শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রাজা দশরথ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। অযোধ্যায় সুগভীর শোকের আঁধার গভীরতর হল। সুদীর্ঘ রাত যেন আরও দীর্ঘ মনে হতে লাগল। অযোধ্যার আকাশে বাতাসে, শোকার্ত নাগরিকদের হাহাকার ধ্বনি। দুঃখভারাক্রান্ত রাত্রি অবশেষে অতিবাহিত হল। দিনের আলোয় শুরু হল রাজকর্মচারীদের কর্মতৎপরতা। বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ মন্ত্রীরা তাঁদের মূল্যবান অভিমত প্রকাশ করলেন। শ্রেষ্ঠ রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ,তাঁদের বক্তব্যের শ্রোতা। তাঁরা বললেন, পুত্রশোকে প্রাণবিয়োগ হল রাজার। তাঁর প্রয়াণের দুঃখদীর্ণ রাতটি যেন শতবর্ষব্যাপী এতটাই দীর্ঘ ছিল সে রাত। স্বর্গত মহারাজ দশরথের পুত্র, রাম, অরণ্যে বসবাস করছেন। তেজস্বী লক্ষ্মণও রামের সহযাত্রী হয়েছেন। ভরত ও শত্রুঘ্ন,দুই ভাই আছেন কেকয়রাজ্যে, তাঁরা দুভাই মাতামহের সুরম্য প্রাসাদে অবস্থান করছেন।

এখনই আজ, ইক্ষ্বাকুবংশীয় কোনও কুমারকে রাজপদে অভিষিক্ত করা কর্তব্য। না হলে রাজাহীন আমাদের এই রাজ্যের বিনাশ নিশ্চিত। ইক্ষ্বাকুনামিহাদ্যৈব কশ্চিদ্রাজা বিধীয়তাম্। অরাজকং হি রাষ্ট্রং নো বিনাশং সমবাপ্নুয়াৎ।। অরাজক জনপদে, বিদ্যুতসহ গুরুগর্জনকারী মেঘ, দিব্য জল বর্ষণ করে না। অরাজক দেশে বীজোদ্গম হয় না। এমন রাজ্যে পুত্র পিতার এবং পত্নী,স্বামীর অনুগত থাকেন না। নির্ধন এমন রাজাহীন রাষ্ট্রে কোনও স্ত্রী বশে থাকেন না। এমন অবস্থায় আরও একটি আশঙ্কার কারণ হল, এখানে সত্য কোথায়? অর্থাৎ সত্যনিষ্ঠতা বজায় থাকে না। অরাজক দেশে পরিতৃপ্ত মানুষ সভাগৃহ, রমণীয় উদ্যান, পুণ্যস্থান গড়তে উদ্যোগী হন না। সেখানে ব্রাহ্মণরা যজ্ঞবিমুখ, কঠিন ব্রতধারী দানশীল ব্রাহ্মণরাও আর যজ্ঞ করতে আগ্রহী নন। ধনবান ব্রাহ্মণেরা মহাযজ্ঞে উৎসাহী হলেও যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষিণা দান করেন না। নট, নর্তকরা সন্তুষ্ট নন। রাষ্ট্রের উন্নয়নসূচক উৎসব ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পায় না। সফল ব্যবহারজীবীরা কথার জাল বিস্তার করেও কথাপ্রিয় শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে পারেন না।

অরাজক দেশে আরও কত অনাসৃষ্টি কাণ্ডই না ঘটে। সেখানে সায়াহ্নে স্বর্ণালঙ্কৃতা কুমারীরা উদ্যানে ক্রীড়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। ধনাঢ্য গৃহস্থ এবং কৃষিজীবী ও গোয়ালারা গৃহদ্বার উন্মুক্ত রেখে শয়ন করতে সক্ষম হন না। মানুষজন, নারীসহ, দ্রুতগামী বাহনসহযোগে অরণ্য অতিক্রম করতে পারেন না। রাজহীন দেশে ষাট বৎসর বয়সী ঘণ্টালঙ্কৃত দাঁতাল গজরা রাজপথে বিচরণ করে বেড়ায় না। সেখানে নিয়ত শরচালনায় দক্ষ, শস্ত্রবিদ যোদ্ধাদের অস্ত্রনির্ঘোষ শোনা যায় না। অরাজক রাষ্ট্রে, দূরগামী বণিকরা পণ্যসহ নিরাপদে পথ পাড়ি দিতে পারেন না।

এমন কি একজন জিতেন্দ্রিয় পরমার্থচিন্তায় মগ্ন, জ্ঞানী, মুনি যিনি সন্ধ্যাকালে একাকী যে কোন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তিনিও অরাজক পরিস্থিতিতে বিচরণ করতে অক্ষম হন। রাজহীন দেশ যোগ (অলব্ধ বস্তুর লাভ) এবং ক্ষেম (প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষণ) সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় সৈন্যরাও শত্রুদের দমন করতে পারে না। অরাজক দেশে তুষ্ট মানুষ সহসা অশ্ব ও রথারোহী হয়ে দেশভ্রমণে সমর্থ হন না। শাস্ত্রবিদরা বনে এবং উপবনে যত্র তত্র তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারেন না। সেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে মাল্য,মিষ্টি,দক্ষিণাসহ দেবারধনায় অক্ষম হন।
চন্দন ও অগরুসজ্জিত রাজপুত্ররা বসন্তের সুশোভিত বৃক্ষের মতো বিরাজ করেন না। অরাজক দেশ, ঠিক জলহীন নদী, তৃণবিহীন অরণ্য, গোপালকহীন গোকুল তুল্য। পতাকা, রথের, ধূম,অগ্নির অস্তিত্বের চিহ্ন বহন করে থাকে তেমনই প্রজাদের পরিচায়ক রাজা। তিনি আজ প্রয়াত হয়েছেন। অরাজক জনপদে কারও কোন বিষয়ে নিজস্ব অধিকারবোধ থাকে না। সেখানে মাৎস্যন্যায় দেখা দেয়। পরস্পর একে অপরকে ভক্ষণ করে অর্থাৎ একে অপরের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। নারাজকে জনপদে স্বকং ভবতি কস্যচিৎ। মৎস্যা ইব জনা নিত্যং ভক্ষয়ন্তি পরস্পরম্। অরাজক অবস্থায় যত নিন্দনীয় অসম্ভবও সম্ভব হয়। যারা ধর্মের অনুশাসন লঙ্ঘনকারী, নাস্তিক, রাজশাসনের মাধ্যমে অবদমিত, তারাও মাথা উঁচু করে চলে। দেহের দৃষ্টি যেমন শরীরের প্রতি ক্রিয়াশীল তেমনই রাজাও সত্য ও ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ। রাজাই সত্য এবং ধর্ম, রাজাই কুলশালীদের কুল। রাজা একাধারে মানুষের পিতা ও মাতা, রাজা একান্তভাবে সাধারণের সতত কল্যাণকামী। রাজা সত্যঞ্চ ধর্মঞ্চ রাজা কুলবতাং কুলং। রাজা মাতা পিতা চৈব রাজা হিতকরো নৃণাম্।।

রাজা বিশিষ্টতায় একযোগে, যম, কুবের, ইন্দ্র ও বরুণের প্রতিমূর্তি। রাজা না থাকলে সাধু ও অসাধুর বিভেদ কে নির্ধারণ করতেন? সবকিছুই অবিজ্ঞাত রয়ে যেত। সমুদ্র যেমন বেলাভূমি অতিক্রম করে না তেমনই রাজা দশরথ জীবদ্দশায় কখনও মহর্ষি বশিষ্ঠের বচন লঙ্ঘন করেননি। মন্ত্রীরাও মাননীয় বশিষ্ঠের বচন অমান্য করতে পারবেন না। তাই তাঁদের অনুরোধ,রাজার অভাবে অরণ্যতুল্য এই রাজ্যের অনিশ্চয়তা দূর করা প্রয়োজন। তাই কুলগুরু বশিষ্ঠ যেন পরিস্থিতি বিবেচনা করে, অন্য কোন ইক্ষ্বাকুবংশীয় কুমারকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন।

ব্রাহ্মণ, বন্ধুবর্গ, অমাত্যদের অনুরোধের উত্তরে, মহর্ষি বশিষ্ঠ তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন। রাজা যে পুত্রকে রাজ্যদান করেছেন, সেই ভরত এখন ভাই শত্রুঘ্নের সঙ্গে মাতুলালয়ে বসবাস করছেন। তাই অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে দ্রুত সেখান থেকে দুই ভাইকে, এখানে নিয়ে আসা হোক।এ বিষয়ে আর বিবেচনার অবকাশ নেই কোনও। অমাত্য সিদ্ধার্থ, বিজয়, জয়ন্ত, অশোক, নন্দনকে আহ্বান জানিয়ে তাঁদের কর্ত্তব্য বিষয়ে অবহিত করলেন। অবিলম্বে রাজগৃহে গমন করা কর্তব্য। এখন আর শোকের সময় নয়। মহর্ষি বশিষ্ঠ, অমাত্যদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভরতের কুশল সংবাদ জানতে চেয়েছেন। অযথা সময় যেন নষ্ট না হয়। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই রামের বনবাসের বার্তা এবং রাজার মৃত্যুসংবাদ প্রদান করা সমীচীন নয়।
আরও পড়ুন:

বাংলা বুকের ভিতরে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

ভরতের মাতামহ কেকয়রাজ ও কুমার ভরতের জন্যে উত্তম কৌশেয় বস্ত্র ও ভূষণ সঙ্গে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করতে উপদেশ দিলেন মাননীয় বশিষ্ঠ। ঋষির কাছ থেকে পাথেয় গ্রহণ করে এবং অবশ্যকর্তব্য সম্পন্ন করে, সত্বর কেকয়রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন দূতেরা। পথে পশ্চিমের অপরতাল নামক দেশ ও উত্তরের প্রলম্বদেশের মধ্যবর্তিনী প্রবহমানা মালিনীর শোভা উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললেন তাঁরা। হস্তিনাপুরে গঙ্গানদী অতিক্রম করে, পাঞ্চালদেশ ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে কুরুজাঙ্গলের মধ্য দিয়ে চললেন ।পথে দৃষ্টিনন্দন কমলদলে সজ্জিত সরোবর ও স্বচ্ছতোয়া নদীর শোভা চোখে পড়লেও, কাজের গুরুত্ব সবার আগে, তাই তাঁরা দ্রুত গমন করলেন। এরপরে দূতবর্গ বেগবতী বিহঙ্গকাকলিতে মুখর, স্বচ্ছ জলে পরিপূর্ণ, মনোহর, শরদণ্ড নদী অতিক্রম করে, অভীষ্ট পূরণ করে যে নিকুলবৃক্ষ সেই দিব্য তরুর নিকটবর্তী হলেন।

বৃক্ষটিকে প্রদক্ষিণান্তে যথাক্রমে, কুলিঙ্গা পুরী, অতিকাল ও তজোভিভবন নামে দুইটি গ্রাম, ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের স্মৃতিধন্যা পবিত্র ইক্ষুমতী নদী অতিক্রম করে, বাহ্লীক দেশের মধ্য দিয়ে, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের আবাস সুদামা পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে বিষ্ণুপদচিহ্ন দর্শন করে, বিপাশা ও শাল্মলী নদীর শোভা ও বহু সরোবর,জলাশয় দেখতে দেখতে সত্বর প্রভুর আদেশ পালন করার লক্ষ্যে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন। ঘোড়াগুলি ক্লান্ত, তবু পথটি কিন্তু নিরুপদ্রব। তাই পথের শ্রান্তি অগ্রাহ্য করে দূতেরা সত্বর গিরিব্রজপুরে পৌঁছলেন। দূতদের লক্ষ্য,প্রভুর প্রিয় কাজটির সমাধান ও প্রভুর বংশের যথার্থ প্রতিষ্ঠা। প্রজাদের স্বার্থরক্ষায় যত্নশীল দূতেরা, অবশেষে রাত্রিতে পৌঁছলেন উদ্দিষ্ট নগরীতে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৬: কোমলপ্রাণা মা সারদা

সেই রাতেই, রাজনন্দন ভরত একটি অশুভ স্বপ্ন দেখলেন। সেই রাত্রি শেষে, কুমার ভরত, সেই অপ্রিয় স্বপ্নটির বিষয়ে গভীর চিন্তা করলেন। তাঁর ভীষণভাবে মনস্তাপ জন্মাল। সমবয়স্যরা তাঁর দুঃখ দূর করতে নানাবিধ কথার অবতারণা করলেন।কেউ বাজালেন বাদ্যযন্ত্র, কেউ নৃত্য করতে লাগলেন, কেউ নাট্যাভিনয় শুরু করলেন। সকলের একটাই উদ্দেশ্য—বিনোদনের মাধ্যমে রাজকুমারের মনোবেদনা উপশম। এইসব হাস্যরস সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। ন প্রাহৃষ্যত রাঘব:। রাঘব ভরতের মনোবেদনা লাঘব হল না। ভরতের এক প্রিয়বন্ধু জানতে চাইলেন, সুহৃদ্ভি:পর্য্যুপাসীন: কিং সখে নানমোদসে।

সখাসঙ্গের রঙ্গকৌতুক কী ভালো লাগছে না তোমার?উত্তরে, দু:খের কারণ ব্যক্ত করলেন ভরত। সুহৃদকে স্বপ্নের বিষয় বর্ণনা করে বললেন, স্বপ্নে পিতরমদ্রাক্ষং মলিনং মুক্তমূর্দ্ধজম্। পতন্তমদ্রিশিখরাৎ কলুষে গোময়ে হ্রদে।। স্বপ্নে দেখেছি ম্লান, উন্মুক্ত কেশ পিতাকে। তিনি পর্বত শিখর হতে গোময়পূর্ণ হ্রদে পতনশীল অবস্থায় রয়েছেন। পতনের সময়ে পিতা হাসতে হাসতে অঞ্জলিবদ্ধ হাতে বার বার তৈল পান করছেন। তিনি স্বপ্নে,আরও দেখলেন, কিছুকাল গোময়পূর্ণ হ্রদে সাঁতরে পিতা তিলমিশ্রিত অন্ন ভক্ষণ করতে করতে, নতশিরে তৈলাক্ত হয়ে, সেখানেই অবগাহন করছেন। ততস্তিলোদনং ভুক্ত্বা পুনঃপুনরধঃশিরাঃ। তৈলেনাভ্যক্তসর্ব্বাঙ্গস্তৈলমেবান্বগাহত।।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: স্ত্রী-২ ছবিতে স্কন্দকাটা দৈত্য আক্রমণ করছে আধুনিক নারীদের

এ ছাড়াও ভরত দেখেছেন,বিশুষ্ক সাগর,মাটিতে পড়ে আছে চাঁদ, পৃথিবী যেন অবরুদ্ধ ও তমসাবৃত। বহনযোগ্য হাতির দাঁত ভগ্ন, জ্বলন্ত আগুনের তেজ প্রশমিত, পৃথিবী বিদীর্ণ,শুকিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষরাজি, বিধ্বস্ত পর্বতগুলি ধূমায়মান। পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র, আসনটি কৃষ্ণবর্ণ, উপবিষ্ট রাজাকে প্রহার করছেন কৃষ্ণবর্ণা নারীরা।ধর্মাত্মা,রাজার কণ্ঠে রক্তমালা, খরযুক্ত রথে আরোহণ করে তিনি চলেছেন দক্ষিণাভিমুখে। রক্তবসনা বিকৃতবদনা এক রাক্ষসী যেন হাসতে হাসতে অবলীলাক্রমে রাজাকে আকর্ষণ করছে।

কুমার ভরতের মতে, ভয়াবহ সেই রাতে, দুঃস্বপ্নের তাৎপর্য বোধ হয় — রাজা দশরথের,তা না হলে স্বয়ং ভরতের বা রাম ও লক্ষ্মণের মধ্যে কারও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হতে চলেছে। কারণ, সাধারণত স্বপ্নে দৃশ্যমান খরযুক্ত যানের, আরোহীর চিতার ধূমশিখা অচিরেই দৃষ্ট হয়। ভরত জানালেন, এই সব কারণেই তিনি দুঃখদীর্ণ, কারও বচনেই তিনি আনন্দিত নন, তাঁর কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে আসছে, মানসিকভাবে তিনি সুস্থ নন। ভয়ের কারণ নেই অথচ এক অমূলক ভীতি আচ্ছন্ন করে রেখছে তাঁকে। কুমার ভরতের স্বর রুদ্ধ হয়েছে, দেহচ্ছায়ার কমনীয়তা যেন অপসারিত প্রায়। নিজেকে ঘৃণ্য মনে হচ্ছে অথচ তার কোনও কারণ তিনি খুঁজে পাননি।এমন বহুমাত্রিক দুঃস্বপ্নের বিষয়টিও কোনওদিন তাঁর চিন্তায় পর্যন্ত আসেনি। অচিন্ত্যপূর্ব অবস্থায় রাজা —এই দর্শনের দরুণ ভরতের মন থেকে ভয় যেন দূরীভূত হচ্ছে না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৩: আধুনিকতার নিরিখে দ্রৌপদী ও অর্জুন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

শাসকহীন রাজ্যের পরিস্থিতি যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন মহর্ষি বিল্মীকি সেই ‘অরাজকতা’ শব্দটি যে যুগে যুগে কত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে সেটি বোধ হয় কল্পনাতীত ছিল তখন। অরাজকতার শিকার হন মানুষ। প্রাকৃতিক, সামাজিক পরিস্থিতিও প্রশাসকের অভাবজনিত কারণে উচ্ছৃঙ্খলতায় ভরে ওঠে। এমনই অমোঘ প্রভাব তার। দৈনন্দিন জনজীবন ব্যাহত হয়, বিঘ্নিত হয় রাষ্ট্রের উন্নয়নের ঊর্দ্ধগতি, আইনশৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে, ভীতি, শঙ্কার বাতাবরণে মানুষ নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। যাতায়াত, স্বচ্ছন্দে চলাফেরা সবকিছুই অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। অভিজাত, অনভিজাত সাধারণ, বণিকশ্রেণী, আত্মতত্ত্ববিদ জ্ঞানীর একাকী বিচরণ অসম্ভবপ্রায় তখন।

এমন কি শস্ত্রবিদ অক্ষম যোদ্ধারাও প্রশাসকের অভাবে কর্মহীন হয়ে পড়ে। আপামর জনজীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয় প্রশাসকের অভাবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্থহীন হয় অরাজক পরিস্থিতিতে। জনগণের স্বাধিকার নষ্ট হয়। মাৎস্যন্যায় অবস্থার সার্থক প্রয়োগ দেখা যায় অরাজক রাজ্যে। অধম, অবদমনের অভাবে যথেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। একজন শাসকের পিতৃপ্রতীম ভাবমূর্তি সর্বদাই কাঙ্খিত। রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে কোনও পার্থক্য নেই। সৎ ও অসতের শাসন যে ভিন্ন, তার নির্ণায়ক একজন প্রশাসক। সেই অনিশ্চয়তা প্রাচীন অযোধ্যার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনই প্রযোজ্য আধুনিক প্রশাসকহীন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। তাই এই দীর্ঘ অরাজকতার বর্ণনা এখনও প্রাসঙ্গিক।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহর্ষি বাল্মীকির ভৌগৌলিক জ্ঞান নিশ্চয়ই প্রশ্নাতীত ছিল। তিনি অসাধারণ নৈপুণ্যে দূতদের কেকয়রাজ্যের যাত্রাপথটি অনুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীকালে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রথিতযশা কবিরা যাত্রাপথ বর্ণনায় আগ্রহী হয়েছেন হয়তো। আদিকবি এ বিষয়ে পথপ্রদর্শক বললে, বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। ভরত দুঃস্বপ্ন দেখেছেন হয়তো তাঁর ষষ্ঠ অনুভূতি কাজ করেছে।পারিবারিক বন্ধন অটুট হলে যে কোন বিশ্বস্ত সদস্যর মর্মে হয়তো তার ভাঙনের বার্তাটি পৌঁছে যায়।

ভরতের স্বপ্নে বিপর্যস্ত রাজা দশরথ দেখা দিয়েছেন। রাজার অন্তিম অবস্থাটি যেন ধরা দিয়েছে সেই স্বপ্নে।তিনি অধঃপতিত হয়েছেন ঘৃণ্য গোময়পূর্ণ হ্রদে। যে কোন পতনই বিচ্যুতির দ্যোতক।রাজার চরম অবক্ষয়, তিনি পান করছেন অঞ্জলিভরা তেল। এই তেল তাঁর শবদেহ সংরক্ষণের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষ স্বেচ্ছায় স্থিতাবস্থা থেকে বিচ্যুত হতে চায় না। পতন আত্মক্ষয়ী। অসহায় রাজা স্বেচ্ছায় অধঃপতিত হননি, তিনি পারাপার্শ্বিকের চাপে অধর্মাচরণে বাধ্য হয়েছেন, তাঁর চরম অবিমৃশ্যকারিতার গুণাগার দিতে হয়েছে নিজের জীবনের বিনিময়ে।তাই স্বপ্নে রাজার পতন বোধ হয় নিজের ধর্মবোধ থেকে বিচ্যুতির প্রতীক।

ভরতের স্বপ্নে তিলমিশ্রিত অন্ন ভক্ষণ করতে করতে তৈলাক্ত দেহে নতমস্তকে সেখানে অবগাহন করছেন রাজা। তিলমিশ্রিত অন্ন অন্তিম সংস্কারের অনুষঙ্গ। রাজার অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হতে চাইছে, কিন্তু সেই তেলতেলে অপযশ, ঘৃণা, অধার্মিকতা এঁটে রয়েছে তাঁর ভাবমূর্তিতে, যার থেকে তার নিস্তার নেই যেন। দশরথের সেই অপযশ, অখ্যাতি তাঁকে যেন মৃত্যুর পরেও তাড়া করে ফিরছে। ভরতের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁকে জানিয়েছে,চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছেন তিনি। এটাই সিক্সথ সেন্স, যা, কখনও কখনও ভাবি কোনও অভাবনীয় ঘটনার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। দুর্জ্ঞেয় এই মানসিক অবস্থা বোধ হয় মনোবিদদের ব্যাখ্যাগম্য বিষয়। বিষাদের প্রতিমূর্তি ভরত অজ্ঞাত কোন আশঙ্কায় শঙ্কিত, ভীত। এ ভয়, মৃত্যুভয়। কোনও প্রাণহানির আশঙ্কায় তিনি মানসিক স্থিতিশীলতা হারিয়েছেন। কোনও প্রিয়জনের চলে যাওয়ার অগ্রিম কোন ইঙ্গিত,অনেকক্ষেত্রে এমনটাই জানান দেয়।জীবন বিচিত্র, বর্ণময়, বহমাত্রিক। স্বপ্ন কখনও অলীক কখনও বা অর্থবাহী হয় এখনও, তখনও।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content