মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

হিউম্যান এরর। মনুষ্যকৃত ভ্রান্তি, যা যন্ত্র করে না, মানুষ, মানুষ বলেই করে। এদিকে ব্যাকরণের বাইরে মানুষের যে সামাজিক লক্ষণ তাতে বলা হয় মান আর হুঁশ নিয়েই নাকি মানুষ। তো, মান মানে কচু, আর হুঁশ… কী জানি, পরে দেখা যাবে। ব্যাপারটা হল এই যে, যাদের মান আর হুঁশ আছে, তারা ভুল করে। ভুল করাটা তাদের অধিকার, কখনও দায়িত্ব-ও বটে। রাষ্ট্রজীবনে এটা ভাবলে, শাস্তি থাকে। কিন্তু অন্যায় আর ভুল কি এক? আচ্ছা, ভুলো কুকুর কী কী ভুল করে? ভোলানাথ কি তাঁর ভুলে ভরা জীবনের কথা জানেন? দূর ছাই! এসব পরে হবেখ’ন।
আসল কথা হল, হিউম্যান এরর, যেটা না থাকলে মানুষ কবেই তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলতো। তো, কেউ বেশি ভুল করে, এই যেমন, নন্দীবাবু বড় বড় অঙ্ক কষেন, ভারি ভারি নামতা থেকে সূত্র তাঁর জিভের ডগায়, অথচ পকেটে ঠিকানা আর নিজের নামটা লিখে না রাখলে ভারি বিপদ হয়। একদিন বোসপাড়া ঘুরে নিজের বসতবাটিখানি খুঁজে না পেয়ে যখন ভ্রূ কুঁচকে বটতলার নেপোর চায়ের দোকানে বসে ভাবছেন, তখন ছেলেটা সাইকেল নিয়ে নাইট শোয়ে সাড়াজাগানো মুভি “কলির কষ্ট” দেখতে যাচ্ছিল বলেই না, তাকে ফলো করে করে সিনেমা হল, তারপর টিকিট কেটে কষ্টভোগ, তারপর আবার ভিড়ের মধ্য থেকে ছেলেকে চিনে নিয়ে ফলো করে করে… হোম সুইট হোম। এত খাটতে হতো, যদি পকেটের কাগজটার কথা মনে পড়তো ঠিক সময়ে। এই হল আসল হিউম্যান এরর, ঊনিশ-বিশের তফাত আর নয় ছয়ের মামলা কি ত্যামন একটা ভুল হল? ছ্যাঃ, ভুল হতে হবে জম্পেশ! যা দেখে ভুলকেও ভুলিয়ে দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

যন্তরপাতি ভুলেও এ সব পথ মাড়ায় না। তোমার নাম, ধাম, কাম সব তাদের নখের ডগায় আর ডাটা ব্যাঙ্কে। তোমাকে তারা তুমি বলেই চেনে। তবুও যন্ত্র অযান্ত্রিক হয়ে মানুষ সাজতে চায়, তবে মানুষের জায়গা নেওয়া অত্তোটাও সহজ নয়। অনেক খেটেখুটে মানুষ পৃথিবীর ফার্স্টপার্সন। আশেপাশে অনেকেই জোর টক্কর দিচ্ছে মানুষ হয়ে ওঠার। সে কুকুর বেড়াল হাতি ঘোড়া বাঘ সিংগি সকলেই। সকলেই মানুষ হতে চায়। তারা কী ভাবে সেটা কথা নয়, মানুষ ভাবে তাদের আসন টলমল। হয়তো, কাল ঘুম থেকে উঠেই অফিসে পাশের কী বসের চেয়ারে সিংহমামাকে দেখবে না তারা, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে? আজ তুমি তোমার পোষ্যকে চরাতে নিয়ে যাচ্ছো, কাল যে সে তোমাকে চরাবে না, সেটা জোর দিয়ে বলতে পারো? উঁহু, জানি জানি, বিজ্ঞানীরা বলেছেন বলে পকেট থেকে ভাষণের কাগজটা বের করছো? ওটা পকেটেই রাখো, বিজ্ঞানীরা তো আরও কিছু বলেন, তার কতটা মানো, তখন তো “পাগলা সাইন্টিস্ট” বলে বেশ করে জাহির করো নিজেকে। রাখো বাপু। তুমিই না হয় ঠিক। আমারটা হিউম্যান এরর।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

তবে যে কথা হচ্ছিল, যন্ত্র কখনও কখনও ভুল করে, ভাবে এই যন্ত্রণায় তার মর্যাদা খুব বাড়ে। যন্ত্রের এমন মানুষিক ভুলে, গুরু অমানুষিক হয়ে গরু হন। বিধাতার রায় যন্ত্রস্থ হয়ে বিধাতার দায় হয়ে দেখা দেয়। অথবা, “মডার্ন টাইমস”-এর জমানায় একটা আস্ত খাদ্যাখাদ্যবিনিশ্চয় যন্ত্র লাঞ্চ আওয়ারে এক সেয়ানা বোকাকে বেছে নিয়ে তার মুখে পরীক্ষামূলকভাবে গুঁজে দেয় খাবারের পর খাবার, নানা অচিন্তনীয় পদ, জল চাইলে খাবার গুঁজে দেয়, আবার, সময় না দিয়ে গিলিয়ে দিতে চায় চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়।

মুখে খাবারটা ঢুকুক না ঢুকুক, একটা বুরুশ মায়ের আঁচলের মতো প্রতিবার মুখ মুছিয়ে দেয়। পরীক্ষামূলকভাবে চলতে থাকে সব। যেমন, মড়ার নাড়ি টিপে তার প্রাণের গতিবিধি খেয়াল করতে হয়, তেমনভাবেই। তারপর দেখা যায় তোতাপাখির শিক্ষা পরিপূর্ণ হয়েছে, সে সর্ববিদ্যার পরপারে গিয়েও দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে, বুকটা উঠছে আর নামছে, মুখ নাড়ছে বেশ। নদীর ঢেউ বাড়লেই বিদ্যেবোঝাই বাবুমশায়ের পিঠে বাঁধা লাউয়ের খোলের বোঝাটা নড়ে ওঠে, তার ভিতর থেকে রাশি রাশি বিদ্যা প্রাণের দায়ে বাবুকে ফেলেই পালাতে চায় বুঝি। তবুও বাবুর ঠাটবাটটা চলতেই থাকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

ওই যন্তরটাও তার নিজের মন্তরে তারপর খাবারটা মুখে লেপ্টে দেয়, ইচ্ছামতো ঘষে দেয়, মুখটাই থেঁতলে দিতে চায় পরীক্ষামূলকভাবে। ছুড়ে মারে যা খেতে চাও। এককণাও পেটে না ঢুকে বেশ একটা প্রাণভরা আয়োজনে একাদশীর পারণ যেন। শেষে ঝোল ঝাল অম্বল চচ্চড়ির সেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনের নিদারুণ প্রহার ও উপহাসের শেষে সেই মুখ মোছানোর বুরুশটা তার আদব কায়দা ধরে রাখে। খাও, কী না খাও মুখটি মুছিয়ে দেওয়া দরকার। শেষে পেট ভরে গেছে ভেবে সেটাও মুখে বাড়ি মারতে থাকে, যাকে সর্বশক্তিমান ভাবো, সে সর্বশক্তি নিয়ে শয়তান হয়ে ওঠে। যন্ত্র।

বলতেই পারো এখন, নহি যন্ত্র আমি প্রাণী, আমি জানি, সব জানি। তুমি যা জানো না তাও জানি, আমি যা জানি না তাও জানি, ওই যন্ত্রের বাঁদরামো তো আমারই হিউম্যান এরর। আর হিউম্যান এরর মানেই একঝলক বাতাস, তাহলে পৃথিবীতে মানবতা বেঁচে আছে, না হলে পরীক্ষা দিতে চলা পরীক্ষার্থী বিপদে পড়া মানুষকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়োতো না, এতো মানুষেরই ক্যাবলামি না কী! তার চেয়ে বাপু লোকটা হাসপাতালে চলে যাক, তুমিও যাও তোমার গন্তব্যে, তারপর পড়েশুনে পৌঁছে যাও একদিন ওই হাসপাতালে ওই বেডের ধারে, যেখানে লোকটা তোমার অপেক্ষায় হাপিত্যেশ হয়ে মরতেও পারেনি। তুমি এলে, সেও মরে বাঁচলো। না, এখানে কোনও হিউম্যান এরর নেই, কান বলতে ধান শোনা নেই, সব একবারে অস্বাভাবিক রকমের ঠাকঠাক যান্ত্রিকভাবে মধুর। এবং মধুরেণ সমাপয়েত্।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

তবুও মনে হয় কোথাও যেন একটা ফাঁক, খাপছাড়া আবোল তাবোল হযবরল? কোথাও যেন একটা বড়সড় ক্যাবলামির পাকা বন্দোবস্ত হয়ে আছে? তবে সেটা মানুষের না যন্ত্রের, রোগের না ওষুধের ধরা যায় না ঠিক। তারে ধরি ধরি মনে করি, তবুও সে অধরা থাকে যেন।

স্ক্রু ঢিলে হলেই বুঝি এসব ঘটে, ঘটে কিছু নেই বলেই এমনতর ঘটনা বুঝি। অন্তত ছোটবেলা থেকে বড়দের এমন মত শুনতে শুনতে ছোটরা বড় হয়। মহামহিম “মডার্ন টাইমস”-এর কলিযুগে সেই মুখের সামনে খাদ্যের গাজর বয়ে চলা লোকটার কাজটাই হল যেমন খুশি টাইট দেওয়া। ঢিলেঢালা স্ক্রুগুলো টাইট দিতে দিতে সে তখন প্রায় মরিয়া। কেউ যেমন মরিয়া প্রমাণ করেছিল যে, সে মরে নাই, তেমনই সেই লোকটা টাইট দিতে দিতে, দিতে দিতে, দিতে দিতে একসময় ছুটি পায়, তখনও সে টাইট দেওয়ার জন্য ছুটে চলে, ছুটিয়ে মারে ছুটে চলা চারপাশকে। এটাই মডার্ন টাইমস, এটাই এখানকার রীতিনীতি হালচাল, কে বলে একে ক্যাবলামি? এত সাধ্য আছে কার? দেবে না টাইট দিয়ে!!

“চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী!” —চলবে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content