শুক্রবার ২ মে, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে সুদূর চিত্রকূট পর্বতে বনবাসী রামের সঙ্গে কৈকেয়ীপুত্র ভরতের সাক্ষাৎ হল। প্রাথমিক কুশল সংবাদ বিনিময়ের পরে, বিবর্ণ মুখ, শীর্ণকায়, চীরবসনধারী ভরতকে দেখে, রাম, পিতার সম্বন্ধে চিন্তান্বিত হলেন। পরবর্তী পর্যায়ে, রামের প্রতিক্রিয়া ছিল,রাজ্যসম্বন্ধে উদ্বেগবোধের প্রকাশ। ভরতের শাসনাধীন অযোধ্যায় প্রশাসনিক শৃঙ্খলা যথাযথভাবে রক্ষিত হচ্ছে তো? এই প্রসঙ্গে রাম যেন দক্ষ অভিজ্ঞ প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি রাজ্য শাসন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, জানতে উদগ্রীব হলেন। এই বিষয়ে রামের সমস্ত প্রশ্নে, প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজ্যশাসনের ঊনকোটি জ্ঞান প্রতিফলিত হল।

এ বার রাম, ভরতের আগমনের প্রকৃত কারণ জানতে উৎসুক হলেন। কিমেতদিচ্ছেয়মহং শ্রোতুং প্রব্যাহৃতং ত্বয়া। যস্মাৎ ত্বমাগতো দেশমিমং চীরজটাজিনী।। যন্নিমিত্তমিমং দেশং কৃষ্ণাজিনজটাধরঃ। হিত্বা রাজ্যং প্রবিষ্টস্ত্বং তৎ সর্ব্বং বক্তুমর্হসি।। আমি তোমার কাছে শুনতে চাই, তুমি কেন চীর, জটা ও অজিনধারীর বেশে এখানে এসেছ? যে কারণে, তুমি রাজ্য ত্যাগ করে, এই কৃষ্ণাজিন ও জটা ধারণ করে এখানে এসেছ, সেই সবকিছু বলতে পার। মহাত্মা রামের প্রস্তাবে আবারও দৃঢ় আলিঙ্গনাবদ্ধ কৈকেয়ীপুত্র করজোড়ে বললেন, মহাশক্তিমান পিতা, অতি দুষ্কর সব কর্ম সম্পন্ন করে, পুত্রশোকাতুর অবস্থায় লোকান্তরিত হয়েছেন। ভরত জানালেন, রাজা দশরথ, তাঁর পত্নী ভরতমাতা কৈকেয়ীর ইচ্ছায়, নিজের যশোনাশক এই মহাপাপ কাজটি করেছেন। সেই বিধবা, শোকতপ্তা, নারী, কৈকেয়ী, রাজ্যলাভজনিত কোনও সুফলই পাননি। ভরতজননী, মহানরকে পতিত হবেনই। বিনম্র ভরতের অকপট স্বীকারোক্তি—ভরত রামের দাসমাত্র। রাম তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করতে সক্ষম। আজই ইন্দ্রের মতো রাম নিজরাজ্যে অভিষিক্ত হোন। তস্য মে দাসভূতস্য প্রসাদং কর্ত্তুমর্হসি। অভিষিঞ্চস্য চাদ্যৈব রাজ্যেন মঘবানিব।। এই প্রজাবৃন্দ, সকল বিধবা জননীরা, সকলে রামের কাছে এসেছেন। এখন রামের প্রসন্নতা যুক্তিযুক্ত। ভরতের আবেদন—হে সম্মানীয় জ্যেষ্ঠ, ক্রমানুযায়ী আপনিই যোগ্য উত্তরাধিকারী। তাই, ধর্মানুসারে রাজ্য গ্রহণ করে, সুহৃদ্বর্গের কামনা পূর্ণ করুন। তথানুপূর্ব্বা যুক্তশ্চ যুক্তঞ্চাত্মনি মানদ। রাজ্যং প্রাপ্নুহি ধর্মেণ সকামান্ সুহৃদঃ কুরু।।
নির্মল চন্দ্র যেমন শারদীয়া রজনীর স্বামী, তেমনই রামের স্বামীত্বে, সমগ্র ধরণী বৈধব্যমুক্ত হোক। ভরত, সচিববৃন্দের সঙ্গে নতমস্তকে, প্রার্থনা করলেন। ভরত যাঁর একযোগে, ভাই, শিষ্য, দাস, সেই ভরতকে রাম, যেন অনুগৃহীত করেন। পুরুষানুক্রমে পৈতৃক এই মন্ত্রীমণ্ডল, সকলের সম্মানীয়। পুরুষোত্তম রামের অমাত্যদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা, উচিত নয়। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে,এই কথা বলে, মহাবাহু কৈকেয়ীতনয়, রামের চরণযুগল মস্তকে গ্রহণ করলেন। প্রমত্ত গজের মতো বার বার নিঃশ্বাস ফেলে, রাম ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে বললেন, কেমন করে, সদ্বংশজাত, মহাপ্রাণ, তেজস্বী ও পবিত্র ব্রতের পালনকারী, রামের মতো কোনও ব্যক্তি, তুচ্ছ রাজ্যের কারণে পাপাচরণ করতে পারে? রাম, ভরতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনও দোষ দেখেন না। অপরিণতবুদ্ধি বালকের মতো মায়ের প্রতি দোষারোপ করাও তাঁর উচিত কাজ নয়। গুরুজনরা, সর্বদা নিজেদের স্ত্রী ও পুত্রের প্রতি ইচ্ছানুসারে অকপট আচরণ করে থাকেন।

এমন শোনা যায়, এই পৃথিবীতে সাধু ব্যক্তিরা যেমন পত্নী, পুত্র, শিষ্যকে আজ্ঞাবহ মনে করেন করেন, তেমনই তাঁরাও (রাম, ভরত লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন) তাঁর (পিতার) আজ্ঞাধীন। মহারাজ (দশরথ), হলেন প্রভু। তিনি, চীরবসন ও কৃষ্ণাজিন বেশধারী রামকে, বনে বা রাজ্যে যেখানে খুশি বাস করাতে পারেন। লোকসমাজে, সদাচারণ হল—পিতার যেমন গৌরব তেমনই মাতারও। ধার্মিক পিতামাতা, যখন বলেন, বনে যাও, তখন রাম কী সে আদেশ অন্যথা করতে পারেন? অযোধ্যার সর্বলোকস্বীকৃত রাজ্য ভরতের প্রাপ্য, বল্কলধারী রামের প্রাপ্য দণ্ডকারণ্যের অরণ্যবাস। লোকসমক্ষে এমনটাই বিভাগ করে এবং সেই মর্মে আদেশ দান করে, রাজা, স্বর্গে গমন করছেন। ভরতের (রাজ্যাধিকারের) পক্ষে, লোকগুরু ধর্মাত্মা রাজাই প্রমাণ। পিতৃপ্রদত্ত যথোপযুক্ত ভাগ, উপভোগ করাই ভরতের কর্তব্য। রাম, দণ্ডকারণ্যের আশ্রয়ে চতুর্দশ বৎসর পিতৃপ্রদত্ত বনবাস উপভোগ করবেন। রামের অনুভব—ইন্দ্রপ্রতিম, লোকমান্য মহাত্মা পিতা আমাকে যেমন বলে গিয়েছেন, তাতেই পরম কল্যাণ নিহিত রয়েছে, সর্বজনের প্রতি চিরন্তন প্রভুত্বভাবে তা নেই, এমনটাই আমি মনে করি। যদব্রবীন্মাং নরলোকসৎকৃতঃ পিতা মহাত্মা বিবুধাধিপোপমঃ।তদেব মন্যে পরমাত্মনো হিতং ন সর্ব্বলোকেশ্বরভাবমব্যয়ম্।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১০: বনবাসী রামের নিরাসক্ত ভাবমূর্তির অন্তরালে, ভাবি রামরাজ্যের স্রষ্টা দক্ষ প্রশাসক রাম

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৮: রান্নার জ্বালানি নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?

রামের কথা শুনে, ভরত, প্রত্যুত্তরে বললেন—তিনি নিজে ধর্মহীন। রাজধর্ম তাঁর কী করবে? আমাদের চিরন্তন পরম্পরাগত কুলধর্ম হল, রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিদ্যমান থাকলে কনিষ্ঠ কখনও রাজা হতে পারেন না। তাই ভরতের অনুরোধ, হে রাঘব, আপনি আমার সঙ্গে সুসমৃদ্ধ অযোধ্যানগরীতে ফিরে চলুন এবং আমাদের রঘুকুলের মঙ্গলের জন্যে নিজে অভিষিক্ত হোন। স সমৃদ্ধাং ময়া সার্দ্ধমযোধ্যাং গচ্ছ রাঘব। অভিষেচয় চাত্মানং কুলস্যাস্য ভবায় নঃ।। ভরতের মতে, রাজাকে মানুষ বলে মনে করা হলেও, তিনি দেবতা। কারণ হল, রাজার ধর্ম ও অর্থের সাযুজ্যময় আচরণ, অতিলৌকিক। ভরত যখন কেকয়রাজ্যে অবস্থান করছেন, রামের আশ্রয় যখন অরণ্য, সেই সময়ে সজ্জন-সম্মত, যাজ্ঞিক, ধীমান রাজা স্বর্গত হয়েছেন। ভরত আরও বিশদে জানালেন, যেই মাত্র রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ-সহ নিষ্ক্রান্ত হয়েছেন, সেই মুহূর্তে দুঃখ-শোকাভিভূত রাজা সুরলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। ভরতের একান্ত অনুরোধ, যে কাজ ভরত নিজে শত্রুঘ্নসহ পূর্বেই সম্পন্ন করেছেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ রাম গাত্রোত্থান করে প্রয়াত পিতার জলদানাদি পারলৌকিক সেই কাজ সম্পন্ন করুন।

ভরত বিশ্বাস করেন, প্রিয়জনপ্রদত্ত যা কিছু পিতৃলোকে অক্ষয় হয়,এমন প্রচলিত কথাটিই সত্য। রাম যে পিতার প্রিয় পুত্র। পিতার জীবনে রামের অবিসংবাদিত উপস্থিতি ভরত স্বীকার করেন। তিনি রামকে বললেন, তোমার শোকে, তোমার দর্শনেচ্ছায়, তোমাতে আসক্ত মনটিকে তিনি ফিরিয়ে নিতে পারেননি।তোমার বিচ্ছেদহেতু শোকরুগ্ন পিতা, তোমায় স্মরণ করতে করতে, চলে গিয়েছেন। ত্বামেব শোচংস্তব দর্শনেপ্সুঃ ত্বয্যেব সকামনিবর্ত্ত্য বুদ্ধিম্। ত্বয়া বিহীনস্তব শোকরুগ্নস্ত্বাং সংস্মরেন্নেব গতঃ পিতা তে।।

ভরতকথিত, পিতার করুণ প্রয়াণবার্তা শুনে, রাম সংজ্ঞা হারালেন। ভরতের সেই চরম বজ্রাঘাতসম শব্দের অভিঘাত ছিল ঠিক, রণক্ষেত্রে ইন্দ্রের নিক্ষিপ্ত বজ্রতুল্য। রাম, যিনি অরিন্দম, তিনি বাহু প্রসারিত করে ভূলুণ্ঠিত হলেন, ঠিক যেন বনে কুঠারাঘাতে ছিন্নমূল কুসুমিত তরুটি। পৃথিবীপতি, রাম ভূমিতে পড়ে আছেন, তিনি যেন হঠাৎ ভূপতিত তটভাগের দ্বারা পিষ্ট নিদ্রামগ্ন গজ। মহাধনুর্দ্ধরের সেই শোকক্লিষ্ট অবস্থায়, সীতা-সহ ভ্রাতারা চারিদিক থেকে তাঁকে ঘিরে ধরলেন, রোরুদ্যমান হয়ে জল সেচন করতে লাগলেন। চেতনা ফিরে পেয়ে,ক্রমাগত অশ্রুসজল চোখে, করুণ স্বরে, রাম বহু কথা বলতে লাগলেন। পৃথিবীপতি পিতা লোকান্তরিত হয়েছেন শুনে, ধর্মাত্মা রাম, ভরতকে ধর্মসঙ্গত কথা বলতে লাগলেন। নিয়তির বিধান অনুসারে পিতা আজ নেই, কি করব অযোধ্যায়? শ্রেষ্ঠ রাজাহীন অযোধ্যাকে কে পরিপালন করব? রাম মনে করেন তাঁর জন্মই বৃথা, কারণ সেই মহান পিতার উপকারের জন্য, রাম কোন কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন? পিতা রামের শোকে মৃত, অথচ তাঁর অন্তিম সংস্কার পর্যন্ত রাম করতে পারেননি। রাম মনে করেন, নিষ্পাপ ভরতের জীবনের উদ্দশ্য আজ সফল। শত্রুঘ্নের সঙ্গে একত্রে ভরত, পিতার প্রেতকার্যটি সম্পন্ন করেছেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৫: ঠাকুর বলতেন—‘যে সয় সে রয়’

প্রধানবিহীন, অযোধ্যায় এখন অনেকে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি রয়েছেন, সেখানে রাজার অভাব, এমন অযোধ্যায় বনবাস হতে প্রত্যাবৃত্ত রাম যেতে উৎসুক নন। পিতা লোকান্তরিত হয়েছেন, এমতাবস্থায় রাম পিতার অনুশাসন অনুসারে পথ চলবেন কীভাবে? পূর্বে পিতা দশরথ, রামের শোভন আচরণ দেখে সান্ত্বনা দান করে,যে সব বাক্য বলতেন, সেই সব শ্রুতিমধুর কথা কার কাছে শুনবেন? এমন কথা বলে, রাম, ভরতের কাছে শোকসন্তপ্ত হৃদয়ভার হয়তো লাঘব করলেন। শোকাকুল রাম, পূর্ণচন্দ্রতুল্য যাঁর বদন সেই সীতাকে জানালেন, তাঁর শ্বশুরমহাশয় পরলোকগমন করেছেন। লক্ষ্মণকে বললেন, পিতৃহীনোঽসি লক্ষ্মণ লক্ষ্মণ তুমি পিতৃহীন হয়েছ। ভরত অতি কষ্টে, পিতার প্রয়াণের দুঃসংবাদটি জানিয়েছেন। রামের, এমন কথা শুনে, যশস্বী রাজপুত্রদের নয়নের অশ্রুজল আরও বৃদ্ধি পেল। ভ্রাতারা সকলে মিলে, দুঃখী রামকে বার বার সান্ত্বনা দিতে দিতে পিতার উদ্দেশে জলাঞ্জলি দান করতে বললেন। দেবী সীতা, শ্বশুরমহাশয় মহারাজ দশরথ স্বর্গত হয়েছেন শুনে, অশ্রপূর্ণ নয়নে প্রিয় রামের দিকে দৃষ্টিপাত করতে, অক্ষম হলেন। ক্রন্দনরতা সীতাকে সান্ত্বনা দান করে, দুঃখিত রাম, কষ্টকর কথা বললেন, লক্ষ্মণ, তুমি পিষ্ট ইঙ্গুদী ফল এবং চীরবসন ও উত্তরীয় আন। মহাত্মা পিতার উদকদান ক্রিয়া সম্পন্ন করব। আনয়েঙ্গুদিপিণ্যাকং চীরমোহর চোত্তরম্।জলক্রিয়ার্থং তাতস্য গমিষ্যামি মহাত্মনঃ।। রাম লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন, সীতা হবেন অগ্রবর্তিনী, তাঁর পশ্চাতে লক্ষ্মণ আর রাম যাবেন সকলের পশ্চাতে, এখন বড় দুঃসময়।

সর্বদা অনুগত, আত্মজ্ঞান যাঁর আয়ত্তাধীন, প্রখর বুদ্ধিমান, যিনি সংযত, কমনীয়, রামের প্রতি যাঁর অটল ভক্তি, সেই সুমন্ত্র, রাজপুত্রদের সঙ্গে রামকে আশ্বস্ত করে, নিজে রামের অবলম্বন হয়ে, পবিত্র মন্দাকিনীতে রামকে অবতরণ করালেন। সেই যশস্বীগণ, অতি কষ্টে, সুন্দর তীর্থশালিনী, সতত কুসুমে সজ্জিত উপবনবিশিষ্ট রমণীয় মন্দাকিনীর সমীপবর্তী হয়ে সদা স্রোতস্বিনী মন্দাকিনীর কর্দমহীন তীর্থে পিতার উদ্দেশে উদকদান করলেন। দক্ষিণাভিমুখে জলপূর্ণ অঞ্জলি গ্রহণ করে, রোরুদ্যমান রামচন্দ্র বলতে লাগলেন, হে রাজশ্রেষ্ঠ,আমার প্রদত্ত এই নির্মল জল, পিতৃলোকগত আপনার কাছে, অক্ষয় হয়ে পৌঁছে যাক। ভ্রাতাদের সঙ্গে একযোগে পিণ্ডদান সম্পন্ন করলেন রাম। কুশাচ্ছাদিত বদরীফলমিশ্রিত পিষ্ট ইঙ্গুদী রেখে, দুঃসহ দুঃখে কেঁদে উঠলেন রাম। মহারাজ, যা আমাদের ভোজ্য, আপনি সেটিই সানন্দে ভোজন করুন। মানুষ যে অন্ন ভোজন করেন, তাঁর দেবতারাও সেই অন্নই আহার করে থাকেন যে। ইদং ভুক্ষ্ব মহারাজ প্রীতো যদশনা বয়ম্। যদন্নঃ পুরুষো রাজন্ তদন্নাস্তস্য দেবতাঃ।।
আরও পড়ুন:

আকাশ এখনও মেঘলা/১৪

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ

প্রেতকার্য সমাপনান্তে, রাম যে পথে গিয়েছিলেন সেই পথেই নদীতীর হতে ক্রমে মনোরম গিরিসানুদেশে উত্তীর্ণ হলেন। পর্ণকুটিরের দ্বারে উপস্থিত হয়ে, তিনি, ভরত ও লক্ষ্মণকে দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। সীতা-সহ ভ্রাতারা সকলে আর্তস্বরে কেঁদে উঠলেন। সিংহনাদতুল্য ক্রন্দনধ্বনির প্রতিধ্বনি সমস্ত পর্বতে ছড়িয়ে পড়ল। পিতার জলদানরত মহাবীরদের তুমুল ক্রন্দনধ্বনি শুনে ভরতের সৈন্যরা সন্ত্রস্ত হয়ে বলাবলি করতে লাগল—নিশ্চয়ই ভরত রামের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। মৃত পিতার উদ্দেশ্যে তাঁদের শোকের প্রকাশে এই মহাশব্দ উত্থিত হয়েছে। সৈনিকরা বাহন ত্যাগ করে, একাগ্রচিত্তে সেই শব্দ লক্ষ্য করে ধাবিত হল। সুকুমার পুরুষরা কেউ অশ্বে,কেউ বা গজে, কেউ সালঙ্কার রথে আরোহণ করলেন, অবশিষ্টাংশ পদব্রজে চললেন।

স্বল্প দিনের জন্য রাম প্রবাসী হয়েছেন, অথচ তিনি যেন চিরকালের জন্যে প্রবাসী হয়েছেন এমন মনে করে, সকলে তাঁর দর্শনেচ্ছায় আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তাঁরা ভ্রাতাদের এই একত্র সমাবেশ দেখতে অত্যন্ত সমুৎসুক হলেন। দ্রুতগামী খুরনেমিযুক্ত বিভিন্ন যানবাহনে আরোহণ করে তাঁরা রওনা দিলেন। অনেক মেঘের সমাবেশে নভোমন্ডলে যেমন তুমুল শব্দের সৃষ্টি হয় তেমনই সৈন্যদের যাত্রাপথে, বহু যানবাহন রথনেমির দ্বারা আহত ভূমিতে ঘোর শব্দ উঠল। সেই শব্দে করেণুপরিবৃত, ত্রস্ত গজরা মদগন্ধে চতুর্দিক আমোদিত করে বনান্তরে যাত্রা করল। বরাহ, মৃগ, সিংহ, মহিষ, সূত্র, ব্যাঘ্র, গোকর্ণ, স্বয়ং ও পৃষতমৃগসহ প্রাণীদের মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হল। চক্রবাক, হংস, দাত্যূহ, কারণ্ডব, পুংস্কোকিল ও ক্রৌঞ্চ প্রভৃতি পক্ষীগণ, দিশাহারা হয়ে দিকে দিকে ছুটে গেল। সেই শব্দে ভীত ত্রস্ত পক্ষীরা আকাশ এবং মানুষেরা ভূপৃষ্ঠ আবৃত করে, উভয়েই যেন শোভা হয়ে উঠল।

সহসা সমবেত জনগণ, দেখলেন—পুরুষব্যাঘ্র, যশস্বী, নিষ্পাপ, রাম, ভূমিতলে উপবিষ্ট রয়েছেন। কৈকেয়ী ও মন্থরার নিন্দারত মানুষ যখন রামের সম্মুখে উপস্থিত হলেন, অশ্রুতে আবৃত হল তাঁদের মুখগুলি। অশ্রুসজলনয়নে দুঃখভারাক্রান্ত মানুষগুলিকে দেখে, ধর্মপ্রাণ রাম তাদের পিতামাতার তুল্য আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি কাউকে আলিঙ্গন করলেন, জনতার মধ্যে কেউ তাঁকে অভিবাদন করলেন। তিনি সমবয়স্ক, বন্ধুদের প্রতি যথাযোগ্য ব্যবহার প্রদর্শন করলেন। ক্রন্দনরত মহাজনদের রোদনধ্বনি, ভূতল, গগনমণ্ডল, গিরিগুহা ও সমস্ত দিকদিগন্তে মৃদঙ্গধ্বনির মতো শ্রুত হতে লাগল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৭: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

ভরতের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রাথমিকপর্যায়ে দক্ষ প্রশাসক রামের রাজ্যের সুরক্ষা ও অস্তিত্বসম্বন্ধে চিন্তাকুল ঔৎসুক্য, প্রমাণ করেছিল, রাজনৈতিক পরিসরে তিনিই অযোধ্যার সিংহাসনের যোগ্য উত্তরসূরী। কিন্তু হৃদয়বৃত্তির স্থান যে প্রশাসনিক তথাকথিত কেজো দুনিয়ার ঊর্দ্ধে রাম সেটা প্রমাণ করেছিলেন।

প্রথমে ভরতের মুখোমুখি রামের আচরণ, মনে করিয়ে দেয়,তিনি বনবাসী নিরাসক্ত রাম নন, তাঁর প্রথম পরিচয় হল তিনি ভাবি অযোধ্যারাজ। ভবিষ্যতে আয়ত্তাধীন রাজ্যের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলকামনায় নিবেদিতপ্রাণ এক যুবরাজ। ভরতের দীন, হীন, জটাচীরাজিনধারিবেশ, তাঁর আকৃতিতে শোকের অভিব্যক্তি, এ সবকিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে এ পর্যন্ত কোনও মানসিক ভাবান্তর সৃষ্টি করেনি। কেন ভরতের এই সর্বত্যাগী ভাবমূর্তি? এ প্রশ্ন জেগেছে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়। দক্ষ প্রশাসক রাম, যেন বর্তমানের কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত এক কর্মাধ্যক্ষের প্রতীক। শুধু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নয়, যে কোন প্রশাসনের জগৎ বড় নিষ্ঠুর, বড় কঠিন, শক্ত, ভূমি, যেখানে প্রশাসনিক কাজের জটিলতা, ব্যক্তিসত্তার নিরন্তর ভাবাবেগ ও সুকুমার কোমলবৃত্তিগুলি শুষে নেয়। থাকে শুধু, কঠোর, শুষ্ক, রুক্ষ, বাস্তবের ঊষর তপ্ত বালুকাময় মরুভূমির শূন্যতা। কর্তব্যবোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠার আগ্রাসী ক্ষুধা, চেটেপুটে শেষ করে দেয় মনের পেলবস্নেহের ফল্গুধারা।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সংবেদনশীল,বিনয়াবনত ভরত। জ্যেষ্ঠর প্রতি তাঁর আবেদনে ছিল আকুল আর্তি ও শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের প্রকাশ। সমস্ত বিরুদ্ধ সমালোচনার মলিন কালিমা নিমেষে নস্যাৎ করে দিয়েছেন ভরত। ভরত, পিতার মৃত্যুসংবাদ ও মৃত্যুর মূল কারণ তাঁর জননী কৈকেয়ী—এই বার্তা অকপটে নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য একটাই, ভাবি রাজাকে উত্তরাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। রাম প্রথমেই ভরতের আবেদন নাকচ করেছেন। রামের অন্তরাত্মা সত্য ও ন্যায়ের দৃঢ় ভিত্তিভূমিতে প্রোথিত। রাজ্য বা ক্ষমতার লিপ্সা তাঁর কাছে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর। জননীর নিন্দায় মুখর ভরতকে, রাম, অপরিণত বুদ্ধি বালক বলে সমালোচনা করেছেন। রামের কর্তব্যনিষ্ঠায় আছে শুধু পিতৃভক্তির অপরিসীম প্রকাশ। যে কোনও কাজের অন্তরালে যদি শ্রদ্ধা, নিষ্ঠাময় দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকার প্রচ্ছন্ন থাকে তবেই সেই কাজ সফল হয় এবং কর্মকর্তা একজন নিপুণ কর্মযোদ্ধার ভূমিকায়, জয়ীর শিরোপা লাভ করে থাকেন। রাম একজন তেমনই কুশল, প্রশাসক, যিনি কর্তব্যপরায়ণাতা ও দায়বদ্ধতা পালন করেন,হৃদয়বৃত্তিকে উপেক্ষা করে নয়, বরং সে বিষয়টির প্রাধান্যই তাঁর প্রথম শর্ত।

রাম সার্থক রাজা হয়েছিলেন।সফল রামরাজ্যের স্রষ্টা রাম, ক্ষুদ্র পারিবারিক পরিসরে,স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে,পিতার প্রতি সত্যনিষ্ঠতাপালনে,বিশ্বস্ততার প্রমাণ রেখেছিলেন।সেই দায়বদ্ধতা,বজায় রেখেছিলেন,বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরেও।রামায়ণের এই উদাহরণ,যে কোন উচ্চতম প্রশাসনিক কাজে যুক্ত কর্মাধ্যক্ষের ক্ষেত্রেই বোধ হয় প্রযোজ্য।আমাদের চেনা জগতের ছোট দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকারগুলিই,ভাবি কালে,অনিশ্চিত পৃথিবীতে,নিজস্ব বৃত্তের বাইরের বৃহত্তর পরিসরে আমাদের আরও উদার ও মহৎ করে তোলে।একটি প্রতিশ্রুতিময় সম্ভাবনার উদ্ভব হয় তখন। পিতার প্রতিশ্রুতিরক্ষায় অনমনীয় রামচন্দ্রের ভবিষ্যতের সফল রাজা হয়ে ওঠার মূলে হয়তো এই শ্রদ্ধামিশ্রিত নিষ্ঠাই কারণ।রামচন্দ্রের আবেগাপ্লুত কর্মনিষ্ঠা, এই কর্মব্যস্ত কর্পোরেট জীবনেও উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে কী?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content