ছবি: প্রতীকী।
অরণ্যবাসে চলেছেন রাম। রজনী অবসানান্তে, বহুদূরে এগিয়ে গেলেন। যেতে যেতে অবশেষে ভোর হল। বড় সুন্দর মঙ্গলময় সে সকাল। রাম তাঁর প্রাতঃকালীন মাঙ্গলিক সন্ধ্যা ইত্যাদি সমাপন করলেন। রাজ্যের শেষ সীমায় উপস্থিত হলেন তিনি। কুসুমিত অরণ্যভূমি দেখতে দেখতে শ্রেষ্ঠ ঘোড়ায় টানা রথে দ্রুত অতিক্রম করে গেলেন অনেকটা পথ। কানে গেল, গ্রামবাসীদের ধিক্কার ও নিন্দা—কামের বশবর্তী রাজা দশরথের প্রতি ধিক্কার। হায় রানি কৈকেয়ী কি নির্মম, সেই পাপাচারিণী পাপিষ্ঠা বড়ই উগ্র মানসিকতার। তিনি ধর্মবিরুদ্ধ উপায় অবলম্বনে এই নিষ্ঠুর কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তিনি কি না ধার্মিক, দয়ালু, জিতেন্দ্রিয় পুত্রকে পাঠাচ্ছেন বনে। আহা, রাজা দশরথ, পুত্রের প্রতি এতটা স্নেহহীন কেন? যিনি এমন প্রজাহিতৈষী পুত্রকে পরিত্যাগ করলেন? অহো দশরথো রাজা নিস্নেহঃ স্বসুতং প্রতি। প্রজানামনঘং রামং পরিত্যক্তুমিহেচ্ছতি।।
কোশলরাজ শৌর্যবান রাম গ্রামবাসীদের এই সব বিরূপ মন্তব্য শুনতে শুনতে কোশলরাজ্য অতিক্রম করলেন। এর পরে পবিত্র স্রোতস্বিনী বেদশ্রুতি নদী পার হয়ে অগস্ত্য অধ্যুষিত দক্ষিণদিকে যেতে লাগলেন। দীর্ঘ সময় পার করে শীতল জলবিশিষ্ট সমুদ্র অভিমুখে ধাবমানা, যার তীরভূমিতে বিচরণ করছে অজস্র গাভী, এমন গোমতী নদী অতিক্রম করলেন তিনি। দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে পার হলেন হংস ও ময়ূরের ধ্বনিতে মুখরিত স্যন্দকা নদীও। রাম সীতাকে দেখালেন, প্রাচীনকালে বৈবস্বত মনু, নগরপরিবৃত যে বিশাল রাজ্য ইক্ষ্বাকুকে দান করেছিলেন, এই সেই রাজ্য। সারথিকে সম্বোধন করে মত্ত হংসের স্বরে বলে উঠলেন, সেই সময় কত দূরে? যখন, বনবাস থেকে ফিরে এসে পিতামাতার সঙ্গে সরযূতীরে ফুলে ফুলে ভরা বাগানে ভ্রমণ করে বেড়াব। কদাহং পুনরাগম্য সরয্বাঃ পুষ্পিতে বনে। মৃগয়াং পর্য্যটিষ্যামি মাত্রা পিত্রা চ সঙ্গতঃ।। মৃগয়াবিহারেই রাজর্ষিদের যত আনন্দ, সরযূবনে মৃগয়া, রামের মোটেই পছন্দ নয়। এই পৃথিবীতে ধনুর্দ্ধারী রাজর্ষিরা পশুবধেই প্রীত হতেন, কালক্রমে সাধারণ ও ধনুর্দ্ধারী বীরদেরও সেটি পছন্দের হয়ে ওঠে। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাম, সারথির সঙ্গে এমন অনেক মধুরালাপে রত হয়ে এগিয়ে চললেন।
কোশলরাজ শৌর্যবান রাম গ্রামবাসীদের এই সব বিরূপ মন্তব্য শুনতে শুনতে কোশলরাজ্য অতিক্রম করলেন। এর পরে পবিত্র স্রোতস্বিনী বেদশ্রুতি নদী পার হয়ে অগস্ত্য অধ্যুষিত দক্ষিণদিকে যেতে লাগলেন। দীর্ঘ সময় পার করে শীতল জলবিশিষ্ট সমুদ্র অভিমুখে ধাবমানা, যার তীরভূমিতে বিচরণ করছে অজস্র গাভী, এমন গোমতী নদী অতিক্রম করলেন তিনি। দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে পার হলেন হংস ও ময়ূরের ধ্বনিতে মুখরিত স্যন্দকা নদীও। রাম সীতাকে দেখালেন, প্রাচীনকালে বৈবস্বত মনু, নগরপরিবৃত যে বিশাল রাজ্য ইক্ষ্বাকুকে দান করেছিলেন, এই সেই রাজ্য। সারথিকে সম্বোধন করে মত্ত হংসের স্বরে বলে উঠলেন, সেই সময় কত দূরে? যখন, বনবাস থেকে ফিরে এসে পিতামাতার সঙ্গে সরযূতীরে ফুলে ফুলে ভরা বাগানে ভ্রমণ করে বেড়াব। কদাহং পুনরাগম্য সরয্বাঃ পুষ্পিতে বনে। মৃগয়াং পর্য্যটিষ্যামি মাত্রা পিত্রা চ সঙ্গতঃ।। মৃগয়াবিহারেই রাজর্ষিদের যত আনন্দ, সরযূবনে মৃগয়া, রামের মোটেই পছন্দ নয়। এই পৃথিবীতে ধনুর্দ্ধারী রাজর্ষিরা পশুবধেই প্রীত হতেন, কালক্রমে সাধারণ ও ধনুর্দ্ধারী বীরদেরও সেটি পছন্দের হয়ে ওঠে। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাম, সারথির সঙ্গে এমন অনেক মধুরালাপে রত হয়ে এগিয়ে চললেন।
কোশলদেশ অতিক্রম করতে উদ্যত রাম অযোধ্যানগরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে বিদায় সম্ভাষণ জনালেন। তিনি নিজবংশীয় রাজাদের পরিপালিতা নগরীশ্রেষ্ঠা অযোধ্যা ও অযোধ্যা নগরীর অধিষ্ঠাতৃদেবতাকে সম্ভাষণ করে জানালেন, তিনি পিতার ঋণ পরিশোধ করে বনবাস থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে পিতামাতার সঙ্গে মিলিত হবেন যখন, আবার দেখা হবে তাঁদের দুজনার। এ বার কোশলনগরবাসীদের কাছে বিদায় নেবার পালা। মনোহর, তাম্রবর্ণ, মহান রাম চোখভরা জল নিয়ে রুদ্ধকণ্ঠে অতি দীনভাবে জানপদবাসী পৌরদের জানালেন, তাঁর প্রতি পুরবাসীরা যথেষ্ট সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন। এখন কাজে যাওয়ার সময় হয়েছে। কারণ বেশীক্ষণ দুঃখভোগ কষ্টকর। তাই এখন তাঁরা যেন নিজেদের উদ্দেশ্যসাধনে তৎপর হন। অনুক্রোশো দয়া চৈব যথার্হং ময়ি বঃ কৃতঃ। চিরং দুঃখস্য পাপীয়ে গম্যতামর্থসিদ্ধয়ে।।
জনপদবাসীদের রামদর্শনের আশ মেটেনি তখনও। তবুও তাঁকে অভিবাদন করে প্রদক্ষিণ করলেন। বিদায় নিতে, মনে সায় নেই তাঁদের। কোথাও কোথাও অপেক্ষমান অবস্থায় বিলাপ করতে লাগলেন। সেই বিলাপরত জনতার দৃষ্টি, পিছনে ফেলে রাম অস্তগামী সূর্যের মতো এগিয়ে চললেন। রামের রথ অতিক্রম করল ধনধান্যে পরিপূর্ণ, দানশীল ব্যক্তির বাস কোশলদেশ, কল্যাণময়, ভয়ের সম্ভাবনামুক্ত, সুন্দর চৈত্য ও যূপে সমাকীর্ণ সেই দেশ, রমণীয় বন উপবন সে দেশের সৌন্দর্য, রমণীয় উপবন, আমবাগান, জলে পরিপূর্ণ সরোবর, পরিপূর্ণতার এমন শোভা সেখানে। সেখানকার মানুষজন হৃষ্টপুষ্ট। বহু গোকুলে পরিব্যাপ্ত চারিদিক। শ্রেষ্ঠ রাজারা রয়েছেন প্রজাসুরক্ষায়। ব্রহ্মনাদে মুখরিত সেই দেশ অতিক্রম করল রামের রথ।
জনপদবাসীদের রামদর্শনের আশ মেটেনি তখনও। তবুও তাঁকে অভিবাদন করে প্রদক্ষিণ করলেন। বিদায় নিতে, মনে সায় নেই তাঁদের। কোথাও কোথাও অপেক্ষমান অবস্থায় বিলাপ করতে লাগলেন। সেই বিলাপরত জনতার দৃষ্টি, পিছনে ফেলে রাম অস্তগামী সূর্যের মতো এগিয়ে চললেন। রামের রথ অতিক্রম করল ধনধান্যে পরিপূর্ণ, দানশীল ব্যক্তির বাস কোশলদেশ, কল্যাণময়, ভয়ের সম্ভাবনামুক্ত, সুন্দর চৈত্য ও যূপে সমাকীর্ণ সেই দেশ, রমণীয় বন উপবন সে দেশের সৌন্দর্য, রমণীয় উপবন, আমবাগান, জলে পরিপূর্ণ সরোবর, পরিপূর্ণতার এমন শোভা সেখানে। সেখানকার মানুষজন হৃষ্টপুষ্ট। বহু গোকুলে পরিব্যাপ্ত চারিদিক। শ্রেষ্ঠ রাজারা রয়েছেন প্রজাসুরক্ষায়। ব্রহ্মনাদে মুখরিত সেই দেশ অতিক্রম করল রামের রথ।
আরও পড়ুন:
ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২১: ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকির মধ্যে আপনি নেই তো? সতর্ক হতে হবে গোড়াতেই/১
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
এরপরে রামের যাত্রাপথের শোভা হল রাজাদের উপভোগ্য, আমোদে পরিপূর্ণ, মনোরম উদ্যানবিশিষ্ট, সুসমৃদ্ধ অনেক রাজ্য। ক্রমে এই পথপরিক্রমায়, শৈবালহীন, শীতলজলবাহিনী ঋষিদের সেবারতা ত্রিপথগামিনী গঙ্গা নদীকে দেখতে পেলেন। গঙ্গার অদূরে শ্রীসম্পন্ন ঋষিদের আশ্রম। জলকেলিতে ব্যস্ত আনন্দমগ্ন অপ্সরাদল। দেব, দানব, কিন্নরেরা এ নদীর যেন নিত্য সৌন্দর্য। প্রতিনিয়ত নাগবধূ ও গন্ধর্বপত্নীরা যে নদীর সেবা করেন এমন এই নদী। গঙ্গার দুই তীরে দেবতাদের শত শত ক্রীড়াভূমি ও উদ্যান বিরাজ করছে। দেবতাদের কারণেই আকাশগামিনী এই নদীর নাম হয়েছে ‘দেবনদী’। কোথাও জলসংক্ষোভের ফলে ভীষণা আবার কোথাও ফেনিল জলরাশিতে সুনির্মলহাসি নিয়ে দৃশ্যমানা সেই নদী।
গঙ্গা কত রূপ নিয়ে মনোরম বিভঙ্গে ধরা দিল রামের দৃশ্যপটে। তার জলরাশি কোথাও যেন বেণী আকৃতির আবার কোথাও জলের আবর্ত সৃষ্টি করে অপরূপা সে নদী। কখনও মন্দ্র গম্ভীর বেগবতীরূপে, কখনও বা প্রবাহবেগে ব্যাকুলা নদীটি গুরুগম্ভীর ধ্বনি সৃষ্টি করে, কোথাও বা ভৈরবরবে প্রবাহিত। এর বিশাল নির্মল বালুময় তটভূমিতে, পদ্মপূর্ণ নদীজলে স্নান করেন দেবতারা। গঙ্গা মুখরিত হয় সারসদের কলকাকলিতে। চক্রবাকেরা এর শোভা। নদী সর্বদাই বিহঙ্গদের কলরবে মুখর। নদীর কোথাও তীরের গাছগুলি মালার আকৃতি নিয়েছে, কোথাও বা প্রস্ফুটিত কমলদল, কোথাও বা পরিব্যাপ্ত কুসুমিত পদ্মবন শোভা বিস্তার করে বিরাজমান। কোথাও বিকশিতপ্রায় কুমুদকলি ও ফুলরেণু ছড়িয়ে মদমত্তা গঙ্গা বয়ে চলেছে। সেই জলধারায় নেই মালিন্য, মণিসদৃশ স্বচ্ছসলিলা গঙ্গার তীরভূমি সতত দিগ্গজ, বনগজ, দেবগজদের নিনাদে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
গঙ্গা কত রূপ নিয়ে মনোরম বিভঙ্গে ধরা দিল রামের দৃশ্যপটে। তার জলরাশি কোথাও যেন বেণী আকৃতির আবার কোথাও জলের আবর্ত সৃষ্টি করে অপরূপা সে নদী। কখনও মন্দ্র গম্ভীর বেগবতীরূপে, কখনও বা প্রবাহবেগে ব্যাকুলা নদীটি গুরুগম্ভীর ধ্বনি সৃষ্টি করে, কোথাও বা ভৈরবরবে প্রবাহিত। এর বিশাল নির্মল বালুময় তটভূমিতে, পদ্মপূর্ণ নদীজলে স্নান করেন দেবতারা। গঙ্গা মুখরিত হয় সারসদের কলকাকলিতে। চক্রবাকেরা এর শোভা। নদী সর্বদাই বিহঙ্গদের কলরবে মুখর। নদীর কোথাও তীরের গাছগুলি মালার আকৃতি নিয়েছে, কোথাও বা প্রস্ফুটিত কমলদল, কোথাও বা পরিব্যাপ্ত কুসুমিত পদ্মবন শোভা বিস্তার করে বিরাজমান। কোথাও বিকশিতপ্রায় কুমুদকলি ও ফুলরেণু ছড়িয়ে মদমত্তা গঙ্গা বয়ে চলেছে। সেই জলধারায় নেই মালিন্য, মণিসদৃশ স্বচ্ছসলিলা গঙ্গার তীরভূমি সতত দিগ্গজ, বনগজ, দেবগজদের নিনাদে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?
গঙ্গা যেন ফল, ফুল, পল্লব, গুল্ম ও বিহগের আভরণসাজে এক প্রমদা নারী। বিষ্ণুর চরণ থেকে যার উদ্ভব, দিব্য পাপহরা পবিত্র গঙ্গা। শিশুমার, কুমীর, সাপেদের রাজ্য এই নদী। রামচন্দ্র,সগরবংশীয় ভগীরথের তপস্যায় মহাদেবের জটাজুটমুক্ত, সারস ও ক্রৌঞ্চ কাকলিমুখর, সমুদ্রপত্নী গঙ্গার দেখা পেলেন শৃঙ্গবেরপুরের কাছে। সেই তরঙ্গোচ্ছ্বাসে আবর্তিতা গঙ্গা দর্শন করে রাম সারথিকে বললেন, ইহৈবাদ্য বসামহে। আজ এখানেই বাস করি। গঙ্গার অদূরে বহু প্রবাল ও পুষ্পবিশিষ্ট ইঙ্গুদী তরুমূলেই রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন রাম। কারণ, ওখান থেকে দেব, দানব, গন্ধর্ব, মৃগ, পন্নগ, পক্ষী সকলের সম্মানীয়া, পবিত্রসলিলা, কল্যাণময়ী, নদীশ্রেষ্ঠা, গঙ্গা তাঁর সম্মুখে সুন্দরভাবে দৃশ্যমানা। প্রেক্ষামি সরিতাং শ্রেষ্ঠাং সম্মান্যসলিলাং শিবাম্। দেবদানবগন্ধর্বমৃগপন্নগপক্ষিণাম্।। সেই সুন্দর ইঙ্গুদীবৃক্ষতলে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা রথ থেকে অবতরণ করলেন।
সেখানে রাজত্ব করেন রামের প্রাণপ্রিয় সখা নিষাদরাজ গুহ। গুহ ছিলেন বলশালী এবং একজন বিখ্যাত স্থপিতি। নিষাদপতি গুহের কানে গেল পুরুষব্যাঘ্র রামের আগমনবার্তা। তিনি বৃদ্ধ অমাত্য,জ্ঞাতি পরিবৃত হয়ে রামের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দূর হতে গুহকে আসতে দেখে রাম, লক্ষ্মণসহ এগিয়ে গেলেন। রামকে আলিঙ্গনে বেঁধে গুহ কাতর হয়ে বললেন, যেমন অযোধ্যা নগরী তোমার, তেমনই আমার এ রাজ্যও তোমার। হে রাম, এ বার বল, তোমার প্রিয় কাজ কী করতে পারি আমি? যথাযোধ্যা তথেদং তে রাম কিং করবাণি তে। কারই বা এমন অতিথিভাগ্য হয়?অতিথিসৎকারে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন গুহ।
সেখানে রাজত্ব করেন রামের প্রাণপ্রিয় সখা নিষাদরাজ গুহ। গুহ ছিলেন বলশালী এবং একজন বিখ্যাত স্থপিতি। নিষাদপতি গুহের কানে গেল পুরুষব্যাঘ্র রামের আগমনবার্তা। তিনি বৃদ্ধ অমাত্য,জ্ঞাতি পরিবৃত হয়ে রামের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দূর হতে গুহকে আসতে দেখে রাম, লক্ষ্মণসহ এগিয়ে গেলেন। রামকে আলিঙ্গনে বেঁধে গুহ কাতর হয়ে বললেন, যেমন অযোধ্যা নগরী তোমার, তেমনই আমার এ রাজ্যও তোমার। হে রাম, এ বার বল, তোমার প্রিয় কাজ কী করতে পারি আমি? যথাযোধ্যা তথেদং তে রাম কিং করবাণি তে। কারই বা এমন অতিথিভাগ্য হয়?অতিথিসৎকারে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন গুহ।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
তিনি সত্বর অর্ঘ্য নিয়ে এলেন। সুস্বাদু বিবিধ অন্ন প্রভৃতি আহার্যের আয়োজন করলেন। রামকে স্বাগত সম্ভাষণে আপ্যায়িত করে বললেন, এই সমগ্র পৃথিবী আপনারই। স্বাগতং তে মহাবাহো তবেয়মখিলা মহী। জানালেন, প্রভু রামের তাঁরা ভৃত্যমাত্র, রাম এ রাজ্য শাসন করুন। রামের জন্যে প্রস্তুত আছে—চব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় প্রভৃতি ভোজ্য এবং পানীয়, শ্রেষ্ঠ শয্যা, এ ছাড়াও ঘোড়াগুলির জন্যে আছে ঘাস। বন্ধুর কথার প্রত্যুত্তরে রাম বললেন, দূর হতে, স্নেহভরে পায়ে হেঁটে এসে যে সৌজন্য প্রদর্শন করেছেন গুহ, তাতেই আমরা সকলে সম্মানিত ও আপ্লুত বোধ করছি। অর্চ্চিতাশ্চৈব হৃষ্টাশ্চ ভবতা সর্ব্বদা বয়ম্। পদ্ভ্যামভিগমাচ্চৈব স্নেহসন্দর্শনেন চ।। রাম গাঢ় আলিঙ্গনে গুহের সার্বিক কুশল কামনা করলেন। জানালেন, তাঁর সৌভাগ্যক্রমে বন্ধু গুহকে নীরোগ দেখছেন। রাম বন্ধুর ভালবাসার উপহারগুলি গ্রহণ করতে পারবেন না। প্রতিগ্রহ এখন নয়। তার কারণ তিনি এখন বনবাসী তাপসদের ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এখন কেবলমাত্র কুশ, চির, অজিন ধারণ বিধেয় এবং ফলমূলই তাঁর ভোজ্যদ্রব্য। শুধু অশ্বখাদ্য আবশ্যক, অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই তাঁর। নাহমর্থী নান্যেন কেনচিৎ।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
এতেই আতিথ্যের গৌরব লাভ করবেন রাম। এই ঘোড়াগুলি পিতা দশরথের অতি প্রিয়। ওদের আপ্যায়নেই তিনি পরিতৃপ্ত হবেন। নিষাদরাজ গুহ ভৃত্যদের সত্বর অশ্বদের খাদ্য ও পানীয় দানের আদেশ দিলেন। রাম চিরবসন ধারণ করে সান্ধ্য উপাসনা সম্পন্ন করলেন। লক্ষ্মণ এনে দিলেন পানীয় জল।ভূমিশয্যায় শয়ন করলেন রাম ও সীতা। লক্ষ্মণ, সস্ত্রীক রামের পা ধুইয়ে দিয়ে অদূরবর্তী একটি গাছের আশ্রয়ে অবস্থান করলেন। নিষাদপতি গুহ, সারথি সুমন্ত্রর সঙ্গে একযোগে, লক্ষ্মণের সঙ্গে আলাপচারিতায় ধনুর্ধারণ করে সতর্ক প্রহরায় জেগে রইলেন সারা রাত। দশরথপুত্র রাম যিনি নিয়ত সুখেই অভ্যস্ত, কোন দুঃখের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই, তিনি আজ ভূমিশয্যায় শায়িত। এইভাবে অতিবাহিত হল দীর্ঘ রাত্রি।
যৌবনে উপনীত বনবাসে গমনোদ্যত রামের আছে সোন্দর্য উপভোগের প্রতি প্রবল অনুরাগ। তিনি বনবাসের যাত্রাপথের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করেছেন প্রতি মুহূর্তে, পিতার মতবিরুদ্ধ সমালোচনা শুনেছেন, প্রতিবাদ করেননি। প্রজাদের কাছে অনাকাঙ্খিত বিমাতা কৈকেয়ীর নিষ্ঠুর আচরণ। সেই বিমাতার প্রতি বিরূপ মন্তব্য তাঁর স্থৈর্য বিঘ্নিত করতে পারেনি। তিনি এগিয়ে চলেছেন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। একের পর এক নদী, জনপদ এবং পিতৃভূমি কোশলদেশ অতিক্রম করে চলেছেন।
যৌবনে উপনীত বনবাসে গমনোদ্যত রামের আছে সোন্দর্য উপভোগের প্রতি প্রবল অনুরাগ। তিনি বনবাসের যাত্রাপথের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করেছেন প্রতি মুহূর্তে, পিতার মতবিরুদ্ধ সমালোচনা শুনেছেন, প্রতিবাদ করেননি। প্রজাদের কাছে অনাকাঙ্খিত বিমাতা কৈকেয়ীর নিষ্ঠুর আচরণ। সেই বিমাতার প্রতি বিরূপ মন্তব্য তাঁর স্থৈর্য বিঘ্নিত করতে পারেনি। তিনি এগিয়ে চলেছেন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। একের পর এক নদী, জনপদ এবং পিতৃভূমি কোশলদেশ অতিক্রম করে চলেছেন।
ছবি: প্রতীকী।
মনে কি কোন পিছুটান নেই তাঁর? যৌবনের ধর্ম যে আবেগ, কোমল পেলব হৃদয়বৃত্তি। পুরুষোত্তম রাম তার ঊর্ধ্বে নন। নবীনদের মতোই তাঁরও আছে বংশগৌরবের অহংকার। ইক্ষ্বাকু বংশের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি তাঁর মনে চির জাগরুক। তাই অরণ্যের উদ্দেশে যাত্রাপথে, তিনি সগৌরবে স্ত্রীকে দেখান, পিতৃপুরুষ মনুর দান, নানা নগরী। চলেছেন অনির্দিষ্ট জীবনপথে, পিতামাতার সঙ্গে আবার কি দেখা হবে? কবে সরযূতীরে মিলিত হবেন প্রিয়জনদের সঙ্গে। প্রবাসে গমনোদ্যত এক ব্যাকুল যুবকের আকুল আর্তির প্রকাশ যেন।
ফিরে আসবেন অযোধ্যায় তবু পিতৃভূমির কাছে আভূমি নত হয়ে যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, নিবৃত্তবনবাসস্ত্বামনৃণো জগতীপতেঃ। পুনর্দ্রক্ষামি মাত্রা চ পিত্রা চ সহ সঙ্গতঃ।। বনবাসের শেষে পিতৃঋণ পরিশোধ করে পিতা মাতার সঙ্গে মিলিত হব যখন, তখন তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। আবেগে থরথর রাম। অযোধ্যানগরীর প্রতি বিদায়বার্তাটিতে তাঁর মনের তীব্র পিছুটান প্রকাশিত। নির্লিপ্ত উদাসীন তপস্বীর ছদ্ম আবরণ ভেদ করে, সাধারণ কোন মানুষের মতো তাঁর আবেগের দুরন্ত প্রকাশ মনোমুগ্ধকর। সেই আবেগের ঘোরে জনপদবাসীদের কাছে বিদায়বেলায়, মুহূর্তের জন্যে চোখ হয়েছিল সজল। কিন্তু পরমুহূর্তে আবেগ সংযত করে যেন রাজসত্তায় আদেশ দিলেন প্রজাদের, গম্যতামর্থসিদ্ধয়ে।
সকলে নিজের কাজে যান। পূর্বপুরুষ ভগীরথের স্মৃথিধন্য গঙ্গানদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে চেয়েছেন। নিষাদরাজ গুহ তাঁর প্রিয় সখা। সখার প্রীতি উপহার, সুস্বাদু আহার্য প্রত্যাখ্যান করেছের তপস্বীর বৈরাগ্যে। পিতার প্রিয় ঘোড়াদের আহার্য প্রার্থনা করেছেন বন্ধুর কাছে। একজন রাজা রাজত্ব গ্রহণ করবেন সুদীর্ঘ চোদ্দ বছর বনবাসান্তে। এতদিন অভিষেকের প্রস্তুতিপর্ব ছিল, সেটি রামের মনোজগতে রাজত্ব করেছে প্রচ্ছন্নভাবে। সাধারণ মানুষসম আবেগ, দুঃখ, সব হারানোর অসহায়তা, সুকুমারবৃত্তির যা কিছু সব ছাপিয়ে, সত্যরক্ষার প্রবল তাগিদে রাম হয়তো ক্রমশ লৌহমানবে পরিণত হয়েছিলেন। তাই অধুনা মন্দিরে দূরবর্তী বিগ্রহ হয়েও আদিকবি বাল্মীকির রাম, কোমল, পেলব, আবেগ ব্যাকুল যুবা, যিনি সাধারণের মনে অধরাই হয়তো রয়ে গেলেন যুগান্তরেও।—চলবে।
ফিরে আসবেন অযোধ্যায় তবু পিতৃভূমির কাছে আভূমি নত হয়ে যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, নিবৃত্তবনবাসস্ত্বামনৃণো জগতীপতেঃ। পুনর্দ্রক্ষামি মাত্রা চ পিত্রা চ সহ সঙ্গতঃ।। বনবাসের শেষে পিতৃঋণ পরিশোধ করে পিতা মাতার সঙ্গে মিলিত হব যখন, তখন তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। আবেগে থরথর রাম। অযোধ্যানগরীর প্রতি বিদায়বার্তাটিতে তাঁর মনের তীব্র পিছুটান প্রকাশিত। নির্লিপ্ত উদাসীন তপস্বীর ছদ্ম আবরণ ভেদ করে, সাধারণ কোন মানুষের মতো তাঁর আবেগের দুরন্ত প্রকাশ মনোমুগ্ধকর। সেই আবেগের ঘোরে জনপদবাসীদের কাছে বিদায়বেলায়, মুহূর্তের জন্যে চোখ হয়েছিল সজল। কিন্তু পরমুহূর্তে আবেগ সংযত করে যেন রাজসত্তায় আদেশ দিলেন প্রজাদের, গম্যতামর্থসিদ্ধয়ে।
সকলে নিজের কাজে যান। পূর্বপুরুষ ভগীরথের স্মৃথিধন্য গঙ্গানদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে চেয়েছেন। নিষাদরাজ গুহ তাঁর প্রিয় সখা। সখার প্রীতি উপহার, সুস্বাদু আহার্য প্রত্যাখ্যান করেছের তপস্বীর বৈরাগ্যে। পিতার প্রিয় ঘোড়াদের আহার্য প্রার্থনা করেছেন বন্ধুর কাছে। একজন রাজা রাজত্ব গ্রহণ করবেন সুদীর্ঘ চোদ্দ বছর বনবাসান্তে। এতদিন অভিষেকের প্রস্তুতিপর্ব ছিল, সেটি রামের মনোজগতে রাজত্ব করেছে প্রচ্ছন্নভাবে। সাধারণ মানুষসম আবেগ, দুঃখ, সব হারানোর অসহায়তা, সুকুমারবৃত্তির যা কিছু সব ছাপিয়ে, সত্যরক্ষার প্রবল তাগিদে রাম হয়তো ক্রমশ লৌহমানবে পরিণত হয়েছিলেন। তাই অধুনা মন্দিরে দূরবর্তী বিগ্রহ হয়েও আদিকবি বাল্মীকির রাম, কোমল, পেলব, আবেগ ব্যাকুল যুবা, যিনি সাধারণের মনে অধরাই হয়তো রয়ে গেলেন যুগান্তরেও।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।