বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

মহর্ষি শৌনক তাঁর দ্বাদশবর্ষব্যাপী সত্রে সৌতি উগ্রশ্রবার কথিত জনমেজয়কৃত সর্পসত্রের বৃত্তান্ত শুনেছেন। তক্ষকের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ জনমেজয়,তক্ষকসর্পের দংশনে মৃত পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধকল্পে, সর্পসত্রের আয়োজন করেছিলেন। মহর্ষি শৌনক জানতে চাইলেন, সর্পসত্রের অবসান হল কীভাবে? এই মারণযজ্ঞ থেকে নাগেদের মুক্তি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? তিনি শুনেছেন আস্তীকমুনি নাগেদের মুক্তিদাতা। তিনি কী কারণে মুক্ত করলেন সর্পকুলকে? কে এই আস্তীক? তিনি কার পুত্র? সবিস্তারে জানতে উৎসুক মহর্ষিকে, সৌতি বললেন সেই মহৎ আখ্যানটি তিনি এখন বর্ণনা করবেন। নৈমিষারণ্যে স্বয়ং বেদব্যাসএই বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছিলেন। পরে ব্যাসশিষ্য, সৌতির পিতা লোমহর্ষণ ব্রাহ্মণদের কাছে এই কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন যেমনটি, পিতার কাছে শোনা সেই উপাখ্যানটিই তিনি বর্ণনা করবেন এখন। আস্তীকমুনির পিতা ছিলেন জরৎকারু। মহর্ষি শৌনক জরৎকারুনামের উৎস সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী। সৌতি জানালেন—
জরেতি ক্ষয়মাহুর্বৈ দারুণং কারুসংজ্ঞিতম্। শরীরং কারু তস্যাসীৎ তৎ স ধীমান্ শনৈঃ শনৈঃ।।

জরৎ অর্থাৎ ক্ষয়, কুমারবয়সের ক্ষয়কর যৌবনকাল। ব্রত, কঠোর তপস্যাদ্বারা যৌবনকালে শরীর ক্ষয় করে কারু অর্থাৎ দারুণ হয়ে উঠেছিলেন জরৎকারু। তীব্র তপস্যার কারণে শরীর ক্ষয় করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রসিদ্ধ। তাই তাঁর নাম হল জরৎকারু। জরৎকারু পরিব্রাজক। তিনি পৃথিবীর সর্বত্র প্ররিক্রমণ করে বেড়াতেন। মহাতেজস্বী, বায়ু ভক্ষণ করে জীবন ধারণকারী, নিরাহারী জরৎকারু একদা পূর্বপুরুষদের সন্ধান পেলেন। তাঁরা, পা উপরে, মুখ নিচের দিকে করে, ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছেন। নীচে গভীর গর্ত। তাও বিপজ্জনকভাবে অধোমুখী তাঁদের গতি। এর কারণ কী? পিতৃগণ জানালেন, বংশলোপের সম্ভাবনায় ব্রতনিষ্ঠ যাযাবরবৃত্তিধারী ঋষিদের এই নিম্নগতিপ্রাপ্তি। তাঁরা আরও জানালেন, জরৎকারু নামে বংশে একটি তপোবৃত্তিধারী সন্তান আছে। বিবাহে তাঁর কোনও আগ্রহই নেই। সেই মূর্খ, পুত্র উৎপাদনের জন্য বিবাহ করতেই চায় না। ন স পুত্রান্ জনয়িতুং দারান্ মূঢ়শ্চিকীর্ষতি। বংশলোপহেতু আমরা গর্তে ঝুলন্ত অবস্থায় এখন লম্বমান রয়েছি। জরৎকারু আত্মপরিচয় দিলেন, ব্রূত কিং করবাণ্যদ্য জরৎকারুরহং স্বয়ম্।।

আমিই স্বয়ং জরৎকারু। বলুন—আমার এখন কী কর্তব্য? পিতৃপুরুষেরা উপদেশ দিলেন, তদ্দারগ্রহণে যত্নং সন্তত্যাঞ্চ মনঃ কুরু। স্ত্রীগ্রহণে যত্নবান হও সন্তান উৎপাদনে মনঃসংযোগ কর। জরৎকারু কথা দিলেন নিজের কারণে নয়, পিতৃপুরুষদের অধঃপতনরোধের কারণে তিনি বিবাহ করবেন। ভবতাং তু হিতার্থায় করিষ্যে দারসংগ্রহম্। একটাই শর্ত, তিনি তাঁর নিজের নামবিশিষ্টা কন্যা, যাঁকে কন্যার স্বজনরা নিজের ইচ্ছায় দান করবেন সেই কন্যাকে তিনি স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবেন। কারণ, তিনি দরিদ্র, তাঁকে কে কন্যাদান করবেন? যদি তেমনটি ঘটে তবে ভিক্ষুকের মতোই তিনি দানগ্রহণ করবেন।
পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েও তেমন কন্যা পেলেন না ব্রতচারী ব্রাহ্মণ জরৎকারু। শেষে অরণ্যমধ্যে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন কন্যা ভিক্ষার্থী তিনি, কেউ তাঁকে কন্যাদান করবেন কী? অনন্তনাগ তাঁর ভগিনীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। কন্যাটির নাম হয়তো তার নিজের নামের অনুরূপ নয়, তাই জরৎকারু তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন। বাসুকি জানালেন, জরৎকারু!জরৎকারুঃ স্বসেয়মনুজা মম। প্রতিগৃহ্ণীষ্ব ভার্য্যার্থে ময়া দত্তাং সুমধ্যমাম্।।

হে জরৎকারু, এ আমার জরৎকারু নাম্নী কনিষ্ঠা ভগিনী। স্ত্রীরূপে এই সুন্দরী কন্যাটিকে আপনি গ্রহণ করুন। জরৎকারু খুশীমনে কন্যাটিকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন। একদা নিদ্রাতুর স্বামীর ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাঁর বিরক্তির কারণ হলেন সেই নাগকুলোদ্ভবা জরৎকারু নামের কন্যাটি। সেই কন্যা তখন অন্তঃসত্তা। তুচ্ছকারণে গৃহত্যাগী হলেন জরৎকারুমুনি। একমাত্র তপস্যাই তাঁর ব্রত। গৃহের বন্ধন হয়তো তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট নয়। চিন্তিতা ধর্মপত্নী জানতেন, মাতৃকুলের শাপমুক্তির কারণ হবেন তাঁর গর্ভস্থ পুত্র। সেই পুত্রটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায়, আশায় দিন গুণেছেন জ্ঞাতিবর্গ। সে যে এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি। কেন তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন স্বামী? মুনি জরৎকারু ধর্মপত্নীকে আশ্বস্ত করে বললেন, অস্ত্যয়ং সুভগে!গর্ভস্তব বৈশ্বানরোপমঃ। ঋষিঃ পরমধর্ম্মাত্মাবেদবেদাঙ্গপারগঃ।। তোমার গর্ভে আছে অগ্নিতুল্য তেজস্বী,পরম ধার্মিক,বেদবেদাঙ্গে পারদর্শী কোন ঋষি।

নাগরাজ বাসুকিকে এই অপ্রিয় সংবাদ দিলেন ভগিনী জরৎকারু। স্বামীর কথায় অপার বিশ্বাস বাসুকির ভগিনী জরৎকারুর। তিনি স্বামীর প্রস্থানকালের আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যদ্বাণীটিও বাসুকিকে জানালেন। বাসুকি তাঁর ভগিনীকে বললেন, জানাসি ভদ্রে!যৎ কার্য্যং প্রদানে কারণঞ্চ যৎ। ভদ্রে, তোমাকে জরৎকারুর পত্নীরূপে সম্প্রদানের কারণ হয়তো অবহিত আছো। নাগরাজ ভগিনীকে অভয় দিয়ে বললেন, স্বয়ং ব্রহ্মা জানিয়েছিলেন সর্পকুলের কল্যাণে জরৎকারুমুনির পুত্র আস্তীক সর্পমারণযজ্ঞ হতে মাতৃকুলকে রক্ষা করবেন। দেবকুমারতুল্য পুত্রের জন্ম দিলেন নাগরাজের ভগিনী জরৎকারু। যেহেতু পিতা জরৎকারু মাতার গর্ভস্থ পুত্রের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘অস্তীতি’ সে আছে,তাই বালকটির নাম হল আস্তীক। অস্তীত্যুক্ত্বা গতো যস্মাৎ পিতা গর্ভস্থমেব তম্। বনং তস্মাদিদং তস্য নামাস্তীকেতি বিশ্রুতম্।।

কুরুরাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে, পুরোহিতরা কৃষ্ণবস্ত্র পরিধান করে ধোঁয়ায় রক্তাভচক্ষু নিয়ে, প্রজ্জ্বলিত আগুনে মন্ত্রোচ্চারণে আহুতি দিতে লাগলেন। আহ্বান জানালেন সাপেদের। কেউ কাঁদতে কাঁদতে, কেউ ফোঁসফোঁস শব্দ করে,কেউ বা পরস্পর জড়াজড়ি করে, মৃত্যুভয়ে ছটফট করতে করতে, ভয়ে কম্পমান অবস্থায়, আগুনে পড়তে লাগল নাগেরা। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। কোনটি সাদা কোনটি নীল, কেউ যুবক কেউ বা প্রৌঢ়, ফলকাকৃতি কেউ, কেউ বা ক্রোশপরিমাণ লম্বা, কারও বা যোজন পরিমাণ শরীর, কেউ আবার গরুর কর্ণাকৃতি ক্ষুদ্র, শুণ্ডাকৃতি, হাতীর মতো বিশালদেহী, মহাশক্তিশালী, বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন বয়সের ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির, দংশনে দক্ষ, হিংস্র সাপেরা মা কদ্রুর অভিশাপের ফলে পীড়িত অবস্থায় আগুনে পতিত হতে লাগল।
জনমেজয়ের প্রতিহিংসার সর্পসত্রে নাগমাতা কদ্রুর অভিশাপটি কী? এর কারণই বা কী?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪২: স্নেহ ও ধর্মবোধের টানাপোড়েনে কার জয়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতির দুই সুলক্ষণা, আশ্চর্য রূপবতী কন্যা, কদ্রু ও বিনতা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপের ভার্যা। কালক্রমে কদ্রু হলেন সহস্র নাগের জননী। বিনতার দুই পুত্র। একদা দেবাসুরের যৌথ অমৃতমন্থনের সময়ে সাগর থেকে উত্থিত সুন্দর, কমনীয়, অলৌকিক লক্ষণযুক্ত শ্রেষ্ঠ অশ্বটিকে দেখে, কদ্রু বিনতাকে বললেন, উচ্চৈঃশ্রবা হি কিংবর্ণো ভদ্রে! প্রব্রূহি মা চিরম্। বিলম্ব না করে বলো দেখি উচ্চৈঃশ্রবার বর্ণটি কী? বিনতা উত্তর দিলেন, শ্বেত এবাশ্বরাজোঽয়ং কিংবা ত্বং মন্যসে শুভে। ব্রূহি বর্ণং ত্বমপ্যস্য ততোঽত্র বিপণাবহে।।

ঘোড়াটিতো শ্বেতবর্ণ। তোমার কি মনে হয়? তুমি বলো, তারপর না হয় বাজি ধরা যাবে। কদ্রু বললেন, তাঁর নিজের মনে হয় ঘোড়াটির রোমগুলি কৃষ্ণবর্ণ। এ বিষয়ে বাজি হয়ে যাক। ঘোড়ার রোমগুলি যদি শ্বেতবর্ণ হয় তবে কদ্রু হবেন বিনতার দাসী, কৃষ্ণবর্ণ হলে বিনতা হবেন কদ্রুর দাসী। তাহলে পরদিন পরখ করে দেখা যাবে সঠিক বর্ণটি ঠিক কি?কদ্রু শঠতার আশ্রয় নিলেন। পুত্র সাপেদের আদেশ করলেন, তারা যেন কাজলকালো লোম হয়ে উচ্চৈঃশ্রবার দেহটি আচ্ছাদিত করে তোলে, কোনওমতেই যেন বিনতার দাসীবৃত্তি করতে না হয় কদ্রুকে। পুত্ররা সকলে সম্মত হল না। যারা মায়ের অবাধ্যতা করল তাদের অভিশাপ দিলেন কদ্রু, সর্পসত্রে বর্ত্তমানে পাবকো বঃ প্রধক্ষ্যতি। জনমেজয়স্য রাজর্ষেঃ পাণ্ডবেয়স্য ধীমতঃ।। পাণ্ডর বংশধর, প্রজ্ঞাবান, রাজর্ষি জনমেজয়ের সর্পযাগে অগ্নি তোদের দগ্ধ করবে। ব্রহ্মাও তাঁর অভিশাপটি অনুমোদন করলেন।

প্রভাতবেলায় দুই ভগিনী কদ্রু ও বিনতা সমুদ্রতীরে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য—উচ্চশ্রবার বর্ণনির্ণয়ের মাধ্যমে দাসীবৃত্তির পণে কে বিজয়িনী হলেন? সেটি সঠিকভাবে নির্ণয়। উচ্চৈঃশ্রবাকে দর্শনের উদ্দেশ্যে গমন করলেন দুজনে। এদিকে সাপেরা, পরস্পর বলাবলি করল, একেতো মা আমাদের প্রতি নির্মম। তার ওপরে মানোবাসনা পূর্ণ না হলে শাপে দগ্ধ করবেন আমাদের, আর তিনি আনন্দিত হলে, আমাদের শাপমুক্ত করবেন হয়তো। তাই তারা স্থির করল উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বটির পুচ্ছটিকে বরং কৃষ্ণবর্ণ করে তুলি। এ বিষয়ে আর কোনও সংশয় নেই। নিস্নেহা বৈ দহেন্মাতা অসম্প্রাপ্তমনোরথা।। প্রসন্না মোক্ষয়েদস্মাচ্ছাপাচ্চ ভামিনী। দুই ভগিনী আকাশপথে সমুদ্রপারে উপস্থিত হলেন। দুজনে কী দেখলেন? বেগবান সেই শ্রেষ্ঠ অশ্বটি চন্দ্র কিরণতুল্য শুভ্রবর্ণ এবং তার পুচ্ছটি কিন্তু রোমশ কৃষ্ণবর্ণের। অগত্যা পরাজিত হলেন বিনতা। তিনি বিষণ্ণমনে সপত্নী কদ্রুর দাসীবৃত্তি গ্রহণ করলেন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮৬: সুন্দরবনের যে কোনও পুকুরে এই মাছ সফল ভাবে চাষ করা সম্ভব

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?

রাজা জনমেজয়ের সর্পসত্রে, নাগমাতা কদ্রুর অভিশাপে সাপেরা অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর সম্মুখীন হল। সেই বিরাট যজ্ঞে দগ্ধ হচ্ছে নাগেরা।নৃশংস সে দৃশ্য। দগ্ধ সাপেদের, চর্বি ও মেদে ছোট ছোট নদী সৃষ্টি হল। পোড়া মাংস ও চর্বির গন্ধে ভরে উঠল চতুর্দিক। রাজা জনমেজয়ের যজ্ঞাহুতির মূল লক্ষ্য ছিল তক্ষকদহন। তক্ষক তখন বিপদের আঁচ পেয়ে ইন্দ্রের শরণাপন্ন হয়েছেন। দেবরাজ তাঁকে ইন্দ্রভবনে সুরক্ষিত আশ্রয় দান করলেন। তক্ষককে অভয় দিলেন ইন্দ্র। নাগকুলের পরিজনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায়, নাগরাজ বাসুকি ব্যথিত অনুতপ্ত হয়ে অবসন্ন হয়ে পড়লেন। মৃত্যুভয়ে মনটি দুরু দুরু কেঁপে উঠল তাঁর। ভগিনী জরৎকারুকে স্মরণ করলেন তিনি। অবশশরীরে জানালেন,স্বজনবন্ধুবিচ্ছেদে তাঁর হৃদয় কম্পমান, ভগ্নহৃদয়ে তাঁর উপলব্ধি হল, এটি স্পষ্ট যে, শীঘ্রই আমার গন্তব্য হবে যমালয়। ব্যক্তং ময়াপি গন্তব্যং প্রেতরাজনিবেশনম্।

তাই ভগিনীকে বাসুকির অনুরোধ, হে বৎসে, পুত্রলাভের কারণে, জরৎকারুমুনিকে তোমায় সম্প্রদান করেছিলাম। এখন স্বজনবর্গসহ আমার রক্ষার নিমিত্ত, তোমার সেই জ্ঞানীবৃদ্ধতুল্য পুত্রকে আহ্বান জানাও। তদ্বৎসে !ব্রূহি বৎসং স্বং কুমারং বৃদ্ধসম্মিতম্।মমাদ্য ত্বং সভৃত্যস্য মোক্ষার্থং বেদবিত্তমম্।। ব্রহ্মার অনুমোদিত কদ্রুমায়ের অভিশাপমুক্ত করবেন জরৎকারুমুনির ঔরসজাত পত্নী জরৎকারুর গর্ভজাত সেই পুত্রটি। জরৎকারুর্জরৎকারুং যাং ভার্য্যাং সমবাপ্স্যতি।তত্র জাতো দ্বিজঃ শাপান্মোক্ষয়িষ্যতি পন্নগাম্।। মায়ের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে আস্তীক, নাগরাজ বাসুকিকে অভয় দান করে বললেন আপনি মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনার কোনও ভয় নেই। আমি সেটাই করব যাতে আপনাদের কল্যাণ হয়। ভব স্বস্থমনা নাগ! ন হি তে বিদ্যতে ভয়ম্। প্রযতিষ্যে তথা রাজন্! যথা শ্রেয়ো ভবিষ্যতি।। প্রলয়কালীন কালাগ্নির মতো ব্রহ্মদণ্ডতুল্য সর্পনাশক মাতৃশাপের অভিঘাতকে তিনি নষ্ট করবেনই। আর কোনও ভয় নেই। ব্রহ্মদণ্ডং মহাঘোরং কালাগ্নিসমতেজসম্। নাশয়িষ্যামি মাঽত্র ত্বং ভয়ং কার্যাঃ কথঞ্চন।।

এরপরের ঘটনাস্থল জনমেজয়কৃত সর্পসত্র। সেখানে উপস্থিত আস্তীককে বাধা দিলেন দ্বাররক্ষক। বুদ্ধিমান, ধার্মিক, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, আস্তীক সর্পযজ্ঞের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। রাজা জনমেজয়ের কীর্ত্তির গুণগান করতে লাগলেন তিনি। পুরোহিত, অন্যান্য সদস্যরাও তাঁর প্রশংসায় বাদ গেলেন না। মুনি আস্তীকের মতে, ভরতবংশপ্রধান জনমেজয়কৃত যজ্ঞ, অন্যান্য প্রখ্যাতরাজাদের কৃত যজ্ঞের সমতুল। পূর্বপুরুষদের যজ্ঞ অপেক্ষা সেটি কোনও অংশে কম নয়। রাজার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন জরৎকারুপুত্র আস্তীক। বললেন, জগতে জনমেজয় হলেন পুরুষশ্রেষ্ঠ। তিনিই মর্তলোকের রক্ষক। তাঁর তুল্য রাজা অতীতে ছিল না বর্তমানেও নেই—এটিই জনমেজয় সম্বন্ধে আস্তীকের অভিমত। মতস্ত্বং নঃ পুরুষেন্দ্রেহ লোকে ন চ ত্বদন্যো ভূপতিরস্তি জজ্ঞে।।

জনমেজয় সম্বন্ধে আস্তীকের মূল্যায়ন হল, রাজা জনমেজয় ধর্মরাজের মতো ধর্মবিষয়ে তত্ত্বজ্ঞ, কৃষ্ণতুল্য সর্বগুণান্বিত,রাজা বসুগণের ন্যায় সম্পদের আধার, আবার তিনি সফল একজন যাজ্ঞিক। যমো যথা ধর্ম্মবিনিশ্চয়জ্ঞঃ কৃষ্ণো তথা সর্ব্বগুণোপপন্নঃ। শ্রিয়াং নিবাসোঽসি যথা বসূনাং নিধানভূতোঽসি তথা ক্রতূনাম্।। আস্তীকের স্তবে, সমবেত, রাজা, সদস্য, পুরোহিতবর্গ, অগ্নি, সকলে তুষ্ট হলেন।

জনমেজয় বললেন, আস্তীক বালক কিন্তু তাঁর কথা বলার ভঙ্গীটি বৃদ্ধের মতো। তাই তিনি আস্তীককে বরদানে উৎসাহিত হলেন। ইচ্ছাম্যহং বরস্মৈ প্রদাতুং তন্মে বিপ্রাঃ! সংবিদধ্বং যথাবৎ। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণদের অনুমতি প্রার্থনা করলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

সদস্যরা বললেন ব্রাহ্মণমাত্রই সম্মানীয়। তাই আস্তীকের অভীপ্সিত বরলাভের যোগ্যতা আছে। কিন্তু সর্পযাগের মূল লক্ষ্য তক্ষকদহন সেটি যাতে শীঘ্রই হয়, সেই চেষ্টাই এখন সঙ্গত হবে। হোতা চণ্ডভার্গবের এই সব কথোকপনে অসন্তোষের শেষ নেই। তিনি জানালেন, তক্ষক কিন্তু এখনও আসেননি হোতা বাক্যং নাতিহৃষ্টান্তরাত্মা কর্ম্মণ্যস্মিংস্তক্ষকো নৈতি তাবৎ।

পুরোহিতরা জানালেন, তক্ষক ইন্দ্রের সুরক্ষিত আশ্রয়ে রয়েছেন। রাজার অনুরোধে, হোতা মন্ত্রদ্বারা ইন্দ্রকে আহ্বান জানালেন। ইন্দ্র বিমানযোগে অবতীর্ণ হওয়ার উপক্রম করলেন। ইন্দ্রের উত্তরীয়ের অন্তরালে স্থান পেলেন ভীত, সন্ত্রস্ত তক্ষক। আকাশে দৃশ্যমান হলেন ইন্দ্র। যজ্ঞের আয়োজন দেখে, ভীত ইন্দ্র, তক্ষককে পরিত্যাগ করলেন। মন্ত্রের প্রভাবে অবসেন্দ্রিয় তক্ষক স্বর্গের আশ্রয় থেকে বিচ্যুত হয়ে যজ্ঞের আগুনের অভিমুখে ঘুরতে ঘুরতে ধাবিত হল। তক্ষকপতনের ঘোর শব্দ শুনে নিশ্চিন্ত হলেন পুরোহিতেরা। তাঁরা রাজাকে বললেন, উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয়েছে। এখন রাজা দ্বিজপ্রধান আস্তীককে বর দিতে পারেন। অস্মৈ তু দ্বিজমুখ্যায় বরং দাতুমর্হসি।

আস্তীককে বরদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন জনমেজয়। নাগশ্রেষ্ঠ তক্ষককে পতনের অভিমুখী দেখে আস্তীকমুনি স্থির করলেন, বর প্রার্থনার এটাই উপযুক্ত সময়। যদি বরদানের যোগ্য মনে করেন আমায়, তবে আমার প্রার্থনা হল, আপনি এই যজ্ঞ থেকে বিরত হন। নাগেরা যেন আর আগুনের গ্রাসে পতিত না হয়। বরং দদাসি চেন্মহ্যং বৃণোমি জনমেজয়! সত্রং তে বিরমত্বেতন্ন পতেয়ুরিহোরগাঃ।। আস্তীকের অনুরোধে রাজা দুঃখিতমনে এর বিকল্প সোনা, রূপা, গরু প্রভৃতি নানা পার্থিব সম্পদ তাঁকে দিতে চাইলেন। আস্তীক শুধুমাত্র মাতৃকুলের হিতাকাঙ্খায় সবকিছু প্রত্যাখ্যান করলেন। অন্য কোনও বর তাঁর অভীপ্সিত নয়। অন্য সদস্যরা, বেদবিদ ব্রাহ্মণগণ, আস্তীককে বরদানে সম্মতি দিলেন। লভতাং ব্রাহ্মণো বরম্।

এই ব্রাহ্মণ বরলাভ করুন। বরপ্রাপ্ত আস্তীক তক্ষকের উদ্দেশ্যে তিনবার বললেন তিষ্ঠ। থাম, থাম, থাম। মধ্য আকাশে শূন্যে, অগ্নিতে পতনাভিমুখী তক্ষকের গতি রুদ্ধ হল। রাজা জনমেজয় ঘোষণা করলেন আস্তীককে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে এবং সমবেত সদস্যদের অনুরোধে তিনি এই যজ্ঞ থেকে তিনি বিরত হলেন। সমাপ্যতামিদং কর্ম্ম পন্নগাঃ সন্ত্বনাময়াঃ। প্রীয়তাময়মাস্তীকঃ সত্যং সূতবচেঽস্তু তৎ।। সর্পযজ্ঞ শেষ হল। জনমেজয়ের যজ্ঞে সমাপ্তি ঘোষিত হলে রাজা আস্তীকমুনিকে যথোচিত সম্মান প্রদান করলেন। জনমেজয়ের দ্বারা সম্মানিত আস্তীক পরমানন্দে মাতুলালয়ে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন নাগেদের আশ্বস্ত করলেন। নির্ভয়ে, নিরুদ্বিগ্ন সর্পকুল আস্তীককে তাঁর অভীষ্ট বরদানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আস্তীকের অভীষ্ট বরটি হল—ব্রাহ্মণ বা অব্রাহ্মণ যে কোনও নির্মলহৃয়ব্যক্তি যদি সকাল সন্ধ্যা ধর্মকাহিনি পাঠ করেন তবে সর্প হতে তাঁর আর কোনও ভয় থাকবে না। আর সর্পভয়নিবারণের উপায় হল চিকিৎসা। তার বিধান হল—অসিতঞ্চার্ত্তিমন্তঞ্চ সুনীথঞ্চাপি যঃ স্মরেৎ। দিবা বা যদি বা রাত্রৌ নাস্য সর্পভয়ং ভবেৎ।। অসিত, আর্ত্তিমান, সুনীথমুনি প্রভৃতি সর্পবিষচিকিৎসককে স্মরণ করলে সর্পভয়মুক্ত হওয়া যায়।

ছবি: প্রতীকী।

ধার্মিক আস্তীক এইভাবে মাতৃকুলের নাগেদের সর্পমারণযজ্ঞের মৃত্যুভয় থেকে মুক্ত করেছিলেন। মহর্ষি শৌনকের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে সৌতি, এ ভাবে আস্তীকের উপাখ্যান বর্ণনা করলেন।

সাদাকালোর দ্বন্দ্ব চিরন্তন। কদ্রু ও বিনতার সাদাকালোর বর্ণময় বাজিরাখার পণে সাদার জয় হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সে অন্য কাহিনি। কদ্রুর ছলনা, শঠতার আশ্রয়ে, পুত্র নাগেদের সম্মতি ছিল না। তাই তারা মায়ের নির্মম অভিশাপের শিকার হয়েছে। কয়েকজনের দায়ভার একটি প্রজাতির ধ্বংস ডেকে এনেছে। বিশাল মানবকুলের মধ্যে বা যে কোন জাতির মধ্যেই হিংসার ও অহিংসার সহাবস্থান। কয়েকজন হিংস্র, নির্মম। তার ফল ভোগ করে সমগ্র জাতিকে। ঘৃণা, বিদ্বেষের বিষোদ্গার চলতে থাকে তাদের উদ্দেশ্যে— এর অবশ্যম্ভাবী ফল হল হত্যা, বিনাশ, ধ্বংস।

অতীতে এমন কি সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনাবলি তার সাক্ষ্য বহন করছে, এ কথাটি, যে কোনও বোধের আলোকে পর্যবেক্ষণের বিষয়। কদ্রুর নৃশংস শাপের আগুনে দগ্ধ হতে হতে অন্তিম পরিণতি, সর্পশূন্য হতে চলেছিল পৃথিবী। যে কোনও প্রাণীর অনুপস্থিতি বা বিলুপ্তিতে জীববৈচিত্র্যের সাম্য বিনষ্ট হয়। আস্তীক প্রকৃত অর্থেই সদর্থকচিন্তার ধারক ও বাহক। তিনি একটি সর্পকুলের রক্ষাকর্তা হয়ে এই ভারসাম্যটি রক্ষা করেছেন। বিরাট প্রাণীকুলের সদস্য হওয়ার সুবাদে প্রত্যেক প্রাণীর অপর প্রাণীর সঙ্গে এক গভীর প্রচ্ছন্ন আত্মীয়তার সম্বন্ধ আছে। একে অপরকে জড়িয়ে রয়েছে সবাই।

তাই কোনও প্রাণীর নির্মূল হওয়া হয়তো বাঞ্ছনীয় নয়। বর্তমানের প্রেক্ষিতেও মহাভারতের জন্মেজয়ের সর্পসত্রের সমাপ্তি, হয়তো চিন্তা উদ্রেক করতে পারে। জরৎকারু নিঃশেষে জরাবিনাশ করেন তিনি।কূপমণ্ডুক জরত্ববিনাশক মুক্তচিন্তার আধার তিনি। তিনি নামসাযুজ্যের স্ত্রী খুঁজে ফেরেন, বংশরক্ষার মাধ্যমে পিতৃপুরুষদের উদ্ধারের লক্ষ্যপূরণে। ভার্যাও জরৎকারু। কোনও ক্ষয় বা বিনাশের চিন্তা তাঁর মনে নেই। তিনি, স্বামীপরিত্যক্তা হয়েও ভাবি পুত্রসন্তানটি মাতৃকুলকে রক্ষা করবেন, এই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তাঁর গর্ভজাত আস্তীক সর্পকুলের পরিত্রাতা হয়ে ওঠেন। যে কোনও ঘূণধরা চিন্তার গর্ভেই জন্ম নেয় মুক্ত সদর্থক ভাবনা। জনমেজয়ের প্রতিহিংসার সর্পমারণযজ্ঞের সমাপ্তির প্রয়োজন ছিল,আবশ্যক ছিল প্রতিশোধস্পৃহার সংক্রমণের সমাপ্তির। তক্ষক জনমেজয়ের পিতা পরীক্ষিতকে দংশন করেছিলেন, তিনি একটি অভিশাপ কার্যকর করেছিলেন মাত্র। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর এই দংশনের হিংস্রতা প্রবল হয়েছিল, হয়তো মহাকাব্যকারের বর্ণনায়, রাজার সুরক্ষাবেষ্টনে প্রতিরোধের আয়োজনের বাহুল্যে।

এ ছাড়া তক্ষকের আর কোন উপায় ছিল না। কদ্রুর অভিশাপকে অব্যর্থ প্রমাণ করবার জন্যেই যেন সর্পসত্রের আয়োজন। একটি প্রতিহিংসার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঘটে অপর হিংসাবৃত্তি চরিতার্থকরবার উদ্যোগ। মানুষের মধ্যেই রয়েছে সর্পবৃত্তি, হিংসার উদ্ধত ফণাবিস্তার,দংশন সবকিছু। সবকিছুর অবসান সর্বদাই কাম্য। সাপের বিষের নিরাময় সম্ভব চিকিৎসার মাধ্যমে। তাই সর্পবিষচিকিৎসকদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে মহাকাব্যে। এটিও প্রাসঙ্গিক। জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞের অবসানে যেন হিংস্রতা, নির্মমতার সমাপ্তি—রাজকীয় মহানুভবতার সম্পূর্ণতা আছে সেখানেই — সেটিই যেন মহাভারতীয় শিক্ষা।—চলবে।

ছবি: লেখক ও সংগৃহীত।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content