শনিবার ৫ অক্টোবর, ২০২৪


মৃগয়া ছবির একটি দৃশ্যে।

কিছু কিছু স্মৃতিকথা একান্ত ব্যক্তিগত থেকে যায়। নানা কারণে তা বহির্জগতে প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না। আজ তেমনই একটি বিষয়ে আলোকপাত করবো। দেশের বিশিষ্ট এবং অন্যতম কৃতী অভিনেতা ও হিন্দি ছবির সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী এ বছর দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার না পেলে হয়তো এ প্রতিবেদন লেখার প্রয়োজন হতো না। স্মৃতির পাতায় তা একান্ত ব্যক্তিগতই থাকতো।
১৯৮৯ সাল। কর্মসূত্রে প্রথমবার মুম্বই (তখন অবশ্য বোম্বে) গিয়েছি। কলকাতায় লোকনাথ ডিভাইন লাইফ মিশনের কয়েকটি অডিয়ো ক্যাসেটে গ্রন্থনা করা এবং মিশনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার সুবাদে দেশের এক বিশিষ্ট ব্যক্তির কলকাতার আত্মীর-পরিজনের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল। আমি মুম্বই যাচ্ছি, তাঁরা আমায় সেখানকার নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। আমি যোগাযোগের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবে খুব সন্দিহান ছিলাম। সেটা ল্যান্ডফোনের সময়। আধুনিকতা বলতে তখন ডিজিটাল ডায়েরি খুব চালু। অফিসে আমার গন্তব্যে যাওয়ার আগেই স্টেশন থেকে কয়েন ঢুকিয়ে নম্বর ডায়াল করলাম।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩০: বাংলাতে রাজাদের চিঠিপত্র

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি

কলকাতায় তখন ফোনে খুব ক্রস কানেকশন হতো। তাই অভ্যাসবশত নম্বর যাচাই করবার জন্য জিজ্ঞেস করবার সঙ্গে সঙ্গে রং নম্বর বলে ওপ্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেওয়া হল। একবার দু’বার তিনবার। সৌভাগ্যক্রমে আমার কাছে ওঁদের আরেকজন আত্মীয়ার ফোন নম্বর ছিল। ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ হল। ব্যক্তিগত পরিচিতি না থাকলেও অডিয়ো ক্যাসেট গ্রন্থনা করার সুবাদে তিনি আমাকে প্রথমবারই চিনতে পারলেন। পরিচয় দেবার দরকার পড়েনি। বারবার রং নম্বরের সমস্যা জানাতে সেই বয়ঃজ্যেষ্ঠা আত্মীয়া আমায় বললেন—
—তুমি হয়তো নম্বর কনফার্ম করেছো?
—হ্যাঁ।
—করো না। এ ভাবে সারাদিনে অসংখ্য ফোন যায়, তাই বার বার কেটে দিচ্ছে। তুমি এ বার বলো মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। অসুবিধে হবে না। আর তুমি অবশ্যই মাকে জানিও পরে কবে আসতে চাও! আর অসুবিধে হয়নি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

মুম্বই অফিসে কাজ শুরুর দুএকদিন পর খার-এর সেই বাড়িতে পৌঁছলাম। নিরাপত্তা কর্মীরা আমার পরিচয় ও আসার উদ্দেশ্য জেনে তার সত্যতা যাচাইয়ের পর নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেণ্টে মায়ের কাছে পৌঁছে দিলেন। সেদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে এলাম এবং কথা দিয়ে এলাম পরের রবিবার ছুটিরদিন সকালবেলায় পৌঁছে যাব। সেই বিশিষ্টজন একসময়ে বাদবিচার না করে দু’ হাতে মানুষকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। পরে ঠকতে ঠকতে ঠেকে শিখেছেন সতের আড়ালে অসৎ মানুষ মিশে থাকে। তাই তখন অনেকটা আঁটোসাঁটো তাঁর বাড়ির নিরাপত্তা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

রবিবার পৌঁছে মায়ের সঙ্গে দেখা করার পর নানান সর্বভারতীয় পুরস্কার বোঝাই বসবার ঘরে কফি কাপ হাতে অপেক্ষা করছি। সেই প্রথম দেশের কোনও সুপারস্টারের লিভিংরুমে বসে আছি। আচমকা ঘরে এল আটখানি কুকুর। বলা হয়নি, কুকুরে আমার সাংঘাতিক ভয়। আজও ভয় এতটুকু কমেনি। দমবন্ধ করে কাঠের মতো বসে আছি। বসা অবস্থায় আমার কাঁধের থেকে হাঁটু এবং হাঁটুর নিচে পর্যন্ত ছোট মাঝারি বড় প্রকাণ্ড নানান আকারের নানান প্রজাতির কুকুর আমার শরীরের আশেপাশে আমার ঘ্রাণ নিচ্ছে। সঙ্গে অবশ্য সেই আটটি কুকুরের ট্রেনারও এসেছেন ঘরে। তিনি বুঝেছেন যে, আমি একেবারেই কুকুর প্রিয় নই এবং যথেষ্ট ভয়ে রয়েছি।
—গো! গো দেয়ার!
বলা মাত্র বসবার ঘরের লাগোয়া গ্রিল দেওয়া একটা টুকরো বাগানমত অংশে মাথা নিচু করে সারমেয়দল চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ওই একবারই! আর অসুবিধে হয়নি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দুপুরে নানাবিধ বাঙালি পদে খাওয়া সারলাম। জানলাম কলকাতা থেকে প্রায় নিয়মিত নানান মাছের যোগান আসে। এরই মাঝে বাংলা থেকে তাঁর ফোন এল। কলকাতা-বম্বের চিত্রতারকাদের নিয়ে হোপ ‘৮৬-র ধাঁচে আরও একটি অনুষ্ঠানে তখন বাংলায় ব্যস্ত তিনি।

খাবার পর সেই বয়ঃজ্যেষ্ঠা আত্মীয়ার স্বামী পীযূষদা আর সেই বিশিষ্টজনের ঘনিষ্ঠবন্ধু বাদলদা আমায় নিয়ে বেড়াতে গেলেন কারজাত- এর ফার্মহাউসে। ফ্ল্যাটের বেসমেন্ট পার্কিংয়ে অনেক বিলাসবহুল গাড়ি আমরা মার্সিডিজের সওয়ারী হলাম। শুনলাম কিছুদিন আগে নিউ বম্বের (অধুনা নভি মুম্বই) ভাসি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। কারজাত যাবার রাস্তা অনেকটা কমে গিয়েছে।

তাহাদের কথা।

সম্ভবত ৪০ একরের ফার্মহাউস। সেখানে বাংলো তৈরি হচ্ছে। নানা ধরণের ফুলফলের গাছ বারুইপুর থেকে নার্সারির পারদর্শী কর্মীরা সেখানে। খোলা জিপে ঘুরতে হল পুরোটা দেখতে। এই ফার্মহাউস পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হবার পর বহু প্রতিবেদন নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।

তখন টেলিভিশনের জন্যে ধারাবাহিক ও টেলিফিল্মের চিত্রনাট্য লিখছি। খুব স্বাভাবিকভাবে চলচ্চিত্রের মক্কা মুম্বই ফিল্মসিটিতে শুটিং দেখার সুপ্ত বাসনা ছিল। সেদিন কারজাত থেকে ফেরার পথে সেকথা বলেছিলাম। দিনকয়েক বাদে অফিসে ফোন এলো। অফিসের শেষে খার পৌঁছলাম। খার থেকে বাদলদা-সহ আমি সেই বিশিষ্ট মানুষের ব্যক্তিগত সচিবের গাড়িতে ফিল্মসিটি। এখন গোরেগাঁও ফিল্মসিটিতে নামিদামি ছবির সেই অর্থে শুটিং হয় না। এখন লোকেশন শুটিং বেশি হয় অনেক শুটিং হয় বিদেশে। তখন ফ্লোরে ফ্লোরে ছবির শুটিং চলতো। সন্তর্পণে নিঃশব্দে নানান ছবির শুটিং-জোন বাঁচিয়ে পৌঁছলাম তাঁর মেকআপ রুমের বাইরে। অনেক গুণগ্রাহীর ভিড়। সচিব ভিতরে গেলেন আর একটু পরেই আমায় ভিতরে ডাকলেন। সেই প্রথম সামনে থেকে দেখলাম আসমুদ্র হিমাচলের যুব মানসের আইকন মিঠুন চক্রবর্তীকে। —চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content