
ছবি: সংগৃহীত।
অর্জুনের গন্তব্য হিমালয় পর্বত। তিনি অগস্ত্যবট, বশিষ্ঠপর্বত এবং তুঙ্গনাথে উপস্থিত হয়ে পবিত্র হলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের সহস্র গাভী এবং নিবাসনির্মাণের জন্যে বহু সামগ্রী দান করলেন। ঋষিগণ সেবিত হিরণ্যবিন্দু তীর্থোদকে স্নান করে, বহু পুণ্যস্থান দর্শন করলেন। এরপরে বহু তীর্থ দর্শনেচ্ছায় অর্জুন, পূর্বদিকে যাত্রা করলেন। নৈমিষারণ্যে উৎপলিনী নামের নদী, এ ছাড়া নন্দা, অপরনন্দা, কৌশিকী, মহানদী, গয়াতীর্থ ও গঙ্গা দর্শন করলেন। তীর্থস্থানে, নিজের শুদ্ধিকরণের লক্ষ্যে ব্রাহ্মণদের ধন দান করলেন। অঙ্গদেশ, বঙ্গ ও কলিঙ্গদেশে যত তীর্থ আছে সেগুলি এবং তীর্থ ও দেবস্থানে তিনি গমন করলেন। যথারীতি সর্বত্র তিনি ধন দান করলেন। কলিঙ্গদেশের প্রবেশদ্বারে অনুসরণকারী ব্রাহ্মণরা বিদায় নিলেন। ব্রাহ্মণদের সম্মতি নিয়ে, অল্পসংখ্যক অনুচর নিয়ে, সমুদ্রের নিকটবর্তী দেশে গেলেন। কলিঙ্গ দেশের দেবালয়গুলি অতিক্রম করে, রম্য বনভূমি দেখতে দেখতে চললেন।
তপস্বীগণ অধ্যুষিত মহেন্দ্রপর্বত দর্শন করে, সমুদ্রতীর ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন মণিপুরে। সেখানে সব তীর্থ ও পুণ্যভূমিতে গমনান্তে সেখানকার মহাবীর রাজার কাছে উপস্থিত হলেন। মণিপুরের রাজা ধর্মজ্ঞ চিত্রবাহন, তাঁর সুন্দরী কন্যাটির নাম চিত্রাঙ্গদা। সেখানে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, চিত্রবাহনকন্যা চিত্রাঙ্গদা। তাঁকে দেখে অর্জুন তাঁর প্রতি আসক্ত হলেন। রাজার কাছে অনুরোধ করলেন, দেহি মে খল্বিমাং রাজন্! ক্ষত্রিয়ায় মহাত্মনে। এই ক্ষত্রিয়কুমারকে কন্যা দান করুন। রাজা অর্জুনের পরিচয় জানতে চাইলেন, কস্য পুত্রোঽসি নাম কিম্ কার পুত্র তুমি, তোমার নামটি কী? অর্জুন পরিচয় দিলেন, পাণ্ডবোঽহং কুন্তীপুত্রো ধনঞ্জয়ঃ।
তপস্বীগণ অধ্যুষিত মহেন্দ্রপর্বত দর্শন করে, সমুদ্রতীর ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন মণিপুরে। সেখানে সব তীর্থ ও পুণ্যভূমিতে গমনান্তে সেখানকার মহাবীর রাজার কাছে উপস্থিত হলেন। মণিপুরের রাজা ধর্মজ্ঞ চিত্রবাহন, তাঁর সুন্দরী কন্যাটির নাম চিত্রাঙ্গদা। সেখানে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, চিত্রবাহনকন্যা চিত্রাঙ্গদা। তাঁকে দেখে অর্জুন তাঁর প্রতি আসক্ত হলেন। রাজার কাছে অনুরোধ করলেন, দেহি মে খল্বিমাং রাজন্! ক্ষত্রিয়ায় মহাত্মনে। এই ক্ষত্রিয়কুমারকে কন্যা দান করুন। রাজা অর্জুনের পরিচয় জানতে চাইলেন, কস্য পুত্রোঽসি নাম কিম্ কার পুত্র তুমি, তোমার নামটি কী? অর্জুন পরিচয় দিলেন, পাণ্ডবোঽহং কুন্তীপুত্রো ধনঞ্জয়ঃ।
আমি পাণ্ডব, কুন্তীপুত্র,নাম ধনঞ্জয়। তখন রাজা, মধুরভাবে এক কাহিনির অবতারণা করলেন। এই বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন। পুত্রহীন সেই রাজা সন্তানকামনায় গভীর তপস্যা শুরু করলেন। তাঁর সেই কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে পিনাকধারী দেবাদিদেব মহাদেব বর দিলেন, একৈকং প্রসবং কুলে বংশের এক একজন পুরুষ এক একটি সন্তান লাভ করবেন। সেই নিয়মই চলে আসছে। পূর্বপুরুষেরা সকলেই পুত্রসন্তানের পিতা হয়েছেন। শুধু রাজা চিত্রবাহনের ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম ঘটেছে। তাঁর একটিই কন্যা, সেই বংশরক্ষা করবে। রাজা চিত্রবাহন মনে করেন, সেই কন্যাই তাঁর পুত্র। রাজা, পুত্রিকাপুত্র (কন্যার সন্তানকে পুত্ররূপে গ্রহণ) লাভহেতু যজ্ঞানুষ্ঠান করেছেন। তাই রাজা চিত্রবাহনের প্রস্তাব, হে ভরতবংশীয়, তোমার দ্বারা এই কন্যার গর্ভে যে পুত্রসন্তান জন্ম নেবে,সেই বংশরক্ষক পুত্রটি হবে তোমার বিবাহের পণ। এই শপথের মাধ্যমে তুমি কন্যাটিকে গ্রহণ কর। এতচ্ছুল্কং ভবত্বস্যাঃ কুলকৃজ্জায়তামিহ। এতেন সময়েনেমাং প্রতিগৃহ্নীষ্ব পাণ্ডব!।। অর্জুন সহমত হলেন। তিনি সেই সুন্দরী রমণী, চিত্রাঙ্গদাকে গ্রহণ করে সেই নগরে তিন বৎসর বসবাস করলেন। যথাকালে পুত্র জন্ম নিল। অর্জুন সুন্দরী চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গন করে, নৃপতি চিত্রবাহনের কাছে বিদায় নিয়ে, দেশান্তরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো
অর্জুনের গন্তব্য দক্ষিণ সমুদ্রতীরের সুপবিত্র তপস্বীগণদ্বারা পরিশোধিত তীর্থগুলি। পূর্বে যে পঞ্চ তীর্থ তপস্বীরা ব্যাপ্ত করে থাকতেন, পরবর্তীকালে সেই পাঁচটী তীর্থকে তপস্বীরা বর্জন করলেন। অর্জুন যথাক্রমে পবিত্রতম অগস্ত্যতীর্থ, সৌভদ্রতীর্থ, পৌলোমতীর্থ এবং চতুর্থ কারান্ধম তীর্থ, যাঁর জল সুনির্মল এবং অশ্বমেধযজ্ঞসম ফলদায়ক এবং এরপরে ভরদ্বাজতীর্থ, যেটি পাপনির্মূল করে, অর্জুন এই পঞ্চ তীর্থ দর্শন করলেন। জনহীন পাঁচটি তীর্থ,ধার্মিক মুনিরা বর্জন করেছেন। অর্জুনের অপার কৌতূহল, করজোড়ে তপস্বীদের কাছে জানতে চাইলেন, ব্রহ্মবাদী ঋষিরা কেন এই তীর্থগুলি বর্জন করছেন?তাপসরা জানালেন, পাঁচটি তীর্থে, পাঁচ পাঁচটি জলজন্তু বাস করে। এটাই তীর্থস্থানগুলি বর্জনের কারণ। জেনে, শুনে, তপোধনদের নিষেধ সত্ত্বেও অর্জুন চললেন এই বর্জিত তীর্থদর্শনে।তারপরে অর্জুন সৌভদ্র নামের তীর্থে অবগাহন স্নান করলেন।সেখানে জলের অভ্যন্তরে জলচর বিরাট প্রাণী কুন্তীপুত্র ধনঞ্জয় অর্জুনকে পদযুগল আক্রমণ করল। আক্রান্ত মহাশক্তিশালী অর্জুন, কম্পমান জলচর প্রাণীটিকে, শক্তিপ্রয়োগ করে, তীরে এনে তুললেন। উপরে এসে সেই জলজন্তুটি একটি কল্যাণী, সর্বালঙ্কারভূষিতা এক নারীতে রূপান্তরিত হল। সেই নারী, সৌন্দর্যে প্রদীপ্তা,মনোহারিণী,তাঁর অঙ্গে স্বর্গীয় রূপ।সেই আশ্চর্য মহান রূপ দেখে,কুন্তীপুত্র ধনঞ্জয়, প্রফুল্ল হয়ে বললেন, কা বৈ ত্বমসি কল্যাণি! কুতোবাঽসি জলেচরি!।। কিমর্থঞ্চ মহৎ পাপমিদং কৃতবতী পুরা। হে কল্যাণি, তুমি কে? ওগো জলচরি, কোথা থেকে তুমি এসেছ? অতীতে কেনই বা এই গুরুতর পাপ কাজ করছিলে?
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৯: বুলবুলি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৪: খরগোশ ও কচ্ছপ
সুন্দরী পরিচয় জানালেন। তিনি স্বর্গের নন্দনবনবাসিনী,অপ্সরা এবং ধনপতি কুবেরের প্রার্থিতা। তিনি এও জানালেন তাঁর চার সখী স্বেচ্ছাগামিনী ও কল্যাণী। সকলে মিলে লোকপাল ইন্দ্রের ভবনে থেকে ফিরবার পথে, এক স্থিরসঙ্কল্প, রূপবান, একান্তে অধ্যয়নরত, একান্তচারী এক ব্রাহ্মণের দেখা পেলেন। সেই বনটিতে যেন সেই ব্রাহ্মণের তপস্যার তেজ বিচ্ছুরিত হচ্ছে।সূর্যসম তেজস্বী তপস্বীর সেই রকম আশ্চর্য উত্তম রূপ দেখে, বর্গা, সৌরভেয়ী, সমীচী, বুদবুদা ও লতা নামের পাঁচ অপ্সরা, সহাস্যে গান গাইতে গাইতে, ব্রাহ্মণকে প্রলুব্ধ করতে সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। তাঁদের দেখে, মহাতেজস্বী ও তপস্যায় স্থিতধী ব্রাহ্মণের নিষ্পাপ মনটি কেঁপে উঠল না। তিনি অপ্সরাদের প্রতি মনোনিবেশ করলেন না, বরং অভিশাপ দিলেন, গ্রাহভূতা জলে যূয়ং চরিষ্যথ শতং সমাঃ।
জলজন্তু হয়ে, জলে শত বৎসর বিচরণ কর। অগত্যা সকল অপ্সরা মিলে ব্যথিত হৃদয়ে সেই ধর্মনিষ্ঠ তপোধনের শরণ নিলেন।অপ্সরারা স্বীকার করলেন,রূপ বয়স এবং কামহেতু গর্বিতা তাঁরা, অসঙ্গত কাজ করেছেন। তপস্বী যেন তাঁদের ক্ষমা করেন। তাঁরা সকাতরে জানালেন, আমাদের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে,মৃত্যু অপেক্ষা তা কম নয়, যেহেতু জিতেন্দ্রিয় আপনাকে প্রলুব্ধ করতে আমরা এখানে এসেছি। এষ এব বধোঽস্মাকং সুপর্য্যাপ্তস্তপোধন!। যদ্বয়ং সংশিতাত্মানং প্রলোব্ধুং ত্বামিহাগতাঃ।। ধার্মিকদের মতে স্ত্রীলোক অবধ্য। তাই তপস্বী, অপ্সরাদের প্রতি হিংস্র হতে পারেন না। ধর্মকে আশ্রয় করেই তপস্বীর উন্নতি হোক। সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণরা দয়াদাক্ষিণ্য প্রদর্শন করেন। তাই তাঁরা সকল প্রাণীর মিত্র, জ্ঞানীদের এই প্রবাদ সত্যে পরিণত হোক। শাস্ত্রজ্ঞরা শরণার্থীদের প্রতিপালন করে থাকেন। অপ্সরাগণ এখন তপস্বী ব্রাহ্মণের আশ্রিতা। তাই তাঁরা ক্ষমার যোগ্যা। এই সব কথা শুনে, সেই হিতকারী ধার্মিক চন্দ্র-সূর্যসম তেজস্বী ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হলেন। তিনি বললেন, শত, সহস্র শব্দগুলি অক্ষয় অর্থ, এগুলি আনন্ত্যসূচক। কিন্তু অভিশাপে উল্লিখিত শতশব্দটি শত সংখ্যার সূচকমাত্র, এর আনন্ত্য অর্থ নয়।অভিশাপের প্রতিকারের উপায়টি জানালেন। যখনই যে কোনও জলজন্তু কোন ব্যক্তিকে জলের গভীরে আকর্ষণ করে নিয়ে যাবে, তখনই কোনও পুরুষশ্রেষ্ঠ সেই জলজন্তুকে জল থেকে টেনে আনবে তখন আবার স্বরূপ ফিরে পাবে জলজন্তরূপধারিণী অপ্সরাগণ। তপস্বী আশ্বস্ত করলেন তিনি কখনও পরিহাস ছলেও মিথ্যা কথা বলেন না। তপস্বী ব্রাহ্মণ আরও বললেন, সেই দিন হতে জলজন্তু অধ্যুষিত সব কটি তীর্থ ‘নারীতীর্থ’ নামে খ্যাত হবে এবং মনীষীদের কাছে পুণ্যময় পবিত্র তীর্থস্থান রূপে পরিগণিত হবে।
জলজন্তু হয়ে, জলে শত বৎসর বিচরণ কর। অগত্যা সকল অপ্সরা মিলে ব্যথিত হৃদয়ে সেই ধর্মনিষ্ঠ তপোধনের শরণ নিলেন।অপ্সরারা স্বীকার করলেন,রূপ বয়স এবং কামহেতু গর্বিতা তাঁরা, অসঙ্গত কাজ করেছেন। তপস্বী যেন তাঁদের ক্ষমা করেন। তাঁরা সকাতরে জানালেন, আমাদের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে,মৃত্যু অপেক্ষা তা কম নয়, যেহেতু জিতেন্দ্রিয় আপনাকে প্রলুব্ধ করতে আমরা এখানে এসেছি। এষ এব বধোঽস্মাকং সুপর্য্যাপ্তস্তপোধন!। যদ্বয়ং সংশিতাত্মানং প্রলোব্ধুং ত্বামিহাগতাঃ।। ধার্মিকদের মতে স্ত্রীলোক অবধ্য। তাই তপস্বী, অপ্সরাদের প্রতি হিংস্র হতে পারেন না। ধর্মকে আশ্রয় করেই তপস্বীর উন্নতি হোক। সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণরা দয়াদাক্ষিণ্য প্রদর্শন করেন। তাই তাঁরা সকল প্রাণীর মিত্র, জ্ঞানীদের এই প্রবাদ সত্যে পরিণত হোক। শাস্ত্রজ্ঞরা শরণার্থীদের প্রতিপালন করে থাকেন। অপ্সরাগণ এখন তপস্বী ব্রাহ্মণের আশ্রিতা। তাই তাঁরা ক্ষমার যোগ্যা। এই সব কথা শুনে, সেই হিতকারী ধার্মিক চন্দ্র-সূর্যসম তেজস্বী ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হলেন। তিনি বললেন, শত, সহস্র শব্দগুলি অক্ষয় অর্থ, এগুলি আনন্ত্যসূচক। কিন্তু অভিশাপে উল্লিখিত শতশব্দটি শত সংখ্যার সূচকমাত্র, এর আনন্ত্য অর্থ নয়।অভিশাপের প্রতিকারের উপায়টি জানালেন। যখনই যে কোনও জলজন্তু কোন ব্যক্তিকে জলের গভীরে আকর্ষণ করে নিয়ে যাবে, তখনই কোনও পুরুষশ্রেষ্ঠ সেই জলজন্তুকে জল থেকে টেনে আনবে তখন আবার স্বরূপ ফিরে পাবে জলজন্তরূপধারিণী অপ্সরাগণ। তপস্বী আশ্বস্ত করলেন তিনি কখনও পরিহাস ছলেও মিথ্যা কথা বলেন না। তপস্বী ব্রাহ্মণ আরও বললেন, সেই দিন হতে জলজন্তু অধ্যুষিত সব কটি তীর্থ ‘নারীতীর্থ’ নামে খ্যাত হবে এবং মনীষীদের কাছে পুণ্যময় পবিত্র তীর্থস্থান রূপে পরিগণিত হবে।
আরও পড়ুন:

শিবরাত্রি: তোমার নৃত্য অমিতবিত্ত ভরুক চিত্ত মম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
অপ্সরারা সেই ব্রাহ্মণকে প্রদক্ষিণপূর্বক অভিবাদন করে, সেই স্থানটি থেকে কিছু দূরে এসে, ব্যথিতমনে চিন্তা করতে লাগলেন। আমরা, সে মানুষ কোথায় পাই? যিনি আমাদের স্বরূপ ফিরিয়ে দেবেন? ক্ব নু নাম বয়ং সর্ব্বাঃ কালেনাল্পেন তং নরম্। সমাগচ্ছেম যো নস্তদ্রূপমাপাদয়েৎ পুনঃ।। এমন চিন্তা করতে করতে মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা মহর্ষি নারদকে দেখলেন। নারদের প্রশ্নের উত্তরে অপ্সরাগণ তাঁদের দুঃখের কারণ জানালেন। মহর্ষি নারদের পরামর্শানুসারে পাঁচ অপ্সরা দক্ষিণসমুদ্রের তীরবর্তী, পবিত্র রমণীয় পঞ্চ তীর্থে অবস্থান করেছিলেন, কারণ, সেখানে শীঘ্রই আসবেন সেই পবিত্রহৃদয়, পুরুষশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয়, যিনি নিঃসন্দেহে মুক্ত করবেন তাঁদের। অপ্সরা বর্গা,অর্জুনকে জানালেন, মহর্ষির কথা সত্য প্রতিপন্ন হল আজ। হে নিষ্পাপ, আপনি আমাদের শাপমুক্ত করলেন। তদিদং সত্যমেবাদ্য মোক্ষিতাহং ত্বয়ানঘ!।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
অপ্সরা বর্গা এবং তাঁর পাঁচ সখীকে শাপমুক্ত করলেন অর্জুন।সকলে পূর্বের রূপ ফিরে পেলেন। তীর্থগুলি বিপদমুক্ত হল। অপ্সরারা স্বস্থানে প্রস্থান করলেন। অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে দেখতে মণিপুরে চললেন। চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহন নামে একটি পুত্রের জন্ম দিলেন।পুত্রটিকে দেখে, অর্জুন, রাজা চিত্রবাহনকে বললেন, আপনি কন্যা শুল্ক অর্থাৎ কন্যাপণ এই বভ্রুবাহনকে গ্রহণ করুন, এর ফলে আমি ঋণমুক্ত হবে। চিত্রাঙ্গদায়াঃ শুল্কং ত্বং গৃহাণ বভ্রুবাহনম্। অনেন চ ভবিষ্যামি ঋণান্মুক্তো নরাধিপ!।। অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে সান্ত্বনা দিলেন, এখানে থেকে বভ্রুবাহনকে বড় করে তোল। ইহৈব ভব ভদ্রং তে বর্দ্ধেথা বভ্রুবাহনম্।। আরও প্রবোধ দিলেন, ভবিষ্যতে বরং ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হয়ে, দেবী কুন্তী, যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেব, এনাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শেষে, আনন্দ উপভোগ করা যাবে। অচিরেই কুন্তীপুত্র, ধর্মে স্থিতধী, যথার্থ ধৈর্যশীল, পৃথিবীজয়ী রাজা যুধিষ্ঠির রাজসূয়যজ্ঞ করবেন। অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে আশার বাণী শোনালেন। সেই যজ্ঞে আমন্ত্রিত মণিপুররাজের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদাও সেখানে যাবেন। আবার তাঁদের দুজনের সাক্ষাৎ হবে। ততদিন অর্জুনের বহির্গত প্রাণপ্রতিম, চিত্রবাহনের বংশরক্ষক পুত্র বভ্রুবাহনকে চিত্রাঙ্গদা পালন করুন এমনভাবে,যাতে পুত্রটি যেন পুরুবংশকে নন্দিত করে পাণ্ডবদের প্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনই নৃপতি চিত্রবাহনের যোগ্য উত্তরাধিকারীও হয়ে ওঠে। অর্জুনের একটিই অনুরোধ — বিপ্রয়োগেণ সন্তাপং মা কৃথাস্ত্বমনিন্দিতে!। আমার বিরহে ব্যথিতা হয়ো না।

ছবি: সংগৃহীত।
চিত্রাঙ্গদার কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন,পশুপতির আদি অধিষ্ঠান,যা দর্শনহেতু মুক্তিলাভ হয় এবং যেখানে পাপিষ্ঠ মানুষ ভয়হীনতার অভয়চরণের আশ্রয় লাভ করেন সেই গোকর্ণতীর্থে গমন করলেন। অর্জুন শর্তানুযায়ী সদ্যপরিণীতা স্ত্রীকে পিছনে ফেলে, ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করে বনবাসে গমন করলেন। এক সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে নতুন নতুন সম্পর্কের সূত্রে জড়িয়ে পড়লেন। হস্তিনাপুরের গণ্ডী অতিক্রম করে অর্জুন তাঁর পারিপার্শ্বিকের ভৌগলিক গণ্ডী চিনলেন, জানলেন। কত তীর্থ,কত নদী,কত নামবৈচিত্র্য তাদের। অঙ্গ, বঙ্গ, লিঙ্গের তীর্থদর্শনের সঙ্গে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল অর্জুনের। অরণ্যভূমি, সমুদ্রতীরবর্তী দেবালয়, মহেন্দ্রপর্বত, শেষে মণিপুরে বিস্তৃত হল তাঁর যাত্রাপথ। মণিপুররাজ চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদার প্রতি আসক্ত হলেন অর্জুন। আবার একটি সম্পর্ক। এই সম্পর্কে উত্তরাধিকারী সন্তানপ্রাপ্তির কোনও আকাঙ্খা নেই, নির্মোহ শর্তসাপেক্ষ সম্পর্ক। তবু বন্ধনের জোড়টুকু থাকল। দক্ষিণের সমুদ্রের নিকটবর্তী জনহীন, ধার্মিক ব্রহ্মবাদীদের পরিত্যক্ত, পঞ্চ তীর্থ, যথাক্রমে অগস্ত্য, সৌভদ্র, পৌলম, কারন্ধম এবং ভারদ্বাজতীর্থ দর্শন করলেন। আসন্ন বিপদ জেনেও হিংস্র জলজন্তুঅধ্যুষিত সৌভদ্রতীর্থে অবগাহন স্নানকালীন আক্রান্ত হলেন। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তৃতীয় পাণ্ডব মহাবীর অর্জুনের এই আচরণ তাঁর প্রবাদপ্রতিম শৌর্য প্রকাশের সঙ্গে মানানসই। অর্জুন, পাঁচ অপ্সরাকে শাপমুক্ত করেছেন। তাঁদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে। মণিপুররাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। পিতৃত্বের দাবিহীন অর্জুন, সন্তানকে শর্তসাপেক্ষ সম্পর্কের দরুণ, মাতামহ রাজা চিত্রবাহনকে অর্পণ করেছেন।
অর্জুন, হস্তিনাপুরের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে গেঁথেছেন উত্তর থেকে দক্ষিণপ্রান্তকে। অর্জুনের এই একান্ত বিচরণ তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি পরিণত ও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। অবস্থান্তরের মধ্যে দিয়ে মানুষ পরিণত, সমৃদ্ধ,বর্ধিত ও উন্নত হয়। অর্জুনের রাজকীয় পরিচয় সরিয়ে রেখে, দেশে স্বেচ্ছানুসারে ভ্রমণরত একজন সাধারণ ব্যক্তি অর্জুনকে দেখে, শৌর্যশালী বীরসত্তা মনে আসে না, শুধু মনে হয়, একজন সাধারণ ভরতবংশীয় বিভিন্ন প্রত্যন্ত প্রদেশকে চিনছেন, জানছেন, আত্মীয়তার বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে হস্তিনাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে সেই সব পরিচিত স্থান। কত বিচিত্র গল্পকথা, কথাস্রোতে ভেসে আসা অজানা কাহিনির উদ্ভাস, মহাভারতীয় বিস্তারে। মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্ব মহাভারতের কলেবরকে পুষ্ট করছে বার বার। মহাভারতের মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে নতুন নতুন সংযোজন এইভাবে চিরন্তন মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।—চলবে।
অর্জুন, হস্তিনাপুরের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে গেঁথেছেন উত্তর থেকে দক্ষিণপ্রান্তকে। অর্জুনের এই একান্ত বিচরণ তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি পরিণত ও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। অবস্থান্তরের মধ্যে দিয়ে মানুষ পরিণত, সমৃদ্ধ,বর্ধিত ও উন্নত হয়। অর্জুনের রাজকীয় পরিচয় সরিয়ে রেখে, দেশে স্বেচ্ছানুসারে ভ্রমণরত একজন সাধারণ ব্যক্তি অর্জুনকে দেখে, শৌর্যশালী বীরসত্তা মনে আসে না, শুধু মনে হয়, একজন সাধারণ ভরতবংশীয় বিভিন্ন প্রত্যন্ত প্রদেশকে চিনছেন, জানছেন, আত্মীয়তার বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে হস্তিনাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে সেই সব পরিচিত স্থান। কত বিচিত্র গল্পকথা, কথাস্রোতে ভেসে আসা অজানা কাহিনির উদ্ভাস, মহাভারতীয় বিস্তারে। মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্ব মহাভারতের কলেবরকে পুষ্ট করছে বার বার। মহাভারতের মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে নতুন নতুন সংযোজন এইভাবে চিরন্তন মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।