রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

কুরুপাণ্ডবকুমাররা এখন অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত।অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন যথোপযুক্ত নিষ্ঠায়।এবার গুরুদক্ষিণাদানের সময় আসন্ন। দক্ষিণাপ্রাপ্তির বিষয়ে কী কোন পরিকল্পনা কার্যকর করবার ইচ্ছা ছিল গুরুর মনে? এটি কী কোন পূর্বকল্পিত বিষয়? মহাভারতকার বলেছেন, পাণ্ডবান্ ধার্ত্তরাষ্ট্রাংশ্চ কৃতাস্ত্রান্ প্রসমীক্ষ্য সঃ। গুর্ব্বর্থদক্ষিণাকালে প্রাপ্তেঽমন্যত বৈ গুরুঃ।। পাণ্ডব ও ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা গুরু দ্রোণাচার্যের গভীর সমীক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। গুরুদক্ষিণাকালে অমন্যত বৈ গুরুঃ” তাঁর নিজের কী করণীয়?—চিন্তা করে কর্তব্যবিষয়ে এক ছক কষে ফেললেন। অমন্যত শব্দের টিকাকারকৃত অর্থ “কর্ত্তব্যং পর্যালোচয়ত”। দক্ষিণাদানবিষয়ে শিষ্যদের আহ্বান করে বললেন, পাঞ্চালরাজং দ্রুপদং গৃহীত্বা রণমূর্দ্ধনি। পর্য্যানয়ত ভদ্রং বঃ সা স্যাৎ পরমদক্ষিণা।। যুদ্ধে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে হরণ করে নিয়ে এসো। সেটিই হোক উত্তম গুরুদক্ষিণা। গুরুর আদেশের দায়বদ্ধতাপালনে টগবগ করে ফুটে উঠল রক্ত। কুমাররা রথ নিয়ে ছুটলেন গুরুর প্রার্থিত দক্ষিণার লক্ষ্যপূরণের অঙ্গীকারে।

কুরুপাণ্ডবদের দুপক্ষের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ সেটি যেন প্রভাবিত করল তাঁদের। প্রথমেই দুর্যোধন, বন্ধু কর্ণ, যুযুৎসু, দুঃশাসন, বিকর্ণ, জলসন্ধ এবং অন্যান্য শৌর্যশালী কুমারেরা অহং পূর্ব্বমহং পূর্ব্বমিতি আমি আগে,আমি আগে এমন ঘোষণা করে রথারূঢ় অবস্থায় অশ্বারোহী সৈন্যসহ পাঞ্চালরাজপথে উপস্থিত হলেন। দ্রুপদরাজার ভ্রাতারাও দমে যাবার পাত্র নন। তাঁরাও প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় রণহুঙ্কার দিলেন। শেষে যুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য, স্বয়ং রাজা দ্রুপদ বাণবর্ষণে প্রতিপক্ষের কৌরবদের জর্জরিত করে তুললেন। এ পর্যন্ত দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন পাণ্ডুপুত্ররা। অর্জুন গর্বোদ্ধত কুমারদের যুদ্ধ নিরীক্ষণ করে আচার্য দ্রোণকে জানালেন, এষাং পরাক্রমস্যান্তে বয়ং কুর্য্যাম সাহসম্। এতৈরশক্যঃ পাঞ্চাল্যো গ্রহীতুং রণমূর্দ্ধনি।। এদের শৌর্যের দৌড় আর কতদূর? এরপর আমাদের দুঃসাহসিকতা প্রকাশের সময়। কারণ এঁরা যুদ্ধে দ্রুপদরাজাকে ধরে আনতে অক্ষম।

পঞ্চপান্ডব, নগরের বাইরে অবস্থান করে যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন। চতুর্দিকে বিচরণরত রাজা দ্রুপদের শরজালে, বাণনিক্ষপে দ্রুততার নৈপুণ্যে, বিভ্রান্ত হলেন কৌরবসৈন্যরা। তিনি একাই যুদ্ধরত অবস্থায়, অঙ্গারচক্রের মতো ঘূর্ণায়মান গতিতে, প্রতিপক্ষের অজস্র সেনা এবং কুমারদের বিদ্ধ করতে থাকলেন। নগরবাসীরাও প্রতিরোধে সামিল হলেন। পুরবাসীরা, বালক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউই এই যুদ্ধ থেকে বাদ গেলেন না। তাঁরা মিলিতভাবে সম্মুখের কৌরবদের বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধে অংশ নিলেন, দূরবর্তী অপেক্ষমান পাণ্ডবদের প্রতি রণহুঙ্কারে আক্রোশ প্রকাশ করতে লাগলেন।
আহত কৌরবদের আর্তচিৎকারে বিচলিত হলেন পাণ্ডবগণ। যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে নিষেধ করে, অবশিষ্ট চারভাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। ভীমসেন, সর্বাগ্রে গদাহাতে ধাবমান হলেন। অর্জুন, রথের শব্দে, মুখর করে তুললেন রণভূমি। গদাধারী ভীম, যেন যমসদৃশ। তিনি গদাঘাতে হস্তী, অশ্ব, রথ সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করতে লাগলেন। গোপালকের ভূমিকায় যেন ভীমসেন। তিনি দণ্ডের মতো গদার আঘাতে পদাতিক ও রথীগণকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলেন। অর্জুনের তীব্র বাণাঘাতে বিধ্বস্ত হল দ্রুপদরাজার অশ্ব, রথ ও হস্তীসমূহ। অর্জুনের লক্ষ্য কিন্তু সেই স্থির,একমুখী—তিনি হলেন রাজা দ্রুপদ। অর্জুনের শরনিক্ষেপে কোন বিরতি নেই।

অর্জুনের এই অপূর্ব রণনিপুণতা প্রতিহত করতে ভাই সত্যজিতের সঙ্গে মিলিত হয়ে এগিয়ে এলেন রাজা দ্রুপদ। অর্জুনের শরাঘাতে সত্যজিতের অশ্ব, ধনু, মুষ্টি, পার্শ্বরক্ষক সারথি বিধ্বস্ত হল বারবার। হতোদ্যম সত্যজিৎ যুদ্ধবিমুখ হলেন। অর্জুনের সম্মুখে এখন শুধুমাত্র দ্রুপদ। তিনি দ্রুপদরাজার ধনুক, পতাকা ছিন্নভিন্ন করে, অশ্ব ও সারথিকে বাণবিদ্ধ করলেন। নির্ভীক অর্জুন, লাফ দিয়ে দ্রুপদরাজার রথে আরোহণ করে তাঁকে ধরে ফেললেন। দিশাহারা পাঞ্চালসৈন্যরা দশদিকে পলায়ন করল।বিজয়ী অর্জুনকে দেখে, কৌরবপক্ষীয় কুমাররা দ্রুপদরাজার রাজধানী তোলপাড় করে তুলল। অর্জুনের উদ্দশ্য সফল হয়েছে।রাজশ্রেষ্ঠ দ্রুপদের সঙ্গে কুরুবীরগণের আত্মীয়তার সম্বন্ধ রয়েছে, তাই আর সংহার নয়। এ বার গুরুদক্ষিণাদানের সময় উপস্থিত। কুমারগণ, গুরু দ্রোণাচার্যকে, সমন্ত্রী রাজা দ্রুপদকে, দক্ষিণারূপে দান করলেন। রাজা দ্রুপদের দর্প চূর্ণ হয়েছে। রিক্ত, নিঃস্ব, দ্রুপদ এখন শত্রুদের আয়ত্তাধীন।

হৃতসর্বস্ব দ্রুপদরাজাকে কৌরবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য বললেন, আমি তোমার রাষ্ট্র ধ্বংস করেছি, তোমার রাজধানীও শত্রুর অধীন, এমন কি প্রাণটুকুও শত্রুর কবলে। তাহলে এখন বন্ধুত্বের সূত্রে কী চাও? বিমৃদ্য তরসা রাষ্ট্রং পুরং তে মৃদিতং ময়া। প্রাপ্য জীবং রিপুবশং সখিপূর্ব্বং কিমিষ্যতে।। দ্রোণের ঠোঁটে যেন ব্যঙ্গের হাসি মা ভৈ প্রাণভয়াদ্বীর! ক্ষমিণো ব্রাহ্মণা বয়ম্ প্রাণের ভয় করও না, আমরা ব্রাহ্মণরা ক্ষমাশীল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩০: রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক, আনন্দের আবহে রাজা দশরথের দুঃস্বপ্ন, কোন অশুভ সংকেত?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী

শৈশবে গুরুর আশ্রমে দ্রুপদের সঙ্গে খেলাচ্ছলে স্নেহ ভালবাসার বন্ধন গড়ে উঠেছিল। সেই বাল্যস্মৃতি স্মরণে এনে আবারও সেই মিত্রতা কামনা করলেন দ্রোণাচার্য। তিনি উদারতায় মহান হয়ে বললেন, শুধু বন্ধুত্বের দাবি, আর কিছু নয়, আমার রাজ্যের অর্দ্ধাংশ গ্রহণ করো তুমি। রাজ্যস্যার্দ্ধমবাপ্নুহি রাজ্যহীন দ্রুপদকে, একদা দ্রোণের প্রতি তাঁর অবমাননাকর বৃত্তান্ত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, অরাজা কিল নো রাজ্ঞঃ সখা ভবিতুমর্হতি। অতঃ প্রযতিতং রাজ্যে! যজ্ঞসেন! ময়া তব।। অরাজার সঙ্গে রাজার বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। তাই হে, যজ্ঞসেন দ্রুপদ, আমি তোমায় আমার রাজ্যের অর্দ্ধাংশ দান করছি। তুমি হও—গঙ্গার দক্ষিণতীরের রাজা। আমি না হয় উত্তর তীরের অংশ গ্রহণ করি। হে পাঞ্চাল, যদি মনে করো, তবে আমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পার। রাজাসি দক্ষিণে কূলে ভাগীরথ্যামুত্তরে। সখায়ং মাং বিজানীহি পাঞ্চাল!যদি মন্যসে।। দ্রুপদ,দ্রোণের বন্ধুত্বের প্রস্তাব স্বীকার করে নিলেন। তিনি দীর্ঘ মিত্রতার প্রত্যাশী। দ্রোণাচার্য সন্তষ্টমনে রাজ্যার্দ্ধসহ সখাকে সাদরে মুক্তি দিলেন। বিষণ্ণ রাজা, দ্রুপদ, চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত, দক্ষিণ পাঞ্চালদেশে, রাজত্ব করতে লাগলেন। দ্রোণাচার্য অহিচ্ছত্রদেশের অধিকার লাভ করলেন।

এর মূলে ছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। এবং রাজন্নহিচ্ছত্রা পুরী জনপদাযুতা। যুধি নির্জিত্য পার্থেন দ্রোণায় প্রতিপাদিতা।। অর্জুন যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে অহিচ্ছত্রা নগরী দ্রোণাচার্যকে দান করলেন।সম্পন্ন হল কুরুপাণ্ডবকুমারদের গুরুদক্ষিণাদান পর্ব।

মুখে যাই বলুন রাজা দ্রুপদ সেই অবমাননা ভুলতে পারলেননা। মনে জ্বলতে থাকল অপমানিতের ধূমায়িত ক্ষোভ, প্রতিহিংসার আগুন। অসৎকারঃ স তু মহান্ মুহূর্ত্তকমপি তস্য তু। নাপৈতি হৃদয়াদ্রাজ্ঞো দুর্ম্মনাঃ স কৃশোঽভবৎ।। দ্রোণকৃত এই অপকারের ক্ষত এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেননা।বিষণ্ণ রাজা মনঃকষ্টে দিন দিন শীর্ণ হতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!

তাঁর মনের প্রতিশোধস্পৃহা পরিতৃপ্ত হতে পারে একমাত্র যজ্ঞাগ্নির প্রজ্জ্বলিত শিখায়। দ্রোণের অপকারের দরুণ, বুকফাটা দীর্ঘশ্বাসে বিদীর্ণ হতে লাগল দ্রুপদের হৃদয়। তাঁর উত্তম পুত্রের অভাব। নাস্তি শ্রেষ্ঠমপত্যং মে ইতি নিত্যমচিন্তয়ৎ। সেই কারণেই, প্রতিহিংসা চরিতার্থের হাতিয়ার, দ্রোণাচার্যের হত্যাকারী এক পুত্রের প্রয়োজন। দ্রুপদ রাজা, চিন্তা করলেন, বন্ধু দ্রোণের প্রভাব, প্রতিপত্তি, বিনয়, শিক্ষা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, তাঁর নিজের ক্ষত্রশক্তি দ্বারা পরাজিত করা অসম্ভব। যজ্ঞই একমাত্র সমাধান। তিনি যজ্ঞ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতেই হবে। দ্রোণহন্তাপুত্র বড়ই প্রয়োজন।

তিনি গঙ্গাযমুনার দুই তীরে ব্রাহ্মণবসতিতে উপযুক্ত যজ্ঞকর্ত্তা ব্রাহ্মণের অনুসন্ধানে তৎপর হলেন। তিনি এই কাজের উপযুক্ত যাজ ও উপযাজ নামে দুই ব্রাহ্মণভ্রাতার সন্ধান পেলেন। উপযাজের পদসেবা করে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন দশকোটি গোদান করবেন তিনি। উপযাজ, রাজার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। দ্রুপদ রাজা হাল ছাড়লেন না। নিরলস অধ্যবসায়ে, বৎসরকাল সেবাপরায়ণ হয়ে অবস্থান করলেন সেখানে। ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ উপযাজ দ্রুপদকে জানালেন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা যাজই, এই যাগের উপযুক্ত যাজক। কারণ তিনি লোভী।অরণ্যে অপবিত্রভূমিতে ফল কুড়িয়ে খান, গুরুগৃহে উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করেও তাঁর পরম তৃপ্তি,প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন তিনি। উপযাজের যুক্তিতে, যাজ ধনলোভী, সেই যাজ নিশ্চয়ই পুত্রার্থে যজ্ঞ করতে সম্মত হবেন। মনে অশ্রদ্ধা নিয়েও দ্রুপদ, কৃপাপ্রার্থী হয়ে বেদজ্ঞ যাজের দ্বারস্থ হলেন। অযুতানি দদাম্যষ্টৌ গবাং যাজয় মাং বিভো! দ্রোণবৈরাভিসন্তপ্তং প্রহ্লাদয়িতুমর্হসি।। আমি অসংখ্য গাভী দান করব। হে মহর্ষি, আপনি আমার হয়ে যজ্ঞ করুন। দ্রোণের শত্রুতায় আমার সন্তপ্তহৃদয়ে আপনিই আনন্দদানে সক্ষম। প্রতিপক্ষ, দ্রোণের গুণ বর্ণনা করে বললেন, বেদজ্ঞদের মধ্যে তিনি সর্বোত্তম, ব্রহ্মাস্ত্রপ্রয়োগে অদ্বিতীয়, তাই যুদ্ধে তিনি দ্রুপদকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। কৌরবদের অস্ত্রগুরু, বুদ্ধিমান, ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণতুল্য বীর যোদ্ধা, পৃথিবীতে বিরল। তিনি ব্রাহ্মতেজ দ্বারা ক্ষাত্রতেজ ধারণ করে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। দ্রোণ যেন বিধাতাসৃষ্ট ক্ষত্রিয়সংহারক। দ্রোণের অস্ত্রবল অতি ভয়ানক। তিনি অপ্রতিরোধ্য, অজেয়।

দ্রুপদরাজ যাজকে তুষ্ট করে বললেন, বিধাতাসৃষ্ট দুইটি তেজ, ব্রাহ্ম ও ক্ষাত্রতেজের মধ্যে, তিনি নিজে, ক্ষাত্রতেজের আধার হয়েও, ত্রাসবশত বিশিষ্ট ব্রাহ্মতেজের শরণাপন্ন হয়েছেন। রাজা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদ্বারা যজ্ঞে অপ্রতিহত, দুর্জয়, দ্রোণহন্তা পুত্র কামনা করেন। দক্ষিণার প্রস্তাবে, লুব্ধ যাজ, সম্মত হলেন। রাজাকে আশ্বস্ত করলেন তিনি, স চ পুত্রো মহাবীর্য্যো মহাতেজা মহাবলঃ।ইষ্যতে যদ্বিধো রাজন্!ভবিতা তে তথাবিধঃ।।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

মহাশৌর্যশালী,মহাতেজা পুত্র, যেমন তোমার অভীপ্সিত, তেমনই পুত্রলাভ করবে তুমি। যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল। দ্রুপদমহিষীকে আহ্বান জানালেন যাজ। রানি পৃষতি,আপনি শীঘ্র আসুন, উপস্থিত দুই সন্তানকে গ্রহণ করুন। প্রৈহি মাং রাজ্ঞি! পৃষতি! মিথুনং ত্বামুপস্থিতম্। রানি তখন প্রস্তুত নন। তিনি মুখ প্রক্ষালন করেননি, স্নানের দ্বারা শুচি হননি, তাঁর অঙ্গে তেলের সৌরভ। এমন অবস্থায় পবিত্র যজ্ঞে লব্ধ প্রিয় পুত্রকে গ্রহণ করবেন কীভাবে? হে যাজক, যাজ,আপনি অপেক্ষা করুন। সুতার্থে নোপলব্ধাস্মি তিষ্ঠ যাজ!মম প্রিয়ে। যাজ অপেক্ষা করতে সম্মত নন। উপায় নেই তাঁর। তিনি যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি প্রদান করছেন, মন্ত্রপাঠরত উপযাজ, এই পরিস্থিতিতে রানি, আপনার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি যাই হোক না কেন, যজ্ঞের অভীষ্ট ফললাভ হবেই।

এই ঘোষণা করে যজ্ঞে আহুতি প্রদান করলেন যাজ। মুহূর্তে যজ্ঞাগ্নি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবপ্রতিম, অগ্নিবরণ, ভীষণাকৃতি, মুকুট ও বর্মে ভূষিত তরবারি ও বাণসহ ধনুর্ধারী এক কুমার। পাঞ্চালগণ সাধু সাধু বলে জয়ধ্বনি করে উঠলেন। তৎক্ষণাৎ শূন্যে ধ্বনিত হল ভবিষ্যদ্বাণী, রাজ্ঞঃ শোকাপহো জাত এষ দ্রোণবধায় বৈ রাজার শোক দূরীভূত করবেন দ্রোণহন্তা এই জাতক। এই যশস্বী রাজপুত্রের কারণে পাঞ্চালদের ভয়ের দিন অপগতপ্রায়। ভয়াপহো রাজপুত্রঃ পাঞ্চালানাং যশস্করঃ।

এরপরে যজ্ঞবেদী থেকে উদ্ভূত হলেন কান্তিময়ী, সুশ্রী, সুনয়নী, শ্যামা, দীর্ঘাঙ্গিনী, কুঞ্চিতকুন্তলা, তাম্র উন্নত নখবিশিষ্টা, সুভ্রূ, সুন্দর সুগঠিত স্তনদ্বয় তার, একক্রোশ দূরেও তার দেহের সুগন্ধ বিস্তৃত, মূর্তিমতী দেবপ্রতিমাসদৃশ এক কন্যা। দৈববাণী হল—সর্ব্বযোষিদ্বরা কৃষ্ণা নিনীয়ুঃ ক্ষত্রিয়ান্ ক্ষয়ম্। রমণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা ক্ষত্রিয়দের ধ্বংসের কারণ। এর কারণে কৌরবদের মহাভয় উপস্থিত। এ যথাকালে দেবকার্য সম্পন্ন করবে। সুরকার্য্যমিয়ং কালে করিষ্যতি সুমধ্যমা। অস্যা হেতোঃ কৌরবাণাং মহদুৎপৎস্যতে ভয়ম্। প্রভূত আনন্দে সিংহনিনাদ করে উঠলেন পাঞ্চালগণ। দ্রুপদ রাজমহিষী, সন্তানদুটিকে, পুত্র ও কন্যারূপে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী হলেন। ব্রাহ্মণগণ দ্রুপদসন্তানদ্বয়ের নামকরণ করলেন। ধৃষ্টত্বাদতিধৃষ্টাচ্চ ধর্ম্মাদ্ দ্যুম্নতরাদপি। ধৃষ্টদ্যুম্নঃ কুমারোঽয়ং দ্রুপদস্য ভবত্বিতি।। ধৃষ্ট অর্থাৎ প্রগল্ভ সেইসঙ্গে দ্যুম্ন অর্থাৎ বহুমূল্য ক্ষত্রিয়বিত্ত, কবচকুণ্ডলসহ পুত্রটির আবির্ভাব এবং এগুলির উৎস, শৌর্য, উৎসাহ প্রতিপত্তিহেতু কুমারের নাম হোক ধৃষ্টদ্যুম্ন।

গাত্রবর্ণ শ্যাম। তাই শ্যামাঙ্গী কন্যাটির নাম হোক কৃষ্ণা। তাঁর শেষ অনিবার্য পরিণতি মৃত্যু সেই দ্রুপদপুত্রের হাতে, তা জেনেও মহান অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, পাঞ্চালরাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিজগৃহে আশ্রয় দিয়ে অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত করে উপকার সাধন করলেন। কারণ, অমোক্ষণীয়ং দৈবং হি ভাবি মত্বা মহামতিঃ। তথা তৎ কৃতবান্ দ্রোণ আত্মকীর্ত্ত্যনুরক্ষণাৎ।। দৈবের বিধান অমোঘ, অনিবার্য কিন্তু নিজের কীর্তিরক্ষায় দ্রোণাচার্য এই কাজটি করলেন। কীর্তি অক্ষয়।তাই নিজের হত্যাকারী জেনেও তাঁর অস্ত্রশিক্ষার ভার গ্রহণ করলেন মহাভারতের বিখ্যাত অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহাভারতে শিষ্যদের গুরুদক্ষিণাপ্রদানে আছে এক মহান দিকদর্শন। অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছিলেন শিষ্যদের দক্ষিণাদানকে উপলক্ষ্য করে।অনুগত শিষ্যরা হয়েছিলেন তাঁর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার হাতিয়ার।ব্যবহৃত হয়েছিলেন কৌরবকুমারেরা। একজন বিখ্যাত গুরুর শিক্ষাপ্রদানের আদর্শে, থাকে সুনীতিবোধের প্রতিফলন। বন্ধু দ্রুপদের প্রতি তাঁর প্রতিশোধস্পৃহায় ছিল ঘৃণার প্রকাশ, বিদ্বেষের বিষবাষ্প ধূমায়িত ছিল সেখানে। একজন রাজাকে, শিষ্যদের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দী হিসেবে উপস্থাপনার মধ্যে, আর যা থাক, গৌরববোধ নেই বোধ হয়। অর্থকষ্ট, দারিদ্র্য, মনোকষ্ট দ্রোণকে অধঃপতিত করেছিল হয়তো। বন্ধুত্বে যদি প্রত্যাশাবোধ থাকে তাহলে বোধ হয় তা ভঙ্গুর হয়, টেকসই হয় না তা।দরিদ্র দ্রোণ একদা বন্ধুত্বের কথা মনে রেখে রাজা দ্রুপদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দ্রুপদ রাজা, নিঃসন্দেহে, রূঢ়ভাষায়, তাঁকে চরম অপমান করেছিলেন যেটি হয়তো অকল্পনীয় ছিল দ্রোণের। তিনি যদি দ্রুপদের সঙ্গে বাগ্ যুদ্ধে রত হতেন সেটি বরং ভাল হোত হয়তো। তিনি অপমানের প্রত্যুত্তরে একটি কথাও বলেননি। চাপা আক্রোশ বুকে নিয়ে সুযোগসন্ধানী ক্রুর ব্রাহ্মণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

হস্তিনাপুরে অস্ত্রগুরুর মর্যাদা লাভ করে তাঁর আর্থিক দৈনদশা দূর হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মনের দীনতা থেকে, হীনমন্যতাবোধ থেকে, মুক্ত হতে পারেননি। তিনি বন্ধুর রাজ্য কেড়ে নিয়ে ঔদার্য দেখিয়েছেন রাজ্যের অর্দ্ধাংশ দান করে। এই রাজ্যদান কিন্তু কোনই সদর্থক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি বন্ধুর মনে।তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা এক সুদূরপ্রসারী শত্রুতার জন্ম দিয়েছে। প্রতিহিংসার আগুন থেকে জন্ম নিয়েছে তাঁর হত্যাকারী দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। কৌরবকুমারদের পাঞ্চালদের সঙ্গে বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।

দ্রোণাচার্যের প্ররোচনায় কুরুপাণ্ডবরা আত্মক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছেন।এর ফলশ্রুতি হল, দ্রুপদকৃত যজ্ঞে কুরুকূলের ধ্বংসের কারণরূপে কৃষ্ণার উত্থান। একটি প্রতিশোধ— অনেক ঘৃণা, অপরিসীম বিদ্বেষের জন্ম দেয়, যা সার্বিক মানবতাবিরোধী।একজন শিক্ষাগুরুর কাছে, এ বিষয়ে সচেতনতা, আশাতীত কোন প্রত্যাশা নয়। এটি বোধ হয় আধুনিকযুগেও, মহাভারতের বিখ্যাত গুরুর আচরণ থেকে এক চরম শিক্ষণীয় বিষয়। দ্রোণাচার্য মহানুভবতা দেখিয়েছেন। বন্ধুকে রাজ্যার্দ্ধ দান করেছেন। যুদ্ধবন্দীকে রাজোচিত সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে মানসিক প্রত্যাঘাত করেছেন তাঁকে। একদা বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে দ্রুপদের কাছে হাজির হয়েছিলেন দ্রোণ।তখন দ্রুপদ বলেছিলেন, নারাজা পার্থিবস্যাপি সখিপূর্ব্বং কিমিষ্যতে। অরাজা রাজার বন্ধু হয় না। যা হোক, বন্ধুত্বের জন্যে কী চাইছেন এখন? এই মর্মভেদী কথা তিলতিল করে মনের গভীরে পুষে রেখেছেন। যথাসময়ে প্রত্যাঘাতে, বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন দ্রুপদকে। একজন ব্রাহ্মণ শিক্ষাগুরুর আচরণ থেকে শিষ্যরা কী চয়ন করলেন। জীবনের অসংখ্য ঘাতপ্রতিঘাতে ক্ষত্রিয় রাজাদের জীবন বিক্ষুব্ধ থাকে সতত। তাঁর মধ্যে গুরুর আচরণ আরও একটি হিংস্রমাত্রা যোগ করল। হত্যাকারীকে প্রশিক্ষণদানে উপযুক্ত অস্ত্রবিদ করে তুলেছেন দ্রোণাচার্য। তার দ্বারা মৃত্যুর অনিবার্য পরিণতি জেনেও অক্ষয় কীর্তিলাভের কামনায় মহত্ত্বের গৌরববোধ ছিল তাঁর। এটিও কী সেই স্বার্থরক্ষার ফলশ্রুতি? মান্যবর হস্তিনাপুরের অস্ত্রগুরু হয়তো এ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।

এই দক্ষিণার রকমফের দেখা যায় দ্রোণাচার্যের একনিষ্ঠ ভক্ত একলব্যের কাছে দক্ষিণাপ্রার্থনায়। সেখানেও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যায় অস্ত্রগুরুর আচরণে। রাষ্ট্রশক্তির সহায়হীন নিষাদপুত্রের যোদ্ধাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে আচার্য দ্রোণের প্রত্যাশিত দক্ষিণহাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠদানের গুরুদক্ষিণায়। দক্ষিণার মহত্ত্ব অপার। মোটা দক্ষিণার আকাঙ্খায় লুব্ধ ব্রাহ্মণ যাজ, ব্রাহ্মণের মতাদর্শের পরিপন্থী, প্রতিহিংসার যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় আরও একজন হিংস্র মানুষের আবির্ভাব হয়েছে এই বিদ্বেষবিষে জর্জরিত ধরায়।মহাভারতের কাহিনিতে, চরিত্রগুলিতে, ঘটনার পরতে পরতে জীবনবোধের চোরাস্রোত, অনাবিষ্কৃত তাত্ত্বিক গভীরতা যা লুকিয়ে রয়েছে সেগুলি হয়তো বহু প্রজন্মের ভাবি জীবনের নানা দিকদর্শন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content