ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
বনবাসী জ্যেষ্ঠ রামকে ফিরিয়ে আনতে চলেছেন কুমার ভরত। পথে রামের সখা নিষাদরাজ গুহর সঙ্গে সাক্ষাৎ। নিষাদপতির মনে সন্দেহের জটিলতা। এই সশস্ত্র ভরত, হয়তো রামের কারণে, নিষাদরাজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবেন। নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে, তিনি ভরতের সাক্ষাতে নিজের আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। গুহর সমস্ত আশঙ্কা দূর করলেন ভরত। তিনি পিতৃতুল্য জ্যেষ্ঠ রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। এই উদ্দেশ্যেই ভরতের আগমন, তাই ভয়ের কোন কারণ নেই। ভরতের শুভ উদ্দশ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে নিষাদপতি, তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন।
গহন অরণ্যবাসী গুহ, ভরতের কাছে রাম ও লক্ষ্মণের সদ্ভাব যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন সেই বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। রামচন্দ্রের রক্ষাকাজে জাগ্রত লক্ষ্মণকে গুহ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাঘব লক্ষ্মণের জন্য সুখশয্যা প্রস্তুত। লক্ষ্মণ, নিশ্চিন্তমনে সেই শয্যায় সুখে শয়ন করতে পারেন। গুহর ব্যাধদের রাজ্যে জনসাধারণ সকলেই দুঃখময় (কষ্টকর) যাপনে অভ্যস্ত। লক্ষ্মণের সুখকর জীবন। তাই রামের সুরক্ষায় তাঁরা নিজেরা জেগে থাকবেন। নিষাদপতির স্থির নিশ্চিত অনুভব, রামের থেকে প্রিয়তর কেউ পৃথিবীতে নেই। তিনি জানালেন, আজ আমি তোমায়, সত্য বলছি, উৎকণ্ঠিত হয়ো না। ন হি রামাৎ প্রিয়তরো মমাস্তি ভুবি কশ্চন। মোৎসুকোঽভূর্ব্রবীম্যেতদদ্য সত্যং তবাগ্রতঃ।। রামের প্রসাদে, জগতে মহান যশ, অর্জিত ধর্ম ও নিরন্তর বিপুল অর্থ ও কাম, তিনি প্রত্যাশা করেন। নিষাদরাজ লক্ষ্মণের শঙ্কা দূর করলেন, জ্ঞাতিগণ-সহ নিষাদরাজ নিজে ধনুর্দ্ধারণ করে, সীতা-সহ প্রিয়সখা রামকে রক্ষা করবেন। এই বনে নিরন্তর বিচরণ করেন, তাই কিছুই তার অজানা নয়। তিনি, যুদ্ধে চতুরঙ্গ সেনার আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম। গুহ জানালেন, তাঁর অনুরোধপূর্ণ আবেদনের উত্তরে, ধার্মিক মহাত্মা লক্ষ্মণ, সানুনয়ে সমবেত সকলকে বললেন, দশরথপুত্র রাম, সীতা সহ ভূশয্যায় শায়িত।এই অবস্থায় লক্ষ্মণের নিদ্রা, জীবন ও সুখানুভূতি কী সম্ভব?
রামানুজ লক্ষ্মণ গুহের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, যুদ্ধে দেবাসুরের সম্মিলিত শক্তি যাঁকে জয় করতে অক্ষম, সেই রাম, সীতার সঙ্গে তৃণশয্যায় শায়িত, গুহ, এই দৃশ্য তুমি দেখ। যো ন দেবাসুরৈঃ সর্ব্বৈঃ শক্যাঃ প্রসহিতুং যুধি। তং পশ্য গুহ সংবিষ্টং তৃণেষু সহ সীতয়া।। কঠোর তপস্যা ও নানা প্রচেষ্টার ফলে, রাজা দশরথ, এমন সুলক্ষণ পুত্র লাভ করেছেন। সেই পুত্র, রাম নির্বাসিত। তাই রাজা দশরথ বেশি দিন বাঁচবেন না। অচিরেই স্বামীহীনা দেবী পৃথিবীর বৈধব্য নিশ্চিত। লক্ষ্মণের অনুমান, মহিলারা তীব্র আর্তনাদ করে,শ্রান্ত হয়ে এখন নিশ্চুপ, তাই এখন রাজান্তঃপুরের প্রবল কোলাহল স্তব্ধ হয়েছে। দেবী কৌশল্যা, রাজা দশরথ ও লক্ষ্মণজননী সুমিত্রা আজ এই রাত্রি পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন, লক্ষ্মণের এমন প্রত্যাশা নেই। লক্ষ্মণমাতা সুমিত্রা, লক্ষ্মণসহোদর শত্রুঘ্নের মুখ দেখে, হয়তো বেঁচে থাকবেন।
শুধু বীরপুত্র রামের শোকার্তা জননীর বিনাশ নিশ্চিত। রাজা দশরথের দীর্ঘকালের মনের বাসনা ছিল, তিনি রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন। লক্ষ্মণ বললেন, রামকে রাজ্যদানরূপ এই ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় পিতা দশরথ প্রাণ হারাবেন।পিতার অন্তিম সময় উপস্থিত হলে, যাঁদের উপস্থিতি সময়োচিতভাবে সিদ্ধ হয়েছে এমন ভাগ্যবানরা, রাজার অন্তিম প্রেতকার্য সম্পন্ন করবেন। পিতার রমণীয় প্রাসাদের অঙ্গন। সেখানে রাজপথগুলি সুন্দরভাবে বিভক্ত, সেখানে কত প্রাসাদ উন্নত হর্মযুক্ত, রত্নরাজি বিভূষিত, গজ, অশ্ব রথসঙ্কুল, সদাই তূর্যনিনাদে পরিপূর্ণ।
গহন অরণ্যবাসী গুহ, ভরতের কাছে রাম ও লক্ষ্মণের সদ্ভাব যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন সেই বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। রামচন্দ্রের রক্ষাকাজে জাগ্রত লক্ষ্মণকে গুহ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাঘব লক্ষ্মণের জন্য সুখশয্যা প্রস্তুত। লক্ষ্মণ, নিশ্চিন্তমনে সেই শয্যায় সুখে শয়ন করতে পারেন। গুহর ব্যাধদের রাজ্যে জনসাধারণ সকলেই দুঃখময় (কষ্টকর) যাপনে অভ্যস্ত। লক্ষ্মণের সুখকর জীবন। তাই রামের সুরক্ষায় তাঁরা নিজেরা জেগে থাকবেন। নিষাদপতির স্থির নিশ্চিত অনুভব, রামের থেকে প্রিয়তর কেউ পৃথিবীতে নেই। তিনি জানালেন, আজ আমি তোমায়, সত্য বলছি, উৎকণ্ঠিত হয়ো না। ন হি রামাৎ প্রিয়তরো মমাস্তি ভুবি কশ্চন। মোৎসুকোঽভূর্ব্রবীম্যেতদদ্য সত্যং তবাগ্রতঃ।। রামের প্রসাদে, জগতে মহান যশ, অর্জিত ধর্ম ও নিরন্তর বিপুল অর্থ ও কাম, তিনি প্রত্যাশা করেন। নিষাদরাজ লক্ষ্মণের শঙ্কা দূর করলেন, জ্ঞাতিগণ-সহ নিষাদরাজ নিজে ধনুর্দ্ধারণ করে, সীতা-সহ প্রিয়সখা রামকে রক্ষা করবেন। এই বনে নিরন্তর বিচরণ করেন, তাই কিছুই তার অজানা নয়। তিনি, যুদ্ধে চতুরঙ্গ সেনার আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম। গুহ জানালেন, তাঁর অনুরোধপূর্ণ আবেদনের উত্তরে, ধার্মিক মহাত্মা লক্ষ্মণ, সানুনয়ে সমবেত সকলকে বললেন, দশরথপুত্র রাম, সীতা সহ ভূশয্যায় শায়িত।এই অবস্থায় লক্ষ্মণের নিদ্রা, জীবন ও সুখানুভূতি কী সম্ভব?
রামানুজ লক্ষ্মণ গুহের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, যুদ্ধে দেবাসুরের সম্মিলিত শক্তি যাঁকে জয় করতে অক্ষম, সেই রাম, সীতার সঙ্গে তৃণশয্যায় শায়িত, গুহ, এই দৃশ্য তুমি দেখ। যো ন দেবাসুরৈঃ সর্ব্বৈঃ শক্যাঃ প্রসহিতুং যুধি। তং পশ্য গুহ সংবিষ্টং তৃণেষু সহ সীতয়া।। কঠোর তপস্যা ও নানা প্রচেষ্টার ফলে, রাজা দশরথ, এমন সুলক্ষণ পুত্র লাভ করেছেন। সেই পুত্র, রাম নির্বাসিত। তাই রাজা দশরথ বেশি দিন বাঁচবেন না। অচিরেই স্বামীহীনা দেবী পৃথিবীর বৈধব্য নিশ্চিত। লক্ষ্মণের অনুমান, মহিলারা তীব্র আর্তনাদ করে,শ্রান্ত হয়ে এখন নিশ্চুপ, তাই এখন রাজান্তঃপুরের প্রবল কোলাহল স্তব্ধ হয়েছে। দেবী কৌশল্যা, রাজা দশরথ ও লক্ষ্মণজননী সুমিত্রা আজ এই রাত্রি পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন, লক্ষ্মণের এমন প্রত্যাশা নেই। লক্ষ্মণমাতা সুমিত্রা, লক্ষ্মণসহোদর শত্রুঘ্নের মুখ দেখে, হয়তো বেঁচে থাকবেন।
শুধু বীরপুত্র রামের শোকার্তা জননীর বিনাশ নিশ্চিত। রাজা দশরথের দীর্ঘকালের মনের বাসনা ছিল, তিনি রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন। লক্ষ্মণ বললেন, রামকে রাজ্যদানরূপ এই ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় পিতা দশরথ প্রাণ হারাবেন।পিতার অন্তিম সময় উপস্থিত হলে, যাঁদের উপস্থিতি সময়োচিতভাবে সিদ্ধ হয়েছে এমন ভাগ্যবানরা, রাজার অন্তিম প্রেতকার্য সম্পন্ন করবেন। পিতার রমণীয় প্রাসাদের অঙ্গন। সেখানে রাজপথগুলি সুন্দরভাবে বিভক্ত, সেখানে কত প্রাসাদ উন্নত হর্মযুক্ত, রত্নরাজি বিভূষিত, গজ, অশ্ব রথসঙ্কুল, সদাই তূর্যনিনাদে পরিপূর্ণ।
সকলের হিতকারী হৃষ্ট পুষ্ট জনসাধারণ সমাকীর্ণ, কত আরামদায়ক উদ্যান বিশিষ্ট,যেখানে সামাজিক উৎসবের রেশ চলতেই থাকে। লক্ষ্মণের মতে, তাঁরাই সুখী যাঁরা পিতার এমন রাজধানীতে বিচরণ করবেন। লক্ষ্মণ সেই দিনটির অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি বললেন, সময় (চতুর্দশ বছর) অতিবাহিত হলে, আমরাও সত্যপ্রতিজ্ঞ রামের সঙ্গে সুখে সেখানে (রাজধানীতে) প্রবেশ করব। অপি সত্যপ্রতিজ্ঞেন সার্দ্ধং কুশলিনো বয়ম্। নির্ব্বৃত্তে সময়ে হ্যস্মিন্ সুখিতাঃ প্রবিশেমহি।। গুহর বর্ণনায়, রাজকুমার লক্ষ্মণের এমন পরিতাপরত অবস্থায় রাত্রি অবসান হল। অমল প্রভাতবেলায়, রাম লক্ষ্মণ, দুই ভাই জটাবন্ধন করিয়ে নিলেন। গুহ জানালেন, নিষাদপতি তাঁদের নিশ্চিন্তে গঙ্গা অতিক্রম করালেন। জটাধারী, পরিধানে বল্কল ও চীর, মহাশৌর্যশালী, শত্রুদহনকারী, গজযূথের দলপতিসদৃশ, রাজকুমারদ্বয়, তীরধনুক ধারণ করে, সীতার সঙ্গে প্রস্থান করেলেন। নিষাদরাজের বর্ণনা শেষ হল।
নিষাদরাজ গুহর নিদারুণ অপ্রিয় কথা শুনে, যাঁর সম্পর্কে অপ্রিয় যা কিছু শুনেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে চিন্তার গভীরে ডুবে গেলেন ভরত। সুকুমার, উদারমনা, সিংহবৎ যাঁর দুটি কাঁধ, দীর্ঘবাহু, কমলনয়ন, নবীন, প্রিয়দর্শন এক নিমেষে আশ্বস্ত থেকে ব্যাকুল হৃদয়ে তোত্রবিদ্ধ হাতির মতো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সংজ্ঞাহীন ভরতকে দেখে, গুহর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হল, ব্যথিত ভরতের দশা যেন ভূকম্পনের ফলে বৃক্ষটির মতো। ভরতকে সেই অবস্থায় দেখে, নিকটস্থ শত্রুঘ্ন, তাঁকে জড়িয়ে ধরে, হতচেতন প্রায় ও শোকার্ত হয়ে, উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। ভরতের মায়েরা ছুটে এলেন, তাঁরা সকলে স্বামীর মৃত্যুর কারণে উপবাসজনিত অনাহারে শীর্ণা, দৈন্যদশায় উপনীত হয়েছেন। তাঁরা সকলে কাঁদতে কাঁদতে ভূলুণ্ঠিত ভরতকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরলেন। ব্যাকুলহৃদয়া দেবী কৌশল্যা, ভরতকে আলিঙ্গনে জড়ালেন।
পুত্রবৎসলা তপস্বিনী শোকার্তা কৌশল্যা, কাঁদতে কাঁদতে যেন নিজের বাছাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভরতের শরীর কোনও রোগাক্রান্ত নয় তো? এই রাজকুলের প্রাণ এখন ভরতের অধীন। লক্ষ্মণ-সহ রাম চলে গিয়েছেন, ভরতের দিকে তাকিয়ে, মা কৌশল্যার এই প্রাণধারণ। রাজা দশরথের মৃত্যুর পরে, আজ ভরতই তাঁদের একমাত্র আশ্রয়। অজানা আশঙ্কায় ভীতা কৌশল্যার এখন প্রশ্ন, ভরত কী লক্ষ্মণ বা সস্ত্রীক বনবাসী একমাত্র পুত্র রামের কোন অশুভ সংবাদ শুনেছেন? রোদন করতে করতেই মুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেয়ে, দেবী কৌশল্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে, মহাযশস্বী ভরত গুহকে বললেন,ভ্রাতা রাম ও লক্ষ্মণ এবং সীতা কোথায় রাত্রিবাস করেছেন? তাঁরা কী ভোজন করেছিলেন? কোথায়ই বা শয়ন করেছিলেন? তিনি গুহর কাছে সব বৃত্তান্ত শুনতে ইচ্ছুক।নিষাদরাজ গুহ, ভরতের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, প্রিয় হিতকামী অতিথি রামের প্রতি তাঁর নিজের ব্যবহার ও রামের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করতে লাগলেন।
নিষাদরাজ গুহর নিদারুণ অপ্রিয় কথা শুনে, যাঁর সম্পর্কে অপ্রিয় যা কিছু শুনেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে চিন্তার গভীরে ডুবে গেলেন ভরত। সুকুমার, উদারমনা, সিংহবৎ যাঁর দুটি কাঁধ, দীর্ঘবাহু, কমলনয়ন, নবীন, প্রিয়দর্শন এক নিমেষে আশ্বস্ত থেকে ব্যাকুল হৃদয়ে তোত্রবিদ্ধ হাতির মতো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সংজ্ঞাহীন ভরতকে দেখে, গুহর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হল, ব্যথিত ভরতের দশা যেন ভূকম্পনের ফলে বৃক্ষটির মতো। ভরতকে সেই অবস্থায় দেখে, নিকটস্থ শত্রুঘ্ন, তাঁকে জড়িয়ে ধরে, হতচেতন প্রায় ও শোকার্ত হয়ে, উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। ভরতের মায়েরা ছুটে এলেন, তাঁরা সকলে স্বামীর মৃত্যুর কারণে উপবাসজনিত অনাহারে শীর্ণা, দৈন্যদশায় উপনীত হয়েছেন। তাঁরা সকলে কাঁদতে কাঁদতে ভূলুণ্ঠিত ভরতকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরলেন। ব্যাকুলহৃদয়া দেবী কৌশল্যা, ভরতকে আলিঙ্গনে জড়ালেন।
পুত্রবৎসলা তপস্বিনী শোকার্তা কৌশল্যা, কাঁদতে কাঁদতে যেন নিজের বাছাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভরতের শরীর কোনও রোগাক্রান্ত নয় তো? এই রাজকুলের প্রাণ এখন ভরতের অধীন। লক্ষ্মণ-সহ রাম চলে গিয়েছেন, ভরতের দিকে তাকিয়ে, মা কৌশল্যার এই প্রাণধারণ। রাজা দশরথের মৃত্যুর পরে, আজ ভরতই তাঁদের একমাত্র আশ্রয়। অজানা আশঙ্কায় ভীতা কৌশল্যার এখন প্রশ্ন, ভরত কী লক্ষ্মণ বা সস্ত্রীক বনবাসী একমাত্র পুত্র রামের কোন অশুভ সংবাদ শুনেছেন? রোদন করতে করতেই মুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেয়ে, দেবী কৌশল্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে, মহাযশস্বী ভরত গুহকে বললেন,ভ্রাতা রাম ও লক্ষ্মণ এবং সীতা কোথায় রাত্রিবাস করেছেন? তাঁরা কী ভোজন করেছিলেন? কোথায়ই বা শয়ন করেছিলেন? তিনি গুহর কাছে সব বৃত্তান্ত শুনতে ইচ্ছুক।নিষাদরাজ গুহ, ভরতের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, প্রিয় হিতকামী অতিথি রামের প্রতি তাঁর নিজের ব্যবহার ও রামের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ
নিষাদরাজ জানালেন, তিনি রামের ব্যবহারের জন্যে নানাবিধ অন্ন, ভোজ্য সামগ্রী যেমন ফল, মূল সবকিছু উপহার দিয়েছিলেন। সত্য যাঁর শক্তি, সেই রাম, সেগুলি অনুমোদন করলেও, ক্ষত্রধর্ম স্মরণ করে সেগুলি রাম গ্রহণ করেননি। রাম, গুহপ্রদত্ত দ্রব্যসামগ্রী প্রত্যর্পণ করে অনুনয়সহকারে বলেছিলেন, ন হ্যস্মাভিঃ প্রতিগ্রাহ্যং সখে দেয়ন্তু সর্বদা। সখা, আমাদের দান গ্রহণ ধর্ম নয়, দানকরাই, ধর্ম। রাম সস্ত্রীক লক্ষ্মণের আনীত জল পান করে উপবাসী রইলেন। লক্ষ্মণও অবশিষ্ট জল পান করে রাম ও সীতার সঙ্গে উপবাসী হলেন। তাঁরা তিনজন, বাক্-সংযম পালন করে, সান্ধ্য উপাসনা সম্পন্ন করলেন। তার পরে, সৌমিত্রি লক্ষ্মণ স্বয়ং, বহু কুশ ঘাস সংগ্রহ করে, রামের জন্যে দ্রুত শয্যা প্রস্তুত করলেন। রাম সীতার সঙ্গে সেই শয্যায় শয়ন করলেন। লক্ষ্মণ তাঁদের চরণ ধুয়ে দিয়ে সেখান হতে সরে গেলেন। গুহ দেখিয়ে দিলেন, এই সেই ইঙ্গুদীতরুতল, এগুলি সেই তৃণরাশি। এখানেই রাম ও সীতা এই শয্যায় রাত্রি যাপন করেছিলেন।
শত্রুহন্তা লক্ষ্মণ, পিঠে শরপূর্ণ তূণীর ও আঙুলগুলিতে অঙ্গুলিত্রাণ পরিধান করে সজ্জিত বৃহৎ ধনুক নিয়ে রাম ও সীতার চতুর্দিকে অবস্থান করছিলেন। গুহ জানালেন, যেখানে লক্ষ্মণ ছিলেন, সেখানে গুহ স্বয়ং, শ্রেষ্ঠ ধনুক ও শর হাতে, নিদ্রাহীন সশস্ত্র জ্ঞাতিবর্গসহ ইন্দ্রপ্রতিম রামের প্রহরায় নিযুক্ত ছিলেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে ভরত, গভীর মনোযোগে নিষাদরাজের বর্ণিত রাম ও লক্ষ্মণের এই পর্যন্ত বনগমনবৃত্তান্ত শুনলেন। ভরতের সঙ্গে আছেন জননীরা। তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ভরত। বিস্মিত ভরতের মন ভাবাবেগে জাড়িত হল। দশরথপুত্র রামের, অঙ্গভার দলে দিয়েছিল, রাজকুমারের একান্তই অনুপযোগী সেই ভূশয্যা। রামের রাজকীয় শয্যায় উত্তম আস্তরণ, পশুচর্মের আবরণে আবৃত থাকত। তিনি কেমন করে ভূশয্যায় শয়ন করলেন? মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, বিহগকূজন নিনাদিত, পুষ্প সম্ভারের সৌরভে আমোদিত, শূন্যে উঁচু শিখরবিশিষ্ট, ভিত্তি দুর্মূল্য ধাতুনির্মিত, এমন সুরম্য প্রাসাদে বসবাসে অভ্যস্ত ছিলেন, রাম। সূত, মাগধ ও বন্দীদের স্তুতিগীতিগাথায় ও উৎকৃষ্ট অলঙ্কারের ধ্বনি ও মৃদঙ্গবাদ্যে যাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হত সেই রামের এ কি দশা আজ। অশ্রদ্ধেয়মিদং লোকে ন সত্যং প্রতিভাতি মা। মুহ্যতে খলু মে ভাবঃ স্বপ্নোঽয়মিতি মে মতিঃ।।
শত্রুহন্তা লক্ষ্মণ, পিঠে শরপূর্ণ তূণীর ও আঙুলগুলিতে অঙ্গুলিত্রাণ পরিধান করে সজ্জিত বৃহৎ ধনুক নিয়ে রাম ও সীতার চতুর্দিকে অবস্থান করছিলেন। গুহ জানালেন, যেখানে লক্ষ্মণ ছিলেন, সেখানে গুহ স্বয়ং, শ্রেষ্ঠ ধনুক ও শর হাতে, নিদ্রাহীন সশস্ত্র জ্ঞাতিবর্গসহ ইন্দ্রপ্রতিম রামের প্রহরায় নিযুক্ত ছিলেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে ভরত, গভীর মনোযোগে নিষাদরাজের বর্ণিত রাম ও লক্ষ্মণের এই পর্যন্ত বনগমনবৃত্তান্ত শুনলেন। ভরতের সঙ্গে আছেন জননীরা। তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ভরত। বিস্মিত ভরতের মন ভাবাবেগে জাড়িত হল। দশরথপুত্র রামের, অঙ্গভার দলে দিয়েছিল, রাজকুমারের একান্তই অনুপযোগী সেই ভূশয্যা। রামের রাজকীয় শয্যায় উত্তম আস্তরণ, পশুচর্মের আবরণে আবৃত থাকত। তিনি কেমন করে ভূশয্যায় শয়ন করলেন? মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, বিহগকূজন নিনাদিত, পুষ্প সম্ভারের সৌরভে আমোদিত, শূন্যে উঁচু শিখরবিশিষ্ট, ভিত্তি দুর্মূল্য ধাতুনির্মিত, এমন সুরম্য প্রাসাদে বসবাসে অভ্যস্ত ছিলেন, রাম। সূত, মাগধ ও বন্দীদের স্তুতিগীতিগাথায় ও উৎকৃষ্ট অলঙ্কারের ধ্বনি ও মৃদঙ্গবাদ্যে যাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হত সেই রামের এ কি দশা আজ। অশ্রদ্ধেয়মিদং লোকে ন সত্যং প্রতিভাতি মা। মুহ্যতে খলু মে ভাবঃ স্বপ্নোঽয়মিতি মে মতিঃ।।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক
ভরতের উপলব্ধিতে এটি শ্রদ্ধাযোগ্য নয়,সত্য তো নয়ই। মনে হচ্ছে, তিনি যেন স্বপ্নের ঘোরে, আবিষ্ট হয়ে আছেন। ভরত ভাবছেন,দাশরথি রাম,ভূমিতলে শায়িত, সেখানে আছেন, তাঁর প্রিয়া, রাজা দশরথের পুত্রবধূ, বিদেহরাজকুমারী সীতা। ন নূনং দৈবতং কিঞ্চিৎ কালেন বলবত্তরম্। ভরতের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত, কালের তুলনায়, কোনও দৈব বলশালী নয়। রামের নিশিযাপনের স্মৃতিচিহ্ন কোথায় নেই? শয্যায়, শরীরের ঘর্ষণের ফলে পিষ্ট তৃণগুলিতে, সীতার আভরণ থেকে স্খলিত বিক্ষিপ্ত স্বর্ণচূর্ণে, সীতার কৌশেয়বস্ত্র হতে তৃণগুলিতে চ্যুত তন্তুতে, সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে স্বামীস্ত্রীর এক শয্যায় শয়নের ছিন্ন স্মৃতিকণা।
ভরত ব্যথিত হলেন। মনে হয়,স্বামীর এমন শয্যা, দেবী সীতার সুখ শয্যা হয়েছে, যেখানে শয়ন করে, সুকুমারী, সাধ্বী, তপস্বিনী সীতা দুঃখ অনুভব করেননি। ভরতের অনুশোচনার অন্ত নেই, হায়, আমার সত্তা মৃত, আমি নিষ্ঠুর, আমারই জন্যে অনাথের মতো সস্ত্রীক এই শয্যায় শয়ন করেছিলেন রাম। হা হতোঽস্মি নৃশংসোঽস্মি যৎ সভার্য্যঃ কৃতে মম। ঈদৃশীং রাঘবঃ শয্যামধিশেতে হ্যনাথবৎ।। সার্বভৌম,পৃথিবীখ্যাত রাজকুলে জাত, সর্ব লৌকিক সুখভোগের যোগ্য, রাম। তিনি প্রিয় রাজসুখ ও সর্বোত্তম রাজ্য ত্যাগ করেছেন।
নীলপদ্মতুল্য শ্যামবরণ, আরক্তনয়ন, প্রিয়দর্শন, দুঃখ নয় শুধুমাত্র সুখভোগের যোগ্য, রাঘব রাম কেন আজ ভূশয্যায় শায়িত? সেই ভাগ্যবান শুভলক্ষণ লক্ষ্মণ ধন্য, যিনি এই বিপদের সময়ে রামের অনুবর্তী হয়েছেন। বৈদেহী সীতা, স্বামীর অনুগমন করেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ভরতের আক্ষেপ, বয়ং সংশয়িতাঃ সর্ব্বে হীনাস্তেন মহাত্মনা। শুধু আমাদের পরিত্যাগ করেছেন মহাত্মা রাম, তাই আমরা সংশয়াপন্ন দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি। রাজা দশরথ পরলোকগমন করেছেন, রাম অরণ্যের আশ্রয়ে রয়েছেন। ভরতের কাছে, কর্ণধারবিহীন শূন্যা এই পৃথিবী। বনবাসী রাম, বাহুবলে এই পৃথিবী রক্ষা করছেন, এই অবস্থায়, কেউ মনে মনেও এই রাজ্য কামনা করে না। যতই অরক্ষিত থাকুক প্রাকারসমূহ, অনিয়ন্ত্রিত হোক হস্তী ও অশ্বরা, পুরদ্বার থাক উন্মুক্ত অনাবৃত, রক্ষকহীন থাক রাজধানী, অসন্তুষ্ট সৈন্যবাহিনী, তাই রাজধানীর প্রতিরক্ষা বিপন্নদশায় উপনীত এবং সম্পূর্ণ অনাবৃত, এমন অরক্ষিত অবস্থায় শত্রুরাও বিষমিশ্রিত ভোজ্যের মতো এই রাজ্য গ্রহণ করবে না।
ভরত সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ থেকে তিনি জটা ধারণ করে, ভূমিতে বা তৃণশয্যায় শয়ন করবেন, ফলমূল হবে তাঁর আহার্য, বসন হবে চীর। ভরতর স্থির করলেন, রামের বনবাসজীবনের অবশিষ্ট কাল তিনি সুখে বনে বাস করবেন,তাহলে আর্য রামচন্দ্রের প্রতিশ্রুতিভঙ্গ হবে না। রামের জন্যে বনবাসকালে, শত্রুঘ্ন হবেন ভরতের অনুগামী। সহযোগী লক্ষ্মণের সঙ্গে আর্য রাম অযোধ্যা রাজ্য পালন করবেন। দ্বিজাতিগণ কাকুৎস্থ রামকে অযোধ্যায় অভিষিক্ত করবেন। দেবতারা ভরতের এই মনোরথ পূর্ণ করবেন। আনতশিরে ভরত রামকে বহু প্রকারে সম্মত করতে অক্ষম হলে, তখন ভরত চিরকাল রামের সঙ্গে বনবাসী হবেন। রাম তাঁকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। প্রসাদ্যমানঃ শিরসা ময়া স্বয়ং বহুপ্রকারং যদি ন প্রপৎস্যতে। ততোঽনুবৎস্যামি চিরায় রাঘবং বনে চিরং নার্হতি মামুপেক্ষিতম্।।
ভরত ব্যথিত হলেন। মনে হয়,স্বামীর এমন শয্যা, দেবী সীতার সুখ শয্যা হয়েছে, যেখানে শয়ন করে, সুকুমারী, সাধ্বী, তপস্বিনী সীতা দুঃখ অনুভব করেননি। ভরতের অনুশোচনার অন্ত নেই, হায়, আমার সত্তা মৃত, আমি নিষ্ঠুর, আমারই জন্যে অনাথের মতো সস্ত্রীক এই শয্যায় শয়ন করেছিলেন রাম। হা হতোঽস্মি নৃশংসোঽস্মি যৎ সভার্য্যঃ কৃতে মম। ঈদৃশীং রাঘবঃ শয্যামধিশেতে হ্যনাথবৎ।। সার্বভৌম,পৃথিবীখ্যাত রাজকুলে জাত, সর্ব লৌকিক সুখভোগের যোগ্য, রাম। তিনি প্রিয় রাজসুখ ও সর্বোত্তম রাজ্য ত্যাগ করেছেন।
নীলপদ্মতুল্য শ্যামবরণ, আরক্তনয়ন, প্রিয়দর্শন, দুঃখ নয় শুধুমাত্র সুখভোগের যোগ্য, রাঘব রাম কেন আজ ভূশয্যায় শায়িত? সেই ভাগ্যবান শুভলক্ষণ লক্ষ্মণ ধন্য, যিনি এই বিপদের সময়ে রামের অনুবর্তী হয়েছেন। বৈদেহী সীতা, স্বামীর অনুগমন করেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ভরতের আক্ষেপ, বয়ং সংশয়িতাঃ সর্ব্বে হীনাস্তেন মহাত্মনা। শুধু আমাদের পরিত্যাগ করেছেন মহাত্মা রাম, তাই আমরা সংশয়াপন্ন দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি। রাজা দশরথ পরলোকগমন করেছেন, রাম অরণ্যের আশ্রয়ে রয়েছেন। ভরতের কাছে, কর্ণধারবিহীন শূন্যা এই পৃথিবী। বনবাসী রাম, বাহুবলে এই পৃথিবী রক্ষা করছেন, এই অবস্থায়, কেউ মনে মনেও এই রাজ্য কামনা করে না। যতই অরক্ষিত থাকুক প্রাকারসমূহ, অনিয়ন্ত্রিত হোক হস্তী ও অশ্বরা, পুরদ্বার থাক উন্মুক্ত অনাবৃত, রক্ষকহীন থাক রাজধানী, অসন্তুষ্ট সৈন্যবাহিনী, তাই রাজধানীর প্রতিরক্ষা বিপন্নদশায় উপনীত এবং সম্পূর্ণ অনাবৃত, এমন অরক্ষিত অবস্থায় শত্রুরাও বিষমিশ্রিত ভোজ্যের মতো এই রাজ্য গ্রহণ করবে না।
ভরত সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ থেকে তিনি জটা ধারণ করে, ভূমিতে বা তৃণশয্যায় শয়ন করবেন, ফলমূল হবে তাঁর আহার্য, বসন হবে চীর। ভরতর স্থির করলেন, রামের বনবাসজীবনের অবশিষ্ট কাল তিনি সুখে বনে বাস করবেন,তাহলে আর্য রামচন্দ্রের প্রতিশ্রুতিভঙ্গ হবে না। রামের জন্যে বনবাসকালে, শত্রুঘ্ন হবেন ভরতের অনুগামী। সহযোগী লক্ষ্মণের সঙ্গে আর্য রাম অযোধ্যা রাজ্য পালন করবেন। দ্বিজাতিগণ কাকুৎস্থ রামকে অযোধ্যায় অভিষিক্ত করবেন। দেবতারা ভরতের এই মনোরথ পূর্ণ করবেন। আনতশিরে ভরত রামকে বহু প্রকারে সম্মত করতে অক্ষম হলে, তখন ভরত চিরকাল রামের সঙ্গে বনবাসী হবেন। রাম তাঁকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। প্রসাদ্যমানঃ শিরসা ময়া স্বয়ং বহুপ্রকারং যদি ন প্রপৎস্যতে। ততোঽনুবৎস্যামি চিরায় রাঘবং বনে চিরং নার্হতি মামুপেক্ষিতম্।।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৫: শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষতায় বীরবিক্রম
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী
নিষাদরাজ গুহের সঙ্গে ভরতের সাক্ষাতের ফলে, রাজপরিবার ভুক্ত নয় এমন একজনের মতানুসারে রামলক্ষ্মণের পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণ সম্বন্ধে অবহিত হলেন কুমার ভরত। সদ্য রাম ও লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা হয়েছে গুহর। তিনি অনুপুঙ্খ বর্ণনা করলেন রাম ও লক্ষ্মণের পারস্পরিক গভীর আন্তরিক সম্পর্ক। লক্ষ্মণ, জ্যেষ্ঠ রামের নিরাপত্তাবিষয়ে এতটাই সতর্ক যে, তিনি নিজের সুখনিদ্রা বিসর্জন দিয়েছেন, রামের সংসর্গে বেছে নিয়েছেন কষ্টকর কৃচ্ছ্রতার জীবন। লক্ষ্মণ, সশস্ত্র জ্ঞাতিবর্গসহ বিশ্বস্ত রামসখা নিষাদপতিকেও, রামের নিরাপত্তার দায়িত্বভার অর্পণ করেননি। তিনি সবিনয়ে গুহর সব অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
অযোধ্যারাজ দশরথের উত্তরসূরী অপরিমিত শক্তিমান রাম সস্ত্রীক তৃণশয্যায় শয়নরত, এই অবস্থা দেখে,জ্যেষ্ঠর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাশীল লক্ষ্মণ, নিদ্রা, সুস্থির জীবন ও সুখানুভূতি হারিয়েছেন। লক্ষ্মণ, সুদূর অরণ্যপথে রামের সহযাত্রী, তবু তিনি অনুমান করেছেন, রাজপরিবার তথা রাজ্যের দৈন্যদশা। রামবিহনে পিতার মৃত্যু, শোকার্তা রাম জননী কৌশল্যার মুমূর্ষু অবস্থা সবটাই যেন লক্ষ্মণের ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি অনুভবের অন্তর্দৃষ্টিবলে চতুর্দশ বৎসরের শেষে তাঁদের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখেন তখনও। রামলক্ষ্মণ এই দুই ভাইয়ের জটাবন্ধনে বনবাসের সূচনা হয়েছে যখন, নিষাদরাজ তার প্রত্যক্ষদর্শী।
লক্ষ্মণ রামের ছায়াসঙ্গী শুধু নন। শ্রদ্ধা মানুষকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেখানে ব্যক্তিগত সুখ, সাচ্ছন্দ্যবোধ নিতান্তই গৌণ হয়ে ওঠে।এর অনন্য উদাহরণ লক্ষ্মণ। তিনি, রামের সহযোদ্ধা,রামের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে একটুও পিছুপা হননি কখনও। স্ত্রী ও মায়ের সাংসারিক বন্ধন লক্ষ্মণের জন্য নয়। লক্ষ্মণ শুধু অগ্রজ রামের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। সেখানে পিতার সিদ্ধান্তের বিরোধিতাতেও তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।রামের বর্ম যেন লক্ষ্মণ,সেই দুর্ভেদ্য নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করবার সাধ্য কারও আছে কী? অতীতে, যৌথপরিবারকেন্দ্রিক ভারতীয় জীবনে জ্যেষ্ঠর প্রতি এমন শ্রদ্ধাবনত নিবেদিতপ্রাণ ভাইয়ের সন্ধান পাওয়া যেত। আধুনিক এক একটি স্বামীস্ত্রীসন্তান-সহ ছোট পরিবারে, সেই দৃষ্টান্ত বিরল, লক্ষ্মণদের অস্তিত্ব এখন লুপ্তপ্রায়।
লক্ষ্মণের পাশে ভরত। তাঁর শ্রদ্ধাবোধ, আবেগ থেকে উৎসারিত। লক্ষ্মণ, রামের সঙ্গে রাজ্য ছেড়ে পথে নেমেছেন। আর ভরত? তিনি, রাজসিংহাসনের বিনিময়ে, রামের বনবাসজীবন প্রার্থনা করেছেন। রামের মায়ের নির্ভরতার আশ্রয় হয়েছেন ভরত। অনেক ভর্ৎসনা, কটূক্তি ও সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে, এই আস্থাটুকু অর্জন করেছেন ভরত। তাঁর অর্জিত সম্পদ হল, তাঁর এই বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি। রামের ভোজন, শয়ন, যাপনের অনুপুঙ্খ বিবরণ, গভীর মনোযোগে শুনেছেন ভরত। রামের রাজকীয় ক্ষত্রধর্মানুসারী আভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ গুহের বিবরণ শুনে আবেগতাড়িত হয়েছেন তিনি। রামের স্মৃতিধন্য শয্যা, দেহের ভারে পিষ্ট তৃণ, সীতার আভরণচ্যুত স্বর্ণকণা ও কৌশেয়তন্তু দেখে, ভরতের মনে হয়েছে,অযোধ্যার স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ রাজকীয় জীবনের সঙ্গে তুলনায়,নিয়তিনির্দিষ্ট দৈবের বিধান নেহাতই দুর্বল। ভরত কোমলপ্রাণ, তিনি ভাবাবেগে স্বপ্ন দেখেন, তিনি রামকে ফিরিয়ে আনবেন, তা না হলে তিনি রামের সঙ্গে বনবাসী হবেন।
অযোধ্যারাজ দশরথের উত্তরসূরী অপরিমিত শক্তিমান রাম সস্ত্রীক তৃণশয্যায় শয়নরত, এই অবস্থা দেখে,জ্যেষ্ঠর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাশীল লক্ষ্মণ, নিদ্রা, সুস্থির জীবন ও সুখানুভূতি হারিয়েছেন। লক্ষ্মণ, সুদূর অরণ্যপথে রামের সহযাত্রী, তবু তিনি অনুমান করেছেন, রাজপরিবার তথা রাজ্যের দৈন্যদশা। রামবিহনে পিতার মৃত্যু, শোকার্তা রাম জননী কৌশল্যার মুমূর্ষু অবস্থা সবটাই যেন লক্ষ্মণের ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি অনুভবের অন্তর্দৃষ্টিবলে চতুর্দশ বৎসরের শেষে তাঁদের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখেন তখনও। রামলক্ষ্মণ এই দুই ভাইয়ের জটাবন্ধনে বনবাসের সূচনা হয়েছে যখন, নিষাদরাজ তার প্রত্যক্ষদর্শী।
লক্ষ্মণ রামের ছায়াসঙ্গী শুধু নন। শ্রদ্ধা মানুষকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেখানে ব্যক্তিগত সুখ, সাচ্ছন্দ্যবোধ নিতান্তই গৌণ হয়ে ওঠে।এর অনন্য উদাহরণ লক্ষ্মণ। তিনি, রামের সহযোদ্ধা,রামের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে একটুও পিছুপা হননি কখনও। স্ত্রী ও মায়ের সাংসারিক বন্ধন লক্ষ্মণের জন্য নয়। লক্ষ্মণ শুধু অগ্রজ রামের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। সেখানে পিতার সিদ্ধান্তের বিরোধিতাতেও তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।রামের বর্ম যেন লক্ষ্মণ,সেই দুর্ভেদ্য নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করবার সাধ্য কারও আছে কী? অতীতে, যৌথপরিবারকেন্দ্রিক ভারতীয় জীবনে জ্যেষ্ঠর প্রতি এমন শ্রদ্ধাবনত নিবেদিতপ্রাণ ভাইয়ের সন্ধান পাওয়া যেত। আধুনিক এক একটি স্বামীস্ত্রীসন্তান-সহ ছোট পরিবারে, সেই দৃষ্টান্ত বিরল, লক্ষ্মণদের অস্তিত্ব এখন লুপ্তপ্রায়।
লক্ষ্মণের পাশে ভরত। তাঁর শ্রদ্ধাবোধ, আবেগ থেকে উৎসারিত। লক্ষ্মণ, রামের সঙ্গে রাজ্য ছেড়ে পথে নেমেছেন। আর ভরত? তিনি, রাজসিংহাসনের বিনিময়ে, রামের বনবাসজীবন প্রার্থনা করেছেন। রামের মায়ের নির্ভরতার আশ্রয় হয়েছেন ভরত। অনেক ভর্ৎসনা, কটূক্তি ও সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে, এই আস্থাটুকু অর্জন করেছেন ভরত। তাঁর অর্জিত সম্পদ হল, তাঁর এই বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি। রামের ভোজন, শয়ন, যাপনের অনুপুঙ্খ বিবরণ, গভীর মনোযোগে শুনেছেন ভরত। রামের রাজকীয় ক্ষত্রধর্মানুসারী আভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ গুহের বিবরণ শুনে আবেগতাড়িত হয়েছেন তিনি। রামের স্মৃতিধন্য শয্যা, দেহের ভারে পিষ্ট তৃণ, সীতার আভরণচ্যুত স্বর্ণকণা ও কৌশেয়তন্তু দেখে, ভরতের মনে হয়েছে,অযোধ্যার স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ রাজকীয় জীবনের সঙ্গে তুলনায়,নিয়তিনির্দিষ্ট দৈবের বিধান নেহাতই দুর্বল। ভরত কোমলপ্রাণ, তিনি ভাবাবেগে স্বপ্ন দেখেন, তিনি রামকে ফিরিয়ে আনবেন, তা না হলে তিনি রামের সঙ্গে বনবাসী হবেন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া
লক্ষ্মণ, হলেন রামের ধ্যানধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগের সহযোদ্ধা। মিতভাষী লক্ষ্মণ,রামের সঙ্গে একত্রে জীবনযুদ্ধে অংশ নিতে ইচ্ছুক। আর ভরতের কোমল মনোভূমিতে শ্রদ্ধার কমল প্রস্ফুটিত হয়, রামের উদ্দেশ্যে নিবেদনের আনন্দে। আরাধ্যের গ্রাহ্য হল কি না সে বিষয়ে তিনি সচেতন নন। রামের অনুপস্থিতিতে ভরত অযোধ্যার নিরাপত্তাবিষয়ে উদাসীন। জ্যেষ্ঠ রামের প্রবল শৌর্যের প্রতি গভীর আস্থাবোধ এই ঔদাসীন্যের জন্ম দিয়েছে। ভরত জটা ও চীর ধারণ করে অরণ্যবাসী হবেন। তাঁর নিজের রাজকীয় জীবনের পরিবর্তে সুখে ভোগ করবেন অরণ্যজীবন, তিনি অগ্রজ রামের চতুর্দশবর্ষব্যাপী বনবাসজীবনের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। এসব কিছুই ভরতের ভাবাবেগের ফলশ্রুতি। বাস্তবে এই পরিকল্পনা সফল হবে কি না, এ বিষয়ে হয়তো তাঁর ধারণা ছিল না। লক্ষ্মণ সিদ্ধান্তে দৃঢ়, সতর্ক। তাঁর শ্রদ্ধার প্রকাশ বাস্তবমুখী। নরম, কোমল, ভরত আবেগের বশবর্তী হয়ে ব্যথিত হন, কষ্টে চোখের জল বাঁধ মানে না তাঁর। তিনি প্রতি মুহূর্তে জ্যেষ্ঠ রামের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মূল কারণ বলে নিজেকে দায়ী করেন, ধিক্কার দেন। পরিশেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন সেটি হয়তো আকাশকুসুম কল্পনামাত্র। ভরতের শ্রদ্ধায় আপ্লুত নির্মল মনটি কিন্তু একটুও দুর্বল হীন বলে মনে হয় না।
রামকে রাজ্যাধিকার হতে বঞ্চিত করেছেন পিতা। প্রতিবাদী লক্ষ্মণ, সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। তিনি রামের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে দ্বিধাহীন। লক্ষ্মণ পিতাকে প্রয়োজনে বধ করতেও পারেন। প্রোৎসাহিতোঽয়ং কৈকেয্যা সন্তুষ্ট যদি নঃ পিতা। অমিত্রভূতো নিঃশঙ্কং বধ্যতাং বধ্যতামপি।।কৈকেয়ীর প্ররোচনায় সন্তুষ্ট হয়ে,আমাদের পিতা যদি শত্রুতা করেন তাহলে তিনি কারারুদ্ধ হবেন এবং নিঃসন্দেহে তিনি বধযোগ্য। লক্ষ্মণ যেন রামের “তিমিরবিদারী উদার অভ্যুদয়”সেই সূর্য। শৌর্যবলে তিনি রামের সমস্ত দুঃখ দূর করবেন — এমনই তাঁর স্থির আত্মবিশ্বাস। হরামি বীর্য্যাদ্দুঃখং তে তমঃ সূর্য ইবোদিতঃ। রামের সমস্ত জীবনযুদ্ধজয়ে লক্ষ্মণের ভূমিকা অপরিসীম। দৈব শক্তি নয়, রামের আত্মশক্তির উৎস লক্ষ্মণ। বিশ্বস্ত পার্শ্বচর, নর্ম সখা, নির্ভরযোগ্য শ্রমিক, স্নেহের কাঙ্গাল এক অনুজ। লক্ষ্মণ পারিবারিক বন্ধনের এক অপরিহার্য অঙ্গ, এখনও তরুণ প্রজন্মের অনুজদের আধুনিক মননে, প্রবাদপ্রতিম এই রামানুজ, আদর্শবাদী, আত্মত্যাগী, এক ভাই, যিনি প্রত্যুপকারের প্রত্যাশাহীন এক তরুণ।
ভরত, জননীকে তীব্র ভর্ৎসনায় বিদ্ধ করেন, পিতাকে প্রকারান্তরে অভিসম্পাত করেন, বিষাদাক্রান্ত ভরত নিজেকে মায়ের ক্রুর চক্রান্তের ফলে নিজেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন। শুধু পরিবারের সদস্যদের নয় বৃহত্তর রাজ্যরূপ পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছেন ভরত, অবিশ্বাস সন্দেহের চোরাস্রোত বার বার তাঁর মানসিক স্থৈর্য নষ্ট করেছে সত্যিই, তবু তিনি ধর্মবোধ হারিয়ে ফেলেননি। পিতাকে দোষারোপ করেননি কখনও। গভীর আত্মপ্রত্যয়ী ভরত ঘোষণা করেছেন,এই দুর্নাম তিনি দূর করে যশ লাভ করবেন আবার। অহন্ত্বপচিতিং ভ্রাতুঃ পিতুশ্চ সকলামিমাম্। বর্দ্ধনং যশশ্চাপি করিষ্যামি না সংশয়ঃ।। বিবেকবান মানুষ, শত প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ধর্মবোধ বিসর্জন দেন না।
ভরতের রামভক্তি অন্তঃসলিলা নদীস্রোতের মতো। নিরবচ্ছিন্ন তার বয়ে চলা, সকলের অধরা থেকে যায়। ভক্তের আত্মনিবেদন, ভাবোচ্ছ্বাসের প্রাবল্য, প্রিয় আরাধ্যকে অনেক প্রতিশ্রুতির বন্ধনে জড়াতে চায়, বাস্তবে কী তা সম্ভব? হয়তো নয়। তবু থেকে যায় তাঁদের অবিসংবাদী আনুগত্য, নির্মল, শুদ্ধ সারল্যের কোমল মায়াময় প্রকাশ। ভরত সেই শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে আপ্লুত রামানুজ, সংসারে যাঁদের উপস্থিতি বড় প্রয়োজন সবসময়ে, সবকালে।—চলবে।
রামকে রাজ্যাধিকার হতে বঞ্চিত করেছেন পিতা। প্রতিবাদী লক্ষ্মণ, সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। তিনি রামের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে দ্বিধাহীন। লক্ষ্মণ পিতাকে প্রয়োজনে বধ করতেও পারেন। প্রোৎসাহিতোঽয়ং কৈকেয্যা সন্তুষ্ট যদি নঃ পিতা। অমিত্রভূতো নিঃশঙ্কং বধ্যতাং বধ্যতামপি।।কৈকেয়ীর প্ররোচনায় সন্তুষ্ট হয়ে,আমাদের পিতা যদি শত্রুতা করেন তাহলে তিনি কারারুদ্ধ হবেন এবং নিঃসন্দেহে তিনি বধযোগ্য। লক্ষ্মণ যেন রামের “তিমিরবিদারী উদার অভ্যুদয়”সেই সূর্য। শৌর্যবলে তিনি রামের সমস্ত দুঃখ দূর করবেন — এমনই তাঁর স্থির আত্মবিশ্বাস। হরামি বীর্য্যাদ্দুঃখং তে তমঃ সূর্য ইবোদিতঃ। রামের সমস্ত জীবনযুদ্ধজয়ে লক্ষ্মণের ভূমিকা অপরিসীম। দৈব শক্তি নয়, রামের আত্মশক্তির উৎস লক্ষ্মণ। বিশ্বস্ত পার্শ্বচর, নর্ম সখা, নির্ভরযোগ্য শ্রমিক, স্নেহের কাঙ্গাল এক অনুজ। লক্ষ্মণ পারিবারিক বন্ধনের এক অপরিহার্য অঙ্গ, এখনও তরুণ প্রজন্মের অনুজদের আধুনিক মননে, প্রবাদপ্রতিম এই রামানুজ, আদর্শবাদী, আত্মত্যাগী, এক ভাই, যিনি প্রত্যুপকারের প্রত্যাশাহীন এক তরুণ।
ভরত, জননীকে তীব্র ভর্ৎসনায় বিদ্ধ করেন, পিতাকে প্রকারান্তরে অভিসম্পাত করেন, বিষাদাক্রান্ত ভরত নিজেকে মায়ের ক্রুর চক্রান্তের ফলে নিজেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন। শুধু পরিবারের সদস্যদের নয় বৃহত্তর রাজ্যরূপ পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছেন ভরত, অবিশ্বাস সন্দেহের চোরাস্রোত বার বার তাঁর মানসিক স্থৈর্য নষ্ট করেছে সত্যিই, তবু তিনি ধর্মবোধ হারিয়ে ফেলেননি। পিতাকে দোষারোপ করেননি কখনও। গভীর আত্মপ্রত্যয়ী ভরত ঘোষণা করেছেন,এই দুর্নাম তিনি দূর করে যশ লাভ করবেন আবার। অহন্ত্বপচিতিং ভ্রাতুঃ পিতুশ্চ সকলামিমাম্। বর্দ্ধনং যশশ্চাপি করিষ্যামি না সংশয়ঃ।। বিবেকবান মানুষ, শত প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ধর্মবোধ বিসর্জন দেন না।
ভরতের রামভক্তি অন্তঃসলিলা নদীস্রোতের মতো। নিরবচ্ছিন্ন তার বয়ে চলা, সকলের অধরা থেকে যায়। ভক্তের আত্মনিবেদন, ভাবোচ্ছ্বাসের প্রাবল্য, প্রিয় আরাধ্যকে অনেক প্রতিশ্রুতির বন্ধনে জড়াতে চায়, বাস্তবে কী তা সম্ভব? হয়তো নয়। তবু থেকে যায় তাঁদের অবিসংবাদী আনুগত্য, নির্মল, শুদ্ধ সারল্যের কোমল মায়াময় প্রকাশ। ভরত সেই শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে আপ্লুত রামানুজ, সংসারে যাঁদের উপস্থিতি বড় প্রয়োজন সবসময়ে, সবকালে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।