বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পিতার আহ্বানে রাজপ্রাসাদে এসেছেন ভাবি যুবরাজ রামচন্দ্র। চোখে স্বপ্ন, মনে আনন্দ, পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাস। অযোধ্যার প্রজাদের পরম কাঙ্ক্ষিত ভাবি রাজা রামচন্দ্র, পিতার আহ্বানে উপস্থিত হলেন রাজা দশরথের প্রাসাদে। বাইরে অপেক্ষমান জনতা, যেমন সমুদ্র সতৃষ্ণনয়নে অস্তমিত চাঁদটির উদয়ের অপেক্ষায় থাকে সেই রকমই যেন রামচন্দ্রের দৃশ্যমান হওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।

প্রাসাদের অন্তঃপুরে কী দেখলেন রাম? শুকনো মুখে দীন হীনের মতো পিতা দশরথকে, বিষন্নতা যেন ঘিরে রেখেছে তাঁকে। রানি কৈকেয়ীও আছেন সেখানে। সবিনয়ে পিতা ও মাতার পাদবন্দনা করলেন রাম। দশরথ শুধুমাত্র চোখ ভরা জল নিয়ে অস্ফুট উচ্চারণে বলে উঠলেন ‘রাম’। রাজার মুখে আর কোনও কথা ফুটল না। বাকরুদ্ধ হলেন তিনি।

শোকে, দুঃখে ব্যাকুল রাজাকে দেখে ভয়ে চমকে উঠে, হতভম্ব হলেন রাম। যেন সাপের দেহে ভুলক্রমে পা দিয়ে ফেলেছেন তিনি। তদ্ পূর্বং নরপতের্দৃষ্ট্বা রূপং ভয়াবহম্। রামোঽপি ভয়মাপন্নঃ পদা স্পৃষ্ট্বৈব পন্নগম্।। রাজা শোকাকুল। তাঁর বুকভাঙ্গা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসে ব্যথায় আলোড়িত মনের আভাস, স্পষ্ট। নিস্তেজ, বিকলেন্দ্রিয় রাজা দশরথ। তাঁর অশান্ত অন্তর্লোকটি যেন হঠাৎ উত্তাল তরঙ্গসংক্ষোভের ফলে শান্ত সমাহিত সমুদ্রের বিক্ষুব্ধরূপ। পিতার চিন্তার অতীত এই শোকের কারণ কী? ভাবতে ভাবতে, হাজার প্রশ্নে উত্তাল হল রামের মন। অন্য সময় তাকে দেখে ক্রুদ্ধ রাজার রাগ প্রশমিত হয়, প্রসন্ন হন তিনি। আজ কী হল তাঁর? অন্যদা মাং পিতা দৃষ্ট্বা কুপিতোঽপি প্রসীদতি। তস্য মামদ্য সম্প্রেক্ষ্য কিমায়াসঃ প্রবর্ত্ততে।।

মলিন মুখে, শোকার্ত, বিষণ্ণ রাম, দীনহীনের মতো, মা কৈকেয়ীর কাছে জানতে চাইলেন, পিতা কী রামের প্রতি ক্রুদ্ধ? নিজের অজ্ঞাতসারে তিনি নিজে, কী পিতার প্রতি কোনও অন্যায় আচরণ করেছেন? যদি রাম পিতার বিরাগভাজন হয়ে থাকেন তবে রানি কৈকেয়ী যেন অবিলম্বে তাঁর প্রসন্নতা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। প্রিয় পুত্রকে স্নেহসম্ভাষণেও রাজার অনীহা। তিনি বিষণ্ণ। প্রবল দৈন্য যেন গ্রাস করেছে তাঁকে। সুখ সুলভ নয়। গভীরভাবে অসুখী রাজার কষ্ট শরীরে ও মনে। এর কারণ কী? শারীরো মানসো বাপি কচ্চিদেনং ন বাধতে। সন্তাপো বাভিতাপো বা দুর্ল্লভং হি সদা সুখম্।।

মায়েদের কেউ কী বিপদাপন্না? সুদর্শন ভরত বা উদারমনা শত্রুঘ্নের কী অমঙ্গলসূচক কিছু ঘটেছে? রামচন্দ্র পিতার আদেশপালনে বিরোধিতা করেছেন কী? অসন্তুষ্ট পিতার বিরাগভাজন হয়ে, বা অজ্ঞাত কোন কারণে যদি পিতা রুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এক মুহূর্তও তিনি বাঁচতে ইচ্ছুক নন। পৃথিবীতে আগমনের মূল কারণ পিতা, সেই দেবতুল্য পিতার প্রতি সর্বদাই সদ্ব্যবহার কাম্য। যতো মূলং নরঃ পশ্যেৎ প্রাদুর্ভাবমিহাত্মনঃ। কথং তস্মিন্ন বর্ত্তেত প্রত্যক্ষে সতি দৈবতে।। দুঃখী পিতাকে ঘিরে আরও অনেক প্রশ্ন, অজস্র দুর্ভাবনা জমে আছে রামের মনের গভীরে। মা কৈকেয়ী কী সক্রোধে অভিমানেভরে কঠোর তিরস্কারে বিদ্ধ করেছেন রাজাকে? যে কারণে অবসাদগ্রস্ত হয়েছেন রাজা? রামচন্দ্র রাজার এই চিত্তবিকারের কারণ জানতে চাইলেন রানি কৈকেয়ীর কাছে। আপনি ঘটনার গভীরে যথাযথ তথ্য কী?প্রকাশ করুন। বলুন, কেন রাজার এই মানসিক পরিবর্তন?
এতদাচক্ষ্ব মে দেবি তত্ত্বেন পরিপৃচ্ছতঃ। কিন্নিমিত্তমপূর্ব্বোঽয়ং বিকারো মনুজাধিপে।।
বিনয়ে আনত রামচন্দ্রের সরল, স্বচ্ছ জিজ্ঞাসার উত্তরে নির্লজ্জা কৈকেয়ী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কঠোর, স্বার্থনিষ্ঠ, ভাষণ শুরু করলেন। রাজার কোনও বিপদ হয়নি তার রাগও হয়নি। প্রিয় রামের ভয়ে, শুধু মনের অভিপ্রায় তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। রাম যে তাঁর অতিপ্রিয়। কিঞ্চিন্মনোগতং ত্বস্য তদ্ভয়ান্নাভিভাষতে।। প্রিয়ং ত্বামপ্রিয়ং বক্তুং বাণী নাস্য প্রবর্ত্ততে। কিন্তু আমার কাছে উনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেটি যে তোমায় পালন করতেই হবে। অতীতে আমাকে বরদানে সম্মানিত করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন যে রাজা, তিনি এখন সেই কারণে অনুতপ্ত। রাজার এটি সাধারন লোকের মতো আচরণ-অঙ্গীকার অস্বীকার করছেন তিনি। স পশ্চাত্তপ্যতে রাজা যথান্যঃ প্রাকৃতস্তথা।।

জল একবার বেড়িয়ে গেলে বাঁধ বেঁধে প্রতিরোধের চেষ্টা বৃথা, রাজার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসবার প্রয়াস, নিষ্ফল। ধর্ম রক্ষার প্রধান শর্তই হল সত্যপরায়ণতা। সজ্জনমাত্রই তা অবগত আছেন। তাই রাজা দশরথ যেন রানির প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে তা থেকে বিচ্যুত না হন। ধর্ম্মমূলমিদং রাম বিদিতঞ্চ সতামপি। তৎ সত্যং ন ত্যজেদ্রাজা কুপিতস্ত্বৎকৃতে যথা।।

রাজা দশরথ, রামকে, ভালো-মন্দ যাই বলুন না কেন রামচন্দ্র যেন তাতে সম্মত হন। তারপরে রানি বিশদে সব কিছু জানাবেন রামকে। তবে রাজা, প্রিয়পুত্রকে কোনওমতেই সেই প্রতিশ্রুতির কথা বলতে পারবেন না। রানি কৈকেয়ীর কথা শুনে, বেদনার্ত রাম বললেন, রাজা দশরথ তাঁর পিতা এবং গুরু এবং সর্বোপরি তিনি রাজা। তাঁর আদেশে, রাম আগুনে প্রবেশ করতে পারেন বিষপানেও তাঁর আপত্তি নেই সমুদ্রেও নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। অহং হি বচনাদ্রাজ্ঞঃ পতেয়মপি পাবকে।। ভক্ষয়েয়ৎ বিষং তীক্ষ্ণং মজ্জেয়মপি চার্ণবে। নিযুক্তো গুরুণা পিত্রা নৃপেণ চ বিশেষতঃ।।

রাজার অভিপ্রেত কী? তিনি সেটিই কাজে পরিণত করবেন—রামের এই প্রতিজ্ঞা। তিনি তা পালন করবেন। রামচন্দ্রের কোন বিষয়ে কখনও কোন দ্বিমত নেই। করিষ্যে প্রতিজানে চ রামো দ্বির্নাভিভাষতে
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৯: রুরু ও প্রমদ্বরার কাহিনিতে সাপের ভূমিকায় কী লুকিয়ে আছে কোনও মহাভারতীয় শিক্ষা?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

রামকে নির্মম বাক্যবাণে বিদ্ধ করে অনার্যা রানি কৈকেয়ী জানালেন, দেবাসুরের যুদ্ধে, আহত স্বামী দশরথের কাছ থেকে শুশ্রূষালব্ধ, প্রতিশ্রুত, বরদুটি লাভের বৃত্তান্ত। সেই বরদুটি এখন প্রার্থনা করছেন তিনি। একবরে পুত্র ভরতের রাজ্যভিষেক ও অপরবরে রামের দণ্ডকারণ্যে গমন। রামচন্দ্রের জন্যে আয়োজিত অভিষেক উপকরণেই ভরতের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হোক। চোদ্দ বছরের জন্য বনবাসে গমন করুন রাম। পিতার ইচ্ছা, এই প্রতিজ্ঞা পালন করুন, রাম। জটাচীর ধারণ করে রাম, দণ্ডকারণ্যে বনবাস জীবন যাপন করবেন আর ভরত তখন কোশলপুরে অভিষিক্ত হয়ে হাতি ঘোড়া রত্নে, সমাকীর্ণ এই বসুধা শাসন করবেন। এই নিদারুণ কারণে রাজা আজ আহতমনে, বিষন্নবদনে, করুণায় মুখ তুলে পুত্র রামের পানে চাইতে পারছেন না। রানির অনুরোধ—রাজার বচন সত্যে পরিণত করে রাম পিতাকে পরিত্রান করুন। নিজের মৃত্যু পরোয়ানা যেন শুনলেন রাম, তবুও একটুও ব্যথিত হল না তাঁর মন। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে জানালেন রামচন্দ্র, তবে তাই হোক।রাজার প্রতিজ্ঞা পালন করে এখান থেকেই জটা এবং চীর ধারণ করে বনবাসে যাব আমি। এবমস্তু গমিষ্যামি বনং বস্তুমহং ত্বিতঃ।জটাচীরধরো রাজ্ঞঃ প্রতিজ্ঞামনুপালয়ন্।।

তিনি ব্যথিত হয়েছেন পিতার নিস্পৃহ আচরণে। তিনি কেন প্রিয় পুত্রকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন না। রানি যেন ক্রোধ প্রকাশ না করেন, রাম বনে যাবেনই। কৃতজ্ঞ গুরু এবং পরম হিতাকাঙ্খী পিতা। তিনি আমার প্রতি আস্থা রাখলে বিশ্বস্ত রাম তাঁর প্রিয় কাজ না করে পারেন? দুঃখে দীর্ণ রাম, পিতার আচরণে ক্ষুব্ধ। কেন ভরতের অভিষেকবার্তা রাজা নিজমুখে ঘোষণা করলেন না? তিনি না বললেও প্রিয় অনুজ ভরতের জন্য রামচন্দ্র সানন্দে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রাজ্য, ধন, এমনকি সীতা এবং প্রাণ পর্যন্ত সমর্পণ করতে পারেন। তাই এত বড় ত্যাগস্বীকারের প্রতিজ্ঞার পরে পিতার আদেশ পালন এবং ভরতকে রাজ্যদানের রামকৃত অঙ্গীকার।

এর পরে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়? তাই পিতা কেন মিথ্যা অধোবদনে চোখের জল ফেলছেন?তাঁকে,রানি আশ্বস্ত করুন। রাজাদেশবলে ভরতকে দ্রুত এখানে আনা হোক। সত্বর রামও এখান থেকেই চোদ্দ বছরের জন্য বনে গমন করবেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

রানি কৈকেয়ী এইবার নিশ্চিন্ত হলেন তিনি খুব খুশী হয়ে রামের বনবাসগমনের উদ্যোগগ্রহণের নিমিত্ত তাড়া দিলেন। যখন বনে যেতে মনস্থ করেছ তুমি, তবে আর বিলম্ব কেন? তিনি জানালেন, লজ্জিত রাজা, মুখ ফুটে রামচন্দ্রকে বলতে পারছেন না এই কথা। সেই কারণে মনঃক্ষুন্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। যতক্ষণ রাম বনে না যাবেন ততক্ষণ তার পিতা স্নানাহার করবেন না। যাবত্ত্বং ন বনং যাতঃ পুরাদস্মাদতি ত্বরন্। পিতা তাবন্ন তে রাম স্নান্যতে ভোজ্যতেঽপি।। কৈকেয়ীর কথায় রাজা ‘হায় কি কষ্ট’ বলে আবারও সংজ্ঞা হারালেন। রানি কৈকেয়ীর অশোভন উক্তিতে, বনগমনের উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাম।

দেবী কৈকেয়ীকে বললেন, রানি যেন বিশেষভাবে অবগত হন, রাম নিজে স্বার্থনিষ্ঠ জীবন যাপন করেন না, ঋষিতুল্য ধর্মবোধে প্রাণিত তিনি। পিতার সেবা ও আজ্ঞা পালন তাঁর কাছে মহান ধর্মাচরণের নামান্তর। প্রাণ তুচ্ছ করেও পরম পূজ্য পিতার যে কোনও প্রিয়কাজ তিনি সম্পন্ন করতে সক্ষম। তাই তিনি যদিও পিতার মৌখিক আদেশ শোনেননি, তবুও দেবী কৈকেয়ীর বচনানুসারে তিনি চতুর্দশ বছর নির্জন বনবাসজীবন যাপন করবেন। অনুক্তোঽপ্যত্রভবতা ভবত্যা বচনাদহম্। বনে বৎস্যামি বিজনে বর্ষাণীহ চতুর্দশ।। রামের মনে কৈকেয়ী মায়ের প্ররোচনাময় চক্রান্তের পরিকল্পনা হয়তো ছায়া বিস্তার করেছে। তবুও স্থিতধী রাম কিন্তু প্রতিক্রিয়াহীন অবিচল। সন্দেহপ্রবণ দেবী কৈকেয়ীকে তাঁর জিজ্ঞাসা—আপনি নিশ্চয়ই আমাকে গুণহীন মনে করেন, কারণ আমার ওপর অধিকারবোধহেতু নিজে আদেশ না করে আমার পিতাকে অনুরোধ করলেন কেন? ন নূনং ময়ি কৈকেয়ি কঞ্চিদাশংসসে গুণম্। যদ্রাজনমবোচস্ত্বং মমেশ্বরতরা সতী।।

রামচন্দ্র স্থির করলেন মা কৌশল্যার অনুমতি নিয়ে, পত্নী সীতাকে অনুনয়সহকারে সম্মত করে আজই তিনি দণ্ডকারণ্যে গমন করবেন। রানি কৈকেয়ীকে সনাতন কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে বললেন,ভরত যেন যথাযথভাবে রাজ্যশাসন করেন এবং বৃদ্ধরাজার শুশ্রূষাভার, এই দুটি কর্তব্য রানি কৈ যেন যথোচিত মর্যাদায় পালন করেন।

কথোপকথন রাজার শ্রুতিগোচর হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় অসহায় রাজা দশরথ আর্তচিৎকারে কেঁদে উঠলেন। হতচেতন পিতা ও মাতা কৈকেয়ীর চরণযুগল বন্দনা করে সুহৃদগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন রাম। চাপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সাশ্রুনয়নে সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণ তাঁর অনুগমন করলেন। পড়ে রইল অভিষেকের উপকরণসমূহ। সেদিকে ফিরেও তাকালেন না রাম। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদও যেমন কান্তিময়, সুন্দর, তেমনই রাজ্যের সত্ত্ব হারিয়েও লোকপ্রিয় রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তার কমনীয়তা একটুও হ্রাস পেলনা।প্রিয় বা অপ্রিয় সবকিছুতেই ঋষিতুল্য আসক্তিহীন, চিত্তবিকারহীন তিনি। না, তিনি আর রাজোচিত ছত্র ও চামর ধারণের অধিকারী নন। এ বিষয়ে নিষেধ করলেন অনুচরদের। স্বজনবন্ধু ও পুরবাসীদের বিদায় দিলেন তিনি।আর বাহনের কি প্রয়োজন। পদব্রজেই চললেন মায়ের কাছে অশুভ বার্তা নিয়ে। মনের গভীরে দুঃখ, ক্ষোভ, বাইরে আচরণে নেই কোনও অস্বাভাবিকতা ইন্দ্রিয়সংযমী, সত্যবাদী, শুদ্ধচরিত্র রামের। শরতের উজ্জ্বল চাঁদের কিরণের মতো সদা প্রফুল্ল রামচন্দ্রের হাসিটি কিন্তু অম্লান। উচিতঞ্চ মহাবাহুর্ন জহৌ হর্ষমাত্মবান্। শারদঃ সমুদীর্ণাংশুশ্চন্দ্রস্তেজ ইবাত্মজম্।।

সমবেত জনমণ্ডলীকে মধুর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করে মায়ের গৃহে প্রবেশ করলেন ধর্মাত্মা, মহাযশস্বী রামচন্দ্র।রামের তুল্য গুণবান, মহাশৌর্যশালী সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণ, মনের দুঃখ, মনেই প্রচ্ছন্ন রেখে, রামের অনুগমন করলেন। আসন্ন বিপদের কোনও আঁচ স্পর্শ করেনি আনন্দমুখর কৌশল্যার গৃহটিকে। আসন্ন বিপদ সামনে, তবু অবিচলিত রামের কোন চিত্তবিকার নেই, উদ্বেগহীন তিনি। শুধু আনন্দের আবহে নিরানন্দময়, ভাবি, আগতপ্রায়, বিপদাশঙ্কায় প্রিয়জনেদের প্রাণহানিও অসম্ভব নয়—এই চিন্তাতেও তাঁর মন অধীর হয়ে উঠলনা,নির্বিকার রইলেন তিনি। প্রবিশ্য বেশ্মাতিভৃশং মুদা যুতং সমীক্ষ্য তাং চার্থবিপত্তিমাগতাম্। ন চৈব রামোঽত্র জগাম বিক্রিয়াং সুহৃজ্জনস্যাত্মবিপত্তিশঙ্কয়া।।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা

সরল, প্রতারিত রামচন্দ্রের রাজপদের উত্তরাধিকারলাভে ছিল বিপুল জনসমর্থন, ছিল পিতৃস্বীকৃতি, আপ্তমন্ত্রীদের, বিদ্বজ্জনেদের, বিখ্যাত বশিষ্ঠপ্রমুখ মুনিঋষিদের মান্যতাদানরূপ সম্মান। তবু তাঁকে হার মানতে হল, পরাজিত হলেন বৃদ্ধ স্নেহদুর্বল পিতা রাজা দশরথ, এ এক অসম মানসযুদ্ধ। একদিকে স্নেহদুর্বল পিতার সন্তানস্নেহ এবং রাজোচিত দায়বদ্ধতা পালনের দায়, অপরদিকে পত্নীর প্রতি কামাসক্ত স্বামীর একদা দত্ত প্রতিশ্রুতিরক্ষার অঙ্গীকার। রাজা চোখের জলে ভেসেছেন, শাপশাপান্ত করেছেন স্ত্রীকে। কিন্তু সবকিছুই ব্যর্থ হয়েছে, স্ত্রী সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন। রামচন্দ্রের এই পালাবদলের মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। এক মুহূর্তে নায়কোচিত গরিমা থেকে মহাকাব্যের ট্র্যাজিক নায়কে পরিণত হলেন তিনি। দুর্দৈবের শিকার রামচন্দ্রের নিয়তির কাছে বারবার এই হেরে যাওয়া, সাধারণের জীবনযুদ্ধের সমান বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মর্মান্তিক পরিণতিতে সত্যরক্ষা সম্ভব হয়েছে, কূটকৌশলের ফলে ধর্মের আপাত জয় হয়েছে হয়তো, রামচন্দ্রের অমূল্য যৌবনের শক্তিসামর্থ্যের বিনিময়ে।

পিতৃসত্যরক্ষা মহান? না রাজোচিত অঙ্গীকার পালন? কোনটি আশ্রয়নীয়? এই দোটানায় জেরবার হয়েছেন হয়তো রাম, কিন্তু বহিঃপ্রকাশ নেই তাঁর। শান্ত, সমাহিত, স্থিতধী রামচন্দ্র হৃদয়বৃত্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন জীবনে। শ্রদ্ধা, সম্মান, গুরুত্ব যে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ পরিবারিক সদস্যের যথোচিত প্রাপ্য মর্যাদা, এটি সবযুগেই অভ্রান্ত সত্য। রামচন্দ্র পিতার প্রতিশ্রুতিরক্ষার থেকেও রাজা দশরথের আদেশপালনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মা কৈকেয়ীর দুরভিসন্ধি অনুমান করেছেন হয়তো কিন্তু তাঁকে দোষারোপ করে অসম্মানিত করেননি। ভাবি রাজা এবং উদারমনা রামের প্রতি কৈকেয়ীর আস্থাহীনতায় ব্যথিত হয়েছেন, অভিযোগ করেছেন। কিন্তু মাত্রাবোধ বজায় রেখেছেন। একবাক্যে, যিনি এক চরম অনিশ্চিত জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন,সেই প্রতারিত সরল রামচন্দ্রের মহানুভবতায় প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলের বা শহুরে কেতায় অভ্যস্ত ভারতবাসী কী আজও নিজেদের জীবনের কোন সাযুজ্য খুঁজে পান?

ভোগসর্বস্ব জীবনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ? না ত্যাগেই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া? এ প্রশ্নে বিবেকবোধ নির্ণায়ক হয়েছে চিরদিন, অভিজাত এবং আভাজন সকলেরই। রামচন্দ্র ক্ষমতা এবং রাজোচিত বিলাসবহুল যাপনের লোভ জয় করেছেন। তাঁর সেই মানসিক সামর্থ্য ছিল।রামচন্দ্রের নির্লিপ্তবৈরাগ্য, অনাসক্তি অতিলৌকিক নায়কে পরিণত করেছে তাঁকে। পারিবারিক ভাঙ্গন ও দ্বন্দ্বরোধে, ভ্রাতৃত্ববোধরক্ষার কারণে নিঃশর্ত স্বাচ্ছন্দ্যবিসর্জনের বিরল উদাহরণ হয়ে উঠেছেন রাম। অতীতে,ভারতীয় পারিবারিক জীবনের পরিসরে, ছোটখাট স্বার্থবিসর্জনের উদাহরণ ছিল জীবনচর্চায়, যাপনচিত্রে। এখন যা বিরলতম দৃষ্টান্ত। ভোগসর্বস্ব আধুনিক জীবনে রামের স্বার্থত্যাগের প্রাসঙ্গিকতা অল্প হলেও হয়তো আছে, যেহেতু মানুষের বিবেকচেতনা আজও মৃতপ্রায় নয়। তাই মন্দিরে পূজিত অবতাররূপ থেকেও তাঁর সর্বত্যাগী জীবনের মানবিক মাহাত্ম্য কী প্রভাবিত করেনা ভারতীয় মানসলোক? —চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content