রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

শিব্রামের ‘গল্পে’ দেখা যাচ্ছে জনৈকা শিক্ষয়িত্রীর অঙ্গুলিহেলনে জনৈক লেখক রেনপাইপ বেয়ে ওপরে উঠছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্লট তাড়া করতে করতে কোন্ এক ওঠার চক্করে পড়ে যান তিনি। শাস্ত্রে “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত” বলে আদা জল খেয়ে লাগতে বলেছে। ওঠার পরেই পড়া আসে। তো শিক্ষিকা মিস আইভির কাছে কোন্ পড়া শিখলেন তিনি? নাকি একেবারে পড়লেন… যাকে “পপাত চ” বলা হয়… ওপরে ওঠার নানা পদ্ধতির কথা শোনা যায়। তার মধ্যে নিজের শ্রীপদযুগল যেমন থাকে, অন্যের পদযুগল এমনকী বুদ্ধি, শ্রম কিংবা মই… নিদেনপক্ষে একটা মই হলেও অনেকদূর ওঠা যায়। তবে ওঠা যেমন কষ্টের, নামাটাও। মই কেড়ে নিলে তা দুঃসাধ্য হয়ে যেতে পারে বৈকি! আজ যিনি চেয়ার-টেবিলে, তাঁর ভূমিষ্ঠ হয়ে পদ্মাসনে বসতে বেজায় কষ্ট, যার যাওয়া-আসা আকাশপথে, ট্রাফিকজ্যামে তার নাভিশ্বাস, হাতি নিয়ে যার কারবার, মশা নিয়ে তার থোড়াই কেয়ার… জাহাজের কারবারির আদার খোঁজে কাজ নেই, খড়কুটো কিংবা Other যারা, তাদের কী কী হয়?
এ সব কথা অবশ্য মিস আইভি বলেননি। চেঞ্জে শিলং যেতে গিয়ে তিনি এমন একটা সমস্যায় পড়েন, যার সমাধান না করে তাঁর ট্রেনে ওঠার সাহস হয়ে ওঠে না। দরজায় চাবি পড়ে গেলে, মালপত্র গাড়ি করে স্টেশনে পাড়ি দিলে, ট্রেন ছাড়ার খুব একটা দেরি না থাকলে আর ওই কাজটা নিতান্তই সেরে ফেলতে গেলে, উপকারী বন্ধুর মতোই সেই বন্ধুর পথ পার হতে হয় বৈকি! তবে এসব কাজ নিজে করার মতো ক্যাবলামি আইভি ম্যাডামের ধাতে নেই। উঠতে হয় লেখককে। ওই পাড়ায় লেখক একজনই আর লেখকমাত্রেই, কর্মহীন অথবা, নিষ্কর্মা… তাই বন্ধঘরের কী এক অজ্ঞাত কর্মে রেনপাইপে পাড়ি দিতে হয় লেখককে। ওপরের দিকে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২০: তোমরা যা বলো, তাই বলো…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

পলেস্তারা খসা বাড়ি, জীর্ণ ইঁট আর শৈবাল-সঙ্কুল সেই পথ, নিচে শিক্ষয়িত্রীর মার্গদর্শন, লেখক কখনও নিজের বিছানাটি ভূতলে পেতে রাখার আর্জি জানান, কখনও ওপরতলায় পৌঁছনোর আগেই আরও ঊর্ধ্বলোকে পাড়ি জমানোর আতঙ্কে খিন্ন ও ক্ষুণ্ণ হন, ক্রমে তাঁর পদ বিপদ ও বিপথগামী হতে থাকে। কিন্তু নৈষ্কর্ম অবলম্বন করা যায় না, ট্রেনের যাওয়া আসার একটা সময় আছে, মানুষের না থাকলেও। শাস্ত্র-ও সর্বদাই কর্মী হতে উৎসাহ দিয়েছে। কর্ম ও জ্ঞানের বিরোধ কখনোই নেই। কর্ম করতে করতে নতুন নতুন শিক্ষা। তাছাড়া, “নাল্পে সুখমস্তি”…আর নিচে স্বয়ং শিক্ষয়িত্রী মিস আইভি মানসসুন্দরীর মতো প্রেরণা দিতে থাকেন। তো এইভাবে কর্ম অবলম্বন করে লেখকের নতুন জ্ঞান ও বোধোদয় ঘটতে থাকে। তাঁর ক্রমেই মনে হতে থাকে, তাঁর পদযুগল বিগত হলেও, সেই সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করেছে হাতদুটি।
এতে মানুষ থেকে নিম্নতর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হলেও, ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য তা অপরিহার্য নিশ্চয়ই… আত্মিক উন্নতি কী আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা শাস্ত্রে সুলভ, “ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া” যে উন্নতির মার্গ, তা নির্বিকল্প-ও তো বটেই! “নান্যঃ পন্থাঃ বিদ্যতে অয়নায়”… তাই ওপরে উঠতেই হয়! ওপরে কোনওমতে পৌঁছে জানা যায় যে বাতায়নপথ তাঁর লক্ষ্য, যেখানে দুটো লোহার শিক না থাকায় সেখানে প্রবেশের পথ সুগম, তা রুদ্ধ হয়ে আছে বন্ধ জানলায়, ঝরকা ওঠানো মুশকিল, তবে কি তীরে এসে তরী ডুববে? তোমার খোলা হাওয়ার থেকে বঞ্চিত-ই থেকে যাবেন কর্মী পুরুষ? আইভি নির্দেশ দেন, নেমে আসতে। একান্তই ঊর্ধ্বগমনের আগে সিঁদকাঠি কী একটা ছুরি কাছে রাখতে নেই বুঝি? লেখক হতবাক হয়েও হতে পারেন না বুঝি, একটা চোরা সন্দেহে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঊর্ধ্বে ঝুলে থাকেন। আইভি মানতে পারেন না, চোর যে কাজটা করে, লেখকের সেটা না করার কী কারণ থাকতে পারে! শাস্ত্রে কর্ম প্রশংসিত হয়েছে, আর জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ কিছুই অকরণীয় নয় যখন, তখন সিঁদকাঠির কী দোষ?
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

তবে, ওই বিপদশঙ্কুল বাড়ির দেওয়ালে যে বাড়াবাড়ি একেবারেই ভালো কথা নয়! হাতির সঙ্গে হাতাহাতি, ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি যদি চলেও বা, বাড়ির সঙ্গে বাড়াবাড়ি! “এক অনিষ্টকর ঘনিষ্ঠতা”র আলিঙ্গনে লেখক হাঁসফাঁস করে অনুযোগ জানান, রেনপাইপ জল নামানোর ব্যাপারে ওস্তাদ হলেও মানুষ তোলার ব্যাপারে তার গলদ আছে বৈকি! এসব তুচ্ছ বিষয়ে ভাবাতুর হতে চান না মিস আইভি! ট্রেন ছেড়ে যাবে যে! তিনি চটপট পা চালাতে বলেন। কিন্তু কোন্ পায়ের কথা বলছেন তিনি? লেখকের পা তো জবাব দিয়েছে। তবে কি সামনের হাত দুটোকেই পা বলে কটাক্ষ করছেন মিস আইভি! বিপদে মানুষের ওপরতলার সাজানো আবরণ খসে পড়ে, তখন শত্রুকেও বন্ধু বলে মনে হয়, হয়তো তা রজ্জুতে সর্পভ্রমের অধ্যাস, তবু তখন সেটাই মরীচিকার মতো সত্য তো বটে!! তবে হাতের-ও তখন পদচ্যুতি ঘটেছে, হোক না লেখকের হাত, বেহাত হল বলে!
সামনের হাত আর পেছনের পা, কিংবা সামনের পা আর পেছনের হাত, কিংবা… আগে-পিছের চারটে পা সামলে লেখক তার পুরুষার্থ সাধনের চেষ্টা করেন। দৌর্বল্য কাটিয়ে ওঠেন অর্জুনের মতো। অভীষ্ট অর্জন করে নিজেকে টারজান মনে হয় বুঝি? তবে তার আগে ছুরিটা নিতে নামতে হয়। গায়ের জামা থেকে চামড়া, সবকিছুর অংশবিশেষ সেই নামার পথে রেখে আবার উঠতে হয়। নামার সময় কম লাগে। উঠতে লাগে বেশি। এ তো নীতিকথার বইতেই থাকে! তবে চেনা রাস্তা আর জানা পড়া ঝালিয়ে নিতে বেগ বেশি পেতে হয় না, বেগে-ই হয়ে যায়। শেষে খোলে জানলা, গৃহপ্রবেশ ঘটে নতুন রকমের। অপ্রীতিকর কিংবা, চূড়ান্তকর গৃহপ্রবেশ।

কিন্তু ঘরের মধ্যে স্বয়ং আইভি এলেন কী করে আগেই? সিঁদকাঠির আগেই তিনি সিঁধোলেন কেমন করে বটে? রোমাঞ্চ জাগে। জানা যায়, চাবিটাবি ঠিকই আছে। হারায়নি। হারালো কখন বা, হারাবেই বা কেন? তবে এতো হাঙ্গামার জন্য ধন্যবাদ। বাড়ির সবদিকেই নিরাপত্তা অটুট। নিচের সদর থেকে ওপরের সব জানলা, একদম মেপে চেপে সপাটে আটকানো। সেখানে কোনও একজটা দেবীর উতল হাওয়া প্রবেশ করবে, এমন আশঙ্কা করা যায় না। কেবল গরাদহীন ওই জানালার পথেই জীবন মুচকি হাসছিল বুঝি? তাই, ওই পথে কিছু হারানোর সম্ভাবনা বা মাতাল হাওয়া ঢুকে পড়তে পারে কি না আদৌ তার জন্য এই একজাম। আর গপ্পোলেখা লেখক ছাড়া এমন দুস্তর পারাবার লঙ্ঘনের দুঃসাহস ক’জন দেখাতে পারে?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

তবে, জীবনের খিড়কি থেকে সিংদরজা, সদর থেকে অন্দর, কিংবা, হাইওয়ে-বাইপাসের মাঝে অলিগলি চলিরামের আড়ে-আবডালে এইসব ফুটপাথে ধুমধাম কতটা… জীবনের ওই সব গরাদহীন পথ “চুড়োবাঁধা মিনসেদের” কার্যকলাপের মাঝে কতটা নিরাপদ তা মাঝেমাঝে দেখে টিপে যাচাই করে নিতে হয় বৈকী!

শাস্ত্রে নামা-ওঠা কী ওঠা-বসা নিয়ে নানা ‘চলচিত্তচঞ্চরী’ আছে… নামতে নামতে পড়তে পড়তে উঠতে উঠতে শিখতে শিখতে যেতে হয়, একটা মাকড়সার থেকেও তা শেখা যায়। মাকড়সার বদলে মিস আইভি থাকলেও নীতিকথার বদল বুঝি ততটা ঘটবে না। তবে ‘ওঠা’ যখন এভাবে পাথরের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত, শ্যাওলায় পিচ্ছিল, রূপকের ম্যাজিক কার্পেট যখন গেছে সরে, শর্টকাট, ব্রিজকোর্স কী ফ্লাইওভারের মায়াকাজল মুছে গেলে… এই ‘নামা’ কী ‘পড়ার’ রূপকটাও যদি সরিয়ে নেওয়া হয়… তবে?

তবে বোঝা যায়, ওই সংশয়ের পথেও চলা খুব অনায়াস নয়, তাই নিশ্চিন্ত হয়ে হাওয়া বদলাতে, চেঞ্জে শিলং-এর লং যাত্রা করাই যায়! She, সেই তিনি, মিস আইভি পরম নিশ্চিন্তে এই এতখানি ত্যাগস্বীকারকে ধন্যবাদ দেন। তবে ততক্ষণে লেখক আরও বড় ত্যাগ স্বীকার করে ফেলেছেন। “মাটিতেই আমি নেমে এসেছি ততক্ষণে। মাথা ঘুরে গিয়ে, ঘুরপাক খেয়ে, পাইপ বেয়ে কী করে নেমে এসেছি, আমি নিজেই জানিনে।”

কবি একেই বুঝি আপন থেকে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানো বলেছিলেন। নিজেকে ভুলতে পারাই তো চরিতার্থ হওয়া। অহংহীন হয়ে এভাবেই বুঝি ত্রিগুণাতীত হতে হয়?

উঠতে উঠতে বড়, নাকি নামতে নামতে ছোট? নাকি উঠতে উঠতে নামতে নামতে ছোট থেকে বড় কিংবা, বড় থেকে ছোট হওয়া যায়? হতে হয়? ক্যাবলারা কি বড় হয়ে লেখক হয়? নাকি, বড়রা ক্যাবলা হয়ে প্রেমিক হয়? নাকি, প্রেমিকরা লেখক হয়ে বড় হয়? নাকি…—চলবে।

ঋণ স্বীকার:
শিবরাম চক্রবর্তীর “চূড়ান্তকর গৃহপ্রবেশ” অবলম্বনে
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content