বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

তো, কথাটা কী নিয়ে হচ্ছিল যেন? পেট আর খিদে নিয়ে, তাই তো? পেটে খেলে পিঠে সয় আর পিঠে খেলে পেটে সয় না, এই তো হল সার কথা? কিন্তু এই যে, খাওয়ার জন্য এতো মারপিট, আস্ত আস্ত বিপ্লব আর রেভোলিউশন, মারামারি কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার আদিমতা কিংবা ভাগ করে খাওয়ার সভ্যতা কিংবা দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়ার অতিসভ্যতার মাঝে মাঝে কৃষিবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব ইত্যাদি ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা ‘পাওয়া’-র কিংবা কেড়ে নেওয়ার সবকিছুর মধ্যেই একটা পেটের টান থাকে। আর সেখানেই যতো গোলমাল। তাই ক্যাবলামিটা যে কোথা থেকে জেগে ওঠে তা নিয়ে সংশয় লাগে ভারি। মন, বুদ্ধি নাকি নিখাদ পেট… কীসের দোষে বা গুণে?
এই যেমন কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা। কুমার কন্দর্পকে ডেকে পাড়ার জ্যেঠু বললেন, “এই যে বাপু কন্দু, এখন করছো টরছো কিছু? কন্দর্প বীরদর্পে বলল, আর্য, এই তো ক্রীড়াঙ্গনে কন্দুকক্রীড়া করছিলাম সতীর্থদের সঙ্গে। শেষে খানিক হস্তাহস্তি আর কেশাকেশি করলাম। মানে আপনারা যাকে জ্যাঠামো বলেন, ভীমসেনকে ধরে অ্যায়সা দিয়েছি না যে, সে এখন তরুগুল্মের পাশে বসে ক্রন্দনং করোতি।”

জ্যেঠু শশব্যস্ত হয়ে “করেছো কী, তোমার মাতৃদেবী জানলে তো….” ইত্যাদি বলে নিয়ে “বত্স! তুমি মেধাবী, কৃতী বলেই জানি, তোমার এসব কাজ সাজে না। জীবন কর্মযোগ। কর্মময় জীবনে এরকম নিরর্থক টাইমপাশ না করে সার্থক কাজকাম করো”… বলে খানিক থামলেন।

কন্দর্প বলল, “কাজ করতে চাইলেই দিচ্ছে কে? তাই নিজের কাজ নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। পাড়ার সকল আম্র, পনস ইত্যাদি বৃক্ষের ফলাফলের বিশদ বৃত্তান্ত আমার অধীন, চিত্রগুপ্ত যেমন মানবগণের কর্মাকর্মের হিসাব রাখেন, ততোধিক সূক্ষ্মতা ও নৈপুণ্যে আমি একাজ করে থাকি। উদরপূর্তির কোনও চিন্তাই নাই।”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩০: বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত

জ্যেঠু বললেন, “পরস্বের অপহরণ তো মন্দ কাজ, তুমি সত্ বৃত্তি অবলম্বন করো। তোমার পিতার সঙ্গে আমি কথা বলবো। চাকুরি করবে?”

কন্দর্প বিস্মিত হয়ে বলল, “আমাকে কে চাকুরি দেবে? পিতা দুইবেলা আমাকে ক্যাবলা বলে তাড়না করেন, বলেন, আমার মস্তিষ্কের অন্দরমহল বিশুদ্ধ গোময়ে পরিপূর্ণ। সংখ্যা কী শব্দ, ভূত কি ভবিষ্যৎ সব বিষয়েই নাকি আমি সমদর্শী, সূক্ষ্মদৃষ্টিহীন একটি আস্ত আকাট। অবশ্য মাতা ও সুহৃদের দল আমার বুদ্ধির প্রশংসা করে।”

জ্যেঠু বললেন, “তবে তো বাবা তুমিই যোগ্য লোক। তোমাদের মতো সাকার ব্রহ্ম-ই জাতির ভবিষ্যৎ। ঠিক তোমার মতো একটি বালক আমি খুঁজছিলাম। আমার কিছু কথা আছে। তোমার শোনার সময় হবে? তোমাকে এখনই চাইলে আমি একটি উত্তম চাকুরি দিতেই পারি। তোমার জীবন কোন চিরবসন্তের দেবলোকে পারিজাতবৃক্ষের মধুগন্ধমেদুর হয়ে উঠবে তা তোমার কল্পনার-ও অতীত। লোক খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৩: বিপর্যয়ের দিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

কন্দর্প বলল, “বলেন কি জ্যেঠু! এই চাকুরি হলে তো বাবা আমাকে আর দূরছাই করতে পারবেন না?”

“শুধু তোমার মাননীয় পিতৃদেব কেন, তোমার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন চতুর্বিংশতি পুরুষ ধন্য হয়ে যাবেন। ধন্য হবে তোমার প্রতিবেশী থেকে দেশবাসী। তোমাকে দেখার জন্য লাইন পড়ে যাবে হে!”

কুমার কন্দর্প আরক্তিম মুখে বলল, “বাবা ভাবেন, আমার কানাকড়ি ক্ষমতা নেই। চাকুরিটি হলে বাবাকে একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র কিনে দেব। চাষের ক্ষেতে বড়ই শষ্যভুক পাখি আর কীটের উৎপাত, মহর্ষি অতলাক্ষ একটি খাসা যন্ত্র প্রস্তুত করেছেন, কিন্তু মূল্য বড়োই অধিক, যন্ত্রে দেখে পিতৃদেব সতর্ক হতে পারবেন, তাছাড়া দূরদর্শী হতে পারবেন, এই যেমন আমি যে এমন একটি চমত্কার সুযোগ পাব নিজগুণে, তা কি কখনো তিনি ভাবতে পেরেছিলেন? কিন্তু কাজটা কী যদি একটু বলেন।”

“কাজ অতি উত্তম। দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ। মেধাবী ও অভিজাত পরিবারের প্রার্থী অগ্রগণ্য, উন্নতির অভাবনীয় সুযোগ, বেতন স্বর্গীয় স্কেলে, বিষ্ণুলোক, চন্দ্রলোক যেটা তোমার বাড়ির কাছাকাছি হবে সেখানেই প্রথম পোস্টিং, বেশি ঘুরতে হবে না, বড়জোর কখনও কখনও যমলোক কী সূর্যলোকে ডেপুটেশনে কাজ করতে হবে, এই যখন চিত্রগুপ্তের মতো লোকজন ছুটিতে যায় তখন একটু ঠেকনা দেওয়া আর কী! বুঝেছো তো, কতবড় কাজ? জীবন বদলে যাবে হে। তবে একটা কথা। একটা নয়, দুটো কথা।”

“কি কথা গুরুদেব!!”
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৩১: সুইট ক্র্যাকার-এর প্রতিটি আইটেমই এক সে বড়কর এক

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী

“প্রথমত:, খুব বড় চাকরি। না পাওয়া পর্যন্ত একটু সাবধানে থাকবে, তোমার পিতৃদেব ছাড়া কাউকেই এখন একথা বলবে না। চারিদিকে বাজে লোকের অভাব নেই বাবা! তুমি যোগ্য, তাই তুমিই এটা পাবে, নারদদেব বড় বিশ্বাস করে আমায় এই খবর দিয়েছেন, তুমি তার মর্যাদা রাখবে আশা করি। আর পরের কথাটা সামান্য, তুমি তো প্রতিষ্ঠিত হয়েই গেলে, তোমার বাবা আর পরিশ্রম করবেন কেন এতো, এখন উনি বিশ্রাম নেবেন। তোমরা ওই পোকায় খাওয়া ভূমিটি আর অধীনস্থ রেখো না। পাশেই আমার গৃহমন্দির। স্থানাভাবে গৃহের পাকশালাটি মনো মতো করে বড় করতে পারছি না। তোমাদের এতো বড় উপকার করলাম, তার বিনিময়ে এটুকু আমার লাগবে, না করতে পারবে না। আমি কাগজপত্র তৈরি করেই রেখেছি, শুধু একটু সম্মতিসূচক হস্তাক্ষর পেলেই হবে। তোমার পিতৃদেবকে জানাবে অপরাহ্নেই আমি কাগজপাতি নিয়ে যাবো, খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। আরে কর কী, কর কী! ও খোকা, পালাচ্ছো কেন? অ্যাই, কোথায় যাচ্ছিস শুনে যা বলছি! কী? আরে বাবা! ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি তো ঠগ জোচ্চোর নই। সত্যি বলছি এই বয়সে কুস্তি করে তোর সঙ্গে পারি নাকি? মনটা আমার বড্ড নরম আসলে, কী বলছিস? খাবি কী? কেন অমৃতের ব্যবস্থা করে দিলাম, পছন্দ হল না! তোর বাপ তোকে ঠিকই বলে, ক্যাবলা হাবা মূর্খ অর্বাচীন কোথাকার, মাথায় ষাঁড়ের গোবর ভরা। পালাবি কোথায়, ধরতে পারলে ছাড়বো না এই বলে দিলাম কিন্তু, যোগ্য লোকেরা পালিয়ে গেলে আমাদের কি হবে?”
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content