
ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
দাম্পত্যের শর্তভঙ্গকারী অর্জুন ফিরে এসেছেন ইন্দ্রপ্রস্থে। পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করছেন। তাঁরা রাজা শান্তনুপুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও পিতামহ ভীষ্মের আদেশানুসারে অন্যান্য রাজাদের জয় করলেন। পুণ্যকর্মকর্তা মানুষ যেমন নিজ দেহ ধারণ করে সুখে বাস করেন তেমনই সব জনসাধারণ ধার্মিক রাজা যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়ে সুখে বাস করতে লাগলেন। নীতিবিদ যুধিষ্ঠির ধর্ম, অর্থ ও কামকে নিজের বন্ধুজ্ঞানে তাদের প্রতি সমভাবাপন্ন হয়ে সেবা করতে লাগলেন। দেহধারী মানুষের পৈত্রিক ধনবিভাগে মধ্যস্থতা করে, উপকারিতার জন্যে যিনি চতুর্থ ব্যক্তিত্ব হয়ে শোভা পান, তেমনই রাজা যুধিষ্ঠির ধর্ম, অর্থ ও কামের সমবিভাগ করে, চতুর্থরূপে পৃথিবীর শোভাবর্ধন করলেন। যিনি পরম বেদাধ্যয়ী (বিদ্যা বিনয় দান করে, তাই বিনয়ী), জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতি যজ্ঞের প্রয়োগকর্তা (ধার্মিক), সজ্জনদের রক্ষক (সদসদ্বিষয়ে নীতিজ্ঞ) এমন নরেশ যুধিষ্ঠিরকে প্রজারা লাভ করলেন। যুধিষ্ঠিরের শাসনাধীন রাজাদের অধীন চঞ্চলা লক্ষ্মীও চিরস্থিরা হলেন, তাঁদের বুদ্ধি হল ন্যায়নিষ্ঠ, সমস্ত ধর্মের বাড়বাড়ন্ত দেখা দিল। চারটি বেদের বিধানানুসারে অনুষ্ঠিত মহাযজ্ঞের মতো রাজা যুধিষ্ঠির, চার ভাইয়ের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শোভা বিস্তার করলেন।
বৃহস্পতিতুল্য ধৌম্য প্রভৃতি প্রধান ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিবেষ্টিত যুধিষ্ঠির যেন দেবগণপরিবেষ্টিত প্রজাপতি ব্রহ্মাসম পূজিত হতে লাগলেন। নির্মল পূর্ণচন্দ্রসম রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রতি প্রীতিবশত প্রজাদের নয়ন ও হৃদয় আনন্দিত হল। প্রজারা দৈবপ্রভাবে হর্ষোৎফুল্ল হলেন, সেটি কিন্তু নয়। পারস্পরিক নিজ নিজ ব্যবহারেও তাঁরা সন্তোষ অনুভব করলেন। কারণ হল, যুধিষ্ঠিরের কর্মের ফলে তাঁদের মন নির্মল হয়েছিল। স্বভাবমধুর ও বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির অযৌক্তিক, অসত্য, অসহনীয় এবং অপ্রিয় কোনও কথা বলতেন না। সর্বলোকের কল্যাণকামী ও সেইসঙ্গে আত্মহিতসাধনে ইচ্ছুক হয়ে সুমহান তেজস্বী ও শ্রেষ্ঠ ভরতবংশীয় যুধিষ্ঠির আনন্দ লাভ করতেন। সবরকম উদ্বেগ ত্যাগ করে, আনন্দিত পাণ্ডবরা, নিজেদের পরাক্রমে, অন্যান্য রাজাদের জ্বালা ধরিয়ে, সন্তোষ সহকারে বাস করতে লাগলেন।
বৃহস্পতিতুল্য ধৌম্য প্রভৃতি প্রধান ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিবেষ্টিত যুধিষ্ঠির যেন দেবগণপরিবেষ্টিত প্রজাপতি ব্রহ্মাসম পূজিত হতে লাগলেন। নির্মল পূর্ণচন্দ্রসম রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রতি প্রীতিবশত প্রজাদের নয়ন ও হৃদয় আনন্দিত হল। প্রজারা দৈবপ্রভাবে হর্ষোৎফুল্ল হলেন, সেটি কিন্তু নয়। পারস্পরিক নিজ নিজ ব্যবহারেও তাঁরা সন্তোষ অনুভব করলেন। কারণ হল, যুধিষ্ঠিরের কর্মের ফলে তাঁদের মন নির্মল হয়েছিল। স্বভাবমধুর ও বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির অযৌক্তিক, অসত্য, অসহনীয় এবং অপ্রিয় কোনও কথা বলতেন না। সর্বলোকের কল্যাণকামী ও সেইসঙ্গে আত্মহিতসাধনে ইচ্ছুক হয়ে সুমহান তেজস্বী ও শ্রেষ্ঠ ভরতবংশীয় যুধিষ্ঠির আনন্দ লাভ করতেন। সবরকম উদ্বেগ ত্যাগ করে, আনন্দিত পাণ্ডবরা, নিজেদের পরাক্রমে, অন্যান্য রাজাদের জ্বালা ধরিয়ে, সন্তোষ সহকারে বাস করতে লাগলেন।
একদা অর্জুনের প্রস্তাবানুযায়ী কৃষ্ণ ও অর্জুন তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের উত্তাপ প্রশমিত করতে, যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে, সুহৃদবর্গের সঙ্গে যমুনায় জলবিহারের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। স্থির হল, দিবস জুড়ে সেখানে বিচরণ করে দিনান্তে ফিরে আসবেন। কৃষ্ণ, মনোরম যমুনার তীরবর্তী উদ্যানগুলিতে কুসুমিত পুষ্পরাশি দর্শন করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন, উভয়ে, যমুনার উপকূলবর্তী ভল্লুকশৃগালশার্দূলনেকড়ে— কৃষ্ণসারমৃগ-অধ্যুষিত খাণ্ডববন ও সন্নিহিত অন্যান্য স্থান দর্শন করলেন। দীর্ঘ ও হ্রস্ব নানা বৃক্ষ ও গৃহে পরিপূর্ণ ইন্দ্রালয়তুল্য জলবিহারের স্থানটি। সেখানে কৃষ্ণ ও অর্জুনের জন্যে পর্যাপ্ত সুখাদ্য, রসযুক্ত পানীয়, মহার্ঘ মাল্য, গন্ধদ্রব্য প্রভৃতি ছিল। সকলে দ্রুত সেই নানা আকৃতিবিশিষ্ট অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন এবং যথাসুখে ক্রীড়ায় অংশ নিলেন। তাঁদের সঙ্গে বিশালনিতম্বা, সুগঠিতস্তনী, মদমত্ততাহেতু স্খলিতগামিনী, সুনয়না নারীরাও জলক্রীড়ায় যোগ দিলেন। পার্থ ও কৃষ্ণের নির্দেশক্রমে তাঁরা কেউ বনে, কেউ বা জলে, কেউ গৃহে আনন্দসহকারে ক্রীড়ারত হলেন। দ্রৌপদী ও সুভদ্রা মদমত্ততাবশত বিহ্বলতার কারণে সেই নারীদের, মহামূল্য বসন ও অলঙ্কারাদি দান করতে লাগলেন। মহানন্দে রমণীরা কেউ নাচতে লাগলেন, কেউ অপরকে আহ্বান জানাতে লাগলেন, কেউ বা হেসেই অস্থির হলেন,কেউ উত্তম মদ্য পান করতে লাগলেন। এক জন অপরকে গৃহাভ্যন্তরে রুদ্ধ করলেন, লীলাভরে একে অপরকে প্রহার করতে লাগলেন,কেউ বা গোপনে, আলাপচারিতায় রত হলেন। মনোজ্ঞ বেণুবীণামৃদঙ্গধ্বনিতে সুসমৃদ্ধ সেই বনভূমি মুখরিত হয়ে উঠল।
নিরন্তর উৎসবের আবহে কৃষ্ণ ও অর্জুন নিকটস্থ একটি রমণীয় স্থানে উপস্থিত হলেন। দুজনে সেখানে মহামূল্য আসনে উপবেশন করে অতীতের নানা শৌর্য ও অন্যান্য বহু বিষয়ে আলোচনা করে আনন্দ লাভ করলেন। যেন দুজনে, সুরলোকে অবস্থানরত দুই অশ্বিনীকুমারদ্বয়। সেই সময়ে, সেখানে উপস্থিত হলেন এক ব্রাহ্মণ। বিশাল শালবৃক্ষের মতো তাঁর দেহ,তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, সূর্যকিরণে তাঁর শ্মশ্রুগুলি পিঙ্গলবর্ণ ও উজ্জ্বলতাবিশিষ্ট, দৈর্ঘ্য ও স্থূলতায় সমতা রয়েছে এমন তাঁর আকৃতি। তাঁর তেজ নবোদিত সূর্যতুল্য, তিনি চীর ও জটাধারী। ব্রাহ্মণের পদ্মপত্রের মতো মুখশ্রী, তিনি যেন পিঙ্গলবর্ণের তেজে জ্বলছিলেন। সমীপস্থ দীপ্ততেজস্বী সেই দ্বিজশ্রেষ্ঠকে দেখে, বাসুদেব কৃষ্ণ ও অর্জুন দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন।
নিরন্তর উৎসবের আবহে কৃষ্ণ ও অর্জুন নিকটস্থ একটি রমণীয় স্থানে উপস্থিত হলেন। দুজনে সেখানে মহামূল্য আসনে উপবেশন করে অতীতের নানা শৌর্য ও অন্যান্য বহু বিষয়ে আলোচনা করে আনন্দ লাভ করলেন। যেন দুজনে, সুরলোকে অবস্থানরত দুই অশ্বিনীকুমারদ্বয়। সেই সময়ে, সেখানে উপস্থিত হলেন এক ব্রাহ্মণ। বিশাল শালবৃক্ষের মতো তাঁর দেহ,তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, সূর্যকিরণে তাঁর শ্মশ্রুগুলি পিঙ্গলবর্ণ ও উজ্জ্বলতাবিশিষ্ট, দৈর্ঘ্য ও স্থূলতায় সমতা রয়েছে এমন তাঁর আকৃতি। তাঁর তেজ নবোদিত সূর্যতুল্য, তিনি চীর ও জটাধারী। ব্রাহ্মণের পদ্মপত্রের মতো মুখশ্রী, তিনি যেন পিঙ্গলবর্ণের তেজে জ্বলছিলেন। সমীপস্থ দীপ্ততেজস্বী সেই দ্বিজশ্রেষ্ঠকে দেখে, বাসুদেব কৃষ্ণ ও অর্জুন দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৮: গার্হস্থ্যজীবনে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ভাবমূর্তি, তাঁর দেববিগ্রহে উত্তরণের একটি অন্যতম কারণ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯২: শ্রীমার সঙ্গে এক মেমসাহেবের কথোপকথন
ব্রাহ্মণ তাঁর বিশিষ্ট পরিচয় দিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ এবং বহুভোজী, তিনি সর্বদা অপরিমিত ভোজনে অভ্যস্ত। ব্রাহ্মণ, কৃষ্ণ ও অর্জুনের কাছে প্রার্থনা জানালেন, ভিক্ষে বার্ষ্ণেয়পার্থৌ! বামেকাং তৃপ্তিং প্রযচ্ছতম্। আমাকে একবার তৃপ্ত কর। কৃষ্ণ ও অর্জুন, উভয়ে, তাঁকে অভীপ্সিত অন্নদান করে পরিতৃপ্তির আশ্বাস দিলেন। ব্রাহ্মণ তাঁর প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটন করলেন।তিনি বললেন, আমি যে কোনও অন্ন ভক্ষণ করি না। আমি অগ্নিদেব। আমার যথাযোগ্য ভোজ্য তোমরা দান কর। নাহমন্নং বুভুক্ষে বৈ পাবকং মাং নিবোধতম্। যদন্নমনুরূপং মে তদ্ যুবাং সম্প্রযচ্ছতম্।। প্রহরারত ইন্দ্র সর্বদা এই খাণ্ডববন রক্ষা করছেন। সেই মহাত্মার কারণে তিনি এই বনটি দগ্ধ করতে পারছেন না। এই বনে বাস করেন ইন্দ্রসখা তক্ষক।সপরিবার তক্ষকের জন্যেই এই বনের রক্ষাকার্যে নিযুক্ত রয়েছেন বজ্রধারী ইন্দ্র। শুধু তক্ষক নয়, সেই সঙ্গে বহু প্রাণীকে রক্ষা করেন ইন্দ্র। ইন্দ্রের তেজস্বিতায় তাই ইচ্ছাসত্ত্বেও,ব্রাহ্মণবেশী অগ্নি,বনটি দগ্ধ করতে অক্ষম। তিনি আরও জানালেন,যেই তিনি বনদহনে উদ্যোগী হন সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রের মেঘেবর্ষণের দরুণ কাঙ্খিত দহনের ইচ্ছাপূরণ সম্ভব হয় না। দুই জন অস্ত্রবিদের সাহায্যে ব্রাহ্মণ এইবার খাণ্ডববন দহনে সক্ষম হবেন। এইটিই হবে তাঁর প্রতি প্রার্থিত অন্নদান।উত্তম অস্ত্রবিদ দুজনে জলধারা ও সমস্ত প্রাণীদের সব দিক হতে প্রতিহত করতে পারবেন।
খাণ্ডববনদহনের বৃত্তান্ত বর্ণনা করছেন, মহাভারতের কাহিনির বক্তা মহর্ষি ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন। শ্রোতা রাজা জনমেজয়। জনমেজয়ের অসীম কৌতূহল, যে বন রক্ষা করছেন স্বয়ং ইন্দ্র, সেই বনটি দগ্ধ করতে অগ্নিদেবের উৎসাহের কারণটি কী? তখন বৈশম্পায়ন,অগ্নির খাণ্ডবদহনের পুরাকাহিনি বিস্তারিত ও যথাযথভাবে বর্ণনা করলেন। পুরাণে বর্ণিত কাহিনিটি মুনিজনের প্রশংসিত বৃত্তান্ত।
পুরাণে কথিত আছে, ইন্দ্রতুল্য প্রভাবশালী এক রাজার কাহিনি, যাঁর নাম শ্বেতকি। তিনি ছিলেন মহান দানবীর, বুদ্ধিমান এবং বৃহৎ যজ্ঞকরা ছিল তাঁর নেশা। এই বিষয়ে তাঁর তুল্য কোন রাজাই ছিলেন না। এই যজ্ঞগুলিতে তিনি প্রচুর দক্ষিণা দান করতেন। অন্য কোনও কাজেই তাঁর মন নেই, কেবল যজ্ঞ ও সৎকর্মোপলক্ষ্যে দান ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। ঋত্বিকগণের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে, সেই রাজা যজ্ঞ করতেন। যজ্ঞে উত্থিত ধূমে আচ্ছন্ন হল ঋত্বিকদের চক্ষু। দীর্ঘকাল ধরে যজ্ঞ করে শ্রান্ত পুরোহিতেরা বিরত হলেন। রাজা কিন্তু যজ্ঞে অংশগ্রহণের নিমিত্ত তাঁদের অনুনয় করতে লাগলেন। ঋত্বিকগণের চক্ষু বিকল হল, তাঁরা যজ্ঞসমাপনে অক্ষম হলেন। তাঁদের অনুমতিক্রমে অন্য ব্রাহ্মণরা আরব্ধ যজ্ঞ সমাপ্ত করলেন। কালক্রমে রাজা শ্বেতকি, মনস্থ করলেন, আবার তিনি শতবর্ষব্যাপী যজ্ঞ করবেন।ঋত্বিকগণ এই বার সেই যজ্ঞসম্পাদনে, অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। মহাযশস্বী রাজা শ্বেতকি সুহৃদবর্গকে সঙ্গে নিয়ে বহু চেষ্টা করলেন। প্রণিপাত, মধুর বাক্যপ্রয়োগ ও দান, কোনওটাই বাদ গেল না। নিরলসভাবে বারে বারে ঋত্বিকদের অনুনয়বিনয় করতে লাগলেন। তাঁরা, মহোৎসাহী রাজার প্রস্তাবে সম্মত হলেন না।
খাণ্ডববনদহনের বৃত্তান্ত বর্ণনা করছেন, মহাভারতের কাহিনির বক্তা মহর্ষি ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন। শ্রোতা রাজা জনমেজয়। জনমেজয়ের অসীম কৌতূহল, যে বন রক্ষা করছেন স্বয়ং ইন্দ্র, সেই বনটি দগ্ধ করতে অগ্নিদেবের উৎসাহের কারণটি কী? তখন বৈশম্পায়ন,অগ্নির খাণ্ডবদহনের পুরাকাহিনি বিস্তারিত ও যথাযথভাবে বর্ণনা করলেন। পুরাণে বর্ণিত কাহিনিটি মুনিজনের প্রশংসিত বৃত্তান্ত।
পুরাণে কথিত আছে, ইন্দ্রতুল্য প্রভাবশালী এক রাজার কাহিনি, যাঁর নাম শ্বেতকি। তিনি ছিলেন মহান দানবীর, বুদ্ধিমান এবং বৃহৎ যজ্ঞকরা ছিল তাঁর নেশা। এই বিষয়ে তাঁর তুল্য কোন রাজাই ছিলেন না। এই যজ্ঞগুলিতে তিনি প্রচুর দক্ষিণা দান করতেন। অন্য কোনও কাজেই তাঁর মন নেই, কেবল যজ্ঞ ও সৎকর্মোপলক্ষ্যে দান ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। ঋত্বিকগণের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে, সেই রাজা যজ্ঞ করতেন। যজ্ঞে উত্থিত ধূমে আচ্ছন্ন হল ঋত্বিকদের চক্ষু। দীর্ঘকাল ধরে যজ্ঞ করে শ্রান্ত পুরোহিতেরা বিরত হলেন। রাজা কিন্তু যজ্ঞে অংশগ্রহণের নিমিত্ত তাঁদের অনুনয় করতে লাগলেন। ঋত্বিকগণের চক্ষু বিকল হল, তাঁরা যজ্ঞসমাপনে অক্ষম হলেন। তাঁদের অনুমতিক্রমে অন্য ব্রাহ্মণরা আরব্ধ যজ্ঞ সমাপ্ত করলেন। কালক্রমে রাজা শ্বেতকি, মনস্থ করলেন, আবার তিনি শতবর্ষব্যাপী যজ্ঞ করবেন।ঋত্বিকগণ এই বার সেই যজ্ঞসম্পাদনে, অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। মহাযশস্বী রাজা শ্বেতকি সুহৃদবর্গকে সঙ্গে নিয়ে বহু চেষ্টা করলেন। প্রণিপাত, মধুর বাক্যপ্রয়োগ ও দান, কোনওটাই বাদ গেল না। নিরলসভাবে বারে বারে ঋত্বিকদের অনুনয়বিনয় করতে লাগলেন। তাঁরা, মহোৎসাহী রাজার প্রস্তাবে সম্মত হলেন না।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২৪: তিন্দুক-জাতক: সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৫: ঝোপ টিকরা
ক্রোধান্বিত রাজা আশ্রমস্থ পুরোহিতদের বললেন, যদ্যহং পতিতো বিপ্রাঃ!শুশ্রূষায়াং ন বঃ স্থিতঃ। হে দ্বিজগণ, আমি যদি পতিত হয়ে থাকি তাহলে আপনাদের সেবা অর্থাৎ শুশ্রূষাকার্যেও আমি নেই।ব্যথিত রাজা অনুনয় করলেন, খুব শীঘ্রই ব্রাহ্মণরা রাজাকে ত্যাগ করেছেন, রাজা তাঁদের নিন্দার পাত্র হয়েছেন। তবে রাজার যজ্ঞের প্রতি শ্রদ্ধায় ব্রাহ্মণরা ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেন না। অকারণে ব্রাহ্মণরা রাজাকে পরিত্যাগ করতে পারেন না। রাজা তাঁদের পৌরোহিত্যে বরণ করেছেন, ব্রাহ্মণগণ রাজার প্রতি প্রসন্ন হন। রাজা আরও জানালেন, প্রয়োজনের তাগিদে, রাজা, সাম ও দানাদি বিষয়ক প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের প্রসন্ন করে, ব্রাহ্মণগণের রাজার প্রতি বিধেয় যে কাজ,সেই বিষয়ে বলবেন। অথবা বিদ্বেষবশত রাজার প্রস্তাব যদি গ্রাহ্য না হয়, তবে তিনি যাজনকার্মের জন্যে অন্য ঋত্বিক নিযুক্ত করবেন। রাজা তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। ব্রাহ্মণরা রাজার যাজনকর্মে সম্মত হলেন না। রুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণরা সেই নৃপশ্রেষ্ঠকে বললেন, আপনার অজস্র কর্ম রয়েছে। তাঁরা রাজার কর্মের দায়িত্বভার বহন করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাই রাজার উচিত তাঁদের রেহাই দেওয়া। ব্রাহ্মণরা জানালেন, রাজার বুদ্ধিনাশ হয়েছে। তাই তিনি সত্বর ব্রাহ্মণদের নিকটে এসেছেন।রাজা বরং রুদ্রের কাছে যান, রুদ্র রাজার যাজনকর্ম সম্পন্ন করবেন।
তিরস্কৃত রাজা শ্বেতকি সক্রোধে কৈলাসপর্বতে উপস্থিত হলেন। শুরু হল তাঁর কঠোর তপস্যা। মহাদেবের আরাধনারত শ্বেতকি ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করে, দীর্ঘকাল নিয়ত ধ্যানমগ্ন রইলেন। কখনও দ্বাদশ মুহূর্তকালে, কখনও বা ষোড়শ মুহূর্তকালে ফলমূল ভক্ষণ করতেন। সন্তুষ্ট মহাদেব দেখা দিলেন, রাজাকে যথেচ্ছ বরদানের অঙ্গীকার করলেন। রাজা শ্বেতকির একটিই প্রার্থনা। দেবাদিদেব স্বয়ং রাজার যাজনকর্ম করুন। যাজয়স্ব সুরেশ্বর!। মহাদেব প্রীত হয়ে জানালেন, নাস্মাকমেষ বিষয়ো বর্ত্ততে যাজনং প্রতি। যাজন আমাদের (দেবতাদের) বিষয় নয়। মহাদেব জানালেন, যেহেতু রাজা বর প্রার্থনা করে কঠোর তপস্যারত ছিলেন, তাই একটি নিয়ম পালন করলে, মহাদেব রাজার হয়ে যাজনকর্মে সম্মত হবেন। রাজা শ্বেতকি যদি দ্বাদশ বৎসর যাবৎ ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করে, সমাহিতচিত্তে, ঘৃতধারায় অগ্নিদেবকে তুষ্ট করেন তবে তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ করবেন।
তিরস্কৃত রাজা শ্বেতকি সক্রোধে কৈলাসপর্বতে উপস্থিত হলেন। শুরু হল তাঁর কঠোর তপস্যা। মহাদেবের আরাধনারত শ্বেতকি ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করে, দীর্ঘকাল নিয়ত ধ্যানমগ্ন রইলেন। কখনও দ্বাদশ মুহূর্তকালে, কখনও বা ষোড়শ মুহূর্তকালে ফলমূল ভক্ষণ করতেন। সন্তুষ্ট মহাদেব দেখা দিলেন, রাজাকে যথেচ্ছ বরদানের অঙ্গীকার করলেন। রাজা শ্বেতকির একটিই প্রার্থনা। দেবাদিদেব স্বয়ং রাজার যাজনকর্ম করুন। যাজয়স্ব সুরেশ্বর!। মহাদেব প্রীত হয়ে জানালেন, নাস্মাকমেষ বিষয়ো বর্ত্ততে যাজনং প্রতি। যাজন আমাদের (দেবতাদের) বিষয় নয়। মহাদেব জানালেন, যেহেতু রাজা বর প্রার্থনা করে কঠোর তপস্যারত ছিলেন, তাই একটি নিয়ম পালন করলে, মহাদেব রাজার হয়ে যাজনকর্মে সম্মত হবেন। রাজা শ্বেতকি যদি দ্বাদশ বৎসর যাবৎ ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করে, সমাহিতচিত্তে, ঘৃতধারায় অগ্নিদেবকে তুষ্ট করেন তবে তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ করবেন।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৭: চায়ের দেশের বিনি-মিনির কথা

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৫: রবীন্দ্রনাথ, মণিপুরী নৃত্য ও ত্রিপুরা
শ্বেতকি যথারীতি নিয়ম পালন করলেন। সম্মুখে উপস্থিত রাজাকে পরম প্রীত মহাদেব বললেন, যাজনং ব্রাহ্মণানান্তুবিধিদৃষ্টং পরন্তপ!। বেদবিহিত বিধান অনুসারে যাজনকর্মটি ব্রাহ্মণদের জন্যই নির্দিষ্ট রয়েছে। তাই মহাদেব অপারগ। কিন্তু উপায় আছে। সেটি হল, পৃথিবীতে, মহাদেবের অংশভূত দুর্বাসা নামে একজন দ্বিজশ্রেষ্ঠ আছেন। মহাদেবের নিয়োগানুসারে, সেই প্রখ্যাত তেজস্বী ব্রাহ্মণ দুর্বাশাই রাজা শ্বেতকির যাজন সম্পন্ন করবেন। মহাদেবের সম্মুখে, যজ্ঞের উপকরণসহ উপস্থিত হলেন রাজা। মহাদেব দুর্বাশাকে আদেশ দিলেন, এনং যাজয় বিপ্রেন্দ্র! মন্নিয়োগেন ভূমিপম্। হে দ্বিজবর, আমি তোমাকে নিয়োগ করলাম, তুমি রাজার যাজন সম্পন্ন কর। ঋষি দুর্বাসা সম্মত হলেন। বিধিমতে, যথাসময়ে, শাস্ত্রোক্ত নিয়মানুসারে, বহু দক্ষিণা দান করে, রাজার যজ্ঞ সম্পন্ন হল। যজ্ঞসমাপনান্তে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণরা রাজাকে সম্মান জানালেন,বন্দীরা রাজারা স্তুতি করতে লাগলেন, নাগরিকবৃন্দ তাঁকে অভিনন্দিত করলেন।এমন বিশিষ্টচরিত্র শ্রেষ্ঠ রাজা শ্বেতকি, দীর্ঘকাল পরে স্বর্গলাভ করলেন। সেই দ্বাদশবর্ষব্যাপী যজ্ঞে অগ্নি ওই সময়ে ঘৃত পান করে পরম তৃপ্ত হলেন এতটাই যে তিনি অন্যপ্রদত্ত ঘৃতগ্রহণে আর আগ্রহী নন। বিবর্ণ অগ্নির অগ্নিমান্দ্য রোগ হল, তাঁর স্বাস্থ্য নষ্ট হল। ক্রমশ অগ্নি তেজোহীন হয়ে পড়লেন। অগত্যা তিনি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন।
অগ্নি, ব্রহ্মাকে জানালেন, অরুচিশ্চাভবত্তীব্রা তাং ন শক্নোম্যপোহিতুম্। তেজসা বিপ্রহীনোঽস্মি বলেন চ জগৎপতে!।। আমার প্রবল অরুচি হয়েছে, যেটি দূর করতে পারছি না। তেজোহীনতা ও বলহীনতায় ভুগছি আমি। ব্রহ্মা সব শুনে, অগ্নিদেবের স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, অগ্নির এই অস্বস্তির কারণ হল, দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষ যাবৎ ঘৃতধারা—পান। ব্রহ্মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, মা গমস্ত্বং ব্যথাং বহ্নে! প্রকৃতিস্থো ভবিষ্যসি। ব্যথিত হয়ো না। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। উপায়? ব্রহ্মা স্মরণে আনলেন, অতীতে দেবগণের আদেশে,অগ্নি, অতিগহনারণ্যে শত্রুর আবাস, খাণ্ডববন ভস্মীভূত করেছিলেন, সেই খাণ্ডববন সব জন্তুর আশ্রয়। জন্তুদের শরীরের মেদ গ্রহণ করে, অগ্নি তৃপ্ত হতে পারেন। তাই ব্রহ্মার পরামর্শ—গচ্ছ শীঘ্রং প্রদগ্ধুং ত্বং ততো মোক্ষ্যসি কিল্বিষাৎ। শীঘ্র যাও,দগ্ধ করে রোগজনিত পাপমুক্ত হও। ক্রুদ্ধ অগ্নি দ্রুতবেগে খাণ্ডববনে উপস্থিত হয়ে, বায়ুর সহায়তায় তৎক্ষণাৎ বনদহনে প্রবৃত্ত হলেন। বন্য জন্তুরা প্রজ্জ্বলিত খাণ্ডববনের অগ্নি প্রশমনের জন্যে যত্নবান হল। সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ শত শত, সহস্র সহস্র, হস্তী শূর দিয়ে জল সিঞ্চন করতে লাগল। ক্রুদ্ধ, ব্যস্তসমস্ত, বহুমস্তকধারী নাগেরা মুখে করে জল নিয়ে অগ্নিতে সেচন করল।অন্যান্য প্রাণীদের নানা উদ্যমে ও তৎপরতার দরুণ অগ্নি নির্বাপিত হল। এইভাবে বার বার অগ্নি সেখানে জ্বলে উঠলেন, সাত বার। কিন্তু অগ্নির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। খাণ্ডববনে, বনবাসী জন্তুরা,অগ্নিকে প্রশমিত করতে সফল হল।
অগ্নি, ব্রহ্মাকে জানালেন, অরুচিশ্চাভবত্তীব্রা তাং ন শক্নোম্যপোহিতুম্। তেজসা বিপ্রহীনোঽস্মি বলেন চ জগৎপতে!।। আমার প্রবল অরুচি হয়েছে, যেটি দূর করতে পারছি না। তেজোহীনতা ও বলহীনতায় ভুগছি আমি। ব্রহ্মা সব শুনে, অগ্নিদেবের স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, অগ্নির এই অস্বস্তির কারণ হল, দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষ যাবৎ ঘৃতধারা—পান। ব্রহ্মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, মা গমস্ত্বং ব্যথাং বহ্নে! প্রকৃতিস্থো ভবিষ্যসি। ব্যথিত হয়ো না। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। উপায়? ব্রহ্মা স্মরণে আনলেন, অতীতে দেবগণের আদেশে,অগ্নি, অতিগহনারণ্যে শত্রুর আবাস, খাণ্ডববন ভস্মীভূত করেছিলেন, সেই খাণ্ডববন সব জন্তুর আশ্রয়। জন্তুদের শরীরের মেদ গ্রহণ করে, অগ্নি তৃপ্ত হতে পারেন। তাই ব্রহ্মার পরামর্শ—গচ্ছ শীঘ্রং প্রদগ্ধুং ত্বং ততো মোক্ষ্যসি কিল্বিষাৎ। শীঘ্র যাও,দগ্ধ করে রোগজনিত পাপমুক্ত হও। ক্রুদ্ধ অগ্নি দ্রুতবেগে খাণ্ডববনে উপস্থিত হয়ে, বায়ুর সহায়তায় তৎক্ষণাৎ বনদহনে প্রবৃত্ত হলেন। বন্য জন্তুরা প্রজ্জ্বলিত খাণ্ডববনের অগ্নি প্রশমনের জন্যে যত্নবান হল। সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ শত শত, সহস্র সহস্র, হস্তী শূর দিয়ে জল সিঞ্চন করতে লাগল। ক্রুদ্ধ, ব্যস্তসমস্ত, বহুমস্তকধারী নাগেরা মুখে করে জল নিয়ে অগ্নিতে সেচন করল।অন্যান্য প্রাণীদের নানা উদ্যমে ও তৎপরতার দরুণ অগ্নি নির্বাপিত হল। এইভাবে বার বার অগ্নি সেখানে জ্বলে উঠলেন, সাত বার। কিন্তু অগ্নির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। খাণ্ডববনে, বনবাসী জন্তুরা,অগ্নিকে প্রশমিত করতে সফল হল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১০: অন্ধকারে, চুপিসারে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’
খাণ্ডবপ্রস্থে পাণ্ডবদের জীবনে এক স্থিতিশীল ভারসাম্য বজায় আছে। ন্যায়নিষ্ঠ ধার্মিক জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের শাসনাধীন রাজ্যে, ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গের সমপ্রাধান্য রয়েছে। একজন সুশাসকের রাজত্বে প্রজারা আনন্দিত, পরিতৃপ্ত। আপাতত পঞ্চ পাণ্ডব সুখে বাস করছেন। একদা জলবিহারের উদ্দেশ্যে খাণ্ডববন সন্নিহিত অরণ্যে অবস্থানের সময়ে এক তেজস্বী ব্রাহ্মণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তিনি স্বয়ং অগ্নিদেব। অগ্নিদেব কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বনদহনের অনুরোধ জানালেন। অগ্নির একক প্রচেষ্টায় যেটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বনদহনের পুরাবৃত্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। শ্বেতকি রাজার কাহিনির প্রাসঙ্গিকতা আছে আজও। আমাদের আধুনিক জীবন যেন অগ্নির অপরিমিত ভোগের প্রতীক। আগ্রাসী আমাদের ক্ষুধা। অগ্নি অপরিমিত ভোজনে অভ্যস্ত, আধুনিকযুগের মানুষের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত। এই অপরিমিত ভোগ্যপণ্যগ্রহণের তাগিদে, অনেক আসমুদ্র চাহিদার চোরাস্রোতে ভেসে যায় মান, সম্মান, পরিবার, মূল্যবোধ, বিবেকচেতনা, নৈতিকতা, ধর্মবোধ অর্থাৎ মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের যত অনুপান। অবশেষে আত্মক্ষয়ী ভোগবাদ অনেক সময়ে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। অগ্নির জঠরজ্বালা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন সহজদাহ্য অরণ্য ও তার বনবাসী প্রাণীরা। মানুষের ভোগানল প্রশমনের জন্য প্রয়োজন ভোগ্যপণ্যের আহুতি। ইন্দ্রের শান্তির বারিবর্ষণে প্রতিহত হয় বিধ্বংসী অগ্নির দহন। তেমনি সুস্থ চিন্তার আবহে হয়তো নিবৃত্ত হতে পারে মানুষের তীব্র ভোগাসক্তির দহন জ্বালা।
বনদহনের পুরাবৃত্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। শ্বেতকি রাজার কাহিনির প্রাসঙ্গিকতা আছে আজও। আমাদের আধুনিক জীবন যেন অগ্নির অপরিমিত ভোগের প্রতীক। আগ্রাসী আমাদের ক্ষুধা। অগ্নি অপরিমিত ভোজনে অভ্যস্ত, আধুনিকযুগের মানুষের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত। এই অপরিমিত ভোগ্যপণ্যগ্রহণের তাগিদে, অনেক আসমুদ্র চাহিদার চোরাস্রোতে ভেসে যায় মান, সম্মান, পরিবার, মূল্যবোধ, বিবেকচেতনা, নৈতিকতা, ধর্মবোধ অর্থাৎ মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের যত অনুপান। অবশেষে আত্মক্ষয়ী ভোগবাদ অনেক সময়ে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। অগ্নির জঠরজ্বালা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন সহজদাহ্য অরণ্য ও তার বনবাসী প্রাণীরা। মানুষের ভোগানল প্রশমনের জন্য প্রয়োজন ভোগ্যপণ্যের আহুতি। ইন্দ্রের শান্তির বারিবর্ষণে প্রতিহত হয় বিধ্বংসী অগ্নির দহন। তেমনি সুস্থ চিন্তার আবহে হয়তো নিবৃত্ত হতে পারে মানুষের তীব্র ভোগাসক্তির দহন জ্বালা।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
রাজা শ্বেতকির পুরাবৃত্তটিতে প্রকৃতির প্রতিশোধের ছায়া যেন লুকিয়ে আছে। রাজা শ্বেতকির একমাত্র ধর্মীয় উন্মাদনা যজ্ঞকেন্দ্রিক। পুরোহিতরা শ্রান্ত হলেন,দৃষ্টি নষ্ট হল। তাঁদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করলেন অন্য ব্রাহ্মণরা। আবারও যজ্ঞে পৌরোহিত্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলেন পুরোহিত ঋত্বিকগণ। সমস্ত অনুনয় ব্যর্থ হল। শেষ আশ্রয় দেবাদিদেবের শরণাপন্ন হলেন রাজা। রাজা শ্বেতকির প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হলেন মহাদেব। পৌরোহিত্যের শর্ত অনুযায়ী দ্বাদশবর্ষব্যাপী যজ্ঞে, অগ্নিদেবকে তুষ্ট করলেন অগ্নি। মহাদেবের পরামর্শানুযায়ী মহর্ষি দুর্বাশার পৌরোহিত্যে যথাবিহিত যজ্ঞ সম্পন্ন হল। রাজা শ্বেতকির উদ্দেশ্য সফল হল। তিনি তথাকথিত পুণ্য অর্জন করলেন। যে কোনও ধর্মীয় উন্মাদনায় আছে ক্ষতিকারক কিছু ফল। যজ্ঞে দ্বাদশবর্ষব্যাপী ঘৃতাহুতির ফলে অগ্নির ক্ষুধামান্দ্য রোগ দেখা দিল। যে কোনও বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি অনেক বিপদ ডেকে আনে, হয়তো আপাত উপভোগ্য কিছু সুফল রয়েছে এর মধ্যে। ব্রহ্মার প্রস্তাবিত অগ্নির অগ্নিমান্দ্যরোগ প্রতিরোধের উপায় হল খাণ্ডববনদহন। প্রকৃতির উষ্ণতাবৃদ্ধির অন্যতম কারণ, অতিমাত্রায় মানুষের ভোগ্যপণ্যের অপব্যবহার। এর ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। অরণ্যে জ্বলে ওঠে দাবানল। দাবানলের বিধ্বংসী আগুনে বিধ্বস্ত হয় অরণ্যজীবন, প্রাণীকুল। প্রকৃতির অন্যতম উপাদান তেজ। তার আগুনে দগ্ধ হয় অরণ্যভূমি। প্রাথমিকভাবে প্রকৃতির বারিধারা তেজোদগ্ধ অরণ্যকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়, তবে শেষপর্যন্ত মানুষের সহায়তায়, অগ্নির করালগ্রাসে পরিণত হয় নিষ্পাপ বন্য প্রাণীদের জীবন। সে কাহিনি পরবর্তী পর্বের বিষয়।
মহাভারতের কাহিনিতে আছে ভাবনার উপাদান, চিন্তার খোরাক। এক একটি কাহিনির তাৎপর্য ব্যাখ্যাকারদের চিন্তার আলোয় বিভিন্ন মাত্রায় উন্নীত হয়। মহাভারতকারের মতে খাণ্ডবদহনের উদ্দেশ্য ছিল হয়তো বনভূমি উচ্ছেদ করে নগরায়ন, যেটির বিরুদ্ধে এখন বিশ্বের জনমত। তবে মহাভারতীয় প্রেক্ষিতে খাণ্ডববন-দহনের প্রয়োজন ছিল, তাই হয়তো অগ্নির আগ্রাসী ক্ষুধার শিকার হয়েছিল বন্যপ্রাণী—অধ্যুষিত খাণ্ডববন।—চলবে।
মহাভারতের কাহিনিতে আছে ভাবনার উপাদান, চিন্তার খোরাক। এক একটি কাহিনির তাৎপর্য ব্যাখ্যাকারদের চিন্তার আলোয় বিভিন্ন মাত্রায় উন্নীত হয়। মহাভারতকারের মতে খাণ্ডবদহনের উদ্দেশ্য ছিল হয়তো বনভূমি উচ্ছেদ করে নগরায়ন, যেটির বিরুদ্ধে এখন বিশ্বের জনমত। তবে মহাভারতীয় প্রেক্ষিতে খাণ্ডববন-দহনের প্রয়োজন ছিল, তাই হয়তো অগ্নির আগ্রাসী ক্ষুধার শিকার হয়েছিল বন্যপ্রাণী—অধ্যুষিত খাণ্ডববন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।