শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

দ্রুপদরাজ্যে রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় কঠোর শর্তসাপেক্ষ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর সম্মান লাভ করলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। পাঞ্চালরাজকন্যা যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী তাঁকে বরমাল্য অর্পণ করলেন। নববধূকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্থানোদ্যত দুই পাণ্ডব ভাই, দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন ও অর্জুন। পরাজিত রাজারা ভীষণ রাগে পাঞ্চালরাজের সমালোচনায় মুখর হলেন। তাঁদের বক্তব্য—সমবেত ক্ষত্রিয় রাজাদের উপস্থিতি তাচ্ছিল্যসহকারে তৃণসম অবজ্ঞা করে, নারীশ্রেষ্ঠ দ্রৌপদীকে কিনা সম্প্রদান করলেন এক সাধারণ ব্রাহ্মণকে? গাছ বপন করে ফললাভের সময়ে একেবারে নিকেশ করে ফেললেন গাছটি? আমাদের অসম্মানকারী এই দুর্বৃত্ত রাজাকে হত্যা করব। অবরোপ্যেহ বৃক্ষস্তু ফলকালে নিপাত্যতে। নিহন্মৈনং দুরাত্মানং যোঽয়মস্মান্ন মন্যতে।।

ক্রুদ্ধ রাজারা স্থির করলেন, সপুত্র, রাজবিদ্বেষী, দুরাচারী, এই রাজাকে বধ করবেন। রাজা দ্রুপদ, অন্য রাজাদের সসম্মানে আহ্বান করে এনে, উত্তমরূপে ভোজন করিয়ে, তারপরে অতিথিদের অগ্রাহ্য করছেন। দেবতুল্য রাজসমূহের মধ্যে কোনও রাজাকেই কন্যার সুযোগ্য পাত্ররূপে মনে ধরল না? এটাই প্রচলিত প্রথা—স্বয়ংবরে ক্ষত্রিয়দের অগ্রাধিকার, ব্রাহ্মণদের নয়।রাজাদের প্রতিহিংসা, মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। বিকল্প উপায় হল এই কন্যা কোন রাজাকেই যখন স্বামীরূপে বরণ করলেন না, তাহলে একে আগুনে নিক্ষেপ করে বরং নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়া যাক্। ব্রাহ্মণ যদিও চপলতাবশতা লোভেহেতু এই অপ্রিয় কাজ করেছেন তবু ব্রাহ্মণ কোনও অবস্থাতেই বধযোগ্য নন।

ব্রাহ্মণদের জন্যে রয়েছে, রাজাদের রাজ্য, জীবন, সম্পদ, পুত্র, পৌত্র আর যা কিছু ধনসামগ্রী। সম্মান ও নিজেদের ক্ষত্রিয়ধর্ম রক্ষার স্বার্থেই এই হত্যার উদ্যোগ। ভবিষ্যতে অন্য সব স্বয়ংবর সভায় এমন যেন না ঘটে। এইভাবে বলাবলি করে লৌহনির্মিত দণ্ডের মতো বাহুবলী রাজশ্রেষ্ঠরা, অস্ত্রসজ্জিত হয়ে, হত্যার উদ্দেশ্যে দ্রুপদরাজার প্রতি ছুটে গেলেন। অঙ্গুলীত্রাণ ধারণকারী মারমুখী রাজাদের আসতে দেখে তটস্থ পাঞ্চালরাজ ব্রাহ্মণদের শরণাপন্ন হলেন। ভয়হেতু বা নিজের দুর্বলতার কারণে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে নয় শুধু পরিবেশ শান্ত করবার জন্যেই দ্রুপদরাজার ছিল এই উদ্যোগ। হয়তো রাজাদের প্রতি ব্রাহ্মণদের অনুরোধের প্রয়োজন ছিল। মদমত্ত হাতিদের মতো বেগে ধাবমান রাজাদের মুখোমুখি হলেন শত্রুদমনকারী মহাধনুর্দ্ধর দুই পাণ্ডুপুত্র।
ক্রুদ্ধ রাজারাও হাতের সুরক্ষার আচ্ছাদন,আঙুলের রক্ষাবরণ ধারণ করে, সাজ সাজ রবে ব্রাহ্মণবেশী ভাইদুটির মোকাবিলায় ধেয়ে এলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হল, দুজনকেই একযোগে হত্যা। উভয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ যিনি, অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সব কাজ করেন, মহাবলী, বজ্রতুল্য দৃঢ় অবয়বধারী, সেই ভীমসেন, দুই হাত দিয়ে দ্রুত উপরে ফেললেন একটি গাছ। প্রমত্ত গজশ্রেষ্ঠতুল্য, অনন্য বীর, ভীম বিপুল শক্তি প্রয়োগ করে, গাছটিকে পত্রহীন করে তুললেন। সেই নিষ্পত্র গাছটি তুলে নিয়ে শত্রুবিজয়ী, দীর্ঘবাহু, দণ্ডধারী যমতুল্য, স্থূলদেহী, পৃথাপুত্র ভীম, পুরুষশ্রেষ্ঠ পার্থ অর্জুনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। দেখে, কাজে ও বুদ্ধিতে যিনি অতিমানবিক শক্তির অধিকারী এবং চিন্তার অতীত সব কাজের রূপকার, সেই জিষ্ণু অর্থাৎ জয়ী অর্জুন ভয় ত্যাগ করলেন তো বটেই, আশ্চর্যও হলেন। তিনি নিজেও ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হলেন।

অতিমানবিক অচিন্তনীয় বুদ্ধিমান এবং তেমনই কার্যকারী অর্জুনকে ভাইয়ের সঙ্গে দেখে সেখানে উপস্থিত দামোদর কৃষ্ণ অতি শৌর্যশালী, জ্যেষ্ঠ, হলায়ুধ, বলরামকে বললেন, হে সঙ্কর্ষণ, যিনি এই তালপ্রমাণ বিশাল ধনু, যেন সিংহ বৃষের মতো খেলাচ্ছলে আকর্ষণ করছেন এমন, তিনিই অর্জুন। যদি আমি বসুদেবপুত্র বাসুদেব হই, তবে, এখানে বিচারবিবেচনার কোন অবকাশ নেই। এতটাই নিশ্চিত ছিলেন কৃষ্ণ। আর এই পৃথিবীতে, যুদ্ধে, ভীম ভিন্ন অন্য কার এত সামর্থ্য আছে যিনি এত দ্রুত গাছ উপরে ফেলে রাজাদের পরাভূত করতে সহসা উদ্যোগী হবেন? যাঁর নয়ন পদ্মসম আয়ত, যিনি বিশালাকৃতি, যিনি সিংহগতি অথচ বিনয়াবনত, গৌরাঙ্গ, লম্বা সুন্দর উজ্জ্বল নাকটি যাঁর, সেই পুরুষটি, যিনি প্রস্থান করলেন, তিনি হলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণের অনুমান, অশ্বিনীকুমারদের ঔরসজাত, কার্ত্তিকের মতো যে অল্পবয়স্ক কুমারদ্বয়, ইতিমধ্যে চলে গিয়েছেন, তাঁরা দুজন নকুল ও সহদেব।

কৃষ্ণ শুনেছেন, পৃথা কুন্তীদেবী ও পাণ্ডুপুত্ররা যতুগৃহদাহ থেকে মুক্তিলাভ করেছেন।জলহীন মেঘবরণ শুভ্র হলায়ুধ বলরাম খুশি হয়ে কনিষ্ঠ কৃষ্ণকে জানালেন, সৌভাগ্যক্রমে পিতার ভগিনী, আমাদের পিসিমাতা, দেবী কুন্তী, কৌরবদের অগ্রজদের সঙ্গে একযোগে মুক্ত হয়েছেন।

পরিধানের মৃগচর্ম ও কমণ্ডলু আন্দোলিত করে, ব্রাহ্মণরা অর্জুনকে উৎসাহিত করলেন, ভীর্ন কর্ত্তব্যা বয়ং যোৎস্যামহে পরান্। ভয় পেয় না, আমরা ওই শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। অর্জুন, স্মিতহেসে তাঁদেরকে বললেন, দর্শক হয়ে পাশে থাকুন। প্রেক্ষকা ভূত্বা যূয়ং তিষ্ঠত পার্শ্বতঃ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮০: একটি ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত হত্যা এবং আনুষঙ্গিক আলোচনা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

অর্জুন ব্রাহ্মণদের আশ্বস্ত করলেন, মন্ত্রের সম্মুখে নতমস্তক সাপেদের মতো তিনি অকুটিল শত শত শর নিক্ষেপ করে ওই ক্রুদ্ধ রাজাদের শায়েস্তা করবেন। সেই স্বয়ংবর সভাতে পণলব্ধ ধনুকখানি নিয়ে ভীমের সঙ্গে পর্বতের মতো অনড় হয়ে দাঁড়ালেন অর্জুন। কর্ণপ্রমুখ যুদ্ধে দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয়মুখ্যদের দেখে দুই ভাই, নির্ভীকভাবে, যেন প্রতিদ্বন্দ্বী গজদের উদ্দশ্যে গজতুল্য বিক্রম প্রকাশ করে ধেয়ে গেলেন। যুযুধান নিষ্ঠুর রাজারা বলে উঠলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে, যুদ্ধে ইচ্ছুক ব্রাহ্মণেরও বধ দেখতে পাওয়া যায়। এই বলে রাজারা সহসা ব্রাহ্মণদের প্রতি দ্রুত ধেয়ে এলেন। আর যুদ্ধে কর্ণের লক্ষ্য মহাতেজস্বী জিষ্ণু অর্জুন। হস্তিনীর কামনায় যেমন একটি হাতি প্রতিস্পর্ধী হাতির প্রতি ধেয়ে যায় তেমনই মদ্ররাজ মহাবলী শল্য ছুটে গেলেন ভীমের মোকাবিলায়। যুদ্ধে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দুর্যোধনদের যুদ্ধ ছিল কোমল দায়সারাগোছের। সৌন্দর্যের আধার,অর্জুন,সেই বলপ্রয়োগ করে সেই সুগঠিত ধনুক আকর্ষণ করে শাণিত তীর দিয়ে বৈকর্ত্তন সূর্যপুত্র কর্ণকে বিদ্ধ করলেন।

রাধার পুত্র,কর্ণ,শাণিত তীক্ষ্ণ শরগুলির গতির তীব্রতা দেখে বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে অর্জুনের প্রতি যত্নশীল হলেন এবং অর্জুনের দিকে ধেয়ে গেলেন। কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধ সমান সমান দুই যোদ্ধার পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দুজনেই বিজয়ার্থী। শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে কার প্রাধান্য?বলা কঠিন।উভয়ে একে অন্যকে আস্ফালন করে হুঙ্কার দিচ্ছেন, কৃতে প্রতিকৃতং পশ্য পশ্য বাহুবলঞ্চ মে। তোমার যোগ্য কীর্তি দেখ, দেখ আমার পেশীশক্তি। অর্জুনের বাহুবলের কোন তুলপনা নেই—অনুভব করলেন কর্ণ। ক্রুদ্ধ কর্ণ সেইমতো যুদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুনের নিক্ষিপ্ত বাণগুলির তীব্র গতিময়তা প্রতিহত করে গর্জন করে উঠলেন। সৈন্যরা তাঁকে সম্মানিত করলেন।

কর্ণ স্বীকার করলেন, যুদ্ধে, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠর বাহুবল, নিরবিচ্ছিন উৎসাহ এবং শস্ত্র ও অস্ত্রের বিজয়ের বহর দেখে তিনি তুষ্ট হয়েছেন। দ্বিজবর নিজে কী স্বয়ং ধনুর্বেদ? না পরশুরাম? কিংবা ইন্দ্র? অথবা সাক্ষাৎ অচ্যুত বিষ্ণু? নিজেকে ছদ্ম ব্রাহ্মণের বেশে আচ্ছাদিত করে, বাহুবল অবলম্বন করে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে আবতীর্ণ হয়েছেন। যুদ্ধে কর্ণ ক্রুদ্ধ হলে শচীপতি ইন্দ্র ও পাণ্ডব কিরীটী অর্জুন ছাড়া অন্য কোন যোদ্ধা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হবেন না। ন হি মামাহবে ক্রুদ্ধমন্যঃ সাক্ষাচ্ছচীপতেঃ। পুমান্ যোধয়িতুং শক্তঃ পাণ্ডবাদ্বা কিরীটিনঃ।।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)

কর্ণের গর্বিতোক্তির প্রত্যুত্তরে অর্জুন জানালেন, তিনি ধনুর্বেদ নন, নন শৌর্যশালী পরশুরাম। অর্জুনের ভাষায় তিনি—ব্রাহ্মণোঽস্মি যুধাং শ্রেষ্ঠ! সর্ব্বশস্ত্রবিদাং বরঃ। ব্রাহ্মে পৌরন্দরে চাস্ত্রে নিষ্ঠিতো গুরুশাসনাৎ।। হে শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিদ, আমি শস্ত্রবিদ্যাবিদদের মধ্যে সর্বোত্তম নেহাতই এক ব্রাহ্মণ, গুরুর আনুশাসনক্রমে ব্রাহ্ম ও ঐন্দ্র অস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেছি। হে বীর, আজ যুদ্ধে তোমাকে জয় করবার লক্ষ্যে আমার অবস্থান। সুস্থির হও বা আমি পরাজিত হয়েছি – এটি ঘোষণা কর। তারপরে যেখানে খুশি চলে যাও। স্থিতোঽস্ম্যদ্য রণে জেতুং ত্বাং বৈ বীর! স্থিরো ভব। নির্জ্জিতোঽস্মীতি বা ব্রূহি ততো ব্রজ যথাসুখম্।। এই বলে অর্জুন ছিন্নকরলেন কর্ণের ধনুক। কর্ণের বিক্রম কম নয়। তিনি তৎক্ষণাৎ ধনুক যোগাড় করে শর যোজনা করলেন। অর্জুন, এবারেও কর্ণের ধনুক ছিন্ন করে তাঁকে বাণবিদ্ধ করলেন। ছিন্ন ধনুক ও শরবিদ্ধ অঙ্গ নিয়ে পলায়নপর হলেন মহাবলী কর্ণ। এ পলায়নবৃত্তি মুহূর্তের। পরক্ষণেই ধনুর্বাণ নিয়ে ফিরে এসে শরবর্ষণ করতে লাগলেন।

অর্জুন সেগুলি প্রতিহত করলেন অভ্রান্ত লক্ষ্যে। সেই সব অতি ভয়ঙ্কর শর বর্ষণ বিফল হল। কর্ণ, ব্রাহ্মণ্যতেজের জয় সুদূর পরাহত মনে করে, রণে ভঙ্গ দিলেন। ওদিকে যুদ্ধরত দুই বীর ভীমসেন ও মদ্ররাজ শল্য। দুজনেই অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত যেমন তেমনই বলশালী। প্রমত্ত গজের মতো দুজনে পরস্পরকে রণ আহ্বান জানিয়ে,হাতের মুঠি ও জানু দিয়ে একে অপরকে আঘাত করতে লাগলেন। পাষাণের মতো চপেটাঘাতে পরস্পরকে আঘাত করে, দুজনে পরস্পরকে আকর্ষণ করতে থাকলেন। ভীমসেন নিজের আয়ত্তে এনেও কিন্তু শল্যকে বধ করলেন না। শল্য ভূপতিত হলেন। কর্ণ-সহ সমবেত রাজারা প্রবল আশঙ্কায় ভীমকে ঘিরে দাঁড়ালেন। সকলে একযোগে ব্রাহ্মণদের কাজের প্রশংসা করলেন। তাঁরা দুই ব্রাহ্মণের পরিচয় জানতে উৎসুক বিজ্ঞায়েতাং ক্বজন্মানৌ ক্বনিবাসৌ তথৈব চ। জানান, কোথায় জন্ম?কোথায় নিবাস? ইত্যাদি।

পরাজিত রাজাদের অভিমত—বলরাম, দ্রোণাচার্য,পাণ্ডুপুত্র অর্জুন, কৃষ্ণ, কৃপাচার্য ছাড়া আর কে আছেন, যিনি যুদ্ধে রাধেয় কর্ণের সমকক্ষ হতে পারেন? রণক্ষেত্রে দুর্যোধনের প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা কে আছেন? বলরাম, পাণ্ডব ভীম, বীর দুর্যোধন ব্যতীত, এমন সামর্থ্য কার আছে যিনি বলশালীদের মধ্যে অন্যতম মদ্ররাজ শল্যকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারেন? সুতরাং এই ব্রাহ্মণের সঙ্গে রণে নিবৃত্ত হওয়াই ভাল। ক্রিয়তামবহারোঽস্মাদ্ যুদ্ধাদ্ ব্রাহ্মণসংবৃতাৎ। অপরাধ করলেও ব্রাহ্মণদের সর্বদাই রক্ষা করাই কর্তব্য। ব্রাহ্মণদের পরিচয়প্রাপ্তির পরে, আবার না হয় যুদ্ধ করা যাবে। সেখানে উপস্থিত কৃষ্ণ, ভীমসেনের তৎপরতা দেখে নিশ্চিত হলেন, এনারা নিশ্চয়ই কুন্তীপুত্র। কৃষ্ণ অনুনয়সহকারে রাজাদের বললেন, ধর্ম্মেণ লব্ধেতি ধর্মানুসারেই ইনি দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন। যুদ্ধবিশারদ বিস্মিত রাজশ্রেষ্ঠরা যুদ্ধ পরিত্যাগ করে নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

সমবেত জনতা বলাবলি করতে লাগল, ব্রাহ্মণপ্রধান এই রঙ্গমঞ্চে, ব্রাহ্মণরাই শেষ পর্যন্ত পাঞ্চালীকে বরণ করলেন। মৃগচর্ম পরিধানে যাঁদের সেই ভীমসেন ও ধনঞ্জয় অর্জুন, ব্রাহ্মণদের ভিড়ের মধ্য হতে নিজেদের অতি কষ্টে মুক্ত করে যাত্রা করলেন গৃহের উদ্দেশ্যে। শত্রুরা তাঁদের কোন ক্ষত সৃষ্টি করতে পারেননি। কৃষ্ণা দ্রৌপদী দুজনের সহযাত্রিণী। পূর্ণিমার মেঘমুক্ত আকাশের চন্দ্র ও সূর্যের মতো গৃহমুখী দুই ভাই, ভীম ও অর্জুন।মা কুন্তী নানা বিপদের কথা চিন্তা করে ব্যাকুল হলেন। ভিক্ষার সময় অতিক্রান্ত হল অথচ পুত্ররা ফিরলেন না। তাঁর আশঙ্কা, ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা কিংবা মায়াবী রাক্ষসেরা পাণ্ডবদের পরিচয় জেনে নিয়ে তাঁদের হত্যা করেনি তো? পুত্রস্নেহাকুলা মায়ের প্রাণে নানা অমূলক চিন্তার আনাগোনা। মহাত্মা ব্যাসদেবের বচন কী অসত্য? অবশেষে মানুষ যখন গভীর নিদ্রাতুর, মেঘাবৃত এক দুর্দিনে, অপরাহ্নের শেষবেলায়, মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের মতো ব্রাহ্মণপরিবৃত জিষ্ণু অর্জুন কুম্ভকারের গৃহে প্রবেশ করলেন।

সাধারণ প্রার্থী ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাণ্ডবরা দ্রুপদরাজকন্যার স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রতিযোগিতার শর্তাবলি এবং উপস্থিত রাজাদের পরাভব,হয়তো নিপুণ তীরন্দাজ অর্জুনের প্রতিযোগীসুলভ মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। প্রতিভাবানেরা নিজেকে প্রমাণ করবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননা। অর্জুনও পারেননি। তিনি জয়ী হলেন, রাজকন্যার বরমাল্য লাভ করলেন। কিন্তু উপস্থিত উন্নাসিক, অভিজাতরা কিছুতেই তা, মেনে নিতে পারলেন না। কারণ হল, বিজয়ী, নামগোত্রহীন এক সাধারণ ব্রাহ্মণমাত্র, না আছে তাঁর কুলগৌরব, না কোন প্রখ্যাত পরম্পরার অধিকারী তিনি। বিজয়ী অর্জুনের বংশগরিমা তখনও প্রকাশ পায়নি। তার ওপরে ছিল কন্যার পিতার দ্বিধাহীন স্বীকৃতি। রাজা দ্রুপদ তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সৎ ছিলেন। গর্বোদ্ধত ক্ষত্রিয় রাজাদের গ্লানিময় পরাজয় এবং পুরস্কৃত ব্রাহ্মণের প্রতিভার স্বীকৃতি যেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এক অপ্রীতিকর হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টি করল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাই প্রকৃতপক্ষে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। একটিই পুরস্কার,অসফল সকলেই পরাজিতের ভূমিকায় গ্লানিময় আত্মপীড়নের শিকার হন। এর বিস্ফোরণ ঘটে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, বিজয়ীর প্রতি অপরিসীম অবমাননাময় বিষোদ্গারের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত ঈর্ষার বিষয়, সেই ব্যক্তির জীবনহানির সম্ভাবনার মধ্যে, নিহিত থাকে অন্তিম পরিণতি। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে সেটাই ঘটেছে। অর্জুনের বিজয়ে ঈর্ষাতুর রাজাদের প্রথম লক্ষ্য ছিলেন রাজা দ্রুপদ। সাধারণের শরণাপন্ন রাজার প্রাণরক্ষার্থে এগিয়ে এলেন সাধারণ দুই ব্রাহ্মণ কুমার। অতিপ্রাকৃত শক্তিধর দুই ভাই সশস্ত্র রাজাদের মোকাবিলায় অস্ত্রধারণ করেছেন। তাঁদের না ছিল তীরধনুক না অন্য কোন সামরিক উপাদান। অর্জুন, সদ্য গুণ পরিয়েছিলেন যে ধনুকটিতে সেটিই তুলে নিলেন। ভীম হাতে নিলেন সদ্য নিজহাতে উৎপাটিত একটি গাছ। যাঁরা প্রতিভাবান তাঁদের কোনও যুদ্ধের উপাদান প্রয়োজন হয় না। তাঁদের আন্তরশক্তি ও দীর্ঘ অনুশীলনলব্ধ জ্ঞানেই তাঁরা ঋদ্ধ। জহুরী দর্শকের চোখ চিনে নিতে পারে সঠিক রত্নটিকে। কৃষ্ণ সেই জহুরী। তিনি ছদ্মবেশের আড়ালে প্রকৃত প্রতিভাধর পাণ্ডপুত্র দুটিকে চিনতে পেরেছেন। প্রখ্যাত বীর কর্ণ ও মদ্ররাজ শল্য হার মেনেছেন যথাক্রমে অর্জুন ও ভীমের কাছে।

নাম ও পরিচয়হীন দুই পাণ্ডুপুত্র, প্রতিভার স্বীকৃতি পেলেন। ধনুকে গুণ পরিয়ে,প্রতিযোগিতার শর্তাবলি পালন করেও যে স্বীকৃতি সহজলভ্য হয়নি। অর্জুন, বিখ্যাত বীরযোদ্ধা কর্ণকে পরাজিত করে, যেন প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। মদ্ররাজ শল্যকে ভূপতিত করে ক্ষত্রিয়দের রাজকীয় শক্তিমত্তাকে যেন ধূলিসাৎ করলেন ভীম। অর্জুন নিজেকে এর আগেও প্রমাণ করেছেন অনেকবার। কিন্তু এবারে তিনি সমগ্র ভূখণ্ডের রাজাদের অহমিকায় আঘাত করে নিজেকে প্রমাণ করলেন, তিনিই অদ্বিতীয়,অনন্য তীরন্দাজ।

নিজেকে অদ্বিতীয় প্রমাণের পথটি কিন্তু গ্লানিময়, ক্লেদাক্ত। ঈর্ষাদ্বেষময় বন্ধুর সে পথে আনাগোনা শুধুমাত্র ব্যতিক্রমী প্রতিভাধরদের। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিজয়মাল্য জোটে যে ভাগ্যবানের কণ্ঠে সেখানেও পরিচয়ের তকমা প্রয়োজন হয়, তাঁর প্রতিভা চিহ্নিতকরণ শুরু হয় বংশ, কুলমর্যাদার নিরিখে। এখনও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত গতিতে চলে আসছে ভরতবংশীয়দের পরম্পরায়। মহাভারতীয় প্রেক্ষিতে ছদ্মবেশধারী নামগোত্র পরিচয়হীন অর্জুনের প্রতিভা যে প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে—বিষয়টি নিয়ে পাঠকদের ভাবনার অবকাশ আছে কী?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content