ছবি: সংগৃহীত।
জনমেজয়ের কৌতূহলনিবৃত্তির জন্যে বৈশম্পায়ন পূর্বপুরুষদের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগলেন। পাণ্ডবদের পর এবার কৌরবদের চিত্তাকর্ষক জন্মকাহিনি। ধৃতরাষ্ট্রের জন্মদাতা পিতা বেদব্যাস, যিনি ধৃতরাষ্ট্রের পিতৃতুল্য, একদা ধৃতরাষ্ট্র ভবনে উপস্থিত হলেন। ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ক্লান্ত মহর্ষিকে পরিচর্যায় সন্তুষ্ট করে ধৃতরাষ্ট্রের মতোই বলশালী শতপুত্রলাভের বর লাভ করলেন পুত্রবধূ গান্ধারী।
সা বব্রে সদৃশং ভর্ত্তুঃ পুত্রাণাং শতমাত্মনঃ।
ধৃতরাষ্ট্রের দ্বারা গর্ভবতী হলেন গান্ধারী। দুই বৎসর কাল অতিক্রান্ত হল। প্রসব হল না। ইতিমধ্যে খবর এল নবোদিত সূর্যের মতো একটি পুত্র হয়েছে পাণ্ডুপত্নী কুন্তীর, সম্পর্কে যিনি গান্ধারীর কনিষ্ঠা, দেবরভার্যা। দুঃখভারাক্রান্ত মনে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে স্বামীর অজ্ঞাতে গর্ভপাত করে ফেললেন গান্ধারী। প্রসব করলেন একটি লৌহপিণ্ডের মতো মাংসপিণ্ড। হয়তো প্রবল অবজ্ঞায়, সেটিকে ফেলে দেবার উদ্যোগ নিলেন তিনি। ধ্যানযোগে মহর্ষি বেদব্যাস তা জানতে পেরে সেখানে উপস্থিত হয়ে গান্ধারীর অভিপ্রায় জানতে পারলেন।
জ্যেষ্ঠং কুন্তীসুতং জাতং শ্রুত্বা রবিসমপ্রভম্। দুঃখেন পরমেণেদমুদরং পাতিতং ময়া।।
একে সূর্যের মতো উজ্জ্বল তার থেকেও বড় কথা জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার কুন্তীপুত্র। তাই তাঁর এই নৈরাশ্য। গান্ধারীর এই রেষারেষির মনোভাব ভবিষ্যতে তাঁর শতপুত্রকে প্রভাবিত করবে না তো? রক্তের সম্পর্কে উত্তরাধিকার বলে একটা কথা আছে যে। ওই যে আধুনিক পরিভাষায় জিন যার নাম। বেদব্যাসের কথা অন্যথা হবার নয়।স্বেচ্ছায় কোনওদিন কথাচ্ছলেও তিনি মিথ্যা বলেন না।
নৈতদ্ জাত্বন্যথা ভবেৎ। বিতর্থং নোক্তপূর্ব্বং মে স্বৈরেষ্বপি কুতোঽন্যথা।।
একশত একটি ঘৃতপূর্ণ কলসিতে শীতল জলে সিক্ত মাংসপিণ্ডকে একশত একটি খণ্ডে বিভক্ত করে রাখলেন শ্রীবেদব্যাস। কলসিগুলো এক বৎসর কাল সুরক্ষিত স্থানে রাখবার জন্যে নির্দেশ দিয়ে ব্যাসদেব প্রস্থান করলেন। এক বৎসরান্তে ভূমিষ্ঠ হলেন দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির তাঁকে সম্বোধন করতেন সুযোধন নামে। একই দিনে জন্ম নিলেন পাণ্ডুপুত্র ভীমসেন। দুর্যোধনের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই অশুভ সংকেত। দুর্যোধনের ক্রন্দন এবং কণ্ঠস্বর গর্দভের স্বরের তুল্য। সেই শব্দে ডেকে উঠল গর্দভ, শকুন, শৃগাল, কাকেরা। প্রকৃতিতেও অস্থিরতা দেখা দিল।
বাতা বিপ্রববুশ্চাপি দিগ্দাহশ্চাভবত্তদা।।
বায়ু বেগে প্রবাহিত হল, দিকদাহ দেখা দিল। যদিও লৌকিক পৃথিবীতে যে কোনও জন্মই তাৎপর্যহীন, তা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানে না যে। কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস, তাই তথাকথিত অশুভ লক্ষণে ভীত ধৃতরাষ্ট্র —ব্রাহ্মণদের কাছে ভীষ্ম ও বিদুরের সমক্ষে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন।
সা বব্রে সদৃশং ভর্ত্তুঃ পুত্রাণাং শতমাত্মনঃ।
ধৃতরাষ্ট্রের দ্বারা গর্ভবতী হলেন গান্ধারী। দুই বৎসর কাল অতিক্রান্ত হল। প্রসব হল না। ইতিমধ্যে খবর এল নবোদিত সূর্যের মতো একটি পুত্র হয়েছে পাণ্ডুপত্নী কুন্তীর, সম্পর্কে যিনি গান্ধারীর কনিষ্ঠা, দেবরভার্যা। দুঃখভারাক্রান্ত মনে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে স্বামীর অজ্ঞাতে গর্ভপাত করে ফেললেন গান্ধারী। প্রসব করলেন একটি লৌহপিণ্ডের মতো মাংসপিণ্ড। হয়তো প্রবল অবজ্ঞায়, সেটিকে ফেলে দেবার উদ্যোগ নিলেন তিনি। ধ্যানযোগে মহর্ষি বেদব্যাস তা জানতে পেরে সেখানে উপস্থিত হয়ে গান্ধারীর অভিপ্রায় জানতে পারলেন।
জ্যেষ্ঠং কুন্তীসুতং জাতং শ্রুত্বা রবিসমপ্রভম্। দুঃখেন পরমেণেদমুদরং পাতিতং ময়া।।
একে সূর্যের মতো উজ্জ্বল তার থেকেও বড় কথা জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার কুন্তীপুত্র। তাই তাঁর এই নৈরাশ্য। গান্ধারীর এই রেষারেষির মনোভাব ভবিষ্যতে তাঁর শতপুত্রকে প্রভাবিত করবে না তো? রক্তের সম্পর্কে উত্তরাধিকার বলে একটা কথা আছে যে। ওই যে আধুনিক পরিভাষায় জিন যার নাম। বেদব্যাসের কথা অন্যথা হবার নয়।স্বেচ্ছায় কোনওদিন কথাচ্ছলেও তিনি মিথ্যা বলেন না।
নৈতদ্ জাত্বন্যথা ভবেৎ। বিতর্থং নোক্তপূর্ব্বং মে স্বৈরেষ্বপি কুতোঽন্যথা।।
একশত একটি ঘৃতপূর্ণ কলসিতে শীতল জলে সিক্ত মাংসপিণ্ডকে একশত একটি খণ্ডে বিভক্ত করে রাখলেন শ্রীবেদব্যাস। কলসিগুলো এক বৎসর কাল সুরক্ষিত স্থানে রাখবার জন্যে নির্দেশ দিয়ে ব্যাসদেব প্রস্থান করলেন। এক বৎসরান্তে ভূমিষ্ঠ হলেন দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির তাঁকে সম্বোধন করতেন সুযোধন নামে। একই দিনে জন্ম নিলেন পাণ্ডুপুত্র ভীমসেন। দুর্যোধনের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই অশুভ সংকেত। দুর্যোধনের ক্রন্দন এবং কণ্ঠস্বর গর্দভের স্বরের তুল্য। সেই শব্দে ডেকে উঠল গর্দভ, শকুন, শৃগাল, কাকেরা। প্রকৃতিতেও অস্থিরতা দেখা দিল।
বাতা বিপ্রববুশ্চাপি দিগ্দাহশ্চাভবত্তদা।।
বায়ু বেগে প্রবাহিত হল, দিকদাহ দেখা দিল। যদিও লৌকিক পৃথিবীতে যে কোনও জন্মই তাৎপর্যহীন, তা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানে না যে। কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস, তাই তথাকথিত অশুভ লক্ষণে ভীত ধৃতরাষ্ট্র —ব্রাহ্মণদের কাছে ভীষ্ম ও বিদুরের সমক্ষে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন।
যুধিষ্ঠিরো রাজপুত্রো জ্যেষ্ঠো নঃ কুলবর্দ্ধনঃ। প্রাপ্তঃ স্বগুণতো রাজ্যং ন তস্মিন্ বাচ্যমস্তি নঃ।।
জ্যেষ্ঠ, বংশবর্দ্ধক, নিজগুণেই রাজ্যাধিকারী যুধিষ্ঠির এ বিষয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু
অয়ন্ত্বনন্তরস্তস্মাদপি রাজা ভবিষ্যতি? এতৎ প্রব্রূত মে তথ্যং যদত্র ভবিতা ধ্রুবম্।।
যুধিষ্ঠিরের পর এই পুত্র রাজা হতে পারবেন তো? যা সত্য সেটাই বলুন আপনারা। বিদুর প্রভৃতি প্রাজ্ঞরা দুর্যোধনের জন্মের দুর্লক্ষণগুলো স্মরণ করে পরামর্শ দিলেন পুত্রটিকে পরিত্যাগ করুন। কারণ, ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে।।
বংশরক্ষার জন্যে একজন ব্যক্তিকে ত্যাগ করা উচিত। এই যুক্তি গ্রাহ্য হল না পুত্রস্নেহাতুর পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। এই হৃদয়দৌর্বল্য কোনও পিতারই বা না আছে? সদ্য পিতা হয়েছেন যিনি তাঁর কাছে তো অসম্ভব এ প্রস্তাব। একমাসের মধ্যেই একশত পুত্র পৃথিবীর আলো দেখল এবং সেই সঙ্গে গান্ধারীর ইচ্ছানুসারে একটি কন্যাও।
মমেয়ং পরমা তুষ্টির্দুহিতা মে ভবেদ্ যদি।।”
একটি কন্যা হলে বেশ হয়। গর্ভবতী গান্ধারীর অচল অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যারতা বৈশ্যা যুবতীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে জন্ম নিল আরও একটি পুত্র,তাঁর নাম যুযুৎসু। জন্মসূত্রে জ্যেষ্ঠ হলেন যুধিষ্ঠির। এদিকে শতশৃঙ্গ পর্বতে পাণ্ডু দেহ রাখলেন। সহমৃতা হলেন মাদ্রী। রাজধানী থেকে দূরে শতশৃঙ্গপর্বতে ভূমিষ্ঠ পাণ্ডুপুত্রদের বড় হয়ে ওঠা কেমন ছিল?
শুভলক্ষণসম্পন্নাঃ সোমবৎ প্রিয়দর্শনঃ। সিংহদর্পা মহেষ্বসাঃ সিংহবিক্রান্তগামিনঃ।।
চন্দ্রের মতো প্রিয়দর্শন, সিংহের মতো দর্পিত, মহাধনুর্ধর, সিংহের মতোই পরাক্রান্ত ছিলেন তাঁরা। মহাবলী ও স্বভাবগুণে যশস্বী হয়ে উঠলেন পাণ্ডবরা। পাণ্ডুর জীবনাবসানের পরে শতশৃঙ্গপর্বতের তপস্বীরা স্থির করলেন, পাণ্ডুর পঞ্চ পুত্র, মহিষী কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে পাণ্ডু ও মাদ্রীর শবদেহ সহ তাঁরা হস্তিনাপুরে যাবেন। এটিই ধর্মসঙ্গত কাজ হবে।
ধর্ম্ম এবং হি নঃ স্মৃতঃ।
উদ্দেশ্য? কুরুমুখ্য ভীষ্ম এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র সমর্পণ।
জ্যেষ্ঠ, বংশবর্দ্ধক, নিজগুণেই রাজ্যাধিকারী যুধিষ্ঠির এ বিষয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু
অয়ন্ত্বনন্তরস্তস্মাদপি রাজা ভবিষ্যতি? এতৎ প্রব্রূত মে তথ্যং যদত্র ভবিতা ধ্রুবম্।।
যুধিষ্ঠিরের পর এই পুত্র রাজা হতে পারবেন তো? যা সত্য সেটাই বলুন আপনারা। বিদুর প্রভৃতি প্রাজ্ঞরা দুর্যোধনের জন্মের দুর্লক্ষণগুলো স্মরণ করে পরামর্শ দিলেন পুত্রটিকে পরিত্যাগ করুন। কারণ, ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে।।
বংশরক্ষার জন্যে একজন ব্যক্তিকে ত্যাগ করা উচিত। এই যুক্তি গ্রাহ্য হল না পুত্রস্নেহাতুর পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। এই হৃদয়দৌর্বল্য কোনও পিতারই বা না আছে? সদ্য পিতা হয়েছেন যিনি তাঁর কাছে তো অসম্ভব এ প্রস্তাব। একমাসের মধ্যেই একশত পুত্র পৃথিবীর আলো দেখল এবং সেই সঙ্গে গান্ধারীর ইচ্ছানুসারে একটি কন্যাও।
মমেয়ং পরমা তুষ্টির্দুহিতা মে ভবেদ্ যদি।।”
একটি কন্যা হলে বেশ হয়। গর্ভবতী গান্ধারীর অচল অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যারতা বৈশ্যা যুবতীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে জন্ম নিল আরও একটি পুত্র,তাঁর নাম যুযুৎসু। জন্মসূত্রে জ্যেষ্ঠ হলেন যুধিষ্ঠির। এদিকে শতশৃঙ্গ পর্বতে পাণ্ডু দেহ রাখলেন। সহমৃতা হলেন মাদ্রী। রাজধানী থেকে দূরে শতশৃঙ্গপর্বতে ভূমিষ্ঠ পাণ্ডুপুত্রদের বড় হয়ে ওঠা কেমন ছিল?
শুভলক্ষণসম্পন্নাঃ সোমবৎ প্রিয়দর্শনঃ। সিংহদর্পা মহেষ্বসাঃ সিংহবিক্রান্তগামিনঃ।।
চন্দ্রের মতো প্রিয়দর্শন, সিংহের মতো দর্পিত, মহাধনুর্ধর, সিংহের মতোই পরাক্রান্ত ছিলেন তাঁরা। মহাবলী ও স্বভাবগুণে যশস্বী হয়ে উঠলেন পাণ্ডবরা। পাণ্ডুর জীবনাবসানের পরে শতশৃঙ্গপর্বতের তপস্বীরা স্থির করলেন, পাণ্ডুর পঞ্চ পুত্র, মহিষী কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে পাণ্ডু ও মাদ্রীর শবদেহ সহ তাঁরা হস্তিনাপুরে যাবেন। এটিই ধর্মসঙ্গত কাজ হবে।
ধর্ম্ম এবং হি নঃ স্মৃতঃ।
উদ্দেশ্য? কুরুমুখ্য ভীষ্ম এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র সমর্পণ।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র: এক অনন্য উত্তরণ
দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত
সামনে কঠিন বাস্তব পুত্রদের রাজোচিত প্রশিক্ষণে বড় করে তোলা, তাই হয়তো পুত্রবৎসল দেবী কুন্তীর কাছে এই দুঃখের আবহেও সুদীর্ঘ হস্তিনাপুরের পথকেও সংক্ষিপ্ত মনে হল। তাঁকে সুখী মনে হল কারণ হয়তো অস্থির জীবনে রাজপ্রাসাদের প্রাজ্ঞবিজ্ঞদের অভিভাবকত্বের আশ্বাস।
সুখিনী সা পুরা ভূত্বা সততং পুত্রবৎসলা। প্রপন্নং দীর্ঘমধ্বানং সংক্ষিপ্তং তদমন্যত।।
পাণ্ডুনন্দনদের বয়স তখন যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের যথাক্রমে ষোড়শ, পঞ্চদশ ও চতুর্দশ বৎসর আর নকুল, সহদেবের ত্রয়োদশ বৎসর। পিতামহ ভীষ্মের কাছে পৌত্রদের জন্মবৃত্তান্ত জানালেন বয়োবৃদ্ধ তপস্বী। জানালেন পাণ্ডপুত্রদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বেদাধ্যয়নে পারদর্শিতা সবকিছুই মনোমুগ্ধকর। সবকিছু জ্ঞাত হয়ে বিদুর ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাণ্ডু ও মাদ্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। পাণ্ডুর পাঁচপুত্র এবং ধৃতরাষ্ট্রের শতসংখ্যক সুত জলে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতোই বিকশিত হতে লাগল অমলিন শৈশবে।
তে চ পঞ্চ শতঞ্চৈব কুরুবংশবর্দ্ধনাঃ।সর্ব্বে ববৃধুরল্পেন কালেনাপ্স্বিব নীরজাঃ।।
পাণ্ডুপুত্রেরা ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সঙ্গে খেলাধূলায় সর্বদাই প্রধান, বিশিষ্ট। গতিবেগে, লক্ষ্যপূরণে, ভোজনে, ধুলো ও লগুড় প্রভৃতির প্রয়োগে ধার্তরাষ্ট্রদের (ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের) অনায়াসে পরাজিত করতেন ভীমসেন। নানান খুনসুটিতে তার জুড়ি মেলা ভার। যেমন শতভ্রাতার মধ্যে কাউকে লুকিয়ে রাখা, পরস্পরের মাথা ঠুকে দেওয়া, ফলের সঙ্গে তাদেরকেও গাছ থেকে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি দুষ্টুমিতে সে সকলের অগ্রবর্তী। বালকসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভীম ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন ভাবলেন, বলবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই কুন্তীপুত্র বৃকোদর।
স্পর্দ্ধতে চাপি সহিতানস্মানেকো বৃকোদরঃ
আমাদের সংহত ঐক্যকেও সেই একমাত্র প্রতিস্পর্ধা দেখাতে পারে। অতএব তাকে ছেটে ফেলা যাক। এরপর যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে কারারুদ্ধ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। রাজা হওয়া কে আটকায়?
গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে উদকক্রীড়ন নামে মণ্ডপে চব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়ের উপযুক্ত বন্দোবস্ত করে দুষ্টমতি দুর্যোধন পাণ্ডবদের বললেন—
গঙ্গাঞ্চৈবানুযাস্যাম উদ্যানবনশোভিতাম্।সহিতা ভ্রাতরঃ সর্ব্বে জলক্রীড়ামবাপ্নুমঃ।।
উদ্যানবনশোভিত গঙ্গাতীরে সব ভাইয়েরা মিলে, চল, জলক্রীড়া উপভোগ করি। সেই সুরম্য স্থানে কৌরব ও পাণ্ডবেরা খেলাচ্ছলে ভোজ্যদ্রব্য পরস্পরের মুখে তুলে দিতে লাগলেন। সেই সুযোগে দুর্যোধন ভীমের খাদ্যে কালকূট বিষ মিশিয়ে দিলেন। কাজটি করে মনে মনে কৃতকার্যের হাসি হাসলেন দুর্যোধন। মনটি যে তার শাণিত ক্ষুরের মতো হৃদয়েন ক্ষুরোপমঃ ধারালো আর মুখের কথা যেন ভাই বা সুহৃদের মুখের অমৃততুল্য বাক্য।
সুখিনী সা পুরা ভূত্বা সততং পুত্রবৎসলা। প্রপন্নং দীর্ঘমধ্বানং সংক্ষিপ্তং তদমন্যত।।
পাণ্ডুনন্দনদের বয়স তখন যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের যথাক্রমে ষোড়শ, পঞ্চদশ ও চতুর্দশ বৎসর আর নকুল, সহদেবের ত্রয়োদশ বৎসর। পিতামহ ভীষ্মের কাছে পৌত্রদের জন্মবৃত্তান্ত জানালেন বয়োবৃদ্ধ তপস্বী। জানালেন পাণ্ডপুত্রদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বেদাধ্যয়নে পারদর্শিতা সবকিছুই মনোমুগ্ধকর। সবকিছু জ্ঞাত হয়ে বিদুর ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাণ্ডু ও মাদ্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। পাণ্ডুর পাঁচপুত্র এবং ধৃতরাষ্ট্রের শতসংখ্যক সুত জলে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতোই বিকশিত হতে লাগল অমলিন শৈশবে।
তে চ পঞ্চ শতঞ্চৈব কুরুবংশবর্দ্ধনাঃ।সর্ব্বে ববৃধুরল্পেন কালেনাপ্স্বিব নীরজাঃ।।
পাণ্ডুপুত্রেরা ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সঙ্গে খেলাধূলায় সর্বদাই প্রধান, বিশিষ্ট। গতিবেগে, লক্ষ্যপূরণে, ভোজনে, ধুলো ও লগুড় প্রভৃতির প্রয়োগে ধার্তরাষ্ট্রদের (ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের) অনায়াসে পরাজিত করতেন ভীমসেন। নানান খুনসুটিতে তার জুড়ি মেলা ভার। যেমন শতভ্রাতার মধ্যে কাউকে লুকিয়ে রাখা, পরস্পরের মাথা ঠুকে দেওয়া, ফলের সঙ্গে তাদেরকেও গাছ থেকে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি দুষ্টুমিতে সে সকলের অগ্রবর্তী। বালকসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভীম ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন ভাবলেন, বলবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই কুন্তীপুত্র বৃকোদর।
স্পর্দ্ধতে চাপি সহিতানস্মানেকো বৃকোদরঃ
আমাদের সংহত ঐক্যকেও সেই একমাত্র প্রতিস্পর্ধা দেখাতে পারে। অতএব তাকে ছেটে ফেলা যাক। এরপর যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে কারারুদ্ধ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। রাজা হওয়া কে আটকায়?
গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে উদকক্রীড়ন নামে মণ্ডপে চব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়ের উপযুক্ত বন্দোবস্ত করে দুষ্টমতি দুর্যোধন পাণ্ডবদের বললেন—
গঙ্গাঞ্চৈবানুযাস্যাম উদ্যানবনশোভিতাম্।সহিতা ভ্রাতরঃ সর্ব্বে জলক্রীড়ামবাপ্নুমঃ।।
উদ্যানবনশোভিত গঙ্গাতীরে সব ভাইয়েরা মিলে, চল, জলক্রীড়া উপভোগ করি। সেই সুরম্য স্থানে কৌরব ও পাণ্ডবেরা খেলাচ্ছলে ভোজ্যদ্রব্য পরস্পরের মুখে তুলে দিতে লাগলেন। সেই সুযোগে দুর্যোধন ভীমের খাদ্যে কালকূট বিষ মিশিয়ে দিলেন। কাজটি করে মনে মনে কৃতকার্যের হাসি হাসলেন দুর্যোধন। মনটি যে তার শাণিত ক্ষুরের মতো হৃদয়েন ক্ষুরোপমঃ ধারালো আর মুখের কথা যেন ভাই বা সুহৃদের মুখের অমৃততুল্য বাক্য।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৪: ইল্বল-বাতাপির বিনাশ কাহিনি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক
স বাচা অমৃতকল্পো২থ ভ্রাতৃবচ্চ সুহৃদ্ যথা।।
জলক্রীড়ায় রত ভীমসেন বিষক্রিয়ায় নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। দুর্যোধন তাকে লতাপাশে বদ্ধ করে জলে নিক্ষেপ করলেন। সংজ্ঞাহীন ভীমসেন জলের অভ্যন্তরে বহু নাগকে দেহভারে নিপীড়িত করে নাগভবনে প্রবেশ করলেন। হিংস্র, ভয়ানক বিষধর নাগেরা তাকে ভীষণভাবে দংশন করতে লাগল। বিষে বিষক্ষয় হল তাতে। শাস্ত্রে আছে, বিষক্রিয়ার ওষুধই বিষ। সাপেদের দংশনের বিষ হল জঙ্গম বিষ। এই জঙ্গম বিষ ভীমসেনের শরীরস্থ স্থাবর বিষকে বিনষ্ট করল। ভীমসেন সংজ্ঞা লাভ করেই লতাবন্ধন ছিন্ন করলেন। নাগেরা ভয়ে পালিয়ে গিয়ে নাগরাজ বাসুকিকে বলবান মানুষটি সম্বন্ধে জানালেন। নাগরাজ অতিলৌকিক বলশালী ভীমসেনকে দেখে তাঁর নিজের দৌহিত্র পাণ্ডবমাতা কুন্তীর পিতা কুন্তীভোজের দৌহিত্র অর্থাৎ কন্যার পুত্র হিসেবে চিনতে পারলেন। খুশি মনে নাগেদের প্রস্তাবিত রসায়নপানে ভীমসেনকে আপ্যায়িত করলেন। একটি কুণ্ডের রসায়ন সহস্র হস্তিবলের জন্মদেয়। একেকটি যেন অমৃতের হ্রদ। ভীমসেন, এবমষ্টৌ স কুণ্ডানি হ্যপিবৎ পাণ্ডুনন্দনঃ আটটি কুণ্ডের রসায়ন পান করলেন। দশ হাজার হাতির বলের সমান বলের অধিকারী হলেন ভীম।
এদিকে যুধিষ্ঠির এইসব চক্রান্তের কথা বুঝতেই পারেননি। কারণ সাধুব্যক্তি নিজের সাধুতার দৃষ্টান্ত দিয়ে সচ্চিন্তায় অন্যকেও সাধু দেখে থাকেন। মা কুন্তী আকুল হয়ে উঠলেন, ভীম কোথায়? কোথায় ভীম? যুধিষ্ঠিরকে আদেশ দিলেন, শীঘ্রমন্বেষণে যত্নং কুরু তার সন্ধানে সত্বর যত্নবান হও। বিদুরকে নিখোঁজ ভীমের বৃত্তান্ত জানালেন উদ্বিগ্না কুন্তী। বহু অনুসন্ধানেও ভীমের খবর মিলল না। মায়ের মন কু গাইল,
ন চ প্রীণয়তে চক্ষুঃ সদা দুর্যোধনস্য সঃ। ক্রূরোঽসৌ দুর্ম্মতিঃ ক্ষুদ্রো রাজ্যলুব্ধোঽনপত্রপঃ।।
দুর্যোধনের চক্ষুশূল সে (ভীমসেন)। দুর্যোধন খল এবং দুষ্টবুদ্ধি, রাজ্যলোভী, নির্লজ্জ সে।
নিহন্যাদপি তং বীরং জাতমন্যুঃ সুযোধনঃ।
ক্রুদ্ধ দুর্যোধন নিশ্চয়ই সেই বীরকে মেরে ফেলেছে, বিদুরের কাছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন মা কুন্তী। বিদুর তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, পূজনীয় বেদব্যাস বলেছেন, আপনার পুত্ররা দীর্ঘায়ু হবেন তাই এত বড় কথা বলবেন না।
জলক্রীড়ায় রত ভীমসেন বিষক্রিয়ায় নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। দুর্যোধন তাকে লতাপাশে বদ্ধ করে জলে নিক্ষেপ করলেন। সংজ্ঞাহীন ভীমসেন জলের অভ্যন্তরে বহু নাগকে দেহভারে নিপীড়িত করে নাগভবনে প্রবেশ করলেন। হিংস্র, ভয়ানক বিষধর নাগেরা তাকে ভীষণভাবে দংশন করতে লাগল। বিষে বিষক্ষয় হল তাতে। শাস্ত্রে আছে, বিষক্রিয়ার ওষুধই বিষ। সাপেদের দংশনের বিষ হল জঙ্গম বিষ। এই জঙ্গম বিষ ভীমসেনের শরীরস্থ স্থাবর বিষকে বিনষ্ট করল। ভীমসেন সংজ্ঞা লাভ করেই লতাবন্ধন ছিন্ন করলেন। নাগেরা ভয়ে পালিয়ে গিয়ে নাগরাজ বাসুকিকে বলবান মানুষটি সম্বন্ধে জানালেন। নাগরাজ অতিলৌকিক বলশালী ভীমসেনকে দেখে তাঁর নিজের দৌহিত্র পাণ্ডবমাতা কুন্তীর পিতা কুন্তীভোজের দৌহিত্র অর্থাৎ কন্যার পুত্র হিসেবে চিনতে পারলেন। খুশি মনে নাগেদের প্রস্তাবিত রসায়নপানে ভীমসেনকে আপ্যায়িত করলেন। একটি কুণ্ডের রসায়ন সহস্র হস্তিবলের জন্মদেয়। একেকটি যেন অমৃতের হ্রদ। ভীমসেন, এবমষ্টৌ স কুণ্ডানি হ্যপিবৎ পাণ্ডুনন্দনঃ আটটি কুণ্ডের রসায়ন পান করলেন। দশ হাজার হাতির বলের সমান বলের অধিকারী হলেন ভীম।
এদিকে যুধিষ্ঠির এইসব চক্রান্তের কথা বুঝতেই পারেননি। কারণ সাধুব্যক্তি নিজের সাধুতার দৃষ্টান্ত দিয়ে সচ্চিন্তায় অন্যকেও সাধু দেখে থাকেন। মা কুন্তী আকুল হয়ে উঠলেন, ভীম কোথায়? কোথায় ভীম? যুধিষ্ঠিরকে আদেশ দিলেন, শীঘ্রমন্বেষণে যত্নং কুরু তার সন্ধানে সত্বর যত্নবান হও। বিদুরকে নিখোঁজ ভীমের বৃত্তান্ত জানালেন উদ্বিগ্না কুন্তী। বহু অনুসন্ধানেও ভীমের খবর মিলল না। মায়ের মন কু গাইল,
ন চ প্রীণয়তে চক্ষুঃ সদা দুর্যোধনস্য সঃ। ক্রূরোঽসৌ দুর্ম্মতিঃ ক্ষুদ্রো রাজ্যলুব্ধোঽনপত্রপঃ।।
দুর্যোধনের চক্ষুশূল সে (ভীমসেন)। দুর্যোধন খল এবং দুষ্টবুদ্ধি, রাজ্যলোভী, নির্লজ্জ সে।
নিহন্যাদপি তং বীরং জাতমন্যুঃ সুযোধনঃ।
ক্রুদ্ধ দুর্যোধন নিশ্চয়ই সেই বীরকে মেরে ফেলেছে, বিদুরের কাছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন মা কুন্তী। বিদুর তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, পূজনীয় বেদব্যাস বলেছেন, আপনার পুত্ররা দীর্ঘায়ু হবেন তাই এত বড় কথা বলবেন না।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৯: ‘মেরা কুছ সামান…’ গানে সুর দেওয়ার প্রস্তাবে গুলজারকে পত্রপাঠ বিদায় জানান পঞ্চম
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে: আপনি কি বডি শেমিং-এর শিকার?
প্রত্যাদিষ্টো হি দুষ্টাত্মা শেষেঽপি প্রহরেত্তব।
তিরস্কৃত হলে সেই দুষ্ট দুর্যোধন হয়তো আরও অনিষ্ট করতে পারেন তাই “শেষরক্ষণং কুরু শেষরক্ষা করুন অর্থাৎ সংযত হোন। দশ হাজার হস্তিবলে বলশালী ভীমসেন অবশেষে ফিরে এলেন। সব শুনে দুর্যোধনের চক্রান্তের কথা বাইরে যেন প্রকাশ না পায়, সে বিষয়ে ভাইদের সতর্ক করে দিলেন যুধিষ্ঠির। বললেন—
ইতঃ প্রভৃতি কৌন্তেয়া রক্ষোতান্যোন্যমাদৃতঃ
হে কৌন্তেয়গণ, আজ থেকে তোমরা পরস্পরের রক্ষায় যত্নবান হও।
এরপর কৃপাচার্যের কাছে কুরুপাণ্ডবদের ধনুর্বিদ্যাচর্চা শুরু হল। কালক্রমে অস্ত্রশিক্ষার ভার নিলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য।
কৌরবদের মা গান্ধারী তিনি কুমারী অবস্থাতেও মহাদেবকে আরাধনায় তুষ্ট করে শতপুত্রলাভের বর পেয়েছিলেন। কোনও দেবতার ঔরসে নয়, স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গর্ভধারণ করেছিলেন। দৈবানুগ্রহ ছিল শুধু দেবাদিদেবের শতপুত্রলাভের বরদানে। গান্ধারী মুক্তমনা, স্বামীর অন্ধত্বের সমদুঃখভাগিনী হয়ে বস্ত্রাবৃত করলেন দৃষ্টশক্তিকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় কুন্তীর পুত্রলাভের সংবাদে দুঃখভারাক্রান্ত মনে গর্ভপাত করলেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। তাঁর এই আচরণ — বংশের রাজমাতা হওয়ার গৌরবের সম্ভাবনা লুপ্তপ্রায় দেখে চরম ব্যর্থতায় ভেঙ্গে পড়া নয়? বড় আদরের প্রার্থিত কামনার ধন বরপুত্রদের সম্ভাবনাকে নির্মূল করতে গিয়ে একটুও বিবেকদংশন অনুভব করলেন না? তাঁর বহুকাঙ্খিত মাতৃত্বলাভের গরিমা উধাও হল শুধু পুত্রের রাজপদের অভিলাষে? একইভাবে রাজোচিত জ্যেষ্ঠত্বের মহিমা হারিয়ে চরম হতাশায় আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির। পরে তা সংক্রামিত হয়েছে গান্ধারীর অন্য পুত্রদের মধ্যেও।
তিরস্কৃত হলে সেই দুষ্ট দুর্যোধন হয়তো আরও অনিষ্ট করতে পারেন তাই “শেষরক্ষণং কুরু শেষরক্ষা করুন অর্থাৎ সংযত হোন। দশ হাজার হস্তিবলে বলশালী ভীমসেন অবশেষে ফিরে এলেন। সব শুনে দুর্যোধনের চক্রান্তের কথা বাইরে যেন প্রকাশ না পায়, সে বিষয়ে ভাইদের সতর্ক করে দিলেন যুধিষ্ঠির। বললেন—
ইতঃ প্রভৃতি কৌন্তেয়া রক্ষোতান্যোন্যমাদৃতঃ
হে কৌন্তেয়গণ, আজ থেকে তোমরা পরস্পরের রক্ষায় যত্নবান হও।
এরপর কৃপাচার্যের কাছে কুরুপাণ্ডবদের ধনুর্বিদ্যাচর্চা শুরু হল। কালক্রমে অস্ত্রশিক্ষার ভার নিলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য।
কৌরবদের মা গান্ধারী তিনি কুমারী অবস্থাতেও মহাদেবকে আরাধনায় তুষ্ট করে শতপুত্রলাভের বর পেয়েছিলেন। কোনও দেবতার ঔরসে নয়, স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গর্ভধারণ করেছিলেন। দৈবানুগ্রহ ছিল শুধু দেবাদিদেবের শতপুত্রলাভের বরদানে। গান্ধারী মুক্তমনা, স্বামীর অন্ধত্বের সমদুঃখভাগিনী হয়ে বস্ত্রাবৃত করলেন দৃষ্টশক্তিকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় কুন্তীর পুত্রলাভের সংবাদে দুঃখভারাক্রান্ত মনে গর্ভপাত করলেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। তাঁর এই আচরণ — বংশের রাজমাতা হওয়ার গৌরবের সম্ভাবনা লুপ্তপ্রায় দেখে চরম ব্যর্থতায় ভেঙ্গে পড়া নয়? বড় আদরের প্রার্থিত কামনার ধন বরপুত্রদের সম্ভাবনাকে নির্মূল করতে গিয়ে একটুও বিবেকদংশন অনুভব করলেন না? তাঁর বহুকাঙ্খিত মাতৃত্বলাভের গরিমা উধাও হল শুধু পুত্রের রাজপদের অভিলাষে? একইভাবে রাজোচিত জ্যেষ্ঠত্বের মহিমা হারিয়ে চরম হতাশায় আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির। পরে তা সংক্রামিত হয়েছে গান্ধারীর অন্য পুত্রদের মধ্যেও।
ছবি: সংগৃহীত।
মহাদেবের অনুগ্রহে এবং ব্যাসদেবের বরে ও তৎপরতায় শতপুত্রের পৃথিবীতে আগমন সম্ভব হয়েছে।প্রথমে লৌহপিণ্ডের মতো মাংসপিণ্ড যা ছিল স্টিল বর্ন বেবি, তার থেকে শতজীবনের সৃজনের রূপকার প্রথম কুরুবংশের বংশরক্ষক মহর্ষি ব্যাসদেব। তাঁর এবং স্বয়ং মহাদেবের বরদান ব্যর্থ হতে পারে না। দুই মহানের ইচ্ছে সফল হয়েছে মাংসের মণ্ডে প্রাণসঞ্চারে। কিন্তু এ কী ছন্দপতন? প্রথমেই দুর্যোধনের জন্মে অশুভলক্ষণ। যে কোনও শিশুর জন্মে কোন আকস্মিকতা নেই। প্রত্যেক শিশুর জন্মমুহূর্তই তাৎপর্যহীন, প্রত্যহিক ঘটনা। জন্ম কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সূচক হতে পারে না। তবে? লৌকিক পৃথিবীর পিতামাতার সন্তান বলেই কী হিংসা, দ্বেষ,প্রতিহিংসার বাহুল্য? শিশু মনস্তত্বেও তার প্রতিফলন? পঞ্চপাণ্ডব অতিলৌকিক গুণের অধিকারী। কুন্তী তিনজন দেবতার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে লাভ করেছিলেন যুধিষ্ঠির,ভীম অর্জুনকে। মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ঔরসে জন্ম দিয়েছিলেন নকুল ও সহদেবকে। বাস্তবজীবনে পঞ্চপাণ্ডুপুত্রের মতো কৃতী হয়তো দেখা যায়। বিরল প্রতিভার, অসাধারণ জিনিয়াসের অভাব নেই পৃথিবীতে।
এঁদের কাম, ক্রোধ,লোভ, মোহ, মাৎসর্য, প্রতিহিংসাপ্রবণতা, বিদ্বেষ—সবকিছুই থাকে কখনও প্রচ্ছন্নভাবে কখনও প্রয়োজনে প্রকট হয় এই নাস্ত্যর্থক নেগেটিভ দিকগুলো, ঠিক পঞ্চপাণ্ডবমুখ্যদের মতোই। মানুষের মধ্যে ষড়রিপুহীন ব্যক্তিত্ব বিরল। মহাপুরুষ ছাড়া পৃথিবীতে অপার্থিব গুণে গুণী বলে কী কেউ আছেন? পৃথিবীর মাটিতে মানুষ অপার্থিব উচ্চতায় পৌঁছতে পারে গুণাধিক্যে, উচ্চচিন্তায়, ধার্মিকতায়, নীতিবোধে। সবমিলিয়ে যাঁরা জিনিয়াস, বিশিষ্ট, কৃতী, তাঁরা প্রাকৃত জনমানসে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কতুল্য আর সেইসঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাস যদি যুক্ত হয় তাহলে তো তাঁরা সমাজের চোখের মণি হয়ে ওঠেন। যেমনটি ঘটেছিল পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে। লৌকিক অলৌকিকের দ্বৈরথ, টানাপোড়েন, জয়পরাজয় নিয়েই যে পার্থিব জীবন।আবহমান ভারতজীবন এই সবকিছু নিয়েই সতত প্রবহমান।—চলবে
এঁদের কাম, ক্রোধ,লোভ, মোহ, মাৎসর্য, প্রতিহিংসাপ্রবণতা, বিদ্বেষ—সবকিছুই থাকে কখনও প্রচ্ছন্নভাবে কখনও প্রয়োজনে প্রকট হয় এই নাস্ত্যর্থক নেগেটিভ দিকগুলো, ঠিক পঞ্চপাণ্ডবমুখ্যদের মতোই। মানুষের মধ্যে ষড়রিপুহীন ব্যক্তিত্ব বিরল। মহাপুরুষ ছাড়া পৃথিবীতে অপার্থিব গুণে গুণী বলে কী কেউ আছেন? পৃথিবীর মাটিতে মানুষ অপার্থিব উচ্চতায় পৌঁছতে পারে গুণাধিক্যে, উচ্চচিন্তায়, ধার্মিকতায়, নীতিবোধে। সবমিলিয়ে যাঁরা জিনিয়াস, বিশিষ্ট, কৃতী, তাঁরা প্রাকৃত জনমানসে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কতুল্য আর সেইসঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাস যদি যুক্ত হয় তাহলে তো তাঁরা সমাজের চোখের মণি হয়ে ওঠেন। যেমনটি ঘটেছিল পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে। লৌকিক অলৌকিকের দ্বৈরথ, টানাপোড়েন, জয়পরাজয় নিয়েই যে পার্থিব জীবন।আবহমান ভারতজীবন এই সবকিছু নিয়েই সতত প্রবহমান।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।