বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পঞ্চপাণ্ডবদের উত্তরসূরী ঘটোৎকচের জন্মের পরে শর্ত অনুযায়ী বিদায় নিলেন ভীমসেনের স্ত্রী হিড়িম্বা। পাণ্ডবরা মা কুন্তীকে নিয়ে এগিয়ে চললেন বনান্তরে। এখন তাঁদের অঙ্গে তপস্বীর ছদ্মবেশ। জটা, বল্কল এবং মৃগচর্ম। যাত্রাপথে মৎস্য, ত্রিগর্ত্ত, পাঞ্চাল ও কীচকদেশ অতিক্রম করে এগিয়ে চললেন তাঁরা। পথে অধ্যয়নের বিরাম নেই। তাঁদের পাঠ্য বিষয় উপনিষদ, বেদ, বেদাঙ্গ, নীতিশাস্ত্র। পথে তাঁদের সঙ্গে দেখা হল পিতামহ মহান বেদব্যাসের। পাণ্ডপুত্ররা, প্রত্যেকে, মা কুন্তীর সঙ্গে একযোগে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে, কৃতাঞ্জলি হয়ে অপেক্ষা করলেন। আচার্য বেদব্যাস মনে মনে জেনেছিলেন, পাণ্ডবরা বিপন্ন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা ধর্মবিরুদ্ধ উপায়ে পাণ্ডবদের প্রতারণা করেছেন। যথা তু তৈরধর্ম্মেণ ধার্ত্তরাষ্ট্রৈর্বিবাসিতাঃ।

পিতামহ বেদব্যাস জানালেন, তাই পাণ্ডবদের কল্যাণকামনায় তাঁর আগমন। তিনি আশ্বস্ত করলেন পৌত্রদের, ন বিষাদোঽত্র কর্ত্তব্যঃ সর্ব্বমেতৎ সুখায় বঃ। দুঃখ করো না, এ সবই তোমাদের সুখের জন্যই ঘটেছে। তিনি আরও জানালেন, কৌরব ও পাণ্ডব—উভয়েই তাঁর কাছে সমান। তবুও পাণ্ডবদের দৈন্যদশা ও বয়স বিবেচনা করে তিনি তাঁদের প্রতি স্নেহে দুর্বল হয়ে পরেছেন। তাই তাঁদের হিতাকাঙ্খী পিতামহের পরামর্শ হল, অদূরে রোগের প্রাদুর্ভাবহীন মনোরম নগরীতে পাণ্ডবরা যেন ছদ্মবেশ অবস্থান করেন।

মা কুন্তীকে আশ্বস্ত করে বললেন, ভবিষ্যতে ধার্মিক যুধিষ্ঠির ধর্মরাজরূপে, ধর্মানুসারে পৃথিবী শাসন করবেন। ভীম ও অর্জুন বাহুবলে আসমুদ্র পৃথিবী ভোগে সমর্থ হবেন। কুন্তী ও মাদ্রীপুত্ররা সকলেই মহাবীর। আনন্দ ও সুখে থাকবে সকলেই। নরব্যাঘ্র পাণ্ডুপুত্ররা দক্ষিণাবহুল রাজসূয়, অশ্বমেধ প্রভৃতি যজ্ঞ সম্পন্ন করবেন। পাণ্ডবরা, বন্ধুবর্গকে ভোগ, ঐশ্বর্য, সুখে অনুগৃহীত করে পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত রাজ্য ভোগ করবেন। বেদব্যাস এক ব্রাহ্মণের গৃহে পাণ্ডবদের বসবাসের ব্যবস্থা করে বিদায় নিলেন। যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ইদং মাং সম্প্রতীক্ষধ্বমাগমিষ্যাম্যহং পুনঃ। দেশকালৌ বিদিত্বৈব লপ্স্যধ্বং পরমাং মুদম্।। আমার অপেক্ষায় থেকো। আমি আবারও আসব। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে পরমানন্দ লাভ কর। পাণ্ডবরা সম্মত হলেন। মহান বেদব্যাস তাঁর নিজ গন্তব্যে প্রস্থান করলেন।
একচক্রা নগরীতে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে কিছুদিন বসবাসকালীন নিজগুণে নগরবাসীদের কাছে প্রিয়দর্শন হয়ে উঠলেন পঞ্চপাণ্ডব। তাঁরা, দিনান্তে ভিক্ষালব্ধ দ্রব্য, মা কুন্তীকে এনে দিতেন। দেবী কুন্তী পুত্রদের মধ্যে সেই ভিক্ষালব্ধ দ্রব্য ভাগ করে দিতেন। যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব গ্রহণ করতেন অর্দ্ধভাগ। অবশিষ্ট অর্দ্ধাংশ ভোজন করতেন একা দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। একদা ভীমসেন ছাড়া, চারজন ভিক্ষা করতে গেলেন। বাড়িতে হঠাৎ আর্ত চিৎকার ও ক্রন্দনশব্দে দেবী কুন্তী করুণা ও সহানুভূতিবশত দয়ার্দ্রচিত্তে পুত্র ভীমসেনকে জানালেন, সেই গৃহকর্ত্তার আশ্রয়ে, দুর্যোধনদের অজ্ঞাতসারে, দৈন্যহীন অবস্থায়, বহুসমাদরে, সুখে দিন অতিবাহিত করছেন তাঁরা। সুখে বসবাসকারী গৃহাশ্রিত জনের কর্তব্য হল গৃহকর্ত্তার প্রত্যুপকার, পাণ্ডবরাও সেই প্রিয় কাজটিই করবেন। তিনিই সার্থক পুরুষ, যাঁর কৃত প্রত্যুপকার নিষ্ফল নয়। তাই এই ব্রাহ্মণের প্রতি ততোধিক প্রত্যুপকার করতেই হবে। ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই কষ্টে আছেন। তাই তাঁকে সাহায্যদান করলেই তিনি উপকৃত হবেন।

ভীম প্রস্তাব দিলেন, তাঁর দুঃখের কারণটি জানা যাক। তারপরে যতো দুষ্কর হোক, তার নিরসনের ব্যবস্থা করা যাবে। আলোচনাকালীন আবার ভার্যাসহ ব্রাহ্মণের আর্ত চিৎকার শুনতে পেলেন। দু’জনে মরিয়া হয়ে দ্রুত ব্রাহ্মণের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। সেখানে পত্নী ও পুত্রকন্যাসহ দুঃখে ম্লান বিষণ্ণ ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন। ব্রাহ্মণ বলছেন, পৃথিবীতে জীবন হল অন্তঃসারশূন্য নলখাগড়ার তুল্য, দুঃখের কারণ। জীবন, পরাধীন এবং অপ্রিয় ফলভোগের হেতু। বেঁচে থাকলেই শুধু কষ্টভোগ। জীবনের অর্থ যত সন্তাপ। প্রাণ থাকলেই নানা দ্বন্দ্বের মুখোমুখী হওয়া। একমাত্র আত্মাই ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করে থাকে। আবার এগুলির অভাবেই অসীম দুঃখবোধ। কেউ মোক্ষের পথ অবলম্বন করেন, কিন্তু সেখানেও দুঃখ হতে নিস্তারলাভের উপায় নেই। আবার অর্থপ্রাপ্তিতেও আছে নরকযন্ত্রণা। অর্থলিপ্সুর পরম কষ্ট। আবার অর্থলাভে তার থেকে বেশি কষ্ট, আবার অর্থ পেয়ে হারালে সর্বাপেক্ষা বেশি দুঃখ। ঈশ্বর, প্রিয়বস্তুগুলিকে যেন শলাকা দিয়ে বিদ্ধ করে দেন হৃদয়ে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৬: রামায়ণে রামচন্দ্রের যাত্রাপথ সুগম হওয়ার কারণেই কি সীতার উপস্থিতি?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৯৮: মাছচাষে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা প্রয়োজন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

যেমন স্ত্রীর সঙ্গে স্বল্পকালীন জীবনও ছিল রোগব্যাধি পীড়িত এবং ভয়ের। সস্ত্রীক সেই জীবন পরিত্যাগ করতে পারলেন না। বিপদ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নেই যখন বরং স্ত্রীপুত্রসহ পরলোকে পলায়ন শ্রেয়। ব্রাহ্মণ পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি, জন্মস্থান ছেড়ে, দেশান্তরে যেতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণী যেতে নারাজ। গভীর পরিতাপের বিষয় হল, স্বজনদের সাহচর্যলাভের আশায় ব্রাহ্মণী এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, এখন সেই নিদারুণ দুঃখময় স্বজনবন্ধুবিচ্ছেদ হতে চলেছে। অথবা ব্রাহ্মণের নিজের বিনাশ হোক।কারণ তিনি নিষ্ঠুরের মতো,নিজে জীবিত থেকে বন্ধুস্বজন ত্যাগ করতে পারেন না। সহধর্মচারিণী, ইন্দ্রিয়সংযমিনী, জননীতুল্যা, দেবনির্দিষ্ট সখী, পরম আশ্রয়, পিতামাতার অনুমোদিত গার্হস্থ্যধর্মের অংশভাগিনী, মন্ত্রপাঠ করে যাঁকে ঘরে এনেছেন, সেই সৎকুলসম্ভূতা, চরিত্রবলে সতী, সন্তানের মা, সাধ্বী স্ত্রী, যিনি কখনও অপকার করেননি। বরং সর্বদাই সহমত হয়ে চলেছেন, নিজের জীবনরক্ষার্থে তাঁকে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। পরিত্যক্তুং ন শক্ষ্যামি ভার্য্যাং নিত্যমনুব্রতাম্

ব্রাহ্মণ বলে চললেন, কন্যাটিকেও বা পরিত্যাগ করবেন কী করে? নেহাতই বালিকা, পরিণত বয়সে পৌঁছোয়নি এখনও, নারীত্বের লক্ষণ ফুটে ওঠেনি শরীরে। পিতার কাছে রক্ষিত, স্বামীর গচ্ছিত ধন সে। পিতৃপুরুষদের সঙ্গে তিনি নিজে কন্যার দ্বারা উৎপন্ন দৌহিত্রপ্রদত্ত স্বর্গলাভের কামনা করেন, সেই নিজের ঔরসজাত কন্যাকে কেন ত্যাগ করবেন তিনি?
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৬: সুখের লাগিয়া

তিনি শুধুমাত্র পুত্রবৎসল বা কন্যাবৎসল নন, পুত্রকন্যা উভয়ের প্রতি তিনি সমভাবাপন্ন। মম তুল্যাবুভৌ স্মৃতৌ। আমি অপাপবিদ্ধা কন্যাকে ত্যাগ করতে অক্ষম। অপাপাং তামহং বালাং কথমুৎস্রষ্টুমুৎসহে। ব্রাহ্মণের হয়েছে উভয়সঙ্কট। বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সন্তান বিসর্জন সম্ভব নয় পত্নীত্যাগও নয়, সম্ভব নয় আত্মবিসর্জন। কারণ সকলের সুরক্ষার কারণে তিনি যদি পরিবার ত্যাগ করেন, তাহলে সেটিও হবে একপ্রকার নৃশংসতা। কারণ তাঁর বিচ্ছেদ, পরিবারের কেউই বাঁচবেন না। আর পরিবারের কাউকে ত্যাগ করাও নিন্দনীয় নিষ্ঠুর কাজ। তাই এই ধর্মসঙ্কট হতে পরিত্রাণের উপায় হল, সকলের একসাথে মৃত্যুবরণ।

ব্রাহ্মণীর প্রতিবাদে স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ব্রাহ্মণের ন্যায় বিদ্বানব্যক্তির, প্রাকৃত সাধারণজনের তুল্য বিষাদ মানায় না। মৃত্যু যখন অমোঘ অবশ্যম্ভাবী, তখন এই নিশ্চিত ভাবি বিষয়ে শোক কেন? যে কোনও সংসারী পুরুষের কাম্য হল, পত্নী, পুত্র, কন্যা।এরা সকলেই সেই পুরুষের ইচ্ছাধীন। তাই নিজ বুদ্ধিবলে কষ্ট জয় করাই বোধ হয় ভালো। ব্রাহ্মণী নিজে যাবেন সেখানে (অপেক্ষমান বিপদের নিকটে)। নারীদের চিরন্তন ধর্ম—নিজের জীবনের বিনিময়ে পতির কল্যাণ। স্বামীর সুখের জন্যে এবং ইহলোক ও পরলোকে অক্ষয় যশলাভের কারণে ব্রাহ্মণী তাঁর প্রাণবিসর্জনে আগ্রহী। ধর্ম কী? সেই বিষয়ে ব্রাহ্মণী বলতে শুরু করলেন। পুরুষ সন্তানকামনায় পত্নীসঙ্গ কামনা করে। সে বিষয়ে তিনি সফল।

ব্রাহ্মণী পুত্র-কন্যা দুটিই দিয়েছেন এবং এর ফলে ব্রাহ্মণ পিতৃঋণমুক্ত হতে পেরেছেন। ব্রাহ্মণ, পুত্রকন্যার পালন-পোষণে সক্ষম। ব্রাহ্মণী কিন্তু সে বিষয়ে অক্ষম। ব্রাহ্মণের বিচ্ছেদে, পুত্রকন্যার ভবিষ্যত কী? ব্রাহ্মণীর কী গতি হবে? স্বামীহারা ব্রাহ্মণী সৎপথে থেকে দুই সন্তানকে কীভাবে বাঁচাবেন? বংশমর্যাদাহীন অযোগ্য গর্বোদ্ধরা যখন কন্যাটির পাণিপ্রার্থী হতে ইচ্ছুক হবেন, তখন ব্রাহ্মণী তাঁদের কবল থেকে কন্যাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন কী? মাটিতে পরিত্যক্ত মাংসখণ্ড যেমন পাখিরা প্রার্থনা করে তেমনই পতিহীনা নারী সকল পুরুষের প্রার্থিতা হয়ে থাকেন। দুর্বৃত্তরা ব্রাহ্মণীকে কামনা করে বিচলিত করে তুললে,ব্রাহ্মণী হয়তো আর সৎপথে থাকতে পারবেন না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

ব্রাহ্মণী মনে করেন সন্তান উৎপাদনের পরে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বরং স্বামীর অনুপস্থিতি বা বিয়োগান্তক পরিণতিতে সপুত্রকন্যা তাঁর নিজের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। সেই সব সম্ভাবনা অমূলক নয়। তাই তিনি নিজে মৃত্যুবরণ করতে ইচ্ছুক। কারণ পত্নীর জীবন, পতির কল্যাণে উৎসর্গীকৃত। ব্রাহ্মণী কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, তিনি কোন রাক্ষসের গ্রাসে পরিণত হতে চলেছেন,যে রাক্ষস মহিলার প্রতি সৌজন্যবশত ব্রাহ্মণীকে রেহাই দিতে পারেন। কারণ, অবধ্যাং স্ত্রিয়মিত্যাহুর্ধর্ম্মজ্ঞা ধর্ম্মনিশ্চয়ে ধর্মনিশ্চিতকরণকালে ধর্মজ্ঞরা বলেন, স্ত্রীলোক অবধ্য। পুরুষের বধ নিশ্চিত, নারীহত্যায় সংশয়ের অবকাশ আছে। তাই তাঁর সেই রাক্ষসের কাছে গমন শ্রেয়। জীবনের কাছে আর তাঁর কোন প্রত্যাশা নেই। ব্রাহ্মণী নিজে প্রিয়বস্তুভোগ, ধর্মসঙ্গত জীবন, সন্তানলাভ করেছেন। এরপরে মৃত্যু আঘাতের ভয়ে তিনি বিচলিত নন। তিনি বার্দ্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। কোনও ক্ষোভ, দুঃখবোধ তাঁর নেই। তা ছাড়া পুরুষের একাধিক বিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়। নারীদের দ্বিতীয় পতিগ্রহণ, শাস্ত্রনিষিদ্ধ ও অধর্ম।তাই ব্রাহ্মণীর অনুরোধ, আত্মানং তারয়াদ্যাশু কুলক্ষেমৌ এ দারকৌ। তাই আত্মরক্ষায় উদ্যোগী হয়ে বংশ এবং সন্তান দুটিকে রক্ষা করো।

পরিশেষে দেখা যেতে পারে আদৌ রক্ষা পেল কী ব্রাহ্মণপরিবার?পাণ্ডবদের প্রত্যুপকারের প্রয়াস কী সফল হল?
জীবনের বহু বাঁকে এমন প্রাণঘাতী সঙ্কট থাবা পেতে বসে আছে, শিকারের অপেক্ষায়।অসহায় মানুষ অনেক সময়েই, সপরিবারে মৃত্যুকেই,এই সঙ্কট থেকে মুক্তির উপায়রূপে ভাবেন। যেমন ভেবেছিলেন সেই ব্রাহ্মণ। এই সামাজিক চিত্র আধুনিক যুগেও বিরল নয়।
একটি পরিবারে প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রত্যেকে একে অপরের পরিপূরক, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এই চিরকালীন পারিবারিক বন্ধন বিপদাপন্ন অবস্থায় আরও গভীরভাবে ফুটে ওঠে। যেমনটি ঘটেছিল ব্রাহ্মণের পারিবারিক জীবনে। সঙ্কটের চালচিত্রে আছে দ্বন্দ্ব, একান্ত অনুভবের উদ্ভাস,আছে তাত্ত্বিকচিন্তার প্রকাশ। বিপদ জীবনকে ঐক্যসূত্রে গাঁথে, এক অপরের অপরিহার্য উপস্থিতি অনুভব করে শোকে বিহ্বল হয়ে ওঠেন পারিবারিক গণ্ডীতে আবদ্ধ মানুষ।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

একচক্রা নগরীতে পিতামহ ব্যাসদেবের পরামর্শ অনুযায়ী অবস্থানকালীন পাণ্ডবরা বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতা রাজপ্রাসাদের অলিন্দ থেকে প্রাকৃত জীবনকে দেখা নয়, জীবনযুদ্ধের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ। জীবন এক অসমাপ্ত গল্পের মতোই রহস্যময়তায় ভরা। পাণ্ডবদের সামনে অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এর সঙ্গে যুক্ত হল আশ্রয়দাতার সঙ্কটমুক্তির চিন্তা। তাঁদের রক্তে রয়েছে মহান বেদব্যাসের পরম্পরা, সঙ্গে ক্ষত্রিয়পুরুষানুক্রম। মাতৃকুলের প্রত্যেকে ক্ষত্রিয়। পিতামহী কাশীরাজকন্যা অম্বালিকা। মা কুন্তী কুন্তীভোজরাজার কন্যা। ক্ষত্রিয় পরম্পরাক্রমে দেশরক্ষা, প্রজাপালন তাঁদের অভ্যাস।

কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ শুধু নয়, আর্তকে উদ্ধার—পাণ্ডবদের জন্মগত দায়িত্বপালনের অঙ্গীকার। মহর্ষি ব্যাসদেবের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হতে পারে না। ধার্মিক যুধিষ্ঠির রাজা হবেনই। অন্য পাণ্ডুপুত্ররা পৃথিবী ভোগ করবেন অবশ্যই। কিন্তু যে কোন সার্থকতায় পৌঁছনোর অন্তরালে থাকে অনেক যুদ্ধ, ঘাম, রক্তক্ষরণের গল্প। পাণ্ডবদের সেই সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে এখন যেন প্রশিক্ষণকাল, সাধারণের জীবনবীক্ষণ ও সমস্যাময় জটিলতার অনুসন্ধান। ভাবি রাজার অনুভব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়, সাধারণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপদমুক্তির চিন্তা। মহর্ষি বেদব্যাস হয়তো সেই কারণেই পাণ্ডবদের জন্য একচক্রার ব্রাহ্মণগৃহের আশ্রয় নির্বাচন করেছিলেন। রাজপুত্ররা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন, এই দীনতা তাঁদের জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে পারেনি। তাঁরা সাধারণের প্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশিষ্টজনদের ব্যতিক্রমী সত্তা কখনও সুপ্ত থাকে না। প্রকট হয়ে ওঠে।

আশ্রয়দাতা গৃহস্থ ব্রাহ্মণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতায় বিনতা মা কুন্তী, ব্রাহ্মণের আসন্ন অজানা কোন সঙ্কটমোচনের উদ্যোগ নিয়েছেন। সপুত্র কুন্তী কৃতজ্ঞচিত্তে ব্রাহ্মণের প্রত্যুপকারে ব্রতী হয়েছেন। ব্রাহ্মণ তাঁর গৃহে বিঘ্নহীন নিশ্চিন্ত জীবন দিয়েছেন তাঁদের। ব্রাহ্মণকৃত উপকারের যে কোনও প্রত্যুপকার করা প্রয়োজন। উপকারীর উপকারের ঋণ পরিশোধে আছে হৃদয়ের ব্যাপ্তি, মনুষ্যত্বের উন্মোচন। এ যে মানবিক গুণের উজ্জ্বল প্রকাশ। আধুনিক ভারত এই মহাভারতীয় উত্তরাধিকার মনে রেখেছে তো?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content