শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহাভারতের একজন বিখ্যাত অস্ত্রগুরু পরশুরাম। ঋষি জমদগ্নির ঔরসে রাজা প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকার গর্ভে তাঁর জন্ম। পরশুরামের প্রপিতামহ ভৃগু তাঁর পুত্রবধূ বিশ্বামিত্রের ভগিনী গাধিরাজার কন্যা সত্যবতীকে সুপুত্রলাভের বর দিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত যে পুত্রলাভের যোগ্যতা অর্জন করলেন সত্যবতী, ভৃগুঋষির ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে সেই পুত্রটি হবে ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রবৃত্তির্বৈ তব পুত্রো ভবিষ্যতি। ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয়বৃত্তি হবে তোমার পুত্রের। পুত্রবধূ অনুরোধ করলেন, তাঁর নিজের পুত্র নয়, পৌত্র যেন ভৃগুনির্দিষ্ট গুণাবলীবিশিষ্ট হন। মাতা রেণুকার পাঁচপুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পরশুরাম। একদা রাজা চিত্ররথকে পত্নীর সঙ্গে জলকেলিরত অবস্থায় দেখে মাতা রেণুকা কামার্ত, ভীত, ত্রস্ত অবস্থায় আশ্রমে ফিরে এলেন। মহাতেজা ঋষি জমদগ্নির কাছে স্ত্রীর এই চিত্তবিকার অসহনীয়। চারপুত্রকে মাতৃহত্যার আদেশ দিলেন। পুত্ররা এই নৃশংস কাজে সম্মত হলেন না। পিতার অভিশাপে জড়বুদ্ধি পশুপক্ষীতে পরিণত হলেন তাঁরা। কনিষ্ঠ পরশুরাম পিতার আদেশমাত্র তাঁর পরশু অর্থাৎ কুঠার দিয়ে মায়ের শিরশ্ছেদ করলেন। তত আদায় পরশুং রামো মাতুঃ শিরোঽহরৎ। সন্তুষ্ট পরিতৃপ্ত পিতা প্রীতিভরে পুত্রকে ইচ্ছাপূরণের বর দিতে চাইলেন। পরশুরাম কী বর চাইলেন? তাঁর প্রথম অভীষ্ট বর ছিল, মায়ের পুনর্জীবন এবং সেই সঙ্গে মায়ের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিনাশ। এরপরে অভিশপ্ত ভাইদের স্বাভাবিকজীবন এবং যুদ্ধে তাঁর নিজের অপ্রতিরোধ্য জয় এবং দীর্ঘায়ু। পিতা জমদগ্নি তাঁর সবগুলি ইচ্ছাই পূর্ণ করলেন।

একদা রাজা কার্ত্তবীর্য্যার্জুন ঋষি জমদগ্নির আশ্রমে আতিথ্যগ্রহণ করলেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় আতিথেয়তায়ও প্রবল অসন্তোষ তাঁর। ঋষির হোমধেনুর বৎসটি বলপূর্বক হরণ করলেন। আশ্রমের সেরা বৃক্ষগুলি ভেঙ্গে দিলেন। পরশুরাম সব বৃত্তান্ত শুনে হোমধেনুটির আর্তনাদে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে কার্ত্তবীর্য্যার্জুনের সহস্র বাহু ছেদন করলেন। মৃত্যু হল রাজার। পরশুরামের অনুপস্থিতিতে কার্ত্তবীর্য্যার্জুনের পুত্ররা আশ্রমে এসে তপস্যারত নিরস্ত্র জমদগ্নিকে হত্যা করলেন। আশ্রমে ফিরে এসে সব শুনে পরশুরাম যথাযোগ্য মর্যাদায় পিতার এই অসময়োচিত মৃত্যুতে দুঃখে বিলাপ করতে লাগলেন। মমাপরাধাত্তৈঃ ক্ষুদ্রৈর্হতস্ত্বং তাত বালিশৈঃ।কার্ত্তবীর্য্যস্য দায়াদৈর্বনে মৃগ ইবেষুভিঃ।। কার্ত্তবীর্য্যার্জুনের
নীচাশয়, মূর্খ, পুত্ররা অসহায় হরিণবধের মতো আপনাকে হত্যা করল, এ অপরাধ আমার। মৃত্যুরেবংবিধো যুক্তঃ সর্ব্বভূতেষ্বনাগসঃ সব প্রাণীদের প্রতি যিনি নিরপরাধ, তাঁর এই মৃত্যু অসঙ্গত। পিতার অন্তিম সংস্কার সম্পন্ন করে মূর্তিমান যমের মতো পরশুরাম কার্ত্তবীর্য্যার্জুনের পুত্রদের হত্যা করলেন। ক্ষত্রিয়বর্ণের ওপর ক্রোধে একুশবার পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য করে তুললেন। অবশেষে প্রয়াত পিতামহ ঋচীকমুনির অনুরোধে ক্ষত্রিয়নিধনযজ্ঞ থেকে বিরত হলেন পরশুরাম। মহাত্মা কশ্যপকে বিজিত পৃথিবী দান করে মহেন্দ্রপর্বতে তপস্যায় নিরত হলেন তিনি।
পরশুরামের একজন বিখ্যাত শিষ্য কুরুপাণ্ডবদের পিতামহ ভীষ্ম। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কৌরবদের নেতৃত্বে তখন পিতামহ ভীষ্ম। যুদ্ধোদ্যোগের প্রারম্ভে তিনি জানালেন, দ্রুপদরাজপুত্র শিখণ্ডী যদি সম্মুখে থাকেন তবে তিনি তাঁর প্রতিরোধে অস্ত্রধারণ করবেন না।
পাঞ্চাল্যন্তু মহাবাহো! নাহং হন্যাং শিখণ্ডিনম্। উদ্যতেষুমথো দৃষ্ট্বা প্রতিযুধ্যন্তমাহবে।। পিতামহের কেন এমন সিদ্ধান্ত? প্রবল উৎকণ্ঠায় ধৃতরাষ্ট্রপুত্র জানতে চাইলেন। মাননীয় ভীষ্ম তখন শিখণ্ডী কেন তাঁর কাছে অবধ্য তার কারণ বর্ণনা করলেন, এই প্রসঙ্গে গুরু পরশুরামের যোগসূত্রটি এর সঙ্গে ঠিক কোথায়? সেই কাহিনিও বাদ গেলনা তাঁর বিবরণে। ভীষ্মের বয়ানে শুরু হল সেই কাহিনি। হস্তিনাপুরের রাজা তখন সত্যবতীপুত্র, ভীষ্মের বৈমাত্রেয় কনিষ্ঠ ভাই বিচিত্তবীর্য্য। কাশীরাজের বীর্য্যশুল্কা তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করে নিয়ে এলেন জ্যেষ্ঠ ভীষ্ম। শৌর্যবলেই এই হরণ, কারণ সেটিই ছিল শর্ত। ভীষ্মের উদ্দেশ্য হল, কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে তিন কাশীরাজপুত্রীর বিবাহদান। অম্বা জানালেন, তিনি মনে মনে শাল্বরাজাকে স্বামীরূপে বরণ করেছেন। শাল্বরাজাও গোপনে অম্বার পিতার অগোচরে তাঁকেই পত্নীরূপে গ্রহণ করেছেন। কাজেই কৃপা করে ধার্মিক সত্যনিষ্ঠ ভীষ্ম যেন অম্বাকে রেহাই দেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের এবং ভীষ্মের অনুমতিক্রমে অম্বা শাল্বরাজসমক্ষে উপস্থিত হয়ে পূর্বপ্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিলেন। রাজা শাল্ব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন তাঁকে। অম্বার কাকুতি, মিনতি, অনুরোধ, উপরোধ, যুক্তি সবকিছু ব্যর্থ হল। সাশ্রুনেত্রে প্রবল মনঃকষ্ট নিয়ে রোরুদ্যমানা অম্বা নিজের দুর্ভাগ্যের জন্যে দায়ী পিতা কাশীরাজকে, শাল্বরাজাকে এবং ভীষ্মকে ধিক্কার দিতে লাগলেন।

পরিশেষে সবকিছুর মূলে ওই ভীষ্ম, তাঁকেই নিজের দুর্ভাগ্যের প্রধান কারণরূপে চিহ্নিত করলেন। প্রতিশোধের দুটি পথ, হয় যুদ্ধ না হয় তপস্যা। পুণ্যবান তপস্বীদের আশ্রমে প্রব্রজ্যা অবলম্বনে দুষ্কর তপস্যায় মনোনিবেশ করবেন স্থির করলেন। আশ্রমবাসীরা তাঁকে সম্ভাব্য বিপদের কথা বলে নিরুৎসাহ করলেন। শুধুমাত্র সেখানে উপস্থিত অম্বার মাতামহ মহর্ষি এবং রাজর্ষি হোত্রবাহন তাঁকে পরামর্শ দিলেন এই মর্মে যে জমদগ্নিপুত্র তপস্বী পরশুরাম অম্বার দুঃখ দূর করতে সক্ষম। কারণ ভীষ্ম যদি গুরু পরশুরামের প্রস্তাব না মানেন তবে যুদ্ধে তিনি ভীষ্মকে বধ করবেন। হনিষ্যতি রণে ভীষ্মং ন করিষ্যতি চেদ্বচঃ। অম্বা পরশুরামকে তাঁর অপহরণ এবং প্রত্যাখ্যান বৃত্তান্ত জানিয়ে অনুরোধ করলেন, ভীষ্মং জহি মহাবাহো!যৎকৃতে দুঃখমীদৃশম্
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২৪: দুই অবতার মুখোমুখি, কী মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে এই সাক্ষাতে?

উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া: প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস

যার কারণে এইরকম দুঃখ, হে মহাবাহু, সেই ভীষ্মকে বধ করুন। পরশুরাম সাহায্যদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, শুধুমাত্র ব্রহ্মবিদদের প্রয়োজনেই তিনি অস্ত্রধারণ করেন,অন্য কারণে নয়। অনুচর অকৃতব্রণ স্মরণ করিয়ে দিলেন, শরণাগতাং মহাবাহো! কন্যাং ন ত্যক্তুমর্হসি। আপনার শরণ নিয়েছেন এই কন্যা, তাঁকে আপনি ত্যাগ করতে পারেননা। ক্ষত্রিয়জয়ের পরে ব্রাহ্মণদের কাছে পরশুরামের তিনটি প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণে আনলেন অকৃতব্রণ। একটি হল—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই ত্রিবর্ণ যদি ধর্মবিরুদ্ধ আচরণ করে তবে সেই অধর্মাচরণকারীকে যুদ্ধে পরাজিত করবেন। পরশুরাম আরও বলেছিলেন,তাঁর নিজের জীবিত অবস্থায় ভীত এবং শরণার্থীকে কখনো পরিত্যাগ করবেননা।আর একটি প্রতিজ্ঞা হল, যে ব্যক্তি যুদ্ধে সমাগত সকল ক্ষত্রিয়কে জয় করবেন সেই তেজস্বীকে তিনি বধ করবেন।

শরণার্থী হয়ে এসেছেন এক ক্ষত্রিয়া আর প্রতিপক্ষ একজন বিজয়ী ক্ষত্রিয়বীর। তাই যুদ্ধে আপত্তি কোথায়? পরশুরাম কুরুরাজ্যে উপস্থিত হলে মাননীয় ভীষ্ম যথাযোগ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁকে বরণ করলেন। পরশুরাম ভীষ্মকে বললেন, ভীষ্ম!কাং বুদ্ধিমাস্থায় কাশীরাজসুতা তদা। অকামেন ত্বয়ানীতা পুনশ্চৈব বিসর্জিতা।। ওহে ভীষ্ম,নিজে কামনার বশবর্তী হয়ে নয়, তবে কোন বুদ্ধিতে কাশীরাজকন্যাটিকে হরণ করে আবার তাঁকে ত্যাগ করলে? শাল্বরাজার প্রত্যাখ্যাতা কন্যাটিকে আমার আদেশে পুনর্গ্রহণ কর। তস্মাদিমাং মন্নিয়োগাৎ প্রতিগৃহ্ণীষ্ব ভারত! ভীষ্ভম জানালেন, ভয়ে, দয়ায়, অর্থলোভে কোনও অবস্থাতেও ক্ষত্রিয়ধর্ম বিসর্জন দিতে পারবেন না।

ভীষ্মের উত্তরে ক্রোধে আত্মহারা হয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে বার বার বলতে লাগলেন, হনিষ্যামি সহামাত্যং ত্বামদ্যেতি পুনঃ পুনঃ আমি তোমাকে অমাত্যসহ হত্যা করব। ভৃগুশ্রেষ্ঠকে শান্ত করবার চেষ্টা নিষ্ফল হল। ভীষ্মকে চতুর্বিধ বাণাস্ত্রপ্রয়োগবিদ্যাবিষয়ে আচার্য পরশুরামই শিক্ষা দিয়েছিলেন, গুরুকে বললেন, হে ভার্গব আমি যে আপনার শিষ্য। উপদিষ্টং মহাবাহো! শিষ্যোঽস্মি তব ভার্গব ভার্গব পরশুরামের শত অনুরোধেও ভীষ্ম তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল।অম্বাকে গ্রহণের সিদ্ধান্ত তিনি কোনমতেই মেনে নিলেন না। তিনি পুরাণের শ্লোক উল্লেখ করে বললেন, গর্বিত,কর্ত্তব্য এবং অকর্ত্তব্যবিষয়ে অজ্ঞ, অসৎপথাবলম্বী গুরুকে পরিত্যাগ করা উচিত। স ত্বং গুরুরিতি প্রেম্ণা ময়া সম্মানিতো ভৃশম্। গুরুবৃত্তিং ন জানীষ্বে তস্মাদ্ যোৎস্যামি বৈ ত্বয়া।। আপনি গুরু তাই ভালবেসে বহু সম্মান করেছি।কিন্তু গুরুবৃত্তি আপনি জানেন না তাই আপনার সঙ্গে যুদ্ধই শ্রেয়। ভীষ্ম আরও বললেন, যখন ক্ষত্রিয়নিধনে একচ্ছত্র আধিপত্যবিস্তার করেছিলেন তখন এই আমার মতো ক্ষত্রিয়, এই ভীষ্ম জন্মগ্রহণ করেননি। তাই আপনার ক্রোধাগ্নিতে তৃণবৎ দগ্ধ হয়েছিল ক্ষত্রিয়কুল। নং তদা জাতবান্ ভীষ্মঃ ক্ষত্রিয়ো বাপি মদ্বিধঃ।

এই কথা বলে ভীষ্ম জানালেন এক সংশয়হীন সত্য—আসন্ন যুদ্ধে তিনি পরশুরামের দর্পচূর্ণ করবেন। ব্যপনেষ্যামি তে দর্পং যুদ্ধে রাম!ন সংশয়ঃ।।* সমান বিক্রমে পরশুরামের প্রত্যুত্তর, *তত্র ত্বাং নিহতং মাতা ময়া শরশতাচিতম্। জাহ্নবী পশ্যতাং ভীষ্ম! গৃধ্রকঙ্কবলাশনম্।। আমি শত শত বাণদ্বারা তোমার শরীর আচ্ছন্ন করে তোমায় বধ করব। তখন শকুন, কঙ্ক, কাক তোমায় ভক্ষণ করবে। তোমার মা গঙ্গাদেবী তা দর্শন করুন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান

ক্লাসরুম: আমার জীবনের সেরা উপহার, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট শুনে মায়ের সেই তৃপ্তির হাসি

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

ভয়ে ত্রস্ত মা গঙ্গা ভীষ্মকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, পরশুরাম শিবের তুল্য শৌর্যশালী এবং ক্ষত্রিয়নিহন্তা, তাঁর সঙ্গে কেন এই অসমযুদ্ধ? তিনি পরশুরামকেও শিষ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে বিরত থাকবার অনুরোধ জানালেন। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। দুই শ্রেষ্ঠবীর, গুরু ও শিষ্য পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলেন। দীর্ঘদিন সে যুদ্ধ চলল। সেই মহাযুদ্ধে পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, বনভূমি, পাহাড়, প্রাণীকুল সবকিছু অস্ত্রজনিত দূষণের প্রভাবে যেন হাহাকার করে উঠল। ত্রিলোকে কুপ্রভাব বিস্তার করল এই যুদ্ধ। দেবতারা যুধ্যমান উভয়কেই অস্ত্রসংবরণের অনুরোধ জানালেন। দুই বীরই অবধ্য—স্বীকৃতি দিলেন তাঁরা।ক্ষতবিক্ষতদেহে ভীষ্ম গুরুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।গুরু পরশুরাম সস্নেহে স্বীকার করলেন ভীষ্মের তুল্য বীর পৃথিবীতে কোথাও নেই। তিনি তাঁর যুদ্ধে তুষ্ট হয়েছেন। অম্বার কাছে পরশুরাম স্বীকার করলেন তিনি যুদ্ধে ভীষ্মকে পরাজিত করতে পারলেন না। অম্বা নিজসামর্থ্যে ভীষ্মনিধনের নিমিত্ত কঠোর তপস্যা করবেন মনস্থ করলেন।পরবর্তী জন্মে এই অম্বাই শিখণ্ডীরূপে জন্মগ্রহণ করলেন দ্রুপদরাজগৃহে। তিনি মহান ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হলেন।

পরশুরামের অপর একজন প্রসিদ্ধ শিষ্য সূর্যের ঔরসে পাণ্ডুভার্যা কুন্তীর কুমারী অবস্থায় গর্ভজাত পুত্র কর্ণ। নিঃসন্তান এক সূতদম্পতি তাঁকে পালন, পোষণ করে অস্ত্রশিক্ষার্থে হস্তিনাপুরে প্রেরণ করলেন। সেই পুত্র দ্রোণাৎ কৃপাচ্চ রামাচ্চ সোঽস্ত্রগ্রামং চতুর্বিধং। লব্ধ্বা লোকেঽভবৎ খ্যাতঃ পরমেষ্বাসতাং গতঃ। সেই সুতপুত্র কর্ণ, আচার্য দ্রোণ, কৃপ, পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করে জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। কর্ণ অর্জুনের ধনুর্বেদে শ্রেষ্ঠত্বে ঈর্ষান্বিত হয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে মন্ত্র ও নির্মাণের উপায়সহ ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কর্ণের উদ্দেশ্য অর্জুনের সমকক্ষ হয়ে যুদ্ধে তাঁকে পরাস্ত করা। আচার্য দ্রোণ তাঁকে প্রকারান্তরে ওই ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যাদান অস্বীকার করলেন, ব্রাহ্মণ ও তপস্বী ক্ষত্রিয়ই শুধু এই বিদ্যা শিক্ষালাভের যোগ্য।অন্য কোন বর্ণ নয়। নান্যো বিদ্যাৎ কথঞ্চন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ

কর্ণ উপস্থিত হলেন মহেন্দ্রপর্বতবাসী পরশুরামের কাছে। তিনি নিজেকে ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণ পরিচয়ে পরশুরামকে গুরুরূপে বরণ করলেন। পরশুরাম তাঁর শিষ্যত্ব স্বীকার করে নিলেন। শুরু হল কর্ণের তত্ত্বাবধানে অস্ত্রশিক্ষা। কর্ণের বাহুবল, শ্রদ্ধা, সংযম, গুরুশুশ্রূষায় ভার্গবশ্রেষ্ঠ তুষ্ট হলেন। কালক্রমে তপস্বী পরশুরাম তপস্বীর মতোই নিষ্ঠাবান কর্ণকে প্রয়োগ ও সংবরণকৌশলসহ ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা দান করলেন। একদা, বিশ্বস্ত স্নেহের পাত্র কর্ণের ক্রোড়ে মাথা রেখে নিদ্রিত হলেন ক্লান্ত গুরু পরশুরাম। একটি রক্তপায়ী ভয়ানক কীট কর্ণের উরু দংশন করল যখন, তখন, গুরুর পাছে নিদ্রাভঙ্গ হয় তাই অসহনীয় বেদনা সহ্য করে অনড় রইলেন কর্ণ। কীটটিকে উপেক্ষা করলেন। উরুতে রক্তপাত হল।

রক্তের স্পর্শে জেগে উঠে আচার্য শিষ্যকে বললেন, কথয়স্ব ভয়ং ত্যক্ত্বা যাথাতথ্যমিদং মম। ভীত হয়ে নয়, আমাকে যথাযথভাবে বল, ঘটনাটি কী? কীটদংশনের বৃত্তান্ত গুরুকে জানালেন কর্ণ। পরশুরাম সব অবগত হয়ে সক্রোধে কর্ণকে বললেন, অতিদুঃখমিদং মূঢ়! ন জাতু ব্রাহ্মণঃ সহেৎ। ক্ষত্রিয়েস্যেব তে ধৈর্য্যং কাময়া সত্যমুচ্যতাম্।। ওরে মূর্খ, এই অপরিসীম কষ্ট কোনও ব্রাহ্মণ সহ্য করতে পারে না। তোর ধৈর্য্য যে ক্ষত্রিয়ের মতো।স্বেচ্ছায় সত্যটি কী? বল। কর্ণ স্বীকার করলেন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মিলনে যে সূতজাতি, সেই সূতজাতিতে তাঁর জন্ম। গুরু পিতার মতোই, তাই গুরু পরশুরামের গোত্রানুযায়ী নিজেকে তিনি ভৃগুবংশীয়রূপে পরিচয় দিয়েছিলেন। ব্রহ্মাস্ত্রলাভের জন্যেই তাঁর এই মিথ্যা পরিচয়।

অভিশাপের ভয়ে কম্পমান কর্ণকে পরশুরাম সক্রোধে বললেন, এই লোভবশত মিথ্যাপরিচয়ের গুণাগার দিতে হবে কর্ণকে। সমপর্যায়ের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে শত্রুহননকালে এই বিদ্যা মনে থাকবেনা। পরশুরাম জানিয়ে দিলেন তাঁর আশ্রমে মিথ্যাবাদীর স্থান নেই। কিন্তু প্রবঞ্চক শিষ্যকে আশীর্বাদ দিতে ভুললেন না। ন ত্বয়া সদৃশো যুদ্ধে ভবিতা ক্ষত্রিয়ো ভুবি পৃথিবীতে কোন ক্ষত্রিয়ই তোমার তুল্য বীরযোদ্ধা হবেন না। কর্ণ আচার্য পরশুরামকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিলেন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ক্ষত্রিয়া মাতা আর ব্রাহ্মণ পিতার সন্তান পরশুরাম। জন্মসূত্রে তিনি ব্রাহ্মণ। সংবেদনশীলতা তাঁর মানবিক উত্তরাধিকার। পিতৃভক্ত পরশুরাম পিতার আদেশে মাতৃহন্তা হয়েছিলেন।হয়তো তিনি জানতেন পিতাকে তুষ্ট করে মায়ের প্রাণভিক্ষা করবেন এবং সফল হবেন। আনুগত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত পরশুরাম, যদিও কাহিনিটি অতি নৃশংস, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ক্ষত্রিয়রাজাদের এমন অনেক বিবেকহীনতার কাহিনিই যে মহাভারতের একটি অন্যতম উপজীব্য বিষয়। কার্ত্তবীর্য্যার্জুনের নিষ্ঠুর আচরণ তাই বিচলিত করে না যতটা বিচলিত করে ধেনুহরণের অপরাধে রাজাকে একজন আশ্রমিক তরুণপ্রদত্ত প্রাণহরণরূপ শাস্তিদান।হত্যা,মৃত্যুর সূত্রপাত সেখানেই। আরও অনেক সংযম হয়তো একজন ভাবি গুরুর কাছে কাঙ্খিত থেকে যায়। পিতার হত্যার প্রতিশোধে নিতে পরশুরাম যে ক্ষত্রিয়নিধনে মেতে উঠেছিলেন তাঁর এই অমানবিক আচরণ আজকের পরিভাষায় গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত এবং তা সবযুগে সবসময়েই নিন্দিত— এটি বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখেনা।

তবুও তিনি একজন অস্ত্রবিদ্যাবিদ আচার্য হিসেবে স্বীকৃত। মহাবীর ভীষ্মের অস্ত্রগুরুতো বটেই সেইসঙ্গে মহাভারতখ্যাত কর্ণেরও গুরু তিনি।গুরু যদি তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত একজন ন্যায়পরায়ণ শিষ্যের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয় তবে ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রের শিষ্য কোনওমতেই তা মেনে নিতে পারেন না। ভীষ্ম ও পরশুরামের দ্বৈরথের মূলে ছিল পরশুরামের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। প্রতিপক্ষ যতই প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী হোন না কেন, মেরুদণ্ড যাঁদের উন্নত তাঁরা শত বিরোধিতায় মাথা নত করেননা। এর দৃষ্টান্ত হলেন ভীষ্ম, গুরুর প্রতি তাঁর অনমনীয় মনোভাব। এ উদাহরণ আধুনিকযুগেও প্রসঙ্গিক মনে হয়। পরশুরামের লড়াই,আশ্রয়হীনা শরণাগতার জন্যে মানবিকবোধে উদ্বুদ্ধ একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষের যুদ্ধ।প্রতিপক্ষ ভীষ্ম নিজের ক্ষাত্রধর্মের আদর্শরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। মনুষ্যত্ববোধের সঙ্গে আদর্শবোধের সংঘাত। দুটিই পরস্পর সংপৃক্ত। জীবনযুদ্ধে এ দুয়ের দ্বন্দ্ব নিত্য সত্য।শেষপর্যন্ত আদর্শবোধের জয় হল। জয়ী হলেন ভীষ্ম।সত্যরক্ষার্থে সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু সবকিছুর জন্যে নিজধর্ম থেকে সরে আসা যায়না। এর জন্যে জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ভীষ্মকেও প্রাণ দিয়ে তার মূল্য দিতে হয়েছিল।

কর্ণ পরশুরামের মিথ্যাচারী শিষ্য। শিক্ষাগ্রহণে মিথ্যাচারের কোন স্থান নেই।কোথাও কোনভাবে তা প্রকাশ পাবেই। মহাভারতের মহান গুরুকে প্রতারণার দৃষ্টান্ত এই যুগেও সত্য। মিথ্যাচারের দ্বারা লব্ধ বিদ্যা কার্যক্ষেত্রে ফলবতী হয়না। আপাত জীবনযুদ্ধে জয়ের সাফল্য ক্ষণস্থায়ীমাত্র। মহাভারতের পরতে পরতে যে জীবনবীক্ষণ ছড়িয়ে রয়েছে তার তত্ত্বানুসন্ধানে অনেক অমূল্যচিন্তার উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় হয়তো। একজন আদর্শ গুরুর সার্থক শিক্ষা হল একজন আদর্শনিষ্ঠ শিষ্য বিনির্মাণে। ভীষ্ম একজন আদর্শ ছাত্র, সেটি নিজের ধর্মনিষ্ঠায় তিনি প্রমাণ করেছেন, অপরজন মিথ্যাচারের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে গুরুর শিক্ষাগ্রহণে সফল হয়েছেন, কৃতবিদ্য যশস্বী শিষ্য হিসেবে খ্যাত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে সমযোদ্ধা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্রপ্রয়োগবিদ্যা বিস্মৃত হয়েছেন। এমনটাই ঘটে হয়তো, শুধুমাত্র সবকিছুই থাকে সময়ের অপেক্ষায়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content