সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মা কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে, পঞ্চ পাণ্ডব, চলেছেন রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের উৎসবমুখর পাঞ্চালদেশে। পথে বহু ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা হল। ব্রাহ্মণদেরও গন্তব্য একই। পাণ্ডবরা ব্রহ্মচারীর বেশ ধারণ করে আছেন। পাণ্ডবরা জানালেন, তাঁরা একচক্রানগর থেকে আসছেন। ব্রাহ্মণরা উৎসাহভরে পরামর্শ দিলেন, একসঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁরা চলেছেন সেই পাঞ্চালদেশে, সেখান অদ্ভুত মহোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। রাজকন্যার স্বয়ংবর সভা অনুষ্ঠিত হবে, দ্রুপদরাজ যজ্ঞসেনের কন্যার, যিনি যজ্ঞবেদী থেকে উদ্ভূতা, পদ্মপাতার মতো যাঁর নয়ন, শারীরিক সৌন্দর্যে যিনি অনিন্দিতা এবং দর্শনীয়া, সুকুমারী, উদারমনা, সেই দ্রৌপদী দ্রোণাচার্যের শত্রু ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী। তাঁর নীলোৎপলতুল্য অঙ্গের সুগন্ধ এক ক্রোশ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। এমন কন্যা ও তাঁর বরনির্বাচনের সেই অভাবনীয় মহোৎসব দেখতে চলেছেন ব্রাহ্মণরা। নানা দেশ থেকে, মহারথ রাজারা ও দর্শনীয় তরুণ রাজপুত্ররা,সেই কন্যার বরমাল্য গ্রহণের আশায় সমবেত হয়েছেন।

এই অভিজাত রাজপুরুষরা কত নিয়মনিষ্ঠ যজ্ঞ করেছেন, প্রভূত দক্ষিণা দান করেছেন, বেদাধ্যয়ন করেছেন। এঁরা সকলে পবিত্র, মহান, যথানিয়মে ব্রতপালনকারী, সেই সঙ্গে অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত। তাঁরা বিজয়ীর সম্মান লাভ করবার জন্য ধন, গরু, সবরকমের ভোজ্য ও পানীয় দান করবেন। ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্য সেই সব দানগ্রহণ এবং স্বয়ংবর দর্শন ও আনন্দানুভব। তারপরে প্রস্থান। আরও কত দেশ দেশান্তর থেকে সেখানে আসবেন অভিনেতা, স্তুতিপাঠক, নর্ত্তক, পুরাণপাঠক, বংশপরিচয়দাতা, বাহুবলীরা। ব্রাহ্মণরা, পঞ্চপাণ্ডবদের প্রস্তাব দিলেন, এই সব দেখে, কৌতূহলপূরণ ও দানগ্রহণ করে আমাদের সঙ্গেই ফিরে আসবেন। এবং কৌতূহলং কৃত্বা দৃষ্ট্বা চ প্রতিগৃহ্য চ। সহাস্মাভির্মহাত্মানঃ পুনঃ প্রতিনিবর্ৎস্যথ।।

ভাগ্য সহায় হলে, ব্রাহ্মণবেশী, দেবতুল্য প্রিয়দর্শন, পাণ্ডবদের মধ্যে কোন একজনকে কৃষ্ণা বরণ করে নিতেও পারেন। সৌভাগ্যক্রমে একটি ভাই দর্শনীয়,মহা বলশালী। তিনি জ্যেষ্ঠর আদেশে বহু ধন জয় করে আনতেও পারেন। যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন, পরমং ভো গমিষ্যামো দ্রষ্টুঞ্চৈব মহোৎসবম্। ভবদ্ভিঃ সহিতাঃ সর্ব্বে কন্যায়াস্তং স্বয়ংবরম্।। আমরা আপনাদের সঙ্গে সেই মহোৎসব ও কন্যার স্বয়ংবর দেখতে যাব।
পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণদের নির্দেশানুযায়ী, দ্রুপদরাজার অধিকৃত দক্ষিণ পাঞ্চালদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সেখানে পবিত্রচিত্ত, তপস্যার ফলে নিষ্পাপ, মহান, মহর্ষি বেদব্যাসের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল।যথাবিধি প্রণামনিবেদন ও আশীর্বাদগ্রহণ করে, কুশল বিনিময়ান্তে মহর্ষি বেদব্যাসের অনুমতি নিয়ে, পাণ্ডবরা দ্রুপদভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। অবশেষে বেদজ্ঞ, পূতচরিত্র, মধুর ও প্রিয়ভাষী পাণ্ডবরা গন্তব্য পাঞ্চালদেশে এসে পৌঁছলেন। নগর ও সেনানিবাস দর্শন করে তাঁরা এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তাঁরা ব্রাহ্মণদের ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করলেন। সেই দেশবাসীদের কাছে, বীর পাণ্ডবদের পরিচয় অজ্ঞাত রয়ে গেল। দ্রুপদরাজার সর্বদাই মনোগত অভিলাষ ছিল, তৃতীয় পাণ্ডপুত্র অর্জুনকেই তিনি কন্যাদান করবেন। তিনি এটি প্রকাশ করেননি কখনও। দ্রুপদরাজ অর্জুনের শক্তিমত্তার কথা স্মরণ করে এমন একটি ধনুক নির্মাণ করলেন যেটি অন্য কেউ অবনত করতে পারবেন না। রাজার উদ্দেশ্য ছিল, অর্জুনকে খুঁজে বের করা।

দ্রুপদরাজ একটি কৃত্রিম যন্ত্র ও তার সংলগ্ন একটি লক্ষ্যও নির্মাণ করলেন। রাজা দ্রুপদ ঘোষণা করলেন, ইদং সজ্যং ধনুঃ কৃত্বা সজ্জৈরেভিশ্চ সায়কৈঃ। অতীত্য লক্ষ্যং যো বেদ্ধা স লব্ধা মৎসুতামিতি।। গুণ আরোপ করে, সজ্জিত ধনুক নিয়ে, এই বাণগুলি দ্বারা নিম্নস্থিত যন্ত্রটি অতিক্রম করে, যিনি লক্ষ্য বিদ্ধ করতে পারবেন, তিনিই আমার কন্যাকে লাভ করবেন। এই ঘোষণা শুনে এগিয়ে এলেন রাজারা, কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন প্রভৃতি কৌরবরা, স্বয়ংবরদর্শনার্থী মহান ঋষিরা। দেশ দেশান্তর থেকে ব্রাহ্মণরা দেখতে এসেছেন এই মহাসমারোহ। দ্রুপদ রাজা, অতিথি রাজাদের, যথোপযুক্ত আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। পুরবাসীরাও বাদ নেই। তাঁরাও এই স্বয়ংবর দর্শনেচ্ছু। তাঁরা যেন মহাসাগরের কলরোল সৃষ্টি করে মঞ্চের ওপরে উঠে বসলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৬: প্রশাসকের প্রাণঘাতী ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিফল ও যুগান্তরেও রামায়ণের অমল মহিমা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

শিশুমারতুল্য আকৃতিবিশিষ্ট নক্ষত্রপুঞ্জের সমাহার নারায়ণের মাথাটি যে দিকে সেই উত্তরের মাঙ্গলিক সমভূমিতে আসন গ্রহণ করলেন রাজারা। স্বয়ংবরের জন্য নির্মিত হয়েছে বিশাল সভামণ্ডপ। মণ্ডপটিকে ঘিরে রয়েছে প্রাসাদগুলি, প্রাচীর ও পরিখা এবং বড় বড় তোরণ রয়েছে সেখানে। বিচিত্র চাঁদোয়ায় অলঙ্কৃত জায়গাটি। বহু ভেরী সমাকীর্ণ, অগরুর সুন্দরসৌরভে পরিপূর্ণ, চন্দনজলে সিক্ত, ফুলের মালায় সজ্জিত সেই সভামণ্ডপ।কৈলাশ পর্বতের শৃঙ্গতুল্য উঁচু ও শুভ্রবর্ণের নির্মিত বহু প্রাসাদগুলিতে মণিময় বেদীগুলি সোনার ঝালর দেওয়া বস্ত্রে আচ্ছাদিত ছিল।

প্রাসাদগুলিতে মালায় বেষ্টিত, অগরুর সুগন্ধযুক্ত সিঁড়িগুলি ছিল অনায়াসে আরোহণযোগ্য।হাঁসের গায়ের মতো সাদা, যোজনব্যাপী সুগন্ধযুক্ত,প্রাসাদের বিশালত্বহেতু মোটেই সংকীর্ণ ছিল না দরজাগুলি। সেখানে শয়ন ও আসনের সুবন্দোবস্ত ছিল। বহু ধাতু দিয়ে নির্মিত প্রাসাদগুলির অঙ্গ, হিমালয়ের শৃঙ্গতুল্য শোভা ধারণ করেছিল। সেই সাততলা প্রাসাদগুলিতে সালঙ্কার রাজারা পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করে আসন গ্রহণ করলেন।

উপস্থিত জনতা দেখলেন, অনন্যসাধারণ অধ্যবসায়ী ও শৌর্যশালী, লোকসাধারণের প্রতি উদার, ব্রাহ্মণদের প্রতি সদাশয়, মহান হৃদয়, নিজ রাষ্ট্রের সুরক্ষক, শ্রেষ্ঠ রাজারা, কৃষ্ণ অগরু প্রভৃতি প্রসাধন দিয়ে সজ্জিত হয়ে মণ্ডপে উপবেশন করেছেন। পুরবাসী ও জনপদবাসীরা কৃষ্ণাকে দেখার আশায় মঞ্চের শ্রেষ্ঠ জায়গাগুলি দখল করলেন। পাণ্ডবরা, সেই ব্রাহ্মণদের দলে উপবেশন করে, পাঞ্চালরাজের সম্পদের উত্তম প্রদর্শনী দেখতে থাকলেন। বহুদিন ধরে জনসমাগম বৃদ্ধি পেল,বহু রত্ন দান চলতে থাকল। নট ও নর্ত্তকদের শোভা প্রদর্শনের শেষ নেই।

অবশেষে, ষোলদিনের দিন, গন্ধ, চন্দন দিয়ে প্রসাধন সেরে, সিক্তদেহে, সুন্দর বসনে ভূষণে সেজে, সোনার মালা হাতে নিয়ে সেই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূতা হলেন দ্রৌপদী। দ্রুপদবংশীয়দের মন্ত্রজ্ঞ, পবিত্র, ব্রাহ্মণ পুরোহিত দর্ভঘাস ছড়িয়ে, যজ্ঞের আগুন জ্বেলে, ঘৃতাহুতি দিলেন। হোমান্তে ব্রাহ্মণদের স্বস্তি বাক্য উচ্চারণের পরে, চারিদিকের বাজনা বন্ধের নির্দেশ দিলেন পুরোহিত। মঞ্চ নিঃস্তব্ধ হলে, মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠস্বর যাঁর, দ্রৌপদীর সেই ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন, কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মানুসারে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন। মেঘের গুরুগর্জনতুল্য কিন্তু কোমল সঙ্গত অর্থযুক্ত স্বরে ধৃষ্টদ্যুম্ন বাক্য উচ্চারণ করলেন। ইদং ধনুর্লক্ষ্যমিমে চ বাণাঃ শৃণ্বন্ত মে ভূপতয়ঃ সমেতাঃ। ছিদ্রেণ যন্ত্রস্য সমর্পয়ধ্বং লক্ষ্যং শিতৈর্ব্যোমচরৈর্দশার্দ্ধৈঃ।।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

সমবেত রাজগণ, আপনাদের অবগতির জন্যে জানাই, সামনে রয়েছে এই লক্ষ্যবস্তু আর আপনাদের হাতিয়ার এই বাণগুলি। শাণিত তীরগুলি শূন্যে আরোপ করে যন্ত্রটির মধ্যবর্তী ছিদ্রপথ অতিক্রম করে লক্ষ্য বিদ্ধ করুন। এই কাজটি করতে পারলেই কেল্লা ফতে।অভিজাতবংশীয়, রূপবান, বলশালী যে পুরুষ এই মহৎ কাজটি সম্পন্ন করতে পারবেন তিনিই আজ আমার ভগিনীকে স্ত্রীরূপে লাভ করবেন।এ বিষয়ে আমি মিথ্যা বলছি না। এতন্মহৎ কর্ম্ম করোতি যো বৈ কুলেন রূপেণ বলেন যুক্তঃ। তস্যাদ্য ভার্য্যা ভগিনী মমেয়ং কৃষ্ণা ভবিত্রী ন মৃষা ব্রবীমি।।

এর পরবর্তী পর্যায়ে উপস্থিত রাজাদের পরিচয়দানের পালা। ধৃষ্টদ্যুম্ন ভগিনীকে উদ্দেশ্য করে, প্রথমেই ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের পরিচয় জ্ঞাপন করলেন। কত না তাঁদের নামের বাহার। দুর্যোধন, দুর্বিষহ, দুর্ম্মুখ, দুষ্প্রধর্ষণ, বিবিংশতি, বিকর্ণ, সহ, দুঃশাসন, যুযুৎসু, বায়ুবেগ, ভীমবেগ প্রভৃতি শত পুত্র, জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন ও বন্ধুবর কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে রাজকন্যার বরমাল্যলাভের আশায় এসেছেন। অগণিত মহান ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠরাও উপস্থিত হয়েছেন। এসেছেন, শকুনি, সৌবল, বৃষক, বৃহদ্বল এই চার গান্ধারদেশের রাজপুত্র।

গুরুপুত্র শ্রেষ্ঠ অস্ত্রজ্ঞ অশ্বত্থামা ও ভোজরাজ দুজনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন এই স্বয়ংবর সভায়। সহদেব, জয়ৎসেন, মগধরাজ মেঘসন্ধি, এঁরাও এসেছেন। পিতা ও পুত্ররা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সমবেত হয়েছেন। যেমন, বিরাটরাজ এসেছেন শঙ্খ ও উত্তর নামের দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে।তেমনই সুকেতুরাজের সঙ্গে আছেন, বার্দ্ধক্ষেমি, সুবর্চ্চা, সেনাবিন্দু, সুনামা ও সুবর্চ্চা নামের পুত্ররা। দ্রৌপদীর বরমাল্যের প্রার্থী তালিকায় আছেন, সুচিত্র, সুকুমার, বৃক, সত্যধৃতি, সূর্য্যধ্বজ, রোচমান, নীল, চিত্রায়ুধ রাজা। বিদণ্ড ও দণ্ড নামের পুত্রসহ উপস্থিত রয়েছেন জলসন্ধ। পৌণ্ড্রক, বাসুদেব এবং শৌর্যশালী ভগদত্ত। কলিঙ্গরাজ, তাম্রলিপ্তের নৃপতি, পত্তনের ভূপতি, সপুত্র শক্তিমান মদ্ররাজ শল্য—এঁরাও উপস্থিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৯: শ্রীমায়ের ভক্তের গ্রামে তীর্থদর্শন

রুক্মাঙ্গদ ও রুক্মরথের সঙ্গে কুরুবংশীয় সপুত্র সোমদত্ত এসেছেন। সমবেত হয়েছেন, তিন বীর—ভূরি, ভূরিশ্রবা এবং শল। কাম্বোজদেশীয় সুদক্ষিণ ও পুরুবংশীয় দৃঢ়ধন্বাও উপস্থিত আছেন। বৃহদ্বল, সুষেণ, উশীনরপুত্র শিবি এবং চৌরহন্তা করূষের রাজাও এসেছেন। বলরাম, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্নপুত্র, গদ, অক্রুর প্রভৃতি বৃষ্ণিবংশীয়রাও উপস্থিত হয়েছেন। ভগীরথ, বৃহৎক্ষেত্র, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, বৃহদ্রথ, বাহ্লিক এবং মহাবীর শ্রুতায়ু এসেছেন। এসেছেন, উলুক, কৈতব, চিত্রাঙ্গদ, শুভাঙ্গদ, বৎসরাজ, কোশলরাজ, পরাক্রমশালী শিশুপাল এবং জরাসন্ধ।

দ্রুপদপুত্র ভগিনী পাঞ্চালীকে জানালেন, দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভের আশায় সমবেত হয়েছেন নানা জনপদের অধীশ্বর এবং পৃথিবীখ্যাত ক্ষত্রিয়রা। এই সব শৌর্যশালী রাজারা তোমার জন্য লক্ষ্যভেদ করতে অগ্রণী হবেন। এনাদের মধ্যে যিনি লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবেন তাঁকেই বরণ করবে তুমি। এতে ভেৎস্যন্তি বিক্রান্তাস্ত্বদর্থে লক্ষ্যমুত্তমম্। বিধ্যেত য ইদং লক্ষ্যং বরয়েথাঃ শুভেঽদ্যে তম্।।

অভিজাত কুণ্ডল প্রভৃতি আভরণে সজ্জিত সালঙ্কার যুবকরা আত্মশক্তি ও অস্ত্রবিদ্যাবলে নিজেদের পারদর্শী মনে করে পরস্পরকে প্রতিপক্ষীয় স্পর্ধা দেখাতে লাগলেন। উদ্যত আয়ুধসহ, লক্ষ্যভেদের উদ্দেশ্যে, আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তাঁরা। রূপ, শৌর্য, বংশ, চরিত্র, ঐশ্বর্য, যৌবন এই সবকিছুই তাঁদের আয়ত্তাধীন। তাই তাঁরা যেন হিমালয়ের প্রমত্ত গজশ্রেষ্ঠর তুল্য দর্প প্রকাশ করতে লাগলেন। একে অপরের দিকে স্পর্ধাভরে তাকিয়ে, কামনাজনিত সঙ্কল্পে রোমাঞ্চিত হয়ে, নিজেদের রাজকীয় আসন থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। প্রত্যেকে এমন মনোভাব প্রকাশ করলেন, কৃষ্ণা মমৈবেতি কৃষ্ণা আমারই হবেন। পুরাকালে পার্বতী উমাকে লাভের আশায় যেমন দেবতারা সমবেত হয়েছিলেন তেমনই ক্ষত্রিয়কুল রাজকন্যাকে জয়ের ইচ্ছায়, রঙ্গমঞ্চে শোভা বিস্তার করলেন। কামনার জ্বালায়, রাজারা পরস্পরের মিত্র হয়েও, দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিদ্বেষ।

এই মহা সমারোহ দেখতে উপস্থিত হলেন একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, অশ্বিনীকুমার দুজন, সাধ্য ও মরুদ্গণ এবং যমকে সামনে রেখে স্বয়ং কুবের।বাদ গেলেন না দৈত্যরা, গরুড়বংশীয়রা, নাগেরা, দেবর্ষিবৃন্দ, গুহ্যকরা, চারণেরা, বিশ্বাবসু, নারদমুনি, পর্ব্বতমুনি এবং অপ্সরাদের সঙ্গে নিয়ে গন্ধর্বরা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

জগদ্বিখ্যাত রাজাদের সমাবেশে সকলে কিন্তু দ্রৌপদীর বরমাল্যলাভের আশায় পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হননি। বলরাম, কৃষ্ণ, বৃষ্ণিবংশীয়রা, অন্ধকবংশীয়রা এবং মুখ্য যদুবংশীয় পুরুষেরা ছিলেন কেবলমাত্র দর্শনার্থী। মত্ত হাতির মতো বলিষ্ঠগঠন যাঁদের, ভস্মাবৃত আগুনের মতো গুপ্ত যাঁদের আকৃতি, একটি প্রস্ফুটিত কমলকে ঘিরে অবস্থানরত পাঁচটি গজশ্রেষ্ঠসদৃশ পঞ্চ পাণ্ডবকে দেখামাত্র, কৃষ্ণ চিনতে পারলেন। কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, ভীম,অর্জুন,নকুল ও সহদেবের বিষয়ে অবহিত করে, তাঁদের প্রতি বলরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বলরাম, ধীরে ধীরে পাণ্ডবদের দেখে, খুশিমনে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। সমবেত রাজাদের মনোযোগ ও দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে দ্রৌপদীর দিকে। তাঁরা পাণ্ডবদের দেখতে পেলেন না। হাই তুলে, রক্তিম নয়নে ঠোঁট কামড়াতে লাগলেন। পঞ্চপাণ্ডবেরও একই দশা, দ্রৌপদীকে দেখে কামনার শরে বিদ্ধ হয়েছেন তাঁরা।

ব্রাহ্মণদের সহযাত্রী হয়ে পঞ্চ পাণ্ডব এক অদৃষ্টপূর্ব সমারোহের দর্শক হতে চললেন পাঞ্চালদেশে। তাঁদের মূলত উদ্দশ্য ছিল দানগ্রহণ এবং নিছক এক স্বয়ংবরদর্শনের আনন্দানুভব। চালচুলোহীন পাণ্ডবদের খাদ্য ও বাসস্থানের কোন নির্দিষ্ট স্থিরতা নেই তখন।তাঁদের সুঠাম দেহধারী, দেবতুল্য রূপবান, প্রিয়দর্শন ভাইটিকে রাজকন্যার মনে ধরতেও পারে এমন কল্পনার অবকাশও তাঁদের ছিল না। এই স্বয়ংবর যেন দ্রুপদরাজার পরিকল্পনার রূপরেখায় যেন রাজাদের সামর্থ্য প্রদর্শনের, নিজেদের শক্তি প্রমাণের জায়গা হয়ে উঠল। যে কোনও লক্ষ্যপূরণে শক্তি, সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন।

রাজারা জন্মসূত্রে সেই সামর্থ্য অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। একটি প্রতিযোগিতায় সুবিধাবাদী সম্প্রদায় (Privileged class) সর্বদাই সুবিধা ভোগ করে থাকে। এখানেও সেই একই ব্যবস্থা। ক্ষত্রিয় রাজরাজরাদের জন্যে রাজকীয় জাঁকজমকপূর্ণ যে বসবাসের ও রঙ্গমঞ্চে আসনের ব্যবস্থা যথেষ্ট আড়ম্বরপূর্ণ, কোনও ত্রুটি নেই সেখানে। একদা পরস্পর মিত্র রাজারা এখন নিজেরা যুযুধান, এ যুদ্ধ মানসযুদ্ধ। যে কোনও প্রতিযোগিতাই এক অস্বাস্থ্যকর মানসিক বিষাক্ত পরিবেশ তৈরী করে।এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। বিষদৃষ্টিতে স্পর্ধাপূর্ণ আস্ফালন তাঁদের হাবভাবের পরিভাষা যেন।

যে কোনও দুরূহ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মানদণ্ড কঠিন শর্তসাপেক্ষ হয়ে থাকে। অগ্নিকন্যা যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী, যজ্ঞবেদী হতে যাঁর উত্থান, আগুন যাঁর পরিচিতি সেই কন্যা (Signature brand) সহজলভ্যা নন। কঠিন পরীক্ষার ফল সবসময়েই মূল্যবান, দুষ্প্রাপ্য হয়ে থাকে। তীক্ষ্ণবাণে বিদ্ধ করতে হবে মাছের চোখ।তীক্ষ্ণমেধা, অনুশীলন,অধ্যবসায় আয়ত্তে আনে দুরূহ ফল। তবে সেই মেধাকে উত্তীর্ণ হতে হয় রেশারেশির সঙ্কীর্ণ পথ, যেমন শাণিত তীরের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে, পারি দিতে হয় সঙ্কীর্ণ ছিদ্রপথ।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের বরমাল্যলাভের প্রতিযোগিতায় সমবেত হয়েছেন পৃথিবীখ্যাত রাজারা। কামনার গন্ধ আমোদিত সভামণ্ডপ। যেখানে পিতা পুত্র, শত্রু মিত্র সকলেই এক অপরের প্রতিযোগী। সেখানে বাছবিচার নেই। কে আগে রাজকন্যার দুর্লভ বরমাল্যটি লাভ করবে সেই আনন্দে বিভোর হয়ে, দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণদের ভিড়ে, ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মিশে থাকা পাণ্ডবদের দেখতে পাননি। একমাত্র লক্ষ্য, দ্রৌপদীর রূপোপভোগ। মুগ্ধবিস্ময়ে তাঁরা সুখস্বপ্নে বিভোর। মনে ধূমায়িত প্রতিপক্ষীয় রাজাদের প্রতি বিদ্বেষবাষ্প। আর হাবভাব যেন যুদ্ধবিজয়ীর। আত্মতুষ্টির ইচ্ছা, কামতৃষ্ণা প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে পিতা পুত্রকে, বন্ধু বন্ধুকে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্লিপ্ত দর্শকরা যোগ্য প্রতিযোগীদের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন। কৃষ্ণ এমন একজন দর্শক যিনি শক্তিমান সবলদেহী পাণ্ডবদের চিনতে পেরেছেন কারণ স্বয়ংবরে কোন প্রত্যাশা নিয়ে তিনি আসেননি। তাঁর মন কামগন্ধের দূষণমুক্ত। নৈর্ব্যক্তিক পক্ষপাতহীন দর্শকের ভূমিকায় যোগ্যতার পরীক্ষণ সম্ভব। কৃষ্ণ সেই আত্মতুষ্টির উদ্দেশ্যবিহীন এক দর্শকমাত্র যিনি অবলীলায় চিহ্নিত করতে পারেন শৌর্যশালী সমর্থ পুরুষাকারদের।

স্বয়ংবর সভায় সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী। যজ্ঞের বেদী, যাঁর জন্মের প্রেক্ষিত। প্রতিহিংসার যজ্ঞের বেদী থেকে তাঁর উত্থান। ধ্বংসের পথপরিক্রমাই তাঁর ভবিতব্য। পাণ্ডবরা জানেন, পিতামহ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস স্বয়ং জানিয়েছিলেন, পৃষতপৌত্রী ও দ্রুপদকন্যা অনিন্দিতা কৃষ্ণা তাঁদের বধূরূপে নির্দিষ্ট হয়ে আছেন। সেই নিয়তির নির্দেশ পালনের জন্যই যেন তাঁরা উপস্থিত হয়েছেন পাঞ্চালদেশে। জন্মমুহূর্তে দৈববাণী ঘোষিত হয়েছিল, সেই কন্যা কৌরবদের মহা আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে। অস্য হেতোঃ কৌরবাণাং মহদুৎপৎস্যতে ভয়ম্।

শৈশবহীনা সেই দ্রৌপদী জন্মমাত্রই পূর্ণযৌবনা। একজন ভারতীয় নারীর জন্মের প্রেক্ষাপট জীবনযজ্ঞের বেদীতে প্রদত্ত আহুতিরূপে। যেখানে আহুতি ও উজ্জীবনের মন্ত্র উচ্চারিত হয় একসঙ্গে। সেই সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখায় নারীর বিস্তার, পুরুষের লালসার আগুনের দহনজ্বালায় জ্বলে, আত্মশক্তির আগুনের দীপ্তিতে কিরণময়ী হয়েও, সহস্র প্রতিকূলতার সঙ্গে তার সহবাস। শেষে জ্বালাময়ী বহ্নিশিখা হয়ে ওঠাতেই তার অন্তিম পরিণতি। যাজ্ঞসেনী তাঁর উপস্থিতিমাত্রই উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে পুরুষতন্ত্রের প্রতীক ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠদের মধ্যে। পঞ্চ পাণ্ডবদের মধ্যেও কামনার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছেন। নিস্তার নেই কারও। তাঁর জীবনে পঞ্চ স্বামীকে একসূত্রে গেঁথে রেখে, প্রাণের উত্তাপে প্রাণবন্ত রেখেছেন শেষ পর্যন্ত। তবুও বংশের ধ্বংসের কারণরূপে চিহ্নিত হয়েছেন দ্রৌপদী।

এমনটাই বোধ হয় ভরতবংশীয়দের বধূদের নিয়তি। এই ভবিতব্যের বিধান মাথায় নিয়ে পুরুষতন্ত্রের ছত্রছায়ায় দিনযাপনের প্রত্যহিক দিনলিপি কী আজও তাঁরা এড়িয়ে যেতে পেরেছেন? অগ্নিশিখা হয়ে উঠেও, ধ্বংস না উত্তাপ কোনটির বিকিরণ তাঁদের যাপনচিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content