সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

ক্যাবলারা কখনও সব কিছু মেনে নেয় নির্বিচারে, কখনও বা মানতেই চায় না। এই দু’রকমের মধ্যে প্রথম দলে যারা থাকে, তারা কেউ কেউ প্রতিপক্ষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না, কেউ বা ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের মতো সকলের পাশে থাকতে চায়, নিজেকে বিলিয়ে দেয়, ক্ষেত্র বিশেষে নিজেকে বিকিয়ে দেয়।

এদের লোভী, বোকা, ন্যাকা, পাগল, হামবড়া, গবেট, গণ্ডমূর্খ ইত্যাদি নানা নাম, যাকে বলে ব্র্যান্ড নেম। জেনেরিক ওই একটাই, ক্যাবলা। ক্যাবলামি থাকা মানে একরাশ বিচ্যুতিকে সঙ্গে নিয়ে চলা। ঠিক মাপে মাপে না চলতে পেরে পথের এদিক-ওদিক অসংলগ্ন যাতায়াত খালি, তাতে ব্যক্তিগত লাভের বদলে ক্ষতিই বেশি। সম্মান, মর্যাদা, ইমেজ, অমুকে কী বলবে, তমুক আমাকে দেখছে না তো ইত্যাদি প্রভৃতির চাপ ক্যাবলামিকে আরও বাড়িয়ে তোলে দমকে দমকে, এমনকী, এসব বিষয় নিয়ে ভাবাটাও যেমন ক্যাবলামি, তেমন না ভাবাটাও ক্যাবলামি বলেই মনে করা যায়।

মুখ বুজে মেনে নিয়ে শান্তিস্থাপনের অবিরাম চেষ্টা করে যাওয়া প্রশ্নহীন মানুষ এমন তকমা পেয়ে কোনঠাসা হয়, এমনকী প্রশ্ন না করতে পারা, প্রশ্ন না করতে চাওয়া ভীতুর ডিমের দল-ও ক্যাবলাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবকে বুঝে উঠতেই দেয় না, তারা নগণ্য হলেও আসলে অগণ্য।

এই দলটার আরেকটা শাখা সর্বদাই নিজের অস্তিত্ব জানাতে চায়, তারা মুখর, তাদের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা কখনও সঙ্গত, কখনও উচ্চকিত, কখনও অপ্রিয়। এরাও দিনের শেষে ক্যাবলা হয়ে ওঠে। টেনিদারা এদের দিকে ঘুষি পাকিয়ে ছুটে আসে। আর এ সবের বাইরে যে মহান সর্বজ্ঞ সবজান্তারা থাকে আর ক্যাবলা বলে সকলকে দাগিয়ে দিতে চায় তারাও আসলে এদের দলেরই, কারণ, সেই প্রাচীন গল্পটাতেই বলা ছিল। নগরের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরেও একমুঠো সর্ষে পাওয়া যায়নি সেদিন। এমন কোনও গৃহস্থ ছিল না নগরে যে দিতে পারে একমুষ্টি সর্ষের দানা, যাকে স্পর্শ করেনি কোনও মৃত্যুশোক।
তাহলে? যারা অপরের মৌনতাকে ক্যাবলামি বলে, মুখর হলেও ক্যাবলা বলে থামিয়ে দেয়, তাদের এই আত্মপ্রসাদ কি এসবের ঊর্ধ্বে নাকি? মানুষের ইতিহাস-পুরাণ অবশ্য অন্য কথা বলে, দেবতা, মহাপুরুষ আর ঋষিদের ভ্রান্তি সেখানে আকাশচুম্বী, আই গো আপ আর উই গো ডাউনের চক্করে পড়ে বাইরের চকচকে মুখ, মূর্তি আর ভাবমূর্তিগুলো ভারি গোলমেলে ঠেকতে থাকে।

এই তিন ধরণের পণ্ডিতন্মন্য, পণ্ডিতমূর্খ বা নেহাত আকাটরা যুক্তিতে পারঙ্গম। ফুটবল মাঠে বল কাড়াকাড়িতে ওস্তাদ। আশ্চর্য এই যে, সকলেই স্বতন্ত্রভাবে অদ্ভুতকর্মা, যুক্তিশীল। এদের কথা মনোগ্রাহী, চলা হৃদয়ে ঝড় তোলে, এদের এক একসময় আদর্শ বলে ভাবতে মন চায়। কিন্তু মনুষ্যসমাজে আদর্শ আচরণবিধি বলে কিছুর ধারণা থাকলেও বাস্তবে তা বুদবুদের মতো শূন্যগর্ভ। দেশ-কাল-ব্যক্তির মনোবৃত্তি আর সমাজদর্শন কখনোই আদর্শের ধারণা ও প্রয়োগকে সমধর্মী হতে দেয় না। একারণেই ব্যক্তি ও ব্যষ্টির বিচিত্র প্রকাশ, সংঘাত আর আপাত ক্যাবলামিতে ভরা জগত্ কিংবা আপাত এই জগতজোড়া ক্যাবলামির মায়াজাল।

যেমন এই ভদ্রলোক।

“লজিকের প্রফেসর গোকুলবাবুর শিকারের নেশা ছিল। শীতকালে কলেজের ছুটিছাটা পাইলেই তিনি বন্দুক লইয়া বাহির হইয়া পড়িতেন।… ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক গোকুলবাবুর মনটি ছিল অতিশয় যুক্তিপরায়ণ। অমোঘ যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়া তিনি বিবাহ করেন নাই; একটি স্ত্রীলোককে কেন তিনি সারা জীবন ধরিয়া ভরণপোষণ করিবেন ইহার কোনও যুক্তিসম্মত কারণই তিনি খুঁজিয়া পান নাই। অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবও কেহ ছিল না। তাঁহার কাছে এই সকল সম্পর্কের কোনও মানে হয় না। বস্তুত এই মানে হয় না কথাটা তাঁহার মনের এবং কথার মাত্রা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।” (কালো মোরগ, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়)

এহ বাহ্য। আগে কহ আর। আরেকজনকে একটু দেখা যাক। ইনি ভূষণ্ডীর মাঠের প্রাচীন যক্ষ। কালিদাস যার ভায়রা ভাই। ভূতপূর্ব জীবনে ইনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা, অভূতপূর্ব ভৌতিক জীবনে বৃক্ষবাসী এক ক্ষুধিতপাষাণ যক্ষ, স্ট্যাম্পপেপারে লেখা তামাদি হয়ে যাওয়া সম্পত্তির রক্ষক। হায় কুবের! যাই হোক, ইনি কী ভাবেন দেখা যাক।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

“বলব কি মশায়, আমি হলুম গিয়ে নাদু মল্লিক—কোম্পানির ফৌজদারি নিজামত আদালত যার মুঠোর মধ্যে—আমারই পিঠে দিলে কিনা এক ঘা চেলাকাঠ কশিয়ে! তার পরেই পালাল বাপের বাড়ি। তিনশ চব্বিশ ধারায় ফেলতুম, কিন্তু কেলেঙ্কারির ভয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আর ছাড়লুম না। কিন্তু যাবে কোথা? গুরু আছেন, ধর্ম আছেন। সাতচল্লিশ সনের মড়কে মাগী ফৌত হ’ল। সংসারধর্মে আর মন বসল না। জর্জটি সাহেব বিলেত গেলে আমিও পেনশন নিয়ে এক শখের যাত্রা খুললুম। তার পর পরমাই ফুরুলে এই হেথা আড্ডা গেড়েছি। ছেলেপুলে হয়নি তাতে দুঃখু নেই দাদা। আমি করব রোজগার, আর কোন আবাগের বেটা ভূত মানুষ হয়ে আমার ঘরে জন্ম নিয়ে সম্পত্তির ওয়ারিস হবে—সেটা আমার সইত না। এখন তোফা আছি, নিজের বিষয় নিজে আগলাই, গঙ্গার হাওয়া খাই।” (ভূশণ্ডীর মাঠে, পরশুরাম)

জন্মান্তরবাদ, অধ্যাত্মতত্ত্ব কিংবা মানুষের লৌকিক ইতিহাসটাই কেমন আপেক্ষিক আর মায়া বলে মনে হয় না? নাকি আদৌ এসব একটা বড় কৈবল্যবাদী ক্যাবলামির ছোট ছোট মণিরত্ন?
দেখা যাক মহেশ কি ভাবছেন। ইনি শরত্ চাটুয্যের নন, রীতিমতো মানুষ। পেশায় অধ্যাপক।

“নগেন জিজ্ঞাসা করিল—’আপনি দেখতে পেয়েছেন চাটুজ্যেমশায়?’

‘জ্যাঠামি করিস নি। এই কলকাতা শহরে রাস্তায় যারা চলাফেরা করে—কেউ কেরানী, কেউ দোকানী, কেউ মজুর, কেউ আর কিছু—তোমরা ভাব সবাই বুঝি মানুষ। তা মোটেই নয়। তাদের ভেতর সর্বদাই দু-দশটা ভূত পাওয়া যায়। তবে চিনতে পারা দুষ্কর। এই রকম ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন মহেশ মিত্তির।’
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

‘কে তিনি?’

‘জান না? আমাদের মজিলপুরের চরণ ঘোষের মামার শালা। এককালে তিনি কিছুই মানতেন না, কিন্তু শেষ দশায় তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছিল।’’

মহেশ মিত্র শ্যামবাজারের শিবচন্দ্র কলেজের অঙ্কের বিশিষ্ট অধ্যাপক, স্বভাবগম্ভীর, তার্কিক, সত্যবাদী ও মহানাস্তিক, সামাজিক বিষয়ে অনাচারী, বিপত্নীক। আত্মীয়দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই, জগতে একমাত্র বন্ধু সহকর্মী হরিনাথ কুণ্ডু। ইনি ভূত ভগবানে বিশ্বাসী, হাস্যমুখ, আমুদে আরেক বিশিষ্ট অধ্যাপক। দুজনের সম্পর্ক কখনও গলায় গলায়, কখনও সাপে-নেউলে কী আদায় কাঁচকলায়। কিন্তু তাঁদের আত্মিক টান অচ্ছেদ্য ছিল।

তর্কের আসরে মহেশবাবু কী
ভাবেন দেখা যাক। কাহিনীকার পরশুরাম, কাহিনী মহেশের মহাযাত্রা। সেকালের পরশুরামের হাতে ছিল কুঠার। একালের পরশুরামের কলম-ই কুঠার।

“মহেশবাবু বললেন,—’লোভ সকলেরই বেড়েছে, আর বাড়াই উচিত, নইলে মনুষ্যত্বের বিকাশ হবে কিসে।’ পণ্ডিতমশায় উত্তর দিলেন—’লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’ মহেশবাবু পালটা জবাব দিলেন—’লোভ ত্যাগ করলেও মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না।’’

লৌকিক জীবনের আলোচনা ক্রমে ঊর্ধ্বে উঠতে উঠতে পৌঁছল স্বর্গে। হরিনাথ কুণ্ডুর ভাবনা এইরকম —

“দীনবন্ধু পণ্ডিত বললেন—’কে বললে তুমি স্বর্গে যাবে? আর স্বর্গের তুমি জানই বা কি?’

‘সমস্তই জানি পণ্ডিতমশায়। খাসা জায়গা, না গরম না ঠাণ্ডা। মন্দাকিনী কুলুকুলু বইছে, তার ধারে ধারে পারিজাতের ঝোপ। সবুজ মাঠের মধ্যিখানে কল্পতরু গাছে আঙ্গুর বেদানা আম রসগোল্লা কাটলেট সব রকম ফ’লে আছে, ছেঁড় আর খাও। জন—কতক ছোকরা দেবদূত গোলাপী উড়ুনি গায়ে দিয়ে সুধার বোতল সাজিয়ে ব’সে রয়েছে, চাইলেই ফটাফট খুলে দেবে। ওই হোথা কুঞ্জবনে ঝাঁকে ঝাঁকে অপ্সরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, দু-দণ্ড রসালাপ কর, কেউ কিছু বলবে না। যত খুশি নাচ দেখ, গান শোন। আর কালোয়াতি চাও তো নারদ মুনির আস্তানায় যাও।’
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

মহেশবাবু বললেন—’সমস্ত গাঁজা। পরলোক আত্মা ভূত ভগবান কিছুই নেই। ক্ষমতা থাকে প্রমাণ কর।’’

মহেশ মিত্র অবিশ্বাসী সাহসী ও বেয়াড়া লোক, ভয় যদি বা আসতে চায়, তিনি তার পৌঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, তার আগে রামনামে তাঁর যুক্তিবোধ তাঁকে বাধা দেয়। নকল ভয়ের আয়োজন কিন্তু তাঁকে টলাতে পারে না। জুয়াচুরিতে গভীর তত্ত্বের মীমাংসা তাঁর মতবিরুদ্ধ, তাই হরিনাথ যখন তাঁকে মিথ্যে ভূতের ভয়ে কাবু করতে বিফল হলেন মহেশ দারুণ ধাক্কা খেলেন বৈকী।

“মানুষের মন যখন নিদারুণ ধাক্কা খায় তখন সে তার ভাব ব্যক্ত করবার জন্য উপায় খোঁজে। কেউ কাঁদে, কেউ তর্জন—গর্জন করে, কেউ কবিতা লেখে। একটা তুচ্ছ কোঁচবকের হত্যাকাণ্ড দেখে মহর্ষি বাল্মীকির মনে যে ঘা লেগেছিল তাই প্রকাশ করবার জন্য তিনি হঠাৎ দু—ছত্র শ্লোক রচনা করে ফেলেন—মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বম ইত্যাদি। তার পর সাতকাণ্ড রামায়ণ লিখে তাঁর ভাবের বোঝা নামাতে পেরেছিলেন। আমাদের মহেশ মিত্তির চিরকাল নীরস অঙ্কশাস্ত্রের চর্চা করে এসেছেন, কাব্যের কিছুই জানতেন না। কিন্তু আজ তাঁরও মনে সহসা একটা কবিতার অঙ্কুর গজগজ করতে লাগল। তিনি আর বেগ সামলাতে পারলেন না, কলেজের পোশাক না ছেড়েই বড় একখানা আলজেবরা খুলে তার প্রথম পাতায় লিখলেন—

হরিনাথ কুণ্ডু,

খাই তার মুণ্ডু।

কাবিতাটি লিখে বার বার ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে আদি কবি বাল্মীকির মতন ভাবলেন, হাঁ, উত্তম হয়েছে।

কিন্তু একটা খটকা বাঁধল। কুণ্ডুর সঙ্গে মুণ্ডুর মিল আবহমান কাল থেকে চ’লে আসছে, এতে মহেশের কৃতিত্ব কোথায়? কালিদাসই হ’ন, আর রবীন্দ্রনাথই হ’ন, কুণ্ডুর সঙ্গে মুণ্ডু মেলাতেই হবে—এ হল প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। মহেশ একটু ভেবে ফের লিখলেন—

কুণ্ডু হরিনাথ।

মুণ্ডু করি পাত।”
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৮: কালীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহানায়ক বলেছিলেন, ‘কাউকে বলো না’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এইভাবে বিরাট এক পদ্য লিখে মহেশ থামলেন। জগতের সকল চলাচলকে মহেশ কিংবা গোকুলবাবুরা অঙ্কের নীরস হিসেবে কিংবা নিজের লজিকে বাঁধতে আর মাপতে চান। কিন্তু তার পিছনে যে মহাকালের অন্তরীণ মহাবিজ্ঞান, তার থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখেন। আজি রজনীতে সেই মহাসত্যের দ্বারোদ্ঘাটন না হলেও শেষের মহারজনী এগিয়ে আসে। প্রেততত্ত্বের বিপুল অবিশ্বাসী চর্চার নেশা তাঁকে কঠিন ব্যধিগ্রস্ত করে মরণাপন্ন করল। দুঃস্বপ্নে তিনি দেখতেন ভূতে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। অবশেষে একদিন তাঁর জাগতিক লীলা ঘুচল, যে হরিনাথকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাঁকে ট্রাস্টি করে মহাভার দিয়ে গেলেন। কেমন সে কাহিনী?

“কিছুদিন পরে মহেশবাবুর খেয়াল হল—প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে এক তরফা বিচার করাটা ন্যায়সংগত নয়, এর অনুকূল প্রমাণ কে কি দিয়েছেন তাও জানা উচিত। তিনি দেশী বিলাতী বিস্তর বই সংগ্রহ ক’রে পড়তে লাগলেন, কিন্তু তাতে তাঁর অবিশ্বাস আরও প্রবল হল। প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছুই নেই, কেবল আছে—অমুক ব্যক্তি কি বলেছেন আর কি দেখেছেন। বাঘের অস্তিত্বে মহেশের সন্দেহ নেই। কারণ জন্তুর বাগানে গেলেই দেখা যায়। ভূত যদি থাকেই তবে খাঁচায় পুরে দেখা না বাপু। তা নয়, শুধু ধাপপাবাজি। প্রেততত্ত্ব চর্চা করে মহেশবাবু বেজায় চ’টে উঠলেন। শেষটায় এমন হ’ল যে ভূতের গুষ্ঠিকে গালাগাল না দিয়ে তিনি জলগ্রহণ করতেন না।”

একারণেই মৃত্যুশয্যায় তিনি জানালেন—

“হরিনাথ তোমায় ক্ষমা করলুম। কিন্তু ভেবো না যে আমার মত কিছুমাত্র বদলেছে। এই রইল আমার উইল, তোমাকেই অছি নিযুক্ত করেছি। আমার পৈতৃক দশ হাজার টাকার কাগজ ইউনিভার্সিটিকে দান করেছি, তার সুদ থেকে প্রতি বৎসর একটা পুরস্কার দেওয়া হবে। যে ছাত্র ভূতের অনস্তিত্ব সম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ লিখবে সে ঐ পুরস্কার পাবে। আর দেখ—খবরদার, শ্রাদ্ধ—ট্রাদ্ধ ক’রো না। ফুলের মালা চন্দন—কাঠ ঘি এসব দিও না, একদম বাজে খরচ। তবে হাঁ, দু—চার বোতল কেরোসিন ঢালতে পার। দেড় সের গন্ধক আর পাঁচ সের সোরা আনানো আছে, তাও দিতে পার, চটপট কাজ শেষ হয়ে যাবে। আচ্ছা, চললুম তা হ’লে।’’

মহাযাত্রায় মহেশ চললেন নিমতলা, হরিনাথের তত্ত্বাবধানে। শববাহকরা পথে একে একে কাত হল, মড়া হয়ে উঠল জগদ্দল, ক্রমে ক্রমে অন্ধকার ভেদ করে কারা সব এসে খাটের ভার নিল। আর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল অনন্তের পানে। আর হরিনাথ?

“হরিনাথ ছুটতে ছুটতে নিরন্তর চিৎকার করছেন—’থাম, থাম।’ ও কি, খাটের ওপর উঠে বসেছে কে? মহেশ? মহেশই তো। কি ভয়ানক! দাঁড়িয়েছে, ছুটন্ত খাটের ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিছন ফিরে লেকচারের ভঙ্গীতে হাত নেড়ে কি বলছে?

দূর দূরান্তর থেকে মহেশের গলার আওয়াজ এল—’হরিনাথ—ও হরিনাথ—ওহে হরিনাথ—’

‘কি কি? এই যে আমি।’

‘ও হরিনাথ—আছে, আছে, সব আছে, সব সত্যি—’

মহেশের খাট অগোচর হয়ে এল, তখনও তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে—’আছে আছে…’

হরিনাথ মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে ওয়েলেসলি স্ট্রীটের পুলিশ তাঁকে দেখতে পেয়ে মাতাল ব’লে চালান দিলে। তাঁর স্ত্রী খবর পেয়ে বহু কষ্টে তাঁকে উদ্ধার করেন।”

পণ্ডিতদের ক্যাবলামি আর ক্যাবলাদের পণ্ডিতিগুলোও এ ভাবে শেষ বা শেষে এমনতর হবে না তো?

শিরোনাম: পরশুরামের ভূশণ্ডীর মাঠে গল্প থেকে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content