শনিবার ২৯ মার্চ, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

দাম্পত্যের নিয়ম ও শর্ত ভঙ্গ করে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন, সুদীর্ঘ বার বৎসরের বনবাস জীবন বরণ করে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি নাগকন্যা উলূপী, মণিপুর রাজদুহিতা চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। বনবাসের শেষাংশে তিনি রৈবতকপর্বতে কৃষ্ণের ভগিনী, বসুদেবকন্যা সুভদ্রাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কৃষ্ণের সম্মতিক্রমে দ্বারকাবাসীদের সম্মানীয় অতিথি অর্জুন, বলপূর্বক সুভদ্রাকে অপহরণ করলেন। অর্জুনের এই দুর্বিনীত ব্যবহারে, অপমানিত, দুঃখিত, ক্রুদ্ধ, বৃষ্ণিবংশীয়রা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। এ বিষয়টিতে, প্রতিক্রিয়াহীন কৃষ্ণের প্রতি জ্যেষ্ঠ বলরাম তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন। কৃষ্ণের নীরবতায় বলরামের গভীর অসন্তোষ। অর্জুন সকলকে অগ্রাহ্য ও অসম্মান করে সুভদ্রাকে হরণ করেছেন। প্রতিশোধকল্পে বলরাম, পৃথিবীকে কৌরবশূন্যা করবেন এই মর্মে কৌরবদের বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞা করলেন। বৃষ্ণিবংশীয় সকলেই বলরামের বক্তব্যকে সমর্থন জানালেন।

অর্জুনের এই আচরণে, কৃষ্ণের সম্মতি ও জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের অনুমোদন ছিল। কৃষ্ণ অর্জুনের সমর্থনে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শুরু করলেন। কৃষ্ণের মতানুসারে, অর্জুন বৃষ্ণিবংশীয়দের অসম্মান করেননি বরং তিনি বৃষ্ণিবংশীয়দের সম্মান বৃদ্ধি করছেন। অর্থদানের মাধ্যমে বৃষ্ণিদের সন্তুষ্ট করে কন্যাকে গ্রহণ করবেন? বৃষ্ণিদের এমন অর্থলোলুপ মনে করেন না অর্জুন অর্থাৎ বৃষ্ণিবংশীয়দের সম্বন্ধে নীচ ধারণা পোষণ করেন না পার্থ। স্বয়ংবরের সূত্রে কন্যাগ্রহণও অর্জুন অসঙ্গত মনে করেন কারণ সেখানেও অন্য কেউ কন্যাকে গ্রহণ করতে পারে। কন্যাদানপ্রথায় অর্জুনের ঘোর আপত্তি। ওই বিবাহে (ব্রাহ্মবিবাহে) ক্ষত্রিয়োচিত শৌর্যপ্রকাশের অবকাশ কোথায়?প্রতিগ্রহ অর্থাৎ দানগ্রহণের অধিকার ক্ষত্রিয়ের না থাকায়, পশুতুল্য ওই বিবাহ, পার্থ অর্জুনের মতবিরুদ্ধ। অর্থের বিনিময়ে কন্যাদান বিক্রয়ের সমতুল্য। কে প্রাণে ধরে আত্মজাকে বিক্রয় করতে পারে? তাই ক্রয়ের প্রশ্নই নেই।

কৃষ্ণের অনুমান, অন্য বিবাহরীতিতে এত সব দোষ পর্যালোচনা করে অর্জুন, ক্ষত্রিয়ধর্মানুসারে কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করেছেন। অর্জুন বীর এবং সুভদ্রাও যশস্বিনী। এই সম্বন্ধ যথাযোগ্য। তাই অর্জুনের এই বলপূর্বক অপহরণ। ভরতবংশজাত, শান্তনু রাজার উত্তরসূরী, রাজা কুন্তীভোজের কন্যার পুত্র, অর্জুন কার প্রার্থিত নয়? অর্জুনের প্রবাদপ্রতিম বীরত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন কৃষ্ণ। হে আর্য,এই ইন্দ্রলোক বা রুদ্রলোকে বা সকল লোকের এমন কাউকে দেখি না যিনি অর্জুনকে জয় করতে পারেন। ন তং পশ্যামি যঃ পার্থং বিজয়েত রণে বলাৎ। অপি সর্ব্বেষু লোকেষু সেন্দ্ররুদ্রেষু মারিষ।। সেই রথ সেই (কৃষ্ণপ্রদত্ত সেই অশ্বগুলি) অশ্বগুলি, অস্ত্রপ্রয়োগনৈপুণ্যে দ্রুততা, এমন যোদ্ধা অর্জুন, তাঁর সমকক্ষ কে হতে পারে? কৃষ্ণের অভিমত হল,আনন্দসহকারে, অর্জুনকে পরম সান্ত্বনা দান করে, অবিলম্বে তাঁকে ফিরিয়ে আনা যাদবদের কর্তব্য। যদি অর্জুন বল প্রয়োগ করে বৃষ্ণিবংশীয়দের পরাজিত করে, নিজের দেশে ফিরে যান তবে তৎক্ষণাৎ বৃষ্ণিদের সব খ্যাতি নষ্ট হবে, কিন্তু সান্ত্বনা দিয়ে ফিরিয়ে আনা হলে কোনও পরাজয়ের গ্লানি তাঁদের স্পর্শ করবে না। অর্জুন পিতার ভগিনীর পুত্র, তাঁর সঙ্গে শত্রুতার সম্বন্ধ নয়। কৃষ্ণের কথা শুনে, যাদবরা সংযত হলেন।
অর্জুন দ্বারকায় এসে সুভদ্রাকে বিবাহ করলেন এবং বৎসরাধিক কাল সেখানে অতিবাহিত করবার পরে, যথেচ্ছ ভ্রমণ করে, বনবাসের অবশিষ্টাংশ পুষ্কর তীর্থে অবস্থান করলেন। বার বৎসর কাল অতিবাহিত হলে, খাণ্ডবপ্রস্থে গমন করে বনবাসব্রতাচরণের নিয়মানুযায়ী সংযতচিত্তে রাজা যুধিষ্ঠির ও ব্রাহ্মণদের অর্চনা করে, দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হলেন। দ্রৌপদী কুরুনন্দন পার্থকে প্রণয়ভরে বললেন, হে কৌন্তেয়,যেখানে সুভদ্রা আছেন, সেখানেই যাও। (নব) প্রেমের সুন্দর বন্ধনের কারণে পূর্বের প্রণয়বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। তত্রৈব গচ্ছ কৌন্তেয়!যত্র সা সাত্বতাত্মজা। সুবদ্ধস্যাপি ভারস্য পূর্ব্ববন্ধঃ শ্লথায়তে।। এমনভাবে বহু বিলাপকারিণী দ্রোপদীকে, ধনঞ্জয় অর্জুন, বার বার সান্ত্বনা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। অর্জুন, রক্তিমবসনা সুভদ্রাকে, গোপবধূর বেশে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন। সেই বেশেই, সুন্দরভাবে শোভমানা, যশস্বিনী, বীরপত্নী, উত্তমা, বিশাল আরক্তনয়না, সুভদ্রা প্রধানভবনে উপস্থিত হয়ে পৃথা কুন্তীদেবীর বন্দনা করলেন। মাতা কুন্তীও সস্নেহে, সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভদ্রার মস্তক আঘ্রাণ করলেন। পরমপ্রীতিভরে তাঁকে অপরিসীম আশীর্বাদে ঋদ্ধ করলেন।

পূর্ণচন্দ্রতুল্যা অনিন্দ্যসুন্দরী সুভদ্রা, অবিলম্বে দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হয়ে, তাঁকে প্রণাম করে পরিচয় দিলেন, প্রেষ্যাহমিতি আমি দাসীমাত্র। কৃষ্ণভগিনীকে তুলে ধরে,কৃষ্ণা দ্রৌপদী, আলিঙ্গনাবদ্ধ করে আশীর্বাদ করলেন, নিঃসপত্নোঽস্তু তে পতিঃ। তোমার স্বামী শত্রুহীন হন। আনন্দিত সুভদ্রা বললেন, এবমস্ত্বিতি। মহারথী পাণ্ডবরা সন্তুষ্ট হলেন, জননী কুন্তীও পরম প্রীত হলেন। শ্রেষ্ঠ পাণ্ডব, অর্জুন, উত্তম নগরী ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসেছেন শুনে, বৃষ্টি, অন্ধক, প্রধান অমাত্যদের সঙ্গে নিয়ে, ভ্রাতৃবৃন্দ-কুমারবৃন্দ-যোদ্ধাগণপরিবৃত, বিরাট সৈন্যদল দ্বারা রক্ষিত, শত্রুদের দমনকারী, পবিত্রহৃদয় কৃষ্ণ, বলরাম-সহ, সেখানে উপস্থিত হলেন। সেখানে ছিলেন, বিখ্যাত দাতা, বুদ্ধিমান, মহাযশস্বী, শত্রুদমনকারী, বৃষ্ণিবীরদের সেনাপতি অক্রূর। মহাতেজস্বী অনাধৃষ্টি, সাক্ষাৎ বৃহস্পতিশিষ্য, মহাবুদ্ধিমান, উদারমনা, মহাযশস্বী উদ্ধব, সত্যক, সাত্যকি, কৃতবর্মা, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, নিশঠ, শঙ্কু, পরাক্রমশালী চারুদেষ্ণ, ঝিল্লী, বিপৃথু, মহাবাহু সারণ, বিদ্বানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গদ, এবং অন্য বহু বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধকবংশীয়রা প্রচুর যৌতুক নিয়ে এসে পৌঁছলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৪: মনের ইচ্ছে থাকলেই কার্যসিদ্ধি সম্ভব

মাধবের আগমনবার্তা শুনে, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নকুল ও সহদেব এই যমজ দুই ভাইকে প্রেরণ করলেন। স্বাগতসম্ভাষণে গৃহীত, সমৃদ্ধ, বৃষ্ণিগণ, পতাকাধ্বজ-সজ্জিত খাণ্ডবপ্রস্থে প্রবেশ করলেন। খাণ্ডবপ্রস্থের পথগুলি পরিষ্কার সিক্ত, বিক্ষিপ্ত পুষ্পরাশিশোভিত, চন্দনের শীতল রসের সুগন্ধপূর্ণ, স্থানে স্থানে দগ্ধ অগরুর গন্ধে সুবাসিত, স্বাস্থ্যবান হৃষ্টপুষ্ট জনগণ ও বণিকদ্বারা শোভন সুন্দর। বলরামের সঙ্গে কেশব এসে পৌঁছলেন। বৃষ্টি, অন্ধক, ভোজবংশীয়রাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সহস্র পুরবাসী ও ব্রাহ্মণদের দ্বারা সম্মানিত অতিথিরা ইন্দ্রের ভবনতুল্য রাজগৃহে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠির, বলরামকে আশীর্বাদ করে যথাবিধি কাছে টেনে নিলেন, কৃষ্ণের মস্তকের আঘ্রাণ নিয়ে তাঁকে দুই বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করলেন। যুধিষ্ঠিরকে সবিনয়ে আনন্দ দান করে, গোবিন্দ, পুরুষশার্দ্দূল ভীমসেনকে বিধি অনুযায়ী প্রণতি নিবেদন করলেন। কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির পরম্পরানুসারে, সেই বৃষ্ণি, অন্ধকবংশীয় শ্রেষ্ঠ পুরুষদের যথানিয়মে সৎকারসহ স্বাগত জানালেন। কাউকে গুরুর তুল্য সম্মানিত করলেন, সমবয়স্কদের যথোচিত এবং কাউকে (কনিষ্ঠদের) সস্নেহ স্বাগত জানালেন। কেউ বা বয়সে নামমাত্র জ্যেষ্ঠ, তাঁকেও (অজ্ঞাতসম্পর্ক) অভিবাদন করলেন।

হৃষীকেশ কৃষ্ণ, তাঁদের সন্তুষ্টির জন্যে উত্তম ধন দান করলেন, সুভদ্রার জন্যে জ্ঞাতিগণপ্রদত্ত যৌতুক ধন ও দ্রব্যাদিও দিলেন। তিনি, স্বর্ণখচিত, কিঙ্কিণীমালাশোভিত, শিক্ষিত নিপুণ সারথি ও চতুরশ্বযুক্ত, সহস্র রথ এবং মথুরাদেশীয়, প্রচুর দুগ্ধবতী, পুণ্যদর্শন, দশ সহস্র গাভীও দান করলেন। কৃষ্ণ, পবিত্র চন্দ্রকিরণসম শুভ্রবর্ণ, স্বর্ণাভরণে শোভিত সহস্র ঘোটকী, আনন্দসহকারে দান করলেন। শিক্ষিত, বায়ুতুল্য বেগবতী, কাজলকালো কেশবিশিষ্ট, শ্বেতবর্ণ এক সহস্র অশ্বতরীও দান করলেন। স্নান পান ও উৎসবে নিযুক্ত, যৌবনবতী, গৌরবর্ণা, সুবেশা, লাবণ্যবতী, এক সহস্র নারী দান করলেন। তাঁদের কণ্ঠে সুবর্ণালঙ্কার, তাঁদের রোমহীণ শরীর, তাঁরা সজ্জায় নিপুণ ও পরিচর্যায় কুশল।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৯: আকাশ এখনও মেঘলা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭০: বিচারক

জনার্দন কৃষ্ণ, বাহ্লিকদেশীয় অতি বেগবান শত সহস্র অশ্ব কন্যাধন অর্থাৎ যৌতুক দিলেন। এ ছাড়াও তিনি দশ জন মানুষ বহন করতে পারে এমন অগ্নিবৎ উজ্জ্বল স্বর্ণালঙ্কার ও দ্রব্যাদি দিলেন। হল ও লাঙ্গলধারী বলরাম, পার্থর সঙ্গে বৈবাহিকসম্বন্ধকে মান্যতা দিয়ে প্রীত হয়ে, তাঁকে পাণিগ্রহণসম্পর্কিত যৌতুক দান করলেন — পর্বতশৃঙ্গসদৃশ, ত্রিধারায় মদস্রাবী, মদমত্ত, যুদ্ধে কখনও যারা ফিরে আসে না এমন, সজ্জিত, অবিরাম ঘণ্টাধ্বনিতে দক্ষ, সুন্দর, স্বর্ণমালিকায় বিভূষিত, মাহুতযুক্ত সহস্র হস্তী। যৌতুকরাশিসম মহানদ, পাণ্ডুপুত্রদের বংশে প্রবেশ করল, ঠিক যেন পূর্ণ সমুদ্রের জলরাশিতে আরও পূর্ণতা এনে দিল এই যৌতুকরূপ জলরাশি, উপহারপ্রাপ্ত ধনরত্ন ছিল সেই সাগরের রত্নসমূহ, বস্ত্র ও কম্বল যেন ফেনা, বিশাল গজগুলি হল সেই সাগরের জলজন্তু, পতাকারূপ শৈবালের দ্বারা পরিব্যাপ্ত ছিল সেই সাগর। যুধিষ্ঠির সেই সব যৌতুক গ্রহণ করলেন। তিনি বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় মহাবীরদের সসম্মানে পূজা করলেন। কুরু, বৃষ্ণি, অন্ধকবংশীয় মহাত্মাগণ একত্রে, পুণ্যাত্মাতুল্য মানুষ যেন সুরলোকে বিহার করছেন, এমনভাবে বিহার করতে লাগলেন। উত্তম মহাযান, যার নিম্নচক্র সুন্দর নাদ সৃষ্টি করে, সেই যানে আরোহণ করে কুরু ও বৃষ্ণিবংশীয়রা,যথেচ্ছভাবে, আনন্দসহকারে, বিহার করতে লাগলেন।

পরমশৌর্যশালী যাদবরা, কুরুদের দ্বারা সম্মানিত হয়ে, দ্বারকানগরীতে ফিরে গেলেন। কুরুশ্রেষ্ঠপ্রদত্ত নির্মল রত্নসমূহ নিয়ে, বলরামকে পুরোভাগে রেখে মহারথ বৃষ্ণি, অন্ধকরা প্রস্থান করলেন। বাসুদেব কৃষ্ণ কিন্তু সেই রমণীয় ইন্দ্রপ্রস্থে পার্থর সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। মহাযশস্বী কৃষ্ণ যমুনা তীরে মৃগয়ার কারণে বিচরণ করতেন। তিনি কিরীটির সঙ্গে মৃগ ও বরাহগুলি তীরবিদ্ধ করে পরমানন্দ লাভ করতেন। কালক্রমে, কেশবের প্রিয় ভগিনী সুভদ্রা,ইন্দ্রাণী পৌলমীর পুত্র জয়ন্তর মতো এক খ্যাতিমান পুত্রের জন্ম দিলেন। সুভদ্রাপুত্র অভিমন্যু ছিল দীর্ঘবাহু, বিশালবক্ষা, শত্রুহননকারী, বীর। নির্ভীক অথচ ক্রোধী এবং শত্রুদমনকারী অর্জুনপুত্র অভিমন্যু নামে পরিচিত হল। অভিশ্চ মন্যুমাংশ্চৈব ততস্তমরিমর্দ্দনম্। অভিমন্যুমিতি প্রাহুরার্জ্জুনিং পুরুষর্ষভম্।।* যজ্ঞে নিঃশেষে মন্থনের ফলে শমীকাষ্ঠের অভ্যন্তরে যেমন অগ্নির উদ্ভব হয় তেমনই সাত্বতবংশীয় সুভদ্রার গর্ভে,ধনঞ্জয় অর্জুনের ঔরসে,মহাবীর পুত্রের জন্ম হল।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৩: সাত-সহেলি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

অভিমন্যুর জন্মোপলক্ষ্যে, যুধিষ্ঠির, ব্রাহ্মণদের অযুত সংখ্যক অর্থাৎ দশ হাজার গাভী ও স্বর্ণালঙ্কার দান করলেন। জন্মমাত্র অভিমন্যু,জনপ্রিয় চন্দ্রতুল্য পিতৃকুল ও বাসুদেবের বংশ অর্থাৎ মাতুলকুলে প্রিয় হয়ে উঠলেন। জন্ম থেকেই কৃষ্ণ,অভিমন্যুর শুভ সংস্কারাদি ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করেছিলেন। শুক্লপক্ষের চন্দ্রের মতো অভিমন্যু ক্রমে বৃদ্ধি পেলেন। শত্রুজয়ী অভিমন্যু, অর্জুনের কাছে, বেদ এবং শিক্ষা-অভ্যাস-প্রয়োগ-উপসংহারবিষয়ক চতুষ্পাদ ও ভারত-সাত্বত-কাশ্যপ-কৌশিক-আলীঢ়-প্রত্যালীঢ়-অনুপদ-বিশাখ-দুর্দ্ধর-মণ্ডল প্রভৃতি দশবিধ ধনুর্বেদ, যেগুলি স্বর্গে ও লৌকিক পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়, সেগুলি শিক্ষা করলেন। অর্জুন, অভিমন্যুকে,বিশিষ্ট শস্ত্রবিদ্যাবিষয়কজ্ঞানে ও অস্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়োগবিষয়ে এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপে প্রভূত শিক্ষা দিলেন। ক্রমে অর্জুন, অভিমন্যুকে, অস্ত্রের জ্ঞান ও চালনায় নিজের সমকক্ষ করে তুললেন। তিনি সুভদ্রাপুত্রকে নিরীক্ষণ করে পরম সন্তোষ অনুভব করলেন। অভিমন্যু শত্রুদমনের সমস্ত কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন, তাঁর মধ্যে সেই গুণগুলি লক্ষিত হোত। বৃষস্কন্ধ, তিনি যেন মুখব্যাদানকারী সর্পের মতো দুর্দম ছিলেন।সিংহতুল্য দর্প, প্রমত্ত হস্তীর মতো বিক্রম,মেঘ ও দুন্দুভিসম গম্ভীর কণ্ঠস্বর, পূর্ণ চন্দ্রের মতো মুখশ্রী ছিল তাঁর। ইন্দ্র যেমন অর্জুনকে কৃষ্ণসদৃশ দেখেছিলেন তেমনই অর্জুন শৌর্যে, বীর্যে, সৌন্দর্যে, আকৃতিতে অভিমন্যুকে কৃষ্ণতুল্য দেখতেন।

পাঞ্চালী দ্রৌপদী পঞ্চ পতি হতে পঞ্চ পর্বতসম, সুলক্ষণান্বিত, বীর, শ্রেষ্ঠ পঞ্চ পুত্র লাভ করলেন। অদিতি যেমন দেবগণের প্রসবকর্ত্রী তেমনই পাঞ্চালী, যুধিষ্ঠিরের ঔরসে প্রতিবিন্ধ্য, বৃকোদর ভীম হতে সুতসোম, অর্জুনপুত্র শ্রুতকর্মা, নকুলের ঔরসজাত শতানীক, সহদেব হতে শ্রুতসেন নামে বীর পুত্রদের জন্ম দিলেন। বিন্ধ্যপর্বততুল্য প্রতিপক্ষের প্রহার তুচ্ছ মনে করবেন এই পুত্র, এমন মনে করে ব্রাহ্মণরা যুধিষ্ঠিরপুত্রের নাম দিলেন প্রতিবিন্ধ্য। দ্রৌপদী, বহু সোমযাগ করে, চন্দ্র ও সূর্যতুল্য মহাযোদ্ধা ভীমসেনের পুত্রটি প্রসব করেছিলেন, তাই তাঁর নাম হল সুতসোম। লোকখ্যাত বহু মহৎ তীর্থ পর্যটনান্তে কিরীটি অর্জুন দ্রৌপদীর পুত্রটির পিতা হয়েছিলেন, সেই কারণে পুত্রটির নামকরণ হল শ্রুতকর্মা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’

কুরুবংশীয় মহান ঋষি শতানীকের নামানুসারে নকুল তাঁর কীর্তিবর্ধক পুত্রের নাম রাখলেন শতানীক। কুমার কার্ত্তিক কৃত্তিকানক্ষত্রে জন্মহেতু বহুসেনা লাভ করেছিলেন তাই তিনি মহাসেন নামে খ্যাত হয়েছিলেন তেমনই কৃষ্ণা দ্রৌপদী কৃত্তিকানক্ষত্রে, সহদেবপুত্রের জন্ম দিলেন। বিখ্যাত সেনাদলের কথা স্মরণ করে তার নাম দেওয়া হল শ্রুতসেন। এক বৎসর অন্তরে জাত দ্রৌপদীর এই পাঁচটি পুত্র যশস্বী এবং পরস্পরের হিতৈষী ছিলেন। রাজপুরোহিত ধৌম্য, পুত্রদের ক্রমানুসারে বিধিসম্মত জাতকর্ম, চূড়া, উপনয়নাদি সংস্কার সম্পন্ন করলেন। পুত্ররা ব্রহ্মচর্যাশ্রমের নিয়ম পালন করে বেদাধ্যয়ন করলেন। এর পরে অর্জুনের কাছে, সকল প্রকার দৈব ও লৌকিক, বাণাদি তথা অন্যান্য অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করলেন। দেববালকতুল্য, দৃঢ়বক্ষা, মহারথী সেই পুত্রদের সাহচর্যে পাণ্ডুপুত্ররা পরমানন্দ লাভ করলেন।

অর্জুন বৃষ্ণিবংশীয়দের সম্মানিত অতিথিরূপে বসুদেবকন্যা সুভদ্রাকে হরণ করে চরম বিশ্বাসভঙ্গ করেছিলেন। জ্যেষ্ঠ বলরাম ও অপরাপর যাদবকুল রুষ্ট হয়ে কৌরবদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সম্পূর্ণ বিষয়টির জন্যে দায়ী কৃষ্ণ। তিনি সকলের অজ্ঞাতসারে ভগিনীকে অপহরণের সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন। হয়তো কোনও মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। কৃষ্ণভক্তদের প্রগাঢ় বিশ্বাস হয়তো এই সদর্থক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু একজন কথক তাঁর কথকতার আসরে, যাদবদের প্রতি, অর্জুনের এই বিশ্বাসঘাতকতাকে অনৈতিক ও গর্হিত আচরণ যদি বলেন তবে বোধ হয় তা অত্যুক্তি নয়। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যদি একটি গর্হিত আচরণকে সম্মতির সীলমোহর দিয়ে স্বীকৃতি দেন তবে তা সাধারণের কাছে গ্রাহ্য বলেই মনে হয়। এখানেও সেটাই ঘটল। কৃষ্ণ, অর্জুনের আচরণের সমর্থনে শাস্ত্রানুমোদিত বিবাহের বিরুদ্ধে সমালোচনায় যুক্তিজাল বিস্তার করলেন। আপামর যাদবগোষ্ঠীর, যাদবমুখ্য কৃষ্ণের সে যুক্তি,অকাট্য ও অখণ্ডনীয় বলে মনে হল। অর্জুন, সুযোগ্যা কন্যা সুভদ্রার যোগ্য সুপাত্র, এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। শুধু বিবাহরীতিটি হয়তো সঠিক নয়। বিশেষকরে বিখ্যাত কুরুবংশীয় বীর অর্জুনের এটি প্রত্যাশিত আচরণ নয়।

ছবি: প্রতীকী।

বনবাসকালে অর্জুন ও সুভদ্রার এই বিবাহবন্ধন সার্থক হল। বসুদেবকন্যা সুভদ্রা তাঁর চরিত্র মাধুর্যে মা কুন্তী ও সতীন দ্রৌপদীর মন জয় করলেন। অভিমানিনী দ্রৌপদীর যত অভিমান দূর করলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। তিনি যে প্রণয়নিপুণ, সেটি সুদীর্ঘ বার বছরের বনবাস জীবনে তিনটি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। বৃষ্ণি ও জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবভাইদের সম্মতিক্রমে মহাসমারোহে অর্জুন ও সুভদ্রার বিবাহ সম্পন্ন হল। উপহার বিনিময় হল। উভয়পক্ষই সন্তুষ্ট, পরিতৃপ্ত। এমন বিবাহই কাঙ্খিত। সুভদ্রা অর্জুনপুত্রের জননী হলেন, এমন পুত্র যিনি খ্যাতিমান, ক্রোধী অথচ নির্ভীক। পিতার তত্ত্বাবধানে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করলেন অভিমন্যু। অর্জুন, রূপ, গুণ, আকৃতিগত সাদৃশ্যহেতু অভিমন্যুকে মাতুল কৃষ্ণের তুল্য মনে করতেন। শর্তানুযায়ী, পঞ্চ পতির সঙ্গে দাম্পত্যসম্পর্কে দ্রৌপদী পঞ্চ পুত্রের জননী হলেন। প্রত্যেকের নাম ক্ষত্রিয়সুলভ বীর্যবত্তার দ্যোতক। মহাভারতের কুরুপাণ্ডবদের বিখ্যাত যুদ্ধে অভিমন্যু তাঁর বীর্যবত্তায় ক্ষত্রিয়বীরের প্রবাদপ্রতিম উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন।
দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র শেষপর্যন্ত জীবিত থেকেও মর্মান্তিক প্রতিশোধের জ্বালায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই সব পরিণতি সকলেরই জানা। দ্রৌপদীর সঙ্গে বিবাহের ফলে পঞ্চ পাণ্ডব, পাঁচটি পুত্রের পিতা হলেন। পাণ্ডবদের শৌর্যের উত্তরাধিকার বহন করলেন বলপূর্বক বিবাহের ফলে জাত সুভদ্রাপুত্র অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র নয়।বিতর্কিত বিবাহ,প্রাথমিকভাবে যাদবগণের অননুমোদিত বিবাহ, এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত করল যাদব ও কুরুবংশীয় পাণ্ডবদের। কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হল। এর পরিণতি পাণ্ডবদের পক্ষে শুভ হল। অর্জুন ও সুভদ্রার বিবাহের সার্থকতা, কৃষ্ণের কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফল বললে হয়তো ভুল হবে না। সকলের মাথার ওপরে কৃষ্ণের শুভাশীর্বাদের হাতটি থাকে না, অনৈতিক আচরণ যে কোন লৌকিক ও দৈবশক্তির সমর্থনহীন বলেই মনে হয়। তাই কন্যাকে অপহরণ করে বলপূর্বক বিবাহ, উদাহরণযোগ্য নয়, অনুকরণীয় তো নয়ই, কোনও যুগে, কোনও কালেই সেটি সমর্থনযোগ্য নয়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content