাদের যুথবদ্ধ থাকার সামাজিক চুক্তিগুলি অনেকটাই আলগা হয়ে যাবে।

প্রতি বছর আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করি, সংবিধানে কী কী মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রতি বছরই দেখেছি, বিশেষ কিছুই বলে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ তাঁরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি তারা এমন কিছু বিষয় নিয়ে বলছে সেগুলো এককথায় বললে বোঝায় নারীরা অনেক সময় নিজেরাই ইচ্ছে করে পুরুষদের ফাঁসিয়ে দেয়। পুরুষদের উপর অত্যাচার করে। এরকম ঘটনা গ্রামের থেকে শহরে বেশি ঘটে থাকে। তাই নারীদের উপর অত্যাচার হচ্ছে বিষয়টি তারা খুব গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চায় না। তখন তাদের জিজ্ঞেস করলাম, নারীদের উপর কি অত্যাচার কেউ করছে না? বা নারীদের উপর অত্যাচারের ঘটনা কোনগুলিকে বলব? এই ক্ষেত্রেও আমি দেখেছি খুব পরিষ্কার উত্তর তারা দিতে পারছে না। কেন উত্তর দিতে পারছে না তার একটি বড় কারণ তাদের সেই চেতনা না থাকা যে তারা কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সেটাই জানা নেই। সংবিধানে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “১৪ নং আর্টিকেলে বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান ও আইন সবাইকে সম ভাবে রক্ষা করবে। ১৫ নং আর্টিকেলে বলা হয়েছে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের সঙ্গে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্ম স্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না”।

আমরা কিন্তু আমাদের জন্য থাকা দুটি গুরুত্ব পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার মনে রাখার কথা ভাবি না। আমরা কি করি, পিতৃতন্ত্রের শেখানো নীতিকেই বিনা প্রশ্নে মনে করি ওটাই আসল আইন। তাই বৈষম্য করাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করি। আবার যদি মনে করেও থাকি এই অধিকার প্রয়োগ করব তাহলে কি নারীরা যথাযথ সাম্যের অধিকার ফিরে পায়?
আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: শুধু স্বাদে নয়, পুষ্টিতেও মাছের রাজা, একঝলকে জেনে নিন ইলিশের গুণাগুণ

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ

২০১৭ সালে ভারতে নারীদের উপরে হওয়া অত্যাচারের কারণে কত মামলা করা হয়েছিল এবং তার ফলাফল কী হয়েছিল এ নিয়ে একটি গবেষণা হয়। এই গবেষণাতে দেখা যায়, মুম্বই হাই কোর্টে ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ৭৮৭টি মামলা করা হয়েছিল ৪৯৮এ ধারাতে। এত সংখ্যক মামলার মধ্যে ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অভিযোগকারী জীবিত ছিলেন। ৩৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, কিন্তু ভুক্তভুগিরা মারা গিয়েছিলেন কিংবা আত্মহত্যা করেছিলেন বা তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল বিচারকরা ছেড়ে দিয়েছিলেন অভিযুক্তদের। কোনও কোনও বিচারক বিষয়টিকে আলাদা ভাবে দেখে অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে বোঝার এবং রায় দান করার চেষ্টা করেছিলেন।

পুরো বিষয়ের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, অত্যাচারের বিষয় প্রমাণ করার জন্য যখন শরীরের ক্ষত কিংবা ইচ্ছুক সাক্ষীদের আলাদা করা, চিকিৎসকের বয়ান প্রভৃতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার ছিল সেগুল হয়নি। তাই আদালতে অভিযোগও প্রমাণ করা যায়নি। এই ঘটনা এখনও হয়ে চলেছে। অত্যাচারের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা যখন করা হল তখন উকিলবাবুর বুদ্ধিতে অভিযোগকারীকেই নাস্তানবুত হতে হল। শেষে উকিলবাবুর বদান্যতায় সেই মেয়েটিকেই খুব সামান্য টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল। জেলা আদালত থেকে হাই কোর্ট অবধি যাওয়ার শারীরিক আর মানসিক জোর না থাকার কারণে সেই মেয়েটি নিজের লড়াই থামিয়ে দিতে বাধ্য হল।

আপনি এখনও যদি মহিলা কমিশনে কোনও বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ জানান, তাহলে দেখবেন প্রথমেই জানতে চাইবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে কিনা। মৃত্যু না হলে সেই ঘটনা বিশেষ উল্লেখ যোগ্য নয়। আপনার বিমা সংস্থা নারীর প্রজনন বা প্রজনন অঙ্গের কোনও সমস্যা খোঁজার ডাক্তারি পরীক্ষা হলে টাকা দেবে না, কিন্তু যদি কোণ প্রাণঘাতী অসুখ ধরা পড়ে মানে ক্যানসার বা কোণ টিউমার ধরা পড়ে তখন টাকা দেবে। আসলে আমাদের দেশে নারীদের অধিকার দেওয়ার বিষয়টি তার জীবনের শেষ প্রান্তে না পৌঁছলে কারও নজরে আসে না।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান

আমাদের দেশে জাস্টিস বর্মার মতো মানুষরা যতই চেষ্টা করুন না কেন, নারীদের কাজের জায়গা বা বাড়িতে যেখানেই সে অত্যাচারের শিকার হবে তাঁকে আইনি অধিকার এবং বিচার দিতে হবে বলে। একদল মানুষ ৪৯৮এ আইন বাতিল বা সংশোধনের কথা বলছেন। এই দলে থাকা মানুষেরা নিজেরা একত্রিত হয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। আমার এদের কাছে প্রশ্ন— এই আইন বাতিল হলে কি পুরুষদের (আমি ধরে নিচ্ছি এখানে বিষমকামী পুরুষের কথা বলা হচ্ছে) উপর বেআইনি অত্যাচারের অভিযোগ কমে শূন্য হয়ে যাবে? আর যে নারীরা অত্যাচারিত হচ্ছে তারা কোথায় যাবেন? তাদের আইনের অধিকার কি কেড়ে নেওয়া যায়? একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ৩০ শতাংশ বিবাহিত মহিলা গৃহ হিংসার শিকার হয়েছেন ২০২২ সালে। এই সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে ৮৭ শতাংশ মহিলা তাদের উপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখই খোলেননি। আর বেআইনি অভিযোগের পরিমাণ শতাংশের হিসেবে আসছে না।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আইনের অধিকার আমাদের সনবিধান এবং আইনের বইতে রয়ে গিয়েছে। আর কিছু মানুষ যারা পিতৃতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাসী তাঁরা উকিল, বিচারক যাঁরা সংখ্যাতে বেশি এবং মানসিকতাতে পিতৃ তান্ত্রিক তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি করা আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিতে চাইছেন কিছু মানুষকে সুবিধে পাইয়ে দেবেন বলে। অথচ এই বৈষম্য আসলে আমাদের যুথবদ্ধ হওয়ার নৈতিকতাকে নষ্ট করে দেয়, সেই ভাবনা ভাবছে না। এই ২০২৩ এ এসে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট নতুন হ্যান্ডবুক বের করেন তাতে বলা আছে একজন নারী কে নারী বলতে হবে তার ধর্ম, দেশ দিয়ে তাকে পরিচিত করা যাবে না। খুব সাধু উদ্যোগ কিন্তু আমাদের দেশের গালাগালি শুরু এবং শেষ হয় মহিলা দের ধর্ষণ করা দিয়ে সেখানে সাম্যের নীতি যত তাড়াতাড়ি প্রবেশ করবে ততই আমরা আশার উজ্জ্বল আলো দেখবো।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content