শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: লেখক

বাঙালির জীবনে যতই বিভিন্ন ও বিচিত্র পুরাণগাথা থাকুক না কেন, একটি পুরাণ ছাড়া কিন্তু বাঙালিজীবন এক্কেবারে অচল, আর সেটি হল বাঙালির মৎস্যপুরাণ। এই একটি পুরাণই দেশ-বিদেশে বাঙালির মাহাত্ম্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের মৎস্যপুরাণে মাছের যাবতীয় পুরাণগাথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে থাকবেন বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়

পর্ব – ২

মহাভারতে অর্জুনের লক্ষ্যভেদের গল্প মনে আছে তো? মনে থাকলে নিশ্চয়ই এও মনে আছে লক্ষ্যভেদ করার সময় গাণ্ডীবধন্য তার গাণ্ডীবের শর যোজনার সময় লক্ষ্য স্থির করেছিলেন কোন দিকে মনোনিবেশ করে? হ্যাঁ একদম ঠিকই ভাবছেন, মাছের চোখকে লক্ষ্য করেই অর্জুন তার লক্ষ্যভেদে সফল হয়েছিলেন। আমি আজ ঠিক এই জায়গা থেকেই আমার আলোচনা আরম্ভ করব। অর্জুন মাছের চোখের দিকে মনোনিবেশ করে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন একথা তো সবাই জানেন, কিন্তু কেন করেছিলেন তা জানেন কি? মাছের গোটা শরীরের মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল অঙ্গ হল তার চোখ, মাছের চোখ এতটাই ঔজ্জ্বল্যপূর্ণ হয়ে থাকে যে সেইদিকে মনোনিবেশ করে শর নিক্ষেপ করলে লক্ষ্যভেদ অনিবার্য। এ তো গেল অর্জুনের লক্ষ্যভেদের মূল মন্ত্র৷

কিন্তু আপনি জানেন কি অর্জুনের লক্ষ্যভেদের মূল মন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে আপনিও কিন্তু যত্নবান হয়ে উঠতে পারেন আপনার স্বাস্থ্যের প্রতি। দৈনিক ব্যস্ততার ফলে বাজারে গিয়ে মাছ কেনার সময় মাছ কতটা টাটকা বা মাছে সার দেওয়া আছে কি না অতশত লক্ষ করা সত্যিই সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কোনও প্রয়োজন নেই, খুব সহজেই আপনি কিন্তু বুঝে নিতে পারেন যে আপনি সার না দেওয়া কোনও টাটকা মাছ কিনছেন নাকি সার দেওয়া মাছ কিনছেন। তার জন্য আপনাকে প্রথমেই যেটি খেয়াল করতে হবে সেটি হল মাছের চোখ। যে মাছের চোখ যত বেশি উজ্জ্বল হবে জানবেন সেই মাছ তত বেশি টাটকা এবং সেই মাছে সারের পরিমাণ তত কম।

অনেকেই আমার কাছে জানতে চান যে মাছে আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন কারণে ফর্মালিন মেশানো হয়ে থাকে। ফর্মালিন মেশানো মাছ দীর্ঘদিন খেলে কি শরীরের কোনও ক্ষতি হতে পারে? সেক্ষেত্রে বলি, হ্যাঁ অবশ্যই ক্ষতি হতে পারে। অনেকে মনে করেন যে মাছ কিনে এনে ধুয়ে ফেলার ফলে বা নুন, হলুদ মাখিয়ে ফেলার পরে হয়তো ফর্মালিনের প্রতিক্রিয়া নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জেনে রাখা দরকার যে এটি একেবারেই ভুল ধারণা৷ কারণ আপনি যতই নুন, হলুদ মাখিয়ে রাখুন না কেন, যে মাছটি ফর্মালিনের প্রতিক্রিয়ার জোরে একটানা তিন দিন ধরে বিক্রি হচ্ছে সেই মাছটিকে আপনি মাত্র কিছু সময়ের জন্য নুন, হলুদ মাখিয়ে রাখলেই ফর্মালিনের সমস্ত প্রতিক্রিয়া নষ্ট হয়ে যেতে পারে না, কিছু প্রতিক্রিয়া অবশ্যই থেকে যায়, যে প্রতিক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে আপনার শরীরের কিডনি, লিভারের মতো বিভিন্ন অংশের ক্ষতি করতে পারে৷

আরেকটা বিষয় এই প্রসঙ্গে অবশ্যই জেনে রাখা দরকার, সেটি হল মাছে কিন্তু কেবলমাত্র ফর্মালিন নয়, বিভিন্ন রকমের সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে এবং সবথেকে মারাত্মক ক্ষতিকারক যে জিনিসটি মাছে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে অসময়ে আকার বৃদ্ধি করার জন্য অনেক সময়েই টেস্টোস্টেরন হরমোন প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে টেস্টোস্টেরন হরমোন প্রযুক্ত মাছ খাওয়ার ফলে এর প্রতিক্রিয়া কেবল আপনার শরীর নয় আপনার মগজেও সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অতিরিক্ত খিটখিটে হয়ে যাওয়া, সামান্য কারণেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলা বা হঠাৎ কোনও মানুষের সঙ্গে অসংযত ব্যবহার করে ফেলা, এই ধরনের সমস্যা যদি হঠাৎ আপনার মধ্যে দেখা দেয় তবে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি আপনার দৈনন্দিন মাছ খাওয়ার রুটিনটির দিকে অবশ্যই একবার নজর দেওয়া দরকার।

মাছে সার প্রয়োগ বর্তমান সময়ের একটি অত্যন্ত সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্তু এর ফলে ধীরে ধীরে আপনার শরীরে ও মস্তিষ্কে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে৷ তাই প্রতিদিনের ব্যস্ততা থেকে কিছুটা সময় বাঁচিয়ে হলেও মাছ কিনুন সতর্ক হয়ে। আপনার পাঁচ মিনিটের সতর্কতা কিন্তু আপনার আগামী পঞ্চাশ বছরের জীবনকে সুরক্ষিত করে তুলতে পারে৷

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content