ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
অযোধ্যা, প্রয়াত রাজা দশরথের শোকে মুহ্যমান। রাজার অবর্তমানে রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিষয়ে চিন্তিত মন্ত্রীবর্গ। পুরুষানুক্রমে, রাজতন্ত্রে, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম। তিনি বনবাসী। সঙ্গে রয়েছেন ছায়াসঙ্গী অনুজ লক্ষ্মণ। অন্য দুই পুত্র, ভরত ও শত্রুঘ্ন মাতামহের আলয় কেকয়রাজ্যে অবস্থান করছেন। রাজাবিহীন রাজ্য যে অস্তিত্বহীন। অমাত্যদের অনুরোধক্রমে মহর্ষি বশিষ্ঠ অবিলম্বে কুমারদের বার্তা প্রেরণের আদেশ দিলেন। প্রথমেই কোন অশুভ সংবাদ নয়। রামের বনবাস ও তার নেপথ্য কাহিনি নয়, নয় পিতার মৃত্যুসংবাদ প্রদান। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে দূতেরা যে রাতে কেকয়রাজ্যে উপস্থিত হলেন সেই রাতেই কুমার ভরত এক নিদারুণ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। পিতার মৃত্যুর অশুভ সঙ্কেত ছিল সেই স্বপ্নে। সখাদের কাছে স্বপ্নের বৃত্তান্ত সবিস্তারে বর্ণনা করে ভীত, শঙ্কিত, ভরত বললেন—ইমাঞ্চ দুঃস্বপ্নগতিং নিশম্য হি ত্বনেকরূপামবিতর্কিতাং পুরা। ভয়ং মহৎ তদ্ধৃদয়ান্ন যাতি মে বিচিন্ত্য রাজানমচিন্ত্যদর্শনম্। সেই স্বপ্নটি ছিল চিন্তার অতীত, কিন্তু স্বপ্নটির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে রাজার বিষয়ে যে ভয় মনে উদিত হয়েছে সেই ভয় কিছুতেই দূর হচ্ছে না।
ঠিক সেই সময়ে সুদূর অযোধ্যা থেকে পথশ্রমে ক্লান্ত বাহনসহ দূতেরা দুর্লঙ্ঘ পরিখা পার হয়ে রাজভবনে প্রবেশ করলেন। রাজপুত্র তাঁদের স্বাগত জানালেন। কেকয়রাজকে বিধিমত পাদবন্দনা করে তাঁরা ভরতকে রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ ও মন্ত্রীদের প্রেরিত কুশলবার্তা নিবেদন করলেন। পরিশেষে বললেন— ত্বরমাণশ্চ নির্যাহি কৃত্যমাত্যয়িকং ত্বয়া। আপনি সত্বর চলুন, কালবিলম্ব করা যাবে না এমন, আবশ্যিক কর্ত্তব্য, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। দূতেরা সঙ্গে এনেছেন ভরতের মাতামহ ও মাতুলের জন্যে বিশকোটি বহুমূল্য বসন ভূষণ।
ঠিক সেই সময়ে সুদূর অযোধ্যা থেকে পথশ্রমে ক্লান্ত বাহনসহ দূতেরা দুর্লঙ্ঘ পরিখা পার হয়ে রাজভবনে প্রবেশ করলেন। রাজপুত্র তাঁদের স্বাগত জানালেন। কেকয়রাজকে বিধিমত পাদবন্দনা করে তাঁরা ভরতকে রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ ও মন্ত্রীদের প্রেরিত কুশলবার্তা নিবেদন করলেন। পরিশেষে বললেন— ত্বরমাণশ্চ নির্যাহি কৃত্যমাত্যয়িকং ত্বয়া। আপনি সত্বর চলুন, কালবিলম্ব করা যাবে না এমন, আবশ্যিক কর্ত্তব্য, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। দূতেরা সঙ্গে এনেছেন ভরতের মাতামহ ও মাতুলের জন্যে বিশকোটি বহুমূল্য বসন ভূষণ।
এ ছাড়াও শুভাকাঙ্খীদের প্রতি অনুরক্ত ভরতের, যথেচ্ছ বিতরণের জন্যে দশকোটি বস্ত্র ও অলঙ্কার। ভরত সবকিছু গ্রহণ করে, দূতদের পারিতোষিক দান করলেন। তারপরে পিতার কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। রামও লক্ষ্মণ সুস্থ আছেন তো? কচ্চিৎ স কুশলী রাজা পিতা দশরথো মম। কচ্চিদারোগ্যতা রামে লক্ষ্মণে চ মহাত্মনি।। পূজ্যা ধর্মাচরণে নিরতা, ধর্মজ্ঞা, ধর্মবাদিনী, বুদ্ধিমান রামের জননী, দেবী কৌশল্যা ভালো আছেন তো? লক্ষ্মণমাতা ধর্মজ্ঞা সুমিত্রা দেবী যিনি বীর শত্রুঘ্নরও জননী তিনি নীরোগদেহে আছেন তো? সতত স্বার্থান্বেষী, সর্বদাই উগ্রমূর্ত্তি, ক্রোধের বশবর্ত্তিনী, প্রাজ্ঞমানিনী আমার মা কৈকেয়ী কী ভালো আছেন? দূতরা জানালেন, সকলেই কুশলে আছেন। পদ্মাসনা রাজলক্ষ্মী আপনাকে বরণ করেছেন, আপনি রথ প্রস্তুত করতে আদেশ দিন। শ্রীশ্চ ত্বাং বৃণুতে পদ্মা যুজ্যতাঞ্চাপি তে রথঃ। ভরত মাতামহকে দূতদের আগমনের উদ্দশ্য জানিয়ে তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাজন্ পিতুর্গমিষ্যামি সকাশং দূতচোদিতঃ। পুনরপ্যহমেষ্যামি যদা মে ত্বং স্মরিষ্যতি।। হে রাজন, দূতদের বার্তানুযায়ী পিতার কাছে অযোধ্যায় যাব। যখনই স্মরণ করবেন, আমি তখনই আবার আসব।
কেকয়রাজ পৌত্রকে অনুমতি দিলেন, গচ্ছ তাতানুজানে ত্বাং কৈকেয়ী সুপ্রজাস্ত্বয়া। আমি সম্মতি দিলাম, বাছা, তুমি যাও, কৈকেয়ী তোমার জন্যেই সুপুত্রের জননী হয়েছেন। মাতা, পিতা, পুরোহিত বশিষ্ঠ, মাননীয় দ্বিজবর এবং ভরতের মহাধনুর্দ্ধর ভাইদের তাঁর কুশলসমাচার জানাতে বললেন। কেকয়রাজ ভরতকে, অসংখ্য উত্তম হাতি, বিচিত্র কম্বলসমূহ, বহু মৃগচর্ম উপহার দিলেন। অন্তঃপুরে বেড়ে ওঠা, বীর্য ও বলশালিত্বে বাঘের তুল্য করাল দাঁতবিশিষ্ট বিশালাকার কুকুর, দুই হাজার নিষ্ক, ষোল শত ঘোড়া উপহার দিলেন। কেকয়রাজা অশ্বপতির আদেশানুসারে, কয়েকজন বিশ্বস্ত গুণী অমাত্য ভরতের সঙ্গী হলেন।
কেকয়রাজ পৌত্রকে অনুমতি দিলেন, গচ্ছ তাতানুজানে ত্বাং কৈকেয়ী সুপ্রজাস্ত্বয়া। আমি সম্মতি দিলাম, বাছা, তুমি যাও, কৈকেয়ী তোমার জন্যেই সুপুত্রের জননী হয়েছেন। মাতা, পিতা, পুরোহিত বশিষ্ঠ, মাননীয় দ্বিজবর এবং ভরতের মহাধনুর্দ্ধর ভাইদের তাঁর কুশলসমাচার জানাতে বললেন। কেকয়রাজ ভরতকে, অসংখ্য উত্তম হাতি, বিচিত্র কম্বলসমূহ, বহু মৃগচর্ম উপহার দিলেন। অন্তঃপুরে বেড়ে ওঠা, বীর্য ও বলশালিত্বে বাঘের তুল্য করাল দাঁতবিশিষ্ট বিশালাকার কুকুর, দুই হাজার নিষ্ক, ষোল শত ঘোড়া উপহার দিলেন। কেকয়রাজা অশ্বপতির আদেশানুসারে, কয়েকজন বিশ্বস্ত গুণী অমাত্য ভরতের সঙ্গী হলেন।
আরও পড়ুন:
বিচিত্রের বৈচিত্র, গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২: লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
ভরতের মাতুল, প্রদান করলেন, ইন্দ্রশিরাদেশজাত, ঐরাবতসদৃশ দৃষ্টিনন্দন অনেক হাতি ও বহু দ্রুতগামী গাধা। কৈকেয়ীপুত্র ভরত, যাবার তাড়া থাকায়, এত সব উপহার সানন্দে গ্রহণ করতে পারলেন না। ভরতের মন ভারাক্রান্ত, কারণ হল, গতরাত্রির দুঃস্বপ্ন ও দূতদের দ্রুত ফিরে যাবার ব্যস্ততা। তিনি, নিজের বাসস্থান অতিক্রম করে মানুষজন, হাতি, ঘোড়া সমাকীর্ণ প্রশস্ত, সুন্দর অনুত্তম রাজপথে উপনীত হলেন। তারপরে তাঁর চোখে পড়ল সুশোভিত রাজান্তঃপুর। অবাধে সেখানে প্রবেশ করলেন তিনি। মাতামহ কেকয়রাজ অশ্বপতি ও মাতুল যুধাজিতের সম্মতিক্রমে, শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়ে, রথে আরোহণ করে, যাত্রা করলেন। ভরতকে অনুসরণ করল, বৃহদাকার চক্রযুক্ত একশত রথ ও উট, গাভী ও অশ্বারোহী সেবকবৃন্দ। মহান ভরতের সঙ্গ নিলেন তাঁর সুরক্ষার কাজে দায়িত্বশীল সৈন্যরা ও রাজা অশ্বপতির প্রাণপ্রতিম অমাত্যগণ। অজাতশত্রু ভরত, শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়ে, ইন্দ্রলোকচ্যুত সিদ্ধপুরুষের মতো মাতামহভবন থেকে যাত্রা করলেন।
রাঘব ভরত, পূর্বদিকে অযোধ্যাভিমুখে যাত্রা করলেন। যথাক্রমে সুদামা নদী ও পশ্চিমবাহিনী বিশাল ব্যাপ্তিবিশিষ্টা ঊর্মিবিক্ষুব্ধ হ্রাদিনী নদী ও শতদ্রু নদী অতিক্রম করে ঐলধান নামক গ্রামের নিকটবর্তী নদী পার হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে উপস্থিত হলেন। উত্তাল পার্বত্য নদীর তরঙ্গভঙ্গ পার হয়ে শিলাবহা নদীকে সামনে দেখে চিত্ররথ বন হল তাঁর গন্তব্য। কুমার ভরত বিশাল পর্বতগুলি অতিক্রম করে গঙ্গা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে পৌঁছলেন। অবশেষে ভারুণ্ড নামের বনে প্রবেশ করলেন। এরপরে পথে,বেগে বয়ে চলা, মনোরম কুলিঙ্গা নামে পার্বত্য নদী পার হয়ে যমুনার নিকটবর্তী হলেন। তিনি সৈন্যদের আশ্বস্ত করলেন। শ্রান্ত ঘোড়াদের অঙ্গ মর্দন করা হল। স্নান করে ও পিপাসা নিবৃত্তির পরে আবার যাত্রা শুরু হল। অংশু নামের নিকটবর্তী দুস্তর গঙ্গা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। তাই, প্রসিদ্ধ প্রাগ্বট নগরে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে, কুটিকোষ্টিকা নদী পার হয়ে যথাক্রমে ধর্মবর্দ্ধন, তোরণ, জম্বুপ্রস্থ নামের গ্রাম পার হয়ে, বরুথ নামক গ্রামের মনোরম বনে রাত্রি যাপন করলেন। পূবদিকে প্রিয়ক গাছের বিস্তীর্ণ বন। যেখানে সেই উজ্জিহানা নগরীর কাছে এসে, রথে দ্রুতগামী ঘোড়া, যুক্ত করতে আদেশ দিলেন। সর্বতীর্থ গ্রামে রাত্রিবাসান্তে উত্তরবাহিনী পার্বত্য নদীগুলি অতিক্রম করে এগিয়ে গেলেন।
রাঘব ভরত, পূর্বদিকে অযোধ্যাভিমুখে যাত্রা করলেন। যথাক্রমে সুদামা নদী ও পশ্চিমবাহিনী বিশাল ব্যাপ্তিবিশিষ্টা ঊর্মিবিক্ষুব্ধ হ্রাদিনী নদী ও শতদ্রু নদী অতিক্রম করে ঐলধান নামক গ্রামের নিকটবর্তী নদী পার হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে উপস্থিত হলেন। উত্তাল পার্বত্য নদীর তরঙ্গভঙ্গ পার হয়ে শিলাবহা নদীকে সামনে দেখে চিত্ররথ বন হল তাঁর গন্তব্য। কুমার ভরত বিশাল পর্বতগুলি অতিক্রম করে গঙ্গা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে পৌঁছলেন। অবশেষে ভারুণ্ড নামের বনে প্রবেশ করলেন। এরপরে পথে,বেগে বয়ে চলা, মনোরম কুলিঙ্গা নামে পার্বত্য নদী পার হয়ে যমুনার নিকটবর্তী হলেন। তিনি সৈন্যদের আশ্বস্ত করলেন। শ্রান্ত ঘোড়াদের অঙ্গ মর্দন করা হল। স্নান করে ও পিপাসা নিবৃত্তির পরে আবার যাত্রা শুরু হল। অংশু নামের নিকটবর্তী দুস্তর গঙ্গা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। তাই, প্রসিদ্ধ প্রাগ্বট নগরে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে, কুটিকোষ্টিকা নদী পার হয়ে যথাক্রমে ধর্মবর্দ্ধন, তোরণ, জম্বুপ্রস্থ নামের গ্রাম পার হয়ে, বরুথ নামক গ্রামের মনোরম বনে রাত্রি যাপন করলেন। পূবদিকে প্রিয়ক গাছের বিস্তীর্ণ বন। যেখানে সেই উজ্জিহানা নগরীর কাছে এসে, রথে দ্রুতগামী ঘোড়া, যুক্ত করতে আদেশ দিলেন। সর্বতীর্থ গ্রামে রাত্রিবাসান্তে উত্তরবাহিনী পার্বত্য নদীগুলি অতিক্রম করে এগিয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৫: সাফল্য কি বংশগত উত্তরাধিকার? না কি ব্যক্তিগত কৃতিত্বের প্রমাণ?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৮: লক্ষ্মীস্বরূপিনী মা সারদা
এ বার ভরতের বাহন হল হাতি। হাতির পিঠে চড়ে হস্তক্ষেপ গ্রামে কুটিকা নদী ও লৌহিত্য গ্রামে কপীবতী নদী পার হলেন। একসাল গ্রামের নিকটবর্তী স্থানুবতী নদী, অতিক্রম করে সামনে বিনত গ্রাম। সেখানে কাছেই বয়ে চলেছে গোমতী নদী। তারপরেই আছে কলিঙ্গ নগর। ক্লান্ত বাহনগুলি নিয়ে দ্রুত সালবনের মধ্যবর্তী পথ ধরে দ্রুত এগিয়ে গেলেন তাঁরা। ক্রমে রাত্রি ভোর হল। অঅবশেষে সম্মুখে দৃশ্যমান হল অযোধ্যা নগরী।
কেকয়রাজ্য হতে অযোধ্যা,সাত রাতের পথ। আটদিনে ভরত অযোধ্যা পৌঁছলেন। নগরীর নিকটবর্ত্তী হয়েও অযোধ্যায় প্রবেশ করলেন না। সারথিকে তাঁর বিচিত্র অনুভূতির কথা জানালেন। ভরতের মনে হল, পুণ্য উদ্যানের কারণে যে নগরীর খ্যাতি সেই অযোধ্যানগরী যেন আর সেই রকম নেই। ভরতের অনুভব,দূর হতে দৃশ্যমানা পাণ্ডরমৃত্তিকাবিশিষ্টা অযোধ্যা, যেখানে যাজ্ঞিক, গুণবান, বেদজ্ঞ,সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের অধিষ্ঠান অনেক বেশি, শ্রেষ্ঠ রাজা যে নগরীর পালক, নরনারীদের কোলাহলমুখর অযোধ্যা এখন শব্দহীন।
একদা নরনারীর ক্রীড়াভূমি উদ্যানগুলি, সন্ধ্যায় পরিত্যক্ত হয়ে, যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে। আমোদপ্রিয়দের অভাবে উদ্যানগুলি যেন কাঁদছে। সারথিকে নিজের বিরূপ অভিজ্ঞতা জ্ঞাপন করছেন দশরথপুত্র ভরত। হে সারথি, রাজপুরী নয় এ যে অরণ্যভূমির দৃশ্য। এখানে নেই যান, নেই হাতি, নেই ঘোড়া। সেই আগের মতো ওই সব যানে, আরোহী পুরপ্রধানেরা যাতায়াত করতেন, তাঁদের দেখা যাচ্ছে না। অরণ্যভূতেব পুরী সারথে প্রতিভাতি মাম্। ন হ্যত্র যানৈর্দৃশ্যন্তে ন গজৈর্ন চ বাজিভিঃ। নির্যান্তো বাভিযান্তো বা পুরমুখ্যা যথা পুরা।। অতীতে অযোধ্যার উদ্যানগুলি সাধারণ বিলাসীদের প্রমোদোদ্যান হয়ে আমোদ প্রমোদের কেন্দ্র ছিল, এখন সেগুলির নিষ্প্রভ নিরানন্দময় শোভা। গাছেরা পাতা ঝরিয়ে বিলাপরত। আনন্দে মত্ত, পশু পাখিদের মধুর রব শোনা যায় না আর। অতীতে চন্দন ও অগরুর সুবাসে সুরভিত বাতাস আর বইছে না। ভেরী, মৃদঙ্গধ্বনি ও বীণার ছড়ে যে সুমধুর ধ্বনি উত্থিত হত,সেই ধ্বনি আজ কোথায়? রাজপুত্র ভরত বিষণ্ণ মনে বললেন— অনিষ্টানি চ পাপানি পশ্যামি বিবিধানি চ। নিমিত্তান্যমনোজ্ঞানি তেন সীদতি মে মনঃ। এমন সব অনভিপ্রেত, অশুভ, পাপ দর্শন করে মনে হচ্ছে এগুলি সবই দুর্লক্ষণ। তাই আমি অবসন্ন বোধ করছি। কুমার ভরতের মনে হল, বন্ধুজনের কুশলসংবাদ তিনি পাবেন না। অন্তর মোহগ্রস্ত নয় অথচ তাঁর মন যেন অবসাদগ্রস্ত। তথা হ্যসতি সম্মোহে হৃদয়ং সীদতীব।
যাঁর বাহনগুলি পর্যন্ত শ্রান্ত, বিষাদাচ্ছন্ন, শিথিলেন্দ্রিয়, সশঙ্কিত মনে, ভরত, ইক্ষ্বাকুরাজাদের লালিত অযোধ্যা নগরীতে প্রবেশ করলেন। বৈজয়ন্ত নামের দরজা দিয়ে প্রবেশোন্মুখ শ্রান্তবাহন ভরতের উদ্দেশ্যে, দ্বারিরা, উঠে দাঁড়িয়ে, জয়ধ্বনি করে উঠল। তাঁদের সঙ্গে এগিয়ে চললেন ভরত। দ্বাররক্ষকদের অভ্যর্থনার সৌজন্যমূলক প্রত্যুত্তর দিয়ে উদ্বিগ্ন ভরত, মাতামহ অশ্বপতির ক্লান্ত সারথিকে প্রশ্ন করলেন, অকারণে কেন এত ব্যস্ত হয়ে আমাকে আনা হল, অশুভ কোনও আশঙ্কায়,আমার মন প্রাণ সুস্থির নেই।
কেকয়রাজ্য হতে অযোধ্যা,সাত রাতের পথ। আটদিনে ভরত অযোধ্যা পৌঁছলেন। নগরীর নিকটবর্ত্তী হয়েও অযোধ্যায় প্রবেশ করলেন না। সারথিকে তাঁর বিচিত্র অনুভূতির কথা জানালেন। ভরতের মনে হল, পুণ্য উদ্যানের কারণে যে নগরীর খ্যাতি সেই অযোধ্যানগরী যেন আর সেই রকম নেই। ভরতের অনুভব,দূর হতে দৃশ্যমানা পাণ্ডরমৃত্তিকাবিশিষ্টা অযোধ্যা, যেখানে যাজ্ঞিক, গুণবান, বেদজ্ঞ,সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের অধিষ্ঠান অনেক বেশি, শ্রেষ্ঠ রাজা যে নগরীর পালক, নরনারীদের কোলাহলমুখর অযোধ্যা এখন শব্দহীন।
একদা নরনারীর ক্রীড়াভূমি উদ্যানগুলি, সন্ধ্যায় পরিত্যক্ত হয়ে, যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে। আমোদপ্রিয়দের অভাবে উদ্যানগুলি যেন কাঁদছে। সারথিকে নিজের বিরূপ অভিজ্ঞতা জ্ঞাপন করছেন দশরথপুত্র ভরত। হে সারথি, রাজপুরী নয় এ যে অরণ্যভূমির দৃশ্য। এখানে নেই যান, নেই হাতি, নেই ঘোড়া। সেই আগের মতো ওই সব যানে, আরোহী পুরপ্রধানেরা যাতায়াত করতেন, তাঁদের দেখা যাচ্ছে না। অরণ্যভূতেব পুরী সারথে প্রতিভাতি মাম্। ন হ্যত্র যানৈর্দৃশ্যন্তে ন গজৈর্ন চ বাজিভিঃ। নির্যান্তো বাভিযান্তো বা পুরমুখ্যা যথা পুরা।। অতীতে অযোধ্যার উদ্যানগুলি সাধারণ বিলাসীদের প্রমোদোদ্যান হয়ে আমোদ প্রমোদের কেন্দ্র ছিল, এখন সেগুলির নিষ্প্রভ নিরানন্দময় শোভা। গাছেরা পাতা ঝরিয়ে বিলাপরত। আনন্দে মত্ত, পশু পাখিদের মধুর রব শোনা যায় না আর। অতীতে চন্দন ও অগরুর সুবাসে সুরভিত বাতাস আর বইছে না। ভেরী, মৃদঙ্গধ্বনি ও বীণার ছড়ে যে সুমধুর ধ্বনি উত্থিত হত,সেই ধ্বনি আজ কোথায়? রাজপুত্র ভরত বিষণ্ণ মনে বললেন— অনিষ্টানি চ পাপানি পশ্যামি বিবিধানি চ। নিমিত্তান্যমনোজ্ঞানি তেন সীদতি মে মনঃ। এমন সব অনভিপ্রেত, অশুভ, পাপ দর্শন করে মনে হচ্ছে এগুলি সবই দুর্লক্ষণ। তাই আমি অবসন্ন বোধ করছি। কুমার ভরতের মনে হল, বন্ধুজনের কুশলসংবাদ তিনি পাবেন না। অন্তর মোহগ্রস্ত নয় অথচ তাঁর মন যেন অবসাদগ্রস্ত। তথা হ্যসতি সম্মোহে হৃদয়ং সীদতীব।
যাঁর বাহনগুলি পর্যন্ত শ্রান্ত, বিষাদাচ্ছন্ন, শিথিলেন্দ্রিয়, সশঙ্কিত মনে, ভরত, ইক্ষ্বাকুরাজাদের লালিত অযোধ্যা নগরীতে প্রবেশ করলেন। বৈজয়ন্ত নামের দরজা দিয়ে প্রবেশোন্মুখ শ্রান্তবাহন ভরতের উদ্দেশ্যে, দ্বারিরা, উঠে দাঁড়িয়ে, জয়ধ্বনি করে উঠল। তাঁদের সঙ্গে এগিয়ে চললেন ভরত। দ্বাররক্ষকদের অভ্যর্থনার সৌজন্যমূলক প্রত্যুত্তর দিয়ে উদ্বিগ্ন ভরত, মাতামহ অশ্বপতির ক্লান্ত সারথিকে প্রশ্ন করলেন, অকারণে কেন এত ব্যস্ত হয়ে আমাকে আনা হল, অশুভ কোনও আশঙ্কায়,আমার মন প্রাণ সুস্থির নেই।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক
ভরত শুনেছেন, রাজাদের বিনাশ হলে যেমন অবস্থা হয় সেই সব লক্ষণ তিনি এখানে দেখছেন। সংমার্জনের অভাবহেতু রুক্ষতা সর্বত্র, অবারিত গার্হস্থ্য কপাট,সার্বিকভাবে শ্রীহীনতা দৃশ্যমান। ধূপের গন্ধে আমোদিত যজ্ঞাহুতি নেই, গৃহস্থরা রয়েছেন অভুক্ত, জনগণ যেন নিষ্প্রভ, ম্লান। গৃহস্থবাড়িগুলির লক্ষ্মীছাড়ার দশা। সেখানে নেই ফুলের মালার বাহার, অপরিষ্কৃত প্রাঙ্গণ। দেবালয়গুলি জনহীন, তাই অতীতের শোভা আর নেই। দেবার্চনার অভাব, যজ্ঞানুষ্ঠানেরও একই অবস্থা। মালার দোকানগুলি পণ্যের অভাবহেতু সৌন্দর্য হারিয়েছে। আগের মতো এখানে বণিকদের আনাগোনা নেই। দেবালয় ও চৈত্যগুলিতে যে সব পশু পাখি থাকে তারাও যেন নিশ্চেষ্ট, ধ্যানমগ্ন। স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে পুরবাসীরা সকলেই ম্লান, তাঁদের চোখভরা জল, দীন, ধ্যানমগ্ন, শীর্ণকায় অবস্থায় দেখছেন ভরত, তাঁরা কী উৎকণ্ঠিত? মলিনঞ্চাশ্রুপূর্ণাক্ষং দীনং ধ্যানপরং কৃশম্। সস্ত্রীপুংসঞ্চ পশ্যামি জনমুৎকণ্ঠিতং পুরে।। অযোধ্যার এই সব অকল্যাণ দৃশ্য দেখে, ভাঙা মন নিয়ে,ভরত রাজভবনে প্রবেশ করলেন। কী দেখলেন সেখানে?ইন্দ্রালয়সম প্রাসাদের অলিন্দ, পথ, জনশূন্য। ঘর,দ্বার ও কপাট যন্ত্রসমূহ ধূলিমলিন অরুণবরণ—দেখে, দুঃখে কাতর হলেন ভরত।অতীতে যে সব অপ্রিয়, অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য দেখেননি সেগুলি দেখে, নতমস্তকে, বিষণ্ণ মনে, পিতৃগৃহে প্রবেশ করলেন ভরত।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৩: বীরচন্দ্রের রাজকার্যে বাংলা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
অযোধ্যার প্রয়াত রাজার শূন্যস্থান পূরণ করবেন কে? চার পুত্রের একজনও প্রাসাদে নেই। স্থির হল, মাতামহের আলয়ে আছেন ভরত, যিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, তাঁকে বার্তা প্রেরণ করা হোক। সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কেকয়রাজ্যে পৌঁছলেন দূতরা। রাজপুত্র ভরত সেদিন রাতে এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখলেন। সেই অশুভ স্বপ্নের বিষয় তাঁর সদ্য মৃত পিতা, যাঁর প্রয়াণবার্তা তখনও ভরতের কাছে অজ্ঞাত। ভরত প্রিয়জনের প্রাণহানির আশঙ্কায় ভীত,সন্ত্রস্ত যখন সেই সময়ে অযোধ্যার দূতগণ উপস্থিত হলেন কেকয়রাজার প্রাসাদে। মাননীয় বশিষ্ঠের উপদেশানুসারে বহুমূল্য উপহার প্রদান করলেন। নিবেদন করলেন, কুমার ভরতের অযোধ্যায় ফিরে যাওয়া আবশ্যক। কারণ, তাঁর জন্যে অপেক্ষমান কোনও অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। ভরত প্রিয়জনের কুশল সংবাদ জানতে চাইলেন। পূজ্য গুরুজনদের সম্বন্ধে সশ্রদ্ধ মন্তব্য ছিল তাঁর।
শুধু ব্যতিক্রম, জননী কৈকেয়ীর প্রতি তাঁর আপাত বিরূপ মন্তব্য। স্বার্থান্বেষী মায়ের কপটতা বোধ হয় অতি প্রিয় সন্তানের কাছেও ধরা পরে যায়। মাতামহ কেকয়রাজ অশ্বপতি পৌত্রকে বিচিত্র উপহার দিলেন। বহুমূল্য উপহার সামগ্রীর মধ্যে ছিল অন্তঃপুরে লালিত বাঘের মতো বলশালী কুকুর। মাতামহ কী পৌত্রের নিরাপত্তাবিষয়ে সতর্কতার বার্তা দিতে চেয়েছেন? গুণী অমাত্যরা ভরতের সঙ্গী হয়েছেন। ভাবি অযোধ্যাপতির মন্ত্রণার প্রয়োজন?সেখানে আছেন সুযোগ্য মন্ত্রীরা। তবে?
রাজনীতির সতর্কতার বেড়াজাল আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখে জীবন, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত যে কোন মহার্ঘ প্রাণের, সেই জাল থেকে নিস্তারের উপায় নেই।
শুধু ব্যতিক্রম, জননী কৈকেয়ীর প্রতি তাঁর আপাত বিরূপ মন্তব্য। স্বার্থান্বেষী মায়ের কপটতা বোধ হয় অতি প্রিয় সন্তানের কাছেও ধরা পরে যায়। মাতামহ কেকয়রাজ অশ্বপতি পৌত্রকে বিচিত্র উপহার দিলেন। বহুমূল্য উপহার সামগ্রীর মধ্যে ছিল অন্তঃপুরে লালিত বাঘের মতো বলশালী কুকুর। মাতামহ কী পৌত্রের নিরাপত্তাবিষয়ে সতর্কতার বার্তা দিতে চেয়েছেন? গুণী অমাত্যরা ভরতের সঙ্গী হয়েছেন। ভাবি অযোধ্যাপতির মন্ত্রণার প্রয়োজন?সেখানে আছেন সুযোগ্য মন্ত্রীরা। তবে?
রাজনীতির সতর্কতার বেড়াজাল আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখে জীবন, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত যে কোন মহার্ঘ প্রাণের, সেই জাল থেকে নিস্তারের উপায় নেই।
ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
কেকয়রাজ্য অযোধ্যা থেকে বহুদূর,পার্বত্য প্রদেশ। দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে অযোধ্যায় পৌঁছতে ভরতের সময় লেগেছে সাতদিন। পথে ভৌগোলিক বিচিত্র শোভা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অজস্র নদী, কত তাদের নামের বাহার। সুদামা, হ্রাদিনী, শতদ্রু, শিলাবহা, সুন্দরী, কুলিঙ্গা, কুটিকোষ্টিকা, কুটিকা, কপীবতী, স্থাণুমতী। পথে সম্মুখে এসেছে, গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, গোমতী নদী। নদীদের এই নামগুলি পরিচিত, আবহমান এদের স্রোতধারা। কিন্তু অপরিচয়ের আড়ালে বয়ে চলা নদীগুলি চিরন্তন ভারতীয় জীবনের অঙ্গ হয়ে আজও অব্যাহত গতিতে প্রবহমান, হয়তো অন্য নামে, অন্য কোনও নিজস্ব পথ ধরে তাদের উর্বরতার লক্ষ্যে যাত্রা। উত্তর ভারতের কত জনপদ, গ্রাম, নগর, বনপথ ধরে ভরতের কেকয়রাজ্য থেকে অযোধ্যামুখী যাত্রাপথটি। ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়,অথচ ভারতবর্ষের মানচিত্রের ছবি যেন এই যাত্রাপথের বিবরণ।
শ্রান্ত ক্লান্ত ভরতের চোখের সামনে রাজাবিহীন অযোধ্যার নৈরাশ্যের চিত্র। শ্রীহীন নগর, বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি পুরবাসীগণ। এই সব দৃশ্য দেখে, ব্যথিত, বিষণ্ণ ভরত আসন্ন কোন বিপদের ইঙ্গিত পেয়েছেন। মনে শঙ্কার কালো মেঘ।
একজন সুশাসকের মৃত্যুর শূন্যতা কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর। হঠাৎ প্রস্তুতিহীন মৃত্যু অযোধ্যায় যে অরাজক অবস্থার সূচনা করল,রাজকীয় প্রশাসনে সেটি অস্বাভাবিক নয়। এমনটাই ঘটে থাকে নেতৃত্বহীন প্রশাসন ব্যবস্থায়। রাজতন্ত্র ও আধুনিক গণতন্ত্রে,এ বিষয়ে কোনও পার্থক্য নেই।
ভরত, অভিভাবকহীন হয়েছেন তেমনই নেতৃত্বহীন হয়েছে ইক্ষ্বাকুবংশ, প্রশাসকহীন অযোধ্যা নগরী। সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ যেমন পরিবারের মধ্যমণি,তিনি একটি বংশের ধারক ও বাহক, তেমনই একজন শ্রদ্ধেয়, ধার্মিক, মাননীয় প্রশাসকের স্থান জনগণের হৃদয়ে। তাঁর অভাবে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুগীন হয় রাষ্ট্র ও নাগরিকবৃন্দ। জনজীবনকে ঘিরে ধরে সাময়িক নৈরাশ্য,অস্থিরতা। ভরত সেই অস্থির সময়ের মুখোমুখি হয়েছেন। এমন অবস্থা বোধ হয় যে কোন শাসকহীন রাষ্ট্রেই প্রত্যাশিত।
নদীমাতৃক দেশের বিচিত্র নদীস্রোতের মতোই চিরন্তন গতিময়তায় প্রবহমান, বৈচিত্র্য ভরপুর ভারতীয় জীবন, সাবলীল, অনায়াস, আবহমান, চিরন্তন। একই ভাবে সেই যাপনচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ভারতীয় ভৌগোলিক মানচিত্রে রামায়ণের ঋষিপ্রদত্ত তথ্য—স্বতঃস্ফূর্ত, অনন্য।—চলবে।
শ্রান্ত ক্লান্ত ভরতের চোখের সামনে রাজাবিহীন অযোধ্যার নৈরাশ্যের চিত্র। শ্রীহীন নগর, বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি পুরবাসীগণ। এই সব দৃশ্য দেখে, ব্যথিত, বিষণ্ণ ভরত আসন্ন কোন বিপদের ইঙ্গিত পেয়েছেন। মনে শঙ্কার কালো মেঘ।
একজন সুশাসকের মৃত্যুর শূন্যতা কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর। হঠাৎ প্রস্তুতিহীন মৃত্যু অযোধ্যায় যে অরাজক অবস্থার সূচনা করল,রাজকীয় প্রশাসনে সেটি অস্বাভাবিক নয়। এমনটাই ঘটে থাকে নেতৃত্বহীন প্রশাসন ব্যবস্থায়। রাজতন্ত্র ও আধুনিক গণতন্ত্রে,এ বিষয়ে কোনও পার্থক্য নেই।
ভরত, অভিভাবকহীন হয়েছেন তেমনই নেতৃত্বহীন হয়েছে ইক্ষ্বাকুবংশ, প্রশাসকহীন অযোধ্যা নগরী। সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ যেমন পরিবারের মধ্যমণি,তিনি একটি বংশের ধারক ও বাহক, তেমনই একজন শ্রদ্ধেয়, ধার্মিক, মাননীয় প্রশাসকের স্থান জনগণের হৃদয়ে। তাঁর অভাবে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুগীন হয় রাষ্ট্র ও নাগরিকবৃন্দ। জনজীবনকে ঘিরে ধরে সাময়িক নৈরাশ্য,অস্থিরতা। ভরত সেই অস্থির সময়ের মুখোমুখি হয়েছেন। এমন অবস্থা বোধ হয় যে কোন শাসকহীন রাষ্ট্রেই প্রত্যাশিত।
নদীমাতৃক দেশের বিচিত্র নদীস্রোতের মতোই চিরন্তন গতিময়তায় প্রবহমান, বৈচিত্র্য ভরপুর ভারতীয় জীবন, সাবলীল, অনায়াস, আবহমান, চিরন্তন। একই ভাবে সেই যাপনচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ভারতীয় ভৌগোলিক মানচিত্রে রামায়ণের ঋষিপ্রদত্ত তথ্য—স্বতঃস্ফূর্ত, অনন্য।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।