যে কোন মাছচাষেই, সে চারাপোনাই হোক বা বড় মাছই হোক না কেন—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন খরচের সাশ্রয়ের কথা ভাবতে হবে। চাষির আয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে, এ বিষয়ে এগোতে হবে। সীমিত খরচের মধ্যেই যদি ব্যবস্থাপনায় নজর থাকে, তবে বিভিন্ন জৈব উপাদানের আবর্তন ঘটিয়ে মাছ পরিপালন সম্ভব।
ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা, খাবার প্রস্তুত ও পুকুরে তা নিয়মিত নিষ্ঠাভরে প্রয়োগ করতে পারলে অনেকটাই ব্যয় সঙ্কোচ হয়। কারণ, মাছচাষে সিংহভাগ খরচ হয় খাবার কেনার জন্য। এ সব ছাড়াও পুকুরে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রাণীকণার পরিমাণ প্ল্যাঙ্কটন নেটের সাহায্যে যাচাই করে নেওয়া আবশ্যক। একাদিক্রমে তা যদি কম হয়, তাহলে পুকুরপাড়েই মাটি বা সিমেন্টের বড় পাত্রে তা বানিয়ে নেওয়া যায়। বিশেষকরে রোটিফার তো সহজেই কালচার করা যায়। দু’ তিন দিনের প্রশিক্ষণ এর জন্য যথেষ্ট।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-১০০: সঠিক পদ্ধতি মেনে মাছচাষ করলে বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার চারাপোনাও পাওয়া সম্ভব
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী
একটি সহজ উপায়ে পুকুরের মধ্যে কয়েকটি কঞ্চির সঙ্গে আঁখের ছিবড়ে (রস বের করে নেওয়ার পরে অবশিষ্টাংশ) জড়িয়ে পুকুরে পুঁতে দিলে অল্প কদিনের মধ্যেই তার গায়ে পেরিফাইটন অণুশৈবাল জন্মায় না কিছু মাছের, বিশেষকরে রুই-এর খুবই পছন্দের খাবার। এ ছাড়া পুকুরে মাঝে মাঝে যে জৈব সার প্রয়োগের দরকার হয়, সেটাও পুকুরপাড়ে সহজে তৈরি করে নেওয়া যায়। এর জন্য কয়েকটি উপকরণ দরকার, সেগুলি হল: গোবর, গোমূত্র, বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে নির্গত স্লারি, সামান্য সর্ষে/বাদামখোল, চিটে গুড়, অ্যাজোলা ফার্ন এবং সেই সঙ্গে বাড়ির রান্নাঘর থেকে প্রাপ্ত ভাতের ফ্যান, শাকসব্জি ও ফলের খোসা।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি
মাটিতে একটি গর্তে খুঁড়ে তার মধ্যে এই সব উপাদান দিতে হবে। এরপরে পরিমাণমতো জল দিয়ে রোজ একটি লাঠি দিয়ে সেগুলিকে রোজ মিশিয়ে দিতে হবে। ক্রমে পচন হয়ে গেলে ওই জৈব সার পরিমাণ মতো নিয়ে ও তাতে জল মিশিয়ে বাতিল করা স্যালাইনের বোতল কিংবা প্লাস্টিক বোতলের মাধ্যমে ড্রিপ পদ্ধতিতে দিতে পারলেই তা প্রাণীকণার বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ঘরোয়া ভেষজপদ্ধতির শরণাপন্ন হওয়া যায়। এর জন্য মূলত দরকার নিমপাতা ও কাঁচাহলুদ বাটা। এর সঙ্গে কিঞ্চিৎ খাবার লবণ মিশিয়ে একইভাবে ড্রিপ পদ্ধতিতে দিতে পারলে রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা কমে যেতে পারে। মাছচাষ চলাকালীন কখনও কখনও জলজ পোকামাকড়ের উপদ্রব হতে পারে। পোকামাকড় থেকে নিস্তার পেতে হলে দু’ চারটি ফলুই মাছ কিংবা দেশি শিঙ্গি, মাগুর ছেড়ে দিলেই কাজ হবে। এই মাছগুলি উপদ্রব সৃষ্টিকারী পোকামাকড় ও তাদের ডিম, শূককীট, মূককীট খেয়ে ফেলে, এতে তাদের নিজেদের বাড়বৃদ্ধিতো তো হবেই, সঙ্গে পুকুরের জলও পরিস্কার থাকবে। এই সব অভিজ্ঞতালব্ধ পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে ব্যয়সঙ্কোচ হয় এবং মাছচাষি পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফলন নিশ্চিত করতে পারেন। —চলবে।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।