মঙ্গলবার ২৫ মার্চ, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামের রাজ্যাভিষেকের আনন্দমুখর অযোধ্যা নগরী। নানা দিক থেকে জনসমাগমে পরিপূর্ণ নগরীর রাজপথ। সুসজ্জিতা অযোধ্যা নগরী আনন্দোচ্ছ্বাসে মুখর।
রাজমহিষী, ভরতমাতা, কৈকেয়ীর খাস দাসী মন্থরা, প্রাসাদ শিখর থেকে এই সমারোহে, সমবেত প্রজাপুঞ্জের পুলক দেখে বিস্মিত হল। দেখল, ধন বিতরণরতা রামমাতা কৌশল্যাকে। তার মনে নানান প্রশ্ন দেখা দিল। উৎসবসাজে সজ্জিতা রামের ধাত্রীকে, জিজ্ঞাসা করল সে, রামের মা এত হর্ষোৎফুল্লা কেন? তাঁর এই ধনবিতরণের কারণ কী? রাজা কি রানি কৌশল্যার মাধ্যমে, কোন বিশেষ কাজ করাবেন? এদের এত আনন্দের কারণ কেন? সবকিছু খুলে বলো তো ধাত্রী। অতিমাত্র প্রহর্ষঃ কিং জনস্যাস্য শংস মে আহ্লাদে আটখানা হয়ে রামের রাজ্যাভিষেকের সংবাদ জানালেন রামের ধাত্রী।

এতক্ষণ কৈকেয়ীভবনে এই আনন্দ সংবাদ পৌঁছয়নি কেন? এটাই ভীষণ আশ্চর্যের বিষয়। কৈকেয়ীপুত্র ভরত নয়, কৌশল্যাপুত্র রাম, যুবরাজরূপে অভিষিক্ত হবেন। ঈর্ষার আগুনে জ্বলে গেল মন্থরার মন। শয্যায় শায়িতা কৈকেয়ীর কাছে ছুটে গেল সে। ওরে বোকা মেয়ে, উঠে পরো। শিয়রে সমন। স্বামীর ওপরে গভীর বিশ্বাস তোমার। ভাবো-তিনি সর্বদাই তোমার প্রিয় কাজটিই করেন। বড় সৌভাগ্যবতী হয়েছো, তাই ভারি অহংকার তোমার। এদিকে ভাগ্য যে তোমার গ্রীষ্মের নদীস্রোতের মতোই চঞ্চল।
অনিষ্টে সুভগাকারে সৌভাগ্যেন বিকত্থসে। চলং হি তব সৌভাগ্যং নদ্যাঃ স্রোত ইবোষ্ণগে।।

মন্থরার বিষন্নতার কারণ জানতে চাইলেন রানি কৈকেয়ী। মন্থরা সুযোগসন্ধানী।সে রামের প্রতি বিরাগ সৃষ্টি করবার সুযোগের, সদ্ব্যবহার করল। খবর দিল, রানি কৈকেয়ীর, সৌভাগ্যের কপাল পুড়েছে এ বার। রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চলেছেন। দুঃখে, শোকে, মন্থরা কাতরা। কারণ রানি কৈকেয়ীর দুঃখেই তিনি দুঃখিনী এবং তাঁর উন্নতিতেই যে তার নিজের সুখ। মন্থরার অভিযোগ, রাজকুলে জন্মগ্রহণ করে, রাজরানি হয়েও, এই কঠোর রাজধর্ম কেন বুঝতে চাইছেন না রানি? রাজা দশরথ সম্বন্ধেও অপবাদে সরব হল মন্থরা। কৈকেয়ীর স্বামী মুখে ধার্মিকমাত্র। আচরণে তিনি শঠ। মুখে মধু, মনে তাঁর নিষ্ঠুর ছলচাতুরী। তাঁকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছেন রানি। তাঁকে স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে, কৌশল্যাকে রাজ্যরূপ অর্থ দান করেছেন রাজা দশরথ।
রাজা ভরতকে রানির বন্ধুবর্গের কাছে রেখে দূর করে দিয়েছেন,পথের কাঁটাটি সড়িয়েছেন তিনি।নিষ্কণ্টক রাজ্যে আগামীকালই রাম অভিষিক্ত হবেন।তিনি আরও রাজা দশরথের নিন্দায় সোচ্চার হলেন।ওই কপটাচারী ক্রুর স্বামী উপেক্ষিত সাপের মতোই ছলান্বেষী। তিনি কৈকেয়ী ও তাঁর পুত্রের প্রতি সেই আচরণই করেছেন। যথা হি কুর্যাচ্ছত্রুর্ব্বা সর্পো বা প্রত্যুপেক্ষিতঃ। রাজ্ঞা দশরথেনাদ্য সপুত্রা ত্বং তথা কৃতা।। তিনি মিনতি করে বললেন, হে কৈকেয়ি, এখনও সময় আছে। দ্রুত নিজেদের মঙ্গলের কথা ভাবো।পুত্রকে,নিজেকে,আমাকেও অশুভ ঘটনার প্রভাবমুক্ত করে, রক্ষা করো।

সা প্রাপ্তকালং কৈকেয়ি ক্ষিপ্রং কুরু হিতং তব। ত্রায়স্ব পুত্রমাত্মানং মাঞ্চ বিস্ময়দর্শনে।।

মন্থরার এই বিষোদ্গারের প্রতিক্রিয়া কী হল? পরমপ্রিয় সংবাদে পরিতৃপ্ত রানি বললেন, তাঁর কাছে রাম ও ভরতের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই।অভিন্ন,তাঁরা দু’জন। রাজা দশরথ, রামকে যুবরাজপদে মনোনীত করেছেন, এ বিষয়ে রানি কৈকেয়ী পরম সন্তুষ্ট। পরমানন্দে মন্থরাকে দিব্য গহনা দান করলেন রানি।

কৈকেয়ীর উপহার, আভরণ প্রত্যাখ্যান করলেন দাসী মন্থরা। ভাবলেন, রানির বিপদকালে বুদ্ধি নাশ হয়েছে। তিনি মনে মনে হাসলেন, তা না হলে সপত্নীপুত্রের উন্নতিতে কেউ এমন আনন্দিত হয়? রানির এই দুর্বুদ্ধিতে তিনি শোকাকুলা। রাজ্য যেমন রামের তেমন ভরতেরও। ভরতের থেকে রামচন্দ্রের বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারণেই মন্থরা নিজে বিষণ্ণা। কারণ ভীতব্যক্তি যাঁর থেকে ভয় আছে তাঁকেই বিনষ্ট করে থাকে।অনুগামী লক্ষ্মণ হতে রামের ভয় নেই। ভরতের অনুগত শত্রুঘ্ন থেকেও রামচন্দ্রের কোন ভয়ের আশঙ্কা নেই। ক্রমানুযায়ী রামের পরেই, ভরত। ভরতও সিংহাসনের একজন উত্তরাধিকারী। কনিষ্ঠদ্বয় লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের স্থান ভরতের পরে। তাই ভরত বিনা, রামের ভয়ের কারণ, আর কোন ভাই-ই নন। বিদ্বান, বুদ্ধিমান, ক্ষত্রিয়োচিত চরিত্রবলের অধিকারী রাম, দ্রুত তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত। তাই সন্দেহনিরসনের জন্যে, তিনি নিশ্চয়ই কৈকেয়ীপুত্র ভরতের ক্ষতি করতে পারেন। বিদুষঃ ক্ষত্রচারিত্রে প্রাজ্ঞস্য প্রাপ্তকারিণঃ। ভয়াৎ প্রবেপে রামস্য চিন্তায়ন্তী তবাত্মজম্।। আর ওই রানি কৌশল্যা? রাজমাতা হয়ে যত সুখ ভোগ করবেন তিনি,আর কৈকেয়ী? রানি কৈকেয়ী তাঁর অন্য সপত্নীদের মতো জোড়হাতে কৌশল্যার সেবাদাসী হবেন মন্থরার মতোই। প্রাপ্তাং বসুমতীং প্রীতিং প্রতীতাং হতবিদ্বিষম্।উপস্থাস্যতি কৌসল্যাং দাসীবত্ত্বং কৃতাঞ্জলিঃ।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩১: গুরুদক্ষিণাদান, প্রতিহিংসার সুদূরপ্রসারী পরিণাম

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

কৈকেয়ীর ভবিতব্য হবে মন্থরার অনুরূপ। ভরত হবেন রামের দাস। ভরতপত্নীর দশা হবে কৈকেয়ীর মতোই। তিনি হবেন সীতার পরিচারিকা। এইসব যুক্তি ধোপে টিকলনা, কৈকেয়ীর অকপট উচ্ছ্বসিত রামপ্রশংসায়। ধর্মজ্ঞো গুণবান্ দান্তঃ কৃতজ্ঞঃ সত্যবান্ শুচিঃ। রামো রাজসুতো জ্যেষ্ঠো যৌবরাজ্যমতোঽর্হতি।।

ধার্মিক, গুণবান, সুশিক্ষিত, কৃতজ্ঞ, সত্যপরায়ণ,পূতচরিত্র রাজপুত্র রাম, যুবরাজপদের যোগ্য উত্তরাধিকারী। রাম দীর্ঘাযু লাভ করে পিতার ন্যায় ভাইদের প্রতিপালন করবেন। কুব্জা মন্থরার ব্যবহারে, রানি বিস্মিত হয়েছেন। নরশ্রেষ্ঠ ভরত, শতবর্ষপরে উত্তরাধিকারসূত্রে অযোধ্যার সিংহাসনতো লাভ করবেনই। ভরতশ্চাপি রামস্য ধ্রুবং বর্ষশতাৎ পরং। পিতৃপৈতামহং রাজ্যমবাপ্স্যতি নরর্ষভঃ।। কেন এই দহনজ্বালা মন্থরার? রাম যে রানি কৈকেয়ীর অতি প্রিয়। রাম, কৌশল্যামা অপেক্ষাও যেন মাতা কৈকেয়ীর প্রতি অধিক যত্নশীল। ভাইরা রামের অভিন্ন আত্মার মতো।তাঁর রাজ্যলাভে ভরতও রাজ্যলাভ করবে। রাজ্যং যদি হি রামস্য ভরতস্যাপি তত্তদা। মন্যতে হি যথাত্মানং তথা ভ্রাতৃংশ্চ রাঘবঃ।। তাই রানির মন্থরার প্রতি উপদেশ—যেমন ভরতকে মান দাও রামকে তার থেকেও বেশি মাননীয় মনে করবে। রানি কৌশল্যার এই উদারতা বিন্দুমাত্র স্পর্শ করল না মন্থরার হৃদয়। চরম দুঃখে, দীর্ঘ, উষ্ণ,শ্বাসত্যাগ করে বহু দূর চিন্তা করলে সে। সেই ভাবনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে দাসী মন্থরা যেন আজ কঠিন শপথ নিয়েছে।

মন্থরা ভাবল— ভালমন্দবোধ লোপ পেয়েছে রানির। তাই হয়তো দুর্গতির আঁচটুকুও স্পর্শ করছে না তাঁকে। রাম রাজা হলে যে বংশপরম্পরাক্রমে তাঁর পুত্রই রাজা হবে। সেখানে ভরতের স্থান কোথায়? ভবিতা রাঘবো রাজা রাঘবস্য চ যঃ সুতঃ। রাজবংশাত্তু ভরতঃ কৈকেয়ি পরিহাস্যতে।। কোন রাজাই সকল পুত্রকে রাজ্য দেন না। কারণ তাতে ‘নানা মুনির নানা মত’ এই প্রবাদ অনুসারে মহা অনর্থের সূচনা হতে পারে। তাই অন্যরা গুণবান হওয়া সত্বেও রাজারা ‘জ্যেষ্ঠর শ্রেষ্ঠ ভাগ’ এই নিয়ম মেনে নিয়ে জ্যেষ্ঠকেই রাজসিংহাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। তস্মাজ্জ্যেষ্ঠে হি কৈকেয়ি রাজতন্ত্রাণি পার্থিবাঃ। স্থাপয়ন্ত্যনবাদ্যাঙ্গি গুণবৎস্বিতরেষ্বপি।।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়

পাখি সব করে রব, পর্ব-৫: জঙ্গল অভিযানের পরে অবশেষে দেখা মিলল মন ভুলিয়ে দেওয়া সেই রেইন কোয়েলের

ভরত রাজ্যাধিকারচ্যুত হবেন, সেইসঙ্গে রাজ্যসুখে বঞ্চিতও হবেন তিনি। তাই দাসীর এই সদুপদেশ। কিন্তু তা বুঝবার ইচ্ছেটাই যে রানীর নেই। সপত্নীর উন্নতিতে খুশি হয়ে দান করছেন রানী কৈকেয়ী। এরপরে মন্থরা আরও সন্দেহের কাঁটাতে বিদ্ধ করল রানিকে। রাম রাজা হয়েই, হয় নির্বাসিত করবেন ভরতকে, না হলে প্রাণহরণ করবেন তাঁর। তাহলেই রাম নিষ্কন্টক হবেন। কারণ, মন্থরার যুক্তি হল—চলমান প্রাণীদের মধ্যে নৈকট্যই, মানুষের মমতার বন্ধনের কারণ।ভরত যে বিচ্ছিন্ন। তিনি মাতুলালয়ে বড় হয়েছেন। ভরতের উপস্থিতিতে হয়তো এমনটা ঘটত না। কারণ, কাঠুরে গাছ কাটতে গিয়ে কাঁটালতায়ভরা গাছ পরিহার করে থাকেন।তাই প্রতিবন্ধকতাশূন্য রাজ্যের যুবরাজ এখন অবিসংবাদী রাম। রানিকে এটি অবগতকরানোই বোধহয় মন্থরার পরামর্শদানের উদ্দেশ্য ছিল।

সুরলোকে যেমন অশ্বিনীকুমারদ্বয় তেমনই জুটি রাম ও লক্ষণ, এই দুই ভাইয়ের। তাই মন্থরার বিবেচনায়, রামের অনুপস্থিতিই কাম্য। রাম যদি বনবাসী হন তাহলে পিতার আজ্ঞায়, ভরত, রাজ্য লাভ করলেই সার্বিক মঙ্গল।ভরতের স্বাভাবিক শত্রু রাম। তিনি রাজা হলে ভরত সুখভোগ করবেন কী? তাঁর উপস্থিতিই নিরর্থক হয়ে যাবে যে। ভরত রামের অধীনে জীবনে বেঁচে থাকবেন কীভাবে? স তে সুখোচিতো বালো রামস্য সহজো রিপুঃ।সমৃদ্ধার্থস্য নষ্টার্থো জীবিষ্যতি কথং বশে।। দলনেতা হাতিটিকে যেমন অরণ্যে সিংহ আক্রমণ করে রাম ভরতকে সেই ভাবে আক্রমণ করবেন। আক্রান্ত ভরতকে রক্ষা করা রানি কৈকেয়ীর কর্তব্য। মন্থরার আরও শাণিত যুক্তি মজুত। তোমার সপত্নী কৌশল্যাকে একদা অতীতে পরাজিত করেছিলেন রানি কৈকেয়ী। কৌশল্যা এখন প্রতিশোধকল্পে শত্রুনির্যাতন করবেনই।কাজেই দুয়ারে সমূহ বিপদ। রাম রাজা হলে সপুত্র তোমার, অশুভ পরাজয় নিশ্চিত।

তদা গমিষস্যশুভং পরাভবং
সহৈব দীনা ভরতেন ভামিনি।


এবার তাহলে তুমি পুত্রের রাজ্যলাভ এবং রামের নির্বাসনের পরিকল্পনায় মন দাও। অতো হি সঞ্চিন্তয় রাজ্যমাত্মজে পরস্য চৈবাস্য বিবাসকারণম্।। মন্থরার কানভাঙানিতে কাজ হল।রাগে রক্তবর্ণা হলেন কৈকেয়ী।তাহলে এখনই উপায় স্থির করা যাক,যাতে উদ্দেশ্য দুটিই সিদ্ধ হতে পারে, রামের বনবাসের দ্রুত আয়োজন এবং আজই ভরতের রাজ্যলাভের উদ্যোগ।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ইদং ত্বিদানীং সম্পশ্য কেনোপায়েন সাধয়ে। ভরতঃ প্রাপ্নুয়াদ্রাজ্যং ন তু রামঃ কথঞ্চন।। অঘটনপটিযসী মন্থরা রামের অনর্থচিন্তায মগ্ন হল। উপায়ও পেয়ে গেল সে।রানির স্মরণে আছে কী? নাকি মন্থরার মুখ থেকেই শুনতে চান? তাহলে বলবে সে। উৎসাহে শয্যায় উঠে বসলেন রানি। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করে বললেন, কথয় ত্বং মমোপায়ং কেনোপায়েন মন্থরে। ভরতঃ প্রাপ্নুয়াদ্রাজ্যং ন তু রামঃ কথঞ্চন।। মন্থরে বলো, বলো সেই উপায়টি কী? যার মাধ্যমে দুটিই সম্ভব? মন্থরা স্মরণ করালেন, সেই দণ্ডকদেশের বৈজয়ন্তনগরের দৈত্যরাজ তিমিধ্বজ, যিনি শম্বর নামে খ্যাত হয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধে, কৈকেয়ীকে সঙ্গে নিয়ে রাজা দশরথ, দেবরাজ ইন্দ্রের সাহায্যের নিমিত্ত গমন করেছিলেন। তখন যুদ্ধে, ক্ষতবিক্ষত দেহ স্বামীকে, রক্ষা করেছিলেন কৈকেয়ী। পরিতুষ্ট স্বামী, স্ত্রীকে দুখানি বরদান করবেন—এই মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন। স ত্বয়োক্তঃ পতির্দেবি যদিচ্ছং তদা বরম্ এখন রামের অভিষেক নিবারণের উপায়, ওই বর দুটি। একবরে চতুর্দশ বৎসর রামের বনবাস, দ্বিতীয় বরে ভরতের যৌবরাজ্যাভিষেক। দূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও মন্থরার মগজে ঘুরছে তখন। ওই দীর্ঘ চোদ্দ বৎসর প্রজাদের প্রীতিভাজন হয়ে আস্থা অর্জন করতে পারবেন ভরত। এখন শিগগির মলিনবসনে গোঁসা ঘরে খিল দাও। স্বামীকে দেখেও না দেখার ভান করো। তাঁকে আর কোন প্রিয় সম্ভাষণ নয়। ভূলুণ্ঠিতা অবস্থায়, কেঁদে আকুল হয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টায় মনোনিবেশের পরামর্শ দিল মন্থরা। রানি তার পরামর্শে আশ্বস্ত হলেন। তাঁর বিশ্বাস দৃঢ় হল।

রাজা দশরথের প্রিয় রানিকে অদেয় কিছুই নেই। তিনি রানির কারণে আগুনে প্রবেশ করতে পারেন। দয়িতার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন। রানির ক্রোধ সৃষ্টিতো নয়ই, রানিকে ক্রোধান্বিত দেখতেও রাজা নারাজ। মন্থরার অশুভ বচনে বিপদসঙ্কেত। তাও তার মধ্যেই কৈকেয়ী অর্থ খুঁজে পেলেন। অনর্থমর্থরূপেণ গ্রাহিতা সা ততস্তয়া বুদ্ধিমতী কৈকেয়ীর বুদ্ধিবিভ্রম হল। তিনি মন্থরার কাছে স্বীকার করলেন, এতদিন রাজার মনের গতি তিনি বুঝতে পারেননি। প্রকৃত শুভাকাঙ্খিনী মন্থরা যথাসময়ে, ভাগ্যিস, রানিকে সতর্ক করে দিয়েছে। এমন কি বিরূপা মন্থরায় বিগলিতা কৈকেয়ী, মন্থরার রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন রাজমাতা হয়ে, অভীষ্ট সিদ্ধ হলে, তিনি কুব্জা মন্থরাকে বহুমূল্য বসনে, ভূষণে সাজিয়ে দেবেন। জল বহির্গত হলে সেতুবন্ধন নিষ্ফল। তেমনই সময় চলে গেলে সমস্ত চেষ্টাই বিফলে যাবে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

গতোদকে সেতুবন্ধো ন কল্যাণি ষ্বিধীয়তে। উত্তিষ্ঠ কুরু কল্যাণং রাজানমনুদর্শয়।
রানিকে স্মরণ করিয়ে দিলেন মন্থরা, সুতরাং যাও, ওঠো, রাজাকে জানাও তোমার অভিপ্রায়। বহুমূল্য রত্নাভরণ অবহেলায় খুলে ফেললেন রানি। তাঁর আর সোনা, অর্থ, রত্ন, ভোজ্য কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। রাম রাজা হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। যদি রাম বনগমন না করেন,তবে তার আর কিছুতে মন নেই, এমনকি জীবনধারণেও অনিচ্ছুক তিনি। ক্রোধের আঁধার তাঁকে ঘিরে ধরল, যেমন আকাশে তারা বিলুপ্ত হলে গভীর অরণ্যের অন্ধকার সৃষ্টি হয় তেমনই প্রসাধনহীনা, ক্রোধান্ধ, কৈকেয়ী ভূমিশয্যায় লুটিয়ে পরলেন।

অযোধ্যার রাজপুরীতে উৎসবের আবহে মন্থরা কৈকেয়ীর কাছে বিষোদ্গার করল। প্রকারান্তরে রানিকে একটি নৃশংসতায় প্রবৃত্ত করল সে। সেটি একটি অন্তর্ঘাত। ঘরে বাইরে, পরিবারে, সমাজে, রাজনীতিতেতো বটেই, এর নিরন্তর লীলা চলছেই। মানুষের মন এর চারণভূমি।কখন যে, কে, কার দ্বারা, প্ররোচিত হন তার হদিস পাওয়া দুষ্কর। একজন বিখ্যাত বংশের রাজকন্যা, দশরথমহিষী প্রভাবিত হলেন তাঁর দাসীর দ্বারা। এইরকম নাশকতার চিন্তায়, রানিকে স্তাবকতার মাধ্যমে তুষ্ট করা ছাড়া আর কোন বড় প্রাপ্তির সম্ভাবনা মন্থরার ছিল কী? বোধ হয়, নয়।কারণ রামচন্দ্র যুবরাজপদে অভিষিক্ত হতে চলেছেন—এই সংবাদ জানানোমাত্রই সে কৈকেয়ীর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল মূল্যবান আভরণ। তাহলে রাম রাজা হলে, তিনিতো অপরিমিত পুরস্কার পেতেনই। এত বলাইবাহুল্য। মন্থরারা চিরকাল এইভাবেই নাশকতা চালিয়ে যান যুগে মুখে, কালে কালে। শুধু পরিস্থিতি আর চরিত্রেরা বদলে যায়। পলকা ভঙ্গুর চরিত্রের কৈকেয়ীরা এদের শাণিত নখরের থাবায় ধরা দেয়,আর পরিবেশ এক দুর্বিষহ দূষণ সৃষ্টি হয়।দূষণের অভিঘাতের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আদিকবি। মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। সেই দূষণের দায়ভার এ বার কৈকেয়ীর। না মন্থরার কোন দায়ভার নেই। সে তার স্বভাবসুলভ কাজই করেছে। হয়তো রাজমহলে এটি তার অস্তিত্বরক্ষার একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। কিন্তু আজন্ম রাজনীতি যাঁর রক্তে সেই রানির আচরণ, কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় কী? অপরিসীম পুত্রস্নেহও বৃহত্তরস্বার্থে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। স্বামীর,রাজা দশরথের দুর্বলতা, স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানো—একটি রাষ্ট্রের প্রতি, প্রজাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর হয়তো।কৈকেয়ীর সরলতা, যা অশুভ শক্তির দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়, সেটি মনে হয় মানুষমাত্রের দুর্বল চরিত্রের একটি দিক। মন্থরারা আছেন, থাকবেন, কৈকেয়ীরা দূষণের বাহক হয়ে, রামের অযোধ্যার মতো সমাজ, সংসার এ ভাবেই দূষিত করে চলেছেন। দূষণ কী মনে মনে ছড়িয়ে যায়না? যায়তো, নিরন্তর, আবহমান জীবনে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content