সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

রাস্তায় কান পেতে শুনবেন, প্রত্যেকেই উত্তম, মধ্যম নয়, প্রথমও নয়। অথচ কী আশ্চর্য, সকলেই প্রথম হতেই তো চাইছে… আমি আর তুমি বাদে বাকি সকল জনগণেশ যদি প্রথম আদি শক্তি হয়, তবে আমি আর তুমি উত্তম-মধ্যম হয়ে কীসের উদযাপন করছি? তুমি নিজের কাছে উত্তম, সে-ও তো নিজেকে উত্তম বলবে… এই অহং থেকে নেমে এলে তবেই কি প্রথম হওয়া যায়?

তো ক্যাবলামিতে কে প্রথম হবে তা নিয়ে পঞ্চতন্ত্র চার পণ্ডিতমূর্খের গল্প বলেছে। চারজনেই ভাবত তারা বুঝি শাস্ত্রসাগর পার হয়ে পণ্ডিত হয়েছে। গুরুগৃহ থেকে ব্রহ্মচর্য শেষ করে বাড়ি ফিরতে গিয়ে…

আচ্ছা, আগে একটা কথা। আবার রাস্তায় চোখ রাখুন। স্কুল ফেরত ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরে। এতে অনেকেই বলবে, কই! আমি তো দিব্যি একাই বাড়ি ফিরি। বাড়িতে না ফিরলে পড়তে যাই। সেখান থেকে বেরিয়ে আরেক জায়গায় পড়ে বাড়ি ফিরি। তাকে কিছু জায়গার নাম জানতে চাওয়া হোক। কোন রাস্তা এসে কোন রাস্তায় মেশে, কোন নদী কোন সাগরে পথ হারায়, তারা বলবে সিলেবাসে নেই তো… আসলে… অ্যাকচুয়ালি হয়েছে কী…
তো সেই চার পণ্ডিতও বাস্তব জ্ঞান বিবর্জিত ছিল। তারা লাউয়ের খোলে বিশ্বের জ্ঞান বহন করছিল হয়ত, কিন্তু সেটি ফেটে গেলে তারাও নির্জ্ঞান… সেই পণ্ডিতমূর্খরা পুথি খুলে খুলে বাস্তবের ঘটনা পুথির নির্দেশে বুঝে নিতে চাইল।

আর নাকাল হল।

তারা দেখল, কুসীদজীবী সুদখোর মহাজনের দল চলেছে শ্মশানযাত্রায়। তারা পিছু নিল। কারণ শাস্ত্রে বলে “মহাজনঃ যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ”। সেখানে তারা গাধাকে ভাবল পরম বন্ধু, কারণ শাস্ত্রে বলে রাজদ্বারে-শ্মশানে ইত্যাদিতে যারা থাকবে তারাই বন্ধু। বন্ধু ইষ্ট জন। ইষ্টকে ধর্মের সঙ্গে যোজনা করতে হয় বলে তারা গাধাকে বাঁধল উটের সঙ্গে।

আর উত্তম-মধ্যম গণপ্রহার খেল খানিক।
তারপর তাদের ক্যাবলামি গগনচুম্বী হল। গল্প এগিয়েছে। একজন পণ্ডিত শাস্ত্র পড়ে ঝাঁপ দিয়েছে জলে। ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে সাঁতারু চৌবাচ্চায় ডুবে মরে, টেনিদা জানিয়েছিল। এখানে তবুও নদী, আর সেই নদী খরস্রোতা। পড়েই ভেসে যায় যায়। আরেকজন শাস্ত্র খুলে দেখল, তাতে বলা আছে, সর্বনাশ সমুত্পন্ন হলে পণ্ডিত অর্ধ ত্যাগ করবেন। যেটা করলে তখন লাভ আছে, সেটাই বুঝি শাস্ত্র করতে বলে। সেই পণ্ডিত জলে হাবুডুবু খাওয়া বিদ্যে বোঝাই বাবুমশায়ের মাথাটা কেটে নিল। মাথা দেহের শ্রেষ্ঠ অংশ, তাই ওটাই আর কী! তারপর হারাধনের যে কটি ছেলে বাঁচল, তারা এল একটি গ্রামে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা পুথিপত্রের আদেশ মেনে চলে না। তাদের ঘরে ডেকে গ্রামের লোকজন খেতে দিল। একজন পেল বড়া। বড়ায় ছোট ছোট ছিদ্র দেখে সেই পণ্ডিত শাস্ত্রবচন স্মরণ করল। ছিদ্রপথে বহু অনর্থ হয়। লখীন্দরের যেমন হয়েছিল আর কী! এতে ছিদ্রান্বেষীরা উৎসাহিত হবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সে ‘বেচারার’ খাওয়া আর হল না। আরেকজনকে লম্বা লম্বা সেমাই দেওয়া হল। সেও ভ্রূ কুঁচকে শাস্ত্রবচন দেখে জানল, ‘দীর্ঘসূত্রী বিনশ্যতি’, দীর্ঘসূত্রতার টালবাহানার ফলে বিনাশ অনিবার্য। অতয়েব সে লম্বা সুতোর মতো ওই সব খাদ্য গ্রহণ করল না। অথচ শাস্ত্রেই কোথাও বুঝি বলা হয়, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর!! তাদের বইতে সে কথা ছিল না বোধহয়!!
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু

তারা ঘরে ফিরেছিল ‘ক্ষুত্ক্ষামকণ্ঠাঃ’ হয়ে… তারা ছিল ‘দেশাচারবিবর্জিত’ ক্যাবলা…
কাট টু টেনিদা।

“পরস্মৈপদী? কে খাওয়াবে? আমাদের মতো অপোগন্ডকে খাওয়াবার জন্য কার মাথা ব্যথা পড়েছে?

টেনিদা বললে, তোর মগজে আগে গোবর ছিল, এখন একেবারে নিটোল খুঁটে। ওরে গর্দভ, আজ যে হালখাতা। দোকানে গেলেই খাওয়াবে।”

হালখাতার খাওয়া দাওয়া। প্যালা ও টেনিদা। বড়া বা সেমাই নয় নিশ্চয়ই, টেনিদার কুট্টিমামা গজগোবিন্দ হালদার এমনই নিমন্ত্রণ পেয়েছেন—”প্রিয় গজগবিন্দবাবু, অবশ্য আসিবেন। মাংস, পোলাও, দই, রসগোল্লার বিশেষ ব্যবস্থা হইয়াছে। ইতি আপনাদের চন্দ্রকান্ত চাকলাদার-প্রোপাইটার, নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি।”

এই নিমন্ত্রণ ‘রক্ষা’ করবে টেনিরাম। তাকে কে রক্ষা করবে? বিনা টিকিটের যাত্রীর মতো এই সুকুমারমতি দুই মহাত্মা দোকানে দোকানে কুট্টিমামার নিমন্ত্রণ এবং নিজেদের গা সযত্নে রক্ষা করছিল। শরবত, মিষ্টি, পান এবং তির্যক বাক্য সকলই নির্বিশেষে তারা উদরস্থ করছিল। শাস্ত্র বলেছে মোক্ষের পথ দুর্গম। হালখাতায় গেলে টাকা দিতে হয় বটে, তবে টেনিদা অতি তীক্ষ্ণধী মানুষ। তার সঙ্গীসাথীরা ক্যাবলা হলেও সে তো তা নয়, প্যালারামের সংশয়ের জবাবে সে বলেছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৫: হিচককের লন্ডন, হিচককের সিরিয়াল কিলার

“না দিলেই হল। দোকানদারেরা এসময় ভারি জব্দ থাকে জানিস তো? যত টাকাই পাওনা থাক না কেন-মুখ ফুটে চাইতে পারে না। যত খুশি খেয়ে আয়, হাসিমুখে বলবে, আর দুটো মিহিদানা দেব স্যার? চল প্যালা–এমন মওকা ছাড়তে নেই।”

এমন করে করে বাগবাজারে নস্য কোম্পানিতে। তারা রাজভোগ রেঁধে বসে আছে… ঠান্ডা হয়ে জড়িয়ে যাবে যে সব!!

“বাইরে একটা সাইনবোর্ড-তাতে প্রকাণ্ড নাকওলা লোক এক জালা নস্যি টানছে এমনি একটা ছবি। সাইনবোর্ডটা কেমন কাত হয়ে ঝুলছে। এরাই খাওয়াবে মাংসপোলাও!”

কী খাওয়াল তারা??
“লোকটা আবার বাজখাই গলায় বললে, ঘুঁটের গন্ধ! শুধু ঘুঁটের গন্ধেই পার পেয়ে যাবে ভেবেছ? এর পরে তিনটি বাছা বাছা গুণ্ডা আসবে–দেবে রাম ঠ্যাঙানি যাকে বলে আড়ং-ধোলাই। প্রাণ খুলে পোলাও-কালিয়া খাবে।”

তাছাড়া, হীরকরাজার পোষা কবি জানিয়েছেন, বেশি খেলে বাড়ে মেদ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, একাধিক সমস্যার অব্যর্থ দাওয়াই, বাজিমাত হবে এই ‘অমৃত’ ফলে

“তোমার মামা গজগোবিন্দ আমাদের কোম্পানি থেকে তিনশো তিপান্ন টাকার নস্যি কিনেছ তিন বছর ধরে সব বাকিতে। একটা পয়সা ছোঁয়ায়নি। তারপর আর এ-পাড়া সে মাড়ায়নি। আর আমাদের কোম্পানি তারই জন্যে লাল বাতি জ্বেলেছে।”

এমন নিমন্ত্রণ যারা এড়ায় তারা বোকচন্দর, ক্যাবলা… আর যারা এমন নিমন্ত্রণ ভোগ করে? তারা একটা পালানোর জানলা খুঁজে পায়, সেটা মুক্তি আনে, তবে সুবর্ণলতার দক্ষিণের বারান্দার মতো আকাঙ্ক্ষিত নয়, অচিন্তনীয়। সেই জানলা খুলে ঝাঁপ দিলেই —

“আর সঙ্গে সঙ্গে–একেবারে ডাস্টবিনে রাজ্যের দুর্গন্ধ আবর্জনার ভিতর।

টেনিদাও আমার ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল পর মুহূর্তেই। আর তক্ষুনি উলটে গেল ডাস্টবিন! আমাদের গায়ে মাথায় পৃথিবীর সব রকম পচা আর নোংরা জিনিস একেবারে মাখামাখি। হালখাতার খাওয়া-দাওয়াই বটে। অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে যা কিছু খেয়েছিলাম—সব ঠেলে বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে।”

চালাক যারা, তারা বলে ‘কি বলিস? ফের হপ্তা? তৌবা, নাক খপ্তা।’
কিন্তু ক্যাবলাদের ক্যাবলামি? ঘোচে না যে!!—চলবে।

ঋণ:
শিরোনাম বাংলা ব্যান্ড ভূমি-র গান থেকে।
বিষ্ণুশর্মা বিরচিত পঞ্চতন্ত্র।
হালখাতার খাওয়া দাওয়া: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

আপনার রায়

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?

Skip to content