শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

যক্ষ গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছিল। কালিদাস এই এক ফাঁসিয়ে গিয়েছেন। আষাঢ় মাসের উপক্রম হলেই আকাশে সেই মেঘখণ্ডটা এসে উপস্থিত হয়। যুগ যুগ ধরে এমনটাই চলছে। তারপর কী যে হয়! কোথায় সেই অলকা, কোথায় বা মেদুর যাত্রাপথ, পথে পথে, জনপদে, নগরে প্রান্তরে যে বিপুল চিত্রবিচিত্র মানবজীবন, নির্বিন্ধ্যা, বিশীর্ণা রেবা, শিপ্রা, গোদাবরী, ব্রহ্মাবর্ত, উজ্জয়িনী, অনিদ্রনয়ান জনপদবধূগণ আর অনন্তসৌন্দর্যের মোহজাল…বহু যুগের ওপারে তাদের সকল মায়াময় আবেশ নিয়ে নিশীথের অন্ধকারে মিশে গিয়েছে। এপারে পড়ে আছে কেবল তাদের হিম হিম ছায়া।
যক্ষ বসে এ সবই ভাবছিল। এই একটা দিন তাকে মনে পড়ে, সেই যক্ষবধূ, সেই রামগিরি, সেই অশ্রুতপূর্ব মন্দাক্রান্তার বিরহের খণ্ডকাব্য। আজ রোদ উঠবে না। সকাল থেকে আকাশ মুখভার করবে। বহুযুগের সঞ্চিত আর্তি আজ বজ্রবাহিনী হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে।

তবুও, মানুষ যুগে যুগে যা ভেবেছে তা হয় না তার মনের মতো করে। হয়তো, আজ বৃষ্টি নামবে না। স্বেদস্নান-ই হয়তো বেদতুল্য সত্য হয়ে জেগে থাকবে। তবুও, পৃথিবীর বুকে প্রাচীন বোকাদের দলের সম্পদ হয়ে ওই মূর্খ যক্ষের আকুলতা বা ক্যাবলামি দেখে খানিক হাসার, খানিক কাঁদার, খানিক আহা উহু করে সান্ত্বনা দেওয়ার বুদ্ধিমানের দল ভারি হতেই থাকবে যুগে যুগে।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

তারপর কী হয়েছিল সে খবর কেউ করে না। জানতেও চায় না মেঘটা শেষ পর্যন্ত অলকাতে পৌঁছেছিল তো? নাকি পথের মাঝেই পথ হারিয়েছিল, যেমন করে মেঘের বুকে মিলিয়ে যায় আকাশযান, দূর কুয়াশায় হারিয়ে যায় জাহাজ থেকে ট্রেন, সার সার মানুষ। হায়রে কবে কেটে গিয়েছে কালিদাসের কাল!

যক্ষ শুনেছে, সমুদ্রমেখলা বঙ্গভূমিতে অকালবোধনের কালে জনৈক মহিষাসুরের এমনই দশা হয়। বিকট দাঁত খিঁচিয়ে দেবীর পদতলে বসে রণহুঙ্কার দিতে হয়, অথচ পরাজয়টাই সারসত্য জেনে। অকালবোধনে একদল লোক তাকেই খোঁজে, আর বর্ষার বোধনে যক্ষের বিরহবেদনার বারোমাস্যা নিয়ে তারাই বর্ষামঙ্গল করতে হাজির হয়। দুটো প্রাচীন নখদন্তহীন জরদগবের এই রোজনামচা চলতেই থাকে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

নববর্ষার দিনক্ষণ আসে, নববর্ষা হয়তো বা আসে না তেমন করে। এই দাবদাহ-ই বুঝি সত্য, তার অবসানের কল্পনাও হয়তো দুরাশা, ভুবন-চরাচর জুড়ে মোহন বর্ষণভার নামে না।

শোনা যায়, অনেক অনেক আগে চারিদিক আঁধার করে যখন নববর্ষার কাজলকালো মেঘ সঞ্চারিত হতো আকাশ জুড়ে, তারপর নেমে আসতো ধারাপাত, পৃথিবী তখন একলা হয়ে যেতো, মানুষ-ও। তখন যুদ্ধযাত্রা থেমে যেত, পথগুলো সব হারিয়ে যেত, যেমন অতীত শুধু তার স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকে, আর জাগতিক থাকাগুলো মুছে যায়। প্রবাসীরা এই সময়ে বাড়ি ফিরতো। “ঘর মানে তার/ বৃষ্টিমোহন ভুবনচরাচর।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

আর যাদের ফেরা হয় না? ফিরবো বললেই যারা ফিরতে পারে না? দু’জনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী হয়ে ওঠাটা যাদের কাছে আকাশকুসুম, তারা?

তারা যক্ষ হয়। অথবা অ-সুর হয়তো বা। ক্যাবলা হয়ে আটকে থাকাটাই যাদের ভবিতব্য, আকাশে নববর্ষার জলভারাবনত শ্যামল মেঘকে দেখে তারা নির্নিমেষে, অথবা দেখে ভুবনমনমোহিনীর রক্তচক্ষু। আর মনে মনে কী সব বলতে থাকে। সাগরপারে নুড়ি কুড়োতে কুড়োতে ক্ষ্যাপা এমনটাই তো করে, সে কথা কেউ শোনে না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

কবিরা হয়তো বলবেন, “যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে সে কথা আজি যেন বলা যায়”… সে কথা কেউ শোনে কীনা বলা যায় না, তবুও আষাঢ়ের আবির্ভাবে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ছুটে এসে চারদিক ঘিরে ধরে, ছেয়ে ফেলে গোটা আকাশ, তারপর মুক্তিকামী শাপগ্রস্ত একটা যক্ষ বেরিয়ে আসে নিজের জমিয়ে রাখা না বলা ক’টা কথা বলবে বলে, কোন্ গভীর অন্দর কন্দর থেকে!!! বপ্রক্রীড়াপরিণতগজ আশ্লিষ্টসানু মেঘটাকে দেখতে পায়। তারপর সেই মেঘ বাড়ে, আরও আরও আরও… ক্রমে ছেয়ে ফেলে বিস্তীর্ণ আকাশ, একঝাঁক বুনো হাঁস পথ হারায়। —চলবে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content