মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সীতা রামচন্দ্রের সঙ্গে বনগমনের সিদ্ধান্তে স্বামীর সম্মতি নিয়ে সহযাত্রিণী হবেন, স্থির হল। বনবাসপ্রসঙ্গে রাম ও সীতার তুমুল বাদানুবাদের সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মণ, যিনি রামের ছায়াসঙ্গী। চোখভরা জল নিয়ে তিনি রামের চরণে লুটিয়ে পড়লেন। দেবী সীতার উদ্দশ্যে তিনি বললেন, বন্যপ্রাণীসঙ্কুল অরণ্যে, তিনি হবেন রাম সীতার অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক। যূথবদ্ধ হরিণ আর পাখীদের কলকাকলিতে মুখর রমণীয় বনে রামসীতা দু’জনে বিহার করবেন। লক্ষ্মণ তাঁদের ছেড়ে সুরলোক, অমরত্ব বা ত্রিলোকের ঐশ্বর্যও কামনা করেন না। ন দেবলোকাক্রমণং নামরত্বমহং বৃণে। ঐশ্বর্য্যং চাপি লোকানাং কাময়ে ন ত্বয়া বিনা।।

বনবাস গমনে দৃঢ়সঙ্কল্প লক্ষ্মণকে রাম বহু সান্ত্বনাবাক্যে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। লক্ষ্মণ বিস্মিত হলেন। কারণ এর পূর্বে সর্বদাই তিনি রামের অনুগামী হয়েছেন, এখন কেন এই নিষেধ? এই কারণে লক্ষ্মণের মনে সংশয়। তিনি স্পষ্টভাবে জানতে ইচ্ছুক, জ্যেষ্ঠ রামের মতিগতি ঠিক কী? বিনয়ী লক্ষ্মণ, জোড়হাতে রামের অনুগমনের আজ্ঞা প্রার্থনা করলেন। রাম, অনুজকে সস্নেহে বললেন, তাঁর মতে লক্ষ্মণ — বীর, কোমলমনা, ধার্মিক, সৎপথে স্থিতিশীল, প্রাণপ্রিয় আজ্ঞানুবর্তী অনুগত অনুজ এবং নর্মসহচর। কিন্তু তিনি যদি রামের সঙ্গে বনে গমন করেন তবে তাদের দুই জননী, যশস্বিনী কৌশল্যা ও দেবী সুমিত্রাকে, কে সেবাযত্ন করবেন? বর্ষণরত মেঘতুল্য মহাতেজস্বী রাজা দশরথ, যিনি কামনাপূরণ করতেন সকলের, তিনি কামপাশে আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন।

কেকয়রাজ অশ্বপতির কন্যা কৈকেয়ী, এই রাজ্য লাভ করে,দুঃখিনী সপত্নীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবেন না। ভরত রাজ্য লাভ করে, মা কৈকেয়ীর মতানুসারেই, কৌশল্যা ও সুমিত্রার কথা মনেই রাখবেন না। রামের ঐকান্তিক ইচ্ছা, লক্ষ্মণ স্বয়ং বা প্রাসাদে অবস্থান করে রাজানুগ্রহে মায়েদের প্রতিপালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। এটিই হবে, জ্যেষ্ঠর প্রতি লক্ষ্মণের শ্রেষ্ঠ ভক্তিপ্রদর্শন। গুরুজনদের সেবাই পরম ধর্ম। এবং ময়ি চ তে ভক্তির্ভবিষ্যতি সুদর্শিতা।ধর্মজ্ঞ গুরুপূজায়াং ধর্ম্মশ্চাপ্যতুলো মহান্।।

তাঁদের দু’ জনের বিচ্ছেদে মায়েদের যে কষ্টের সীমা থাকবে না। অস্মাভির্বিপ্রহীনায়া মাতুর্নো ন ভবেৎ সুখম্। বিনীত লক্ষ্মণ, সেই বাকপটু রামকে প্রত্যুত্তরে জানালেন, রামের প্রভাবে ভরত, কৌশল্যা ও সুমিত্রা এই দুই মাকে সম্মান করবেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর যদি ভরত এই উত্তম রাজ্যলাভ করে দুরভিসন্ধিবশত গর্বোদ্ধত হয়ে রাজ্যটি রক্ষা না করে তবে লক্ষ্মণ সেই দুষ্ট, কুটিলমতি ও বিপথগামী ভরতকে নিঃসন্দেহে হত্যা করবেন। ভরতপক্ষীয়রা ত্রিলোকবাসী হলেও তাঁর হাত থেকে নিস্তার নেই তাঁদের। লক্ষ্মণ আরও জানালেন, দেবী কৌশল্যা সম্পূর্ণভাবে স্বাবলম্বী। কৌশল্যা দেবীর অনুগৃহীত আশ্রিতদের ভরণপোষণের জন্যে সহস্র গ্রাম লাভ করেছেন। তিনি লক্ষ্মণের মতো সহস্র মানুষকে প্রতিপালনে সক্ষম।
লক্ষ্মণ জ্যেষ্ঠ রামকে আশ্বস্ত করলেন, সেই মহীয়সী আপনার,আমার মা এবং আমার তুল্য বহু মানুষের ভারবহনে সমর্থ। তদাত্মভরণে চৈব মম মাতুস্তথৈব চ। পর্য্যাপ্তা মদ্বিধানাং চ ভর্তায় মনস্বিনী।। কৌশল্যা বা সুমিত্রার ভবিষ্যত অনিশ্চিত নয়, তাই তাঁদের বিষয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। এটি কোনঅ ধর্মহানিকর কাজ হবে না। যদি রাম, বনবাসে লক্ষ্মণকে সহযাত্রীরূপে গ্রহণ করেন, লক্ষ্মণ রামের সদর্থক সিদ্ধান্তে কৃতার্থ বোধ করবেন। রামের নিজের প্রয়োজনেও লক্ষ্মণের উপস্থিতি দরকার। কৃতার্থোঽহং ভবিষ্যামি তব চার্থঃ প্রকল্পতে।

ধনুর্দ্ধারী লক্ষ্মণ, খনিত্র ও রত্নপেটিকা নিয়ে পথপ্রদর্শকরূপে, সম্মুখে এগিয়ে যাবেন। তিনি রামের জন্যে মুনিঋষিদের উদ্দেশ্যে দানার্থে ফলমূল সংগ্রহ করে আনবেন। গিরিসানুদেশে রাম, বৈদেহী সীতার সঙ্গে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করবেন যখন, লক্ষ্মণ, দিন রাত, অতন্দ্র প্রহরায় রামের সব কাজ সম্পন্ন করবেন নিষ্ঠাভরে। ভবাংস্তু সহ বৈদেহ্যা গিরিসানুষু রংস্যসে। অহং সর্ব্বং করিষ্যামি জাগ্রতঃ স্বপতশ্চ তে।। লক্ষ্মণের এই স্বার্থহীন বনবাসেচ্ছায় রাম প্রীত হলেন। তিনি জানালেন, লক্ষ্মণের বনবাসযাত্রা নিকটজনদের অনুমতিসাপেক্ষ। তাঁরা সম্মত হলে তবেই লক্ষ্মণ বনবাসে রামের অনুগামী হতে পারেন। রাম, বরুণদেবের দুটি দিব্য ধনুক, অভেদ্য কবচ, অক্ষয়বাণপূর্ণ তূণীর, স্বর্ণখচিত সূর্যপ্রভ খড়্গ, রাজা জনকেরর কাছ থেকে যৌতুকরূপে পেয়েছিলেন।

এই সবকিছু গুরুদেব বশিষ্ঠের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। নির্দেশ দিলেন রাম, লক্ষ্মণ সেগুলি সংগ্রহ করে দ্রুত ফিরে আসেন যেন। সর্ব্বমায়ুধমাদায় ক্ষিপ্রমাব্রজ লক্ষ্মণ।। লক্ষ্মণ স্বজনবর্গের অনুমতি গ্রহণ করে, ইক্ষ্বাকুকুলগুরু বশিষ্ঠের কাছে গচ্ছিত মাল্যে সজ্জিত, চন্দনলিপ্ত অস্ত্রগুলি রামচন্দ্রকে দেখালেন। আনন্দসহকারে, রাম জানালেন, তিনি তাঁর সমস্ত ধনরত্ন ভাই লক্ষ্মণের সঙ্গে একযোগে ব্রাহ্মণ ও তপস্বীদের দান করতে ইচ্ছুক। পরম্পরাক্রমে যাঁরা সেবাপরায়ণ ভক্তিমান শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ এবং আশ্রিত অনুগত সকলকে ধনদানে আগ্রহী, রামচন্দ্র। দ্বিজশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠপুত্র সুযজ্ঞ, ব্রাহ্মণদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁকে এবং অপরাপর ব্রাহ্মণদের অর্চনা করে রাম, বনগমনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

চির অনুগত লক্ষ্মণ জ্যেষ্ঠর আদেশ কার্যকর করলেন। প্রথমে বশিষ্ঠপুত্র সুযজ্ঞকে রামের ভবনে আহ্বান জানালেন। রামচন্দ্র তাঁর বহুমূল্য অলঙ্কার অঙ্গদ, কুণ্ডল, সোনার সুতোয় গাঁথা কণ্ঠহার, কেয়ূর, বলয়। সেই সঙ্গে অন্যান্য রত্ন দিয়ে পুজো করলেন তাঁকে। বনগমনে সহযাত্রিণী, ভার্যা সীতার ইচ্ছাটিও জানালেন। সীতা তাঁর চন্দ্রহার, বিচিত্র অঙ্গদ, মনোহর কেয়ূর সুযজ্ঞের ভার্যাকে দান করেছেন আর রত্নখচিত পালঙ্কটি দান করেছেন সুযজ্ঞকে। রামের মাতুল শত্রুঞ্জয় নামে যে হাতীটি উপহার দিয়েছিলেন সেই হাতিটিকেও রাম দান করলেন দ্বিজশ্রেষ্ঠ সুযজ্ঞকে, সঙ্গে দিলেন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা।রামপ্রদত্ত ধন গ্রহণ করে,বনগমনে উদ্যত রাম,লক্ষ্মণ ও সীতাকে শুভাশীর্বাদ করলেন ঋষি।

রাম, লক্ষ্মণভাইকে নির্দেশ দিলেন ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ অগস্ত্য ও কৌশিককে যেন সহস্র গোধন, সোনা, রূপা, বহু রত্ন এবং মূল্যবান মণিসমূহ দান করে প্রীত করা হয়। মা কৌশল্যা নিত্য যাঁর আশীর্বাদধন্যা সেই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সেই দানগ্রহীতাদের তালিকায় আছেন। তাঁর জন্য রামনির্দিষ্ট দেয় সামগ্রী ছিল —যান, বাহন, দাসী ও কৌশেয় বস্ত্র ইত্যাদি। স্বজন সহকর্মী কেউ বাদ রইল না। চিত্ররথ, যিনি দীর্ঘকাল সচিব ও সারথির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তাঁর সন্তোষবিধান রামের লক্ষ্য। তাই রাম আদেশ দিলেন, মন্ত্রী চিত্ররথকে মহামূল্য, রত্ন, বসন, ধন, পশু, সহস্র ধেনু দান করা হোক। একমাত্র বেদাধ্যয়নকেই যাঁরা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, অন্য কোন বিষয়ে যাঁদের অনীহা সেই বেদের কঠশাখা অধ্যয়নকারী, দণ্ডধারী, বেদবিদ্যায় পারঙ্গম এবং সুস্বাদুভোজনপ্রিয় ব্রাহ্মণদের রত্নপূর্ণ আশিটি যান, শালিধানে ভরা সহস্র বৃষ, দুই হাজার হাতী এবং সেই সংখ্যক ধেনু এবং গাভী যেন প্রদান করা হয়। জননী কৌশল্যার কাছে নিত্য সমাগম ব্রহ্মচারীদের। তাঁদের প্রত্যেককে এক সহস্র গোধন এবং সঙ্গে দেবী কৌশল্যার ইচ্ছানুসারে পর্যাপ্ত দক্ষিণা দান করা হোক।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩১: বীণাপাণির চরণ ছুঁয়ে…

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

রামের এই সব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন লক্ষ্মণ। ধনদাতা লক্ষ্মণ যেন সুরলোকের কোষাধ্যক্ষ কুবেরের ভূমিকায়। রাম, এই দীর্ঘ চতুর্দশ বছরে জীবিকা নির্বাহের উপযোগী বহু দ্রব্য দান করলেন সেবকদের। তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, লক্ষ্মণস্য চ যদ্বেশ্ম গৃহঞ্চ যদিদং মম।। অশূন্যং কার্য্যমেকৈকং যাবদাগমনং মম। যতদিন আমরা ফিরে না আসি ততদিন, আমার ও লক্ষ্মণের শূন্যগৃহ তোমরা পূর্ণ করে রেখো।

এরপরে, পুরুষোত্তম রাম, লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ধনাগারের ঐশ্বর্য বালক, বৃদ্ধ ও দীনদুঃখীদের দান করতে লাগলেন। সেইসময়ে সেখানে পিঙ্গলবর্ণের ত্রিজটা নামের গর্গগোত্রের এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর জীবিকা ছিল ফাল, লাঙ্গল, কুদ্দাল দিয়ে অরণ্যভূমিখনন। রামের দানধর্মের কথা, তরুণী স্ত্রীর কাছে শুনতে পেয়ে, একটি জীর্ণবস্ত্রে কোনমতে দেহ আবৃত করে দানগ্রহণের আশায় হাজির হলেন রামের কাছে। তিনি তাঁর আর্থিক দুরবস্থা বর্ণনা করে, জানালেন, তিনি রামের কৃপাপ্রার্থী। নির্ধনো বহুপুত্রো২স্মি রাজপুত্র মহাযশঃ। ক্ষতবৃত্তির্ব্বনে নিত্যং প্রত্যবেক্ষস্ব মামিতি।। হে মহাযশস্বী রাজকুমার, আমি ধনহীন, বহু সন্তানের পিতা, বনে খননবৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। আমার প্রতি আপনার কৃপাদৃষ্টি দান করুন। রাম পরিহাসচ্ছলে বললেন, সরযূনদীর পরপারে তাঁর শতসহস্র গোধন আছে, তার মধ্যে গাভীর সংখ্যা একসহস্র। ব্রাহ্মণ ত্রিজটা ওই গোধনক্ষেত্রের যতদূর পর্যন্ত দণ্ড নিক্ষেপ করতে পারবেন, ততদূরবর্তী স্থানের সমস্ত গোধন লাভ করবেন ত্রিযটা। ধনগ্রহণে মরিয়া দীনদরিদ্র ত্রিজটা, বেশবাস আঁটসাঁট করে বাঁধলেন। প্রস্তুতি নিয়ে, প্রাণপনে, সজোরে নিক্ষেপ করলেন দণ্ডটি। ত্রিজটার নিক্ষিপ্ত দণ্ডটি সবেগে, সরযূ অতিক্রম করে, বহু গোশালা পার হয়ে গোচারণ ভূমিতে অর্থাৎ গোসঙ্কুল স্থানে গিয়ে পড়ল।

পরমানন্দে রাম, ব্রাহ্মণকে অভিনন্দন জানিয়ে সমুদায় গোধন দান করলেন তাঁকে। ত্রিজটা যেন রামের এই আচরণে ক্রুদ্ধ না হন। ত্রিজটার সামর্থ্য পরীক্ষা করাই ছিল রামের উদ্দেশ্য। রাম সান্ত্বনাবাক্য পরিহাসজনিত ত্রুটি শুধরে নিলেন।উদারমনা রাম,সত্যের নামে শপথ নিয়ে জানালেন, তাঁর যা কিছু ধনৈশ্বর্য, সবকিছুই দানের জন্যে নির্দিষ্ট। তাতেই রামের আনন্দ ও সুখ। এই কারণেই ধনরক্ষণ ও বিতরণ। তিনি ত্রিজটাকে আরও কিছু অভীপ্সিত বস্তু দান করতে ইচ্ছুক। মহানন্দে সপত্নী ত্রিজটা দানগ্রহণ করে, রামকে শক্তি, কীর্তি, আনন্দ ও সুখবৃদ্ধির আশীর্বাদ জানিয়ে, প্রস্থান করলেন। রাম শৌর্যবলে ধর্মসঙ্গত উপায়ে, স্বোপার্জিত ধনরাশি, শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে বিতরণ করলেন। সুহৃদ্বর্গ যথোচিত সম্মানবোধক বাক্যে অভিনন্দন জানালেন রামকে। সম্মুখে উপস্থিত ব্রাহ্মণ, সুহৃদ, ভৃত্য, ভিক্ষাজীবী দীনদরিদ্রদের সম্ভ্রমসহকারে ধনবণ্টন করলেন রামচন্দ্র। এই ধনদানে ছিল তাঁর শ্রদ্ধার প্রকাশ।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

বনবাসগমনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রভূত ধনদানে তৃপ্ত রাম, পত্নী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে পিতা দশরথের ভবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী তাঁর ভাই লক্ষ্মণ, যেন রামেরই আরও এক রূপ। লক্ষ্মণ, অসাধারণ অপ্রাকৃত রামের যেন প্রাকৃত মানবিক মুখ। লক্ষ্মণ দুঃখ বেদনায় প্রতিবাদে সোচ্চার হন, ক্ষোভে, দুঃখে ভেঙ্গে পরেন। লক্ষ্মণ, পিতার আচরণ বা সিদ্ধান্ত গর্হিত মনে হলে,পিতৃহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননা। সাধারণ মানুষের মতো তাৎক্ষণিক আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠেন। তাঁর একমাত্র দুর্বলতার দিক হল জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আনুগত্য। ভারতীয় যৌথপরিবারে এ চিত্র ব্যতিক্রম নয়। নির্ভরতার আশ্রয় ছিল বটচ্ছায়ার মতো বড়ভাইটি, যাঁর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ছিল অন্যদের দিনযাপন। রামচন্দ্র অপর তিন ভায়ের পরম আশ্রয়, সংসারেও তিনিই রাজোচিত মহিমায় অদ্বিতীয়। তাঁর নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বত্যাগী ভাবমূর্তি যেন একমুখী সম্মোহনী শক্তি, সেটিই তাঁর ভাইদের একত্রে বেঁধে রাখবার যোগসূত্র।

আর লক্ষ্মণ? মহর্ষি বাল্মীকির ভাষায় বাল্যাৎ প্রভৃতি সুস্নিগ্ধো লক্ষ্মণো লক্ষ্মিবর্দ্ধনঃ। রামস্য লোকরামস্য ভ্রাতুর্জ্যেষ্ঠস্য নিত্যশঃ। সর্ব্বপ্রিয়করস্তস্য রামস্যাপি শরীরতঃ।। লক্ষ্মণ শৈশব থেকে জ্যেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় রামের একান্ত অনুগত স্নেহের পাত্র। সর্বদাই রামের শ্রীসম্পাদনে তৎপর। প্রিয়কার্যানুষ্ঠান পালনে যত্নশীল। এমন কি এ বিষয়ে প্রাণত্যাগেও পিছুপা হন না তিনি। কবির বর্ণনায় রামের জীবনে লক্ষ্মণ যেন বহির্গত অপর প্রাণ। বহিঃ প্রাণ ইবাপরঃ। আর রাম? লক্ষ্মণ বিনা তাঁর রাতে ঘুম আসে না। ন চ তেন বিনা নিদ্রাং লভতে পুরুষোত্তমঃ। সুমিষ্ট অন্ন রামের মুখে রোচেনা লক্ষ্মণ বিনা। অশ্বারোহী রাম যখন মৃগয়ায় যান, তখন ধনুর্দ্ধারী লক্ষ্মণ তাঁর অনুগমনকরেন। strong>মৃষ্টমন্নমুপানীতমশ্নাতি ন হি তং বিনা। যদা হি হয়মারূঢ়ো মৃগয়াং যাতি রাঘবঃ।। অথৈনং পৃষ্ঠতোঽভ্যেতি সধনুঃ পরিপালয়ন্। রামের অভিন্ন সত্তা যেন লক্ষ্মণ। সুখে, দুঃখে, আপদে, বিপদে রামের নর্ম সহচর লক্ষ্মণ। দুঃখদিনে সমদুঃখভাগী লক্ষ্মণ। বনবাসগমনে—দৃঢ় তাঁর সঙ্কল্প। নিজের স্ত্রীর কথা ভাবেননি। রামের সহযাত্রী হওয়াতেই তাঁর আনন্দ, গৌরব সবকিছু।
রাজ্য ও রাজা দুটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন বিশ্বস্ত জনেরা।

রামের অনুপস্থিতিতে ভরত, অযোধ্যা রাজ্যটিকে এবং লক্ষ্মণ, ভাবি প্রশাসক রাজা রামচন্দ্রকে সপরিবারে সুরক্ষিত রেখেছেন। লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের স্নেহের প্রতিদানে জীবন উৎসর্গ করেছেন। বনবাসে রামের তল্পিতল্পা বহনেই, লক্ষ্মণের আত্মতৃপ্তি। বনবাসযাপনে বৈদেহী সীতার সঙ্গে রামচন্দ্রের নিশ্চিন্ত বিহার, তাঁর অভিপ্সীত। এক মুহূর্তের জন্যেও নিজের দাম্পত্য জীবনের শূন্যতাবোধ তাঁর মনে নৈরাশ্য সৃষ্টি করেনি। ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে ভ্রাতৃত্বের আদর্শসৃষ্টি করেছেন লক্ষ্মণ। বিশ্বকবির মানসলোকে শিশুচিত্তের, বনবাসের অন্যতম অনুপ্রেরণা লক্ষ্মণের মতো ভায়ের সাহচর্য।
“কিন্তু আমি পারি যেতে, ভয় করি নে তাতে–লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে থে।”

রামায়ণে, ভ্রাতৃত্বের অন্যতম উদাহরণরূপে, লক্ষ্মণের আলোকিত উপস্থিতি, চিরকাল, ভারতবাসীর মনে অম্লান হয়ে থাকবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content