শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


আরফান নিশো।

 

চিত্রনাট্য ও সংলাপ: আদনান হাবিব ও ইমতিয়াজ হোসেন

পরিচালনা: ইয়াসির আল হক

অভিনয়: আরফান নিশো, ইন্তেখাব দিনার, জাকিয়া বারি মম, ইমতিয়াজ বর্ষণ, শাহেদ আলি, নওশাবা আহমেদ, আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ, ইরফান রনি প্রমুখ

পর্ব সংখ্যা: ছয়

ভাষা: বাংলা

রেটিং: ৭.৫/১০

১৯৫৩ সালে বাংলায় যুগান্ত সৃষ্টিকারী কমেডির নাম ছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। আর ২০২৩-এ হইচই নিয়ে এল নতুন বাংলা থ্রিলার সিরিজ সেন্স মেকার্স প্রোডাকশন্সের সেন্সিবল প্রযোজনা ‘সাড়ে ষোলো’ (১৬.৫০)। ১৬ টপকে ১৭ অগাস্ট মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ ১৬.৫।

সেকালের সেই ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছিল তুলসী চক্রবর্তীর। উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন থাকা সত্ত্বেও সারা ছবি জুড়ে ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। এই সিরিজ জুড়ে রয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম অভিনেতা নায়ক আরফান নিশো। যার আসল নাম আহম্মেদ ফজলে রাব্বি। সম্প্রতি কলকাতায় মুক্তিপ্রাপ্ত সুড়ঙ্গ ছবিতে তিনি বিশেষভাবে নজর কাড়েন। ২০০৩-এ মডেলিং দিয়ে শুরু তারপর নিয়মিত টেলিভিশন নাটক ও সিরিজে অভিনয়, আর এবার ছবিতে। এই থ্রিলার সিরিজ ‘সাড়ে ষোলো’র মুখ্য অভিনেতা তিনিই।

এক তারকা হোটেলের সাড়ে ১৬ তলার রুমগুলোর নম্বর ১৬৫১, ১৬৫২, ১৬৫৩… এরকম। সমাজের বিশেষ স্তরের মানুষজনই সেখানে যান। অতিথিদের জন্য সাড়ে ১৬ তলায় নিশ্চিদ্র প্রাইভেসি। সেখানে রিভলবারের গুলিতে মৃত এক মহিলা। তার হত্যাকারী কে? সেই নিয়ে এই টানটান থ্রিলার। তবে পরিচালক ইয়াসির আল হক চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা আদনান হাবিব ও ইমতিয়াজ হোসেন এমন একটি টানটান থ্রিলারের পটভূমি তৈরি করেছেন যেটি একটি সিজনে শেষ হবার নয়।
প্রতিবেদন লিখতে বসে সেই সিরিজ, সিনেমা বা থিয়েটারের গল্প বলা আমি একেবারেই পছন্দ করি না। পরিচালক চিত্রনাট্যকার চিত্র সম্পাদক দিনের পর দিন পরিশ্রম করে রাতের পর রাত ভাবনায় ডুবে থেকে যে নিটোল গল্পকে দর্শকের সামনে পরতে পরতে মেলে ধরেন। তাকে চারটি লাইনে শেষ করে দিতে আমি রাজি নই। আমি লিখতে চাই কোনও সিনেমা সিরিজ বা থিয়েটারের দর্শক হিসেবে আমার কী ভালো লেগেছে আর কেন ভালো লেগেছে। সেই প্রতিবেদন যিনি বা যাঁরা পড়বেন তাঁদের যদি সেই ভালোলাগাগুলো আকর্ষণ করে তখন তারা নিজেরা দেখবেন এই সিরিজ এবং পর্বে পর্বে একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করবেন। শুধু আলোচনার স্বার্থে যতটুকু না বললে নয় গল্পের ঠিক ততটুকুই উন্মুক্ত করাই ভালো।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: ওয়েব সিরিজ ‘স্কুপ’, ওটিটি হল বিনোদনের আইপিএল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৫: কোন আলো লাগলো ‘পুত্রবধূ’-র চোখে

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

কলকাতার পথ-হেঁশেল: উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া—প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস

ঢাকা আমি কয়েকবার গিয়েছি। প্রতিবার ঢাকাকে বদলে যেতে দেখেছি। ‘১৬.৫০’-তে বড় সুন্দর লাগছে ঢাকাকে। সিরিজের গোটাটাই প্রায় হোটেলে বন্দি, কিন্তু একবারের জন্যও আপনার গতিহীন মনে হবে না। একেবারে রিলিফের মতো সকাল বা রাতের ঢাকা শহর এ সিরিজে দেখা দিয়েছে।

আজকের দিনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও টেকনোলজির সুবাদে ছবিতে নানান কায়দা কানুন দেখানো যায়। কিন্তু রান্নাঘরে মজুদ সমস্ত মসলাই যদি রান্নায় ঢেলে দেওয়া হয় তাহলে রান্নার যা হাল হয় ‘১৬.৫০’ দেখার ঠিক আগে আগে দেখা দুটো বাংলা থ্রিলার সিরিজ দেখে আমার ঠিক তেমনি মনে হয়েছে। সেই সিরিজ নিয়ে লিখছি না সঙ্গত কারণেই সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না।

যেটা বলার সেটা হল অকারণে অপ্রয়োজনীয় ড্রোন শট ব্যবহার করে ব্যাঁকা ট্যারা অ্যাঙ্গেলে কার চেসিং, ঝোড়ো, দুমদাড়াক্কা মারামারির দৃশ্য পায়ের ধাক্কায় স্টান্টমানের ঝাঁপাঝাঁপি উল্টেপাল্টে পড়ে যাওয়ায় উড়তে থাকা গ্র্যাফিক্সের ধুলো আর কথায় কথায় সাঁইসুঁই ছোরাছুরি চলা, ঠাঁইঠুঁইগুলি গোলা, রক্তারক্তি… এ সব আদপে কোনও থ্রিল দেয় না। বরং বিরক্ত মস্তিষ্ক রিমোট খোঁজে।
‘১৬.৫০’ দেখতে বসে রিমোট ছুঁতে ইচ্ছে করে না। অসাধারণ শুরু। কেউ একজন মোবাইলে ভিডিও করে রাখছে জুতোর কারখানায় কাজ করার ফাঁকে তার ঘনিষ্ঠ কারও হাতে মেহেন্দির কাজ বা তার হাত ধরার মনোরম মুহূর্তকে আচমকা ভয়ংকর শব্দ। মোবাইলের দৃশ্য উধাও আমরা দেখি একটি বহুতল ভেঙে পড়েছে। একটি বহুতল ভেঙে পড়া বহু মানুষের মৃত্যু, হতাহত শ্রমিকদের পরিবারকে দেওয়া ক্ষতিপূরণ নিয়ে মামলা আর এই সব কিছু নিয়ে জটিল কর্পোরেট পলিটিক্স। এই হল ‘১৬.৫০’-র মূল উপজীব্য।

আগামীকালই বহুদিন ধরে চলা এই মামলার শুনানি। আর সেই নিয়ে ঠিক আগের দিন ও রাতের টানটান ষড়যন্ত্র। কোনও একটি ঘটে যাওয়া ঘটনাকে বারবার নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা বা সেই ফেলে আসা সময়ের নানান টুকরোকে ময়নাতদন্ত করে পুরো ঘটনার জিগস-পাজল সমাধান করা হয়েছে সারা সিরিজ জুড়ে।

প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি প্রপসের প্রায় প্রতিটি সংলাপের এত সুনিপুণ ব্যবহার ইদানিংকালে আমি কোনও সিরিজ বা সিনেমায় দেখিনি। আর এখানেই পরিচালক চিত্রনাট্যকারকে কুর্নিশ জানাতে হয়। সিরিজের প্রত্যেকটি চরিত্র অত্যন্ত পরিমিত এবং যথাযথ অভিনয় করেছেন। যেমনভাবে পরিচালক তার দৃশ্যভাবনাকে ব্যবহার করেছেন। লোভ বা আকাঙ্খা মানুষকে সর্বনাশের কোন অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যেতে পারে সেটা জানতে গেলে দেখতে হবে ‘১৬.৫’।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৫: পঞ্চম মনস্থির করেন, যাই হয়ে যাক না কেন—এ বার তিনি আশাকে প্রেম নিবেদন করবেনই

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

দেখে এবং সব জানার পর চমকে উঠতে হবে। এই সিরিজের উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এদিলা ফারিদ তুরিনের নজরকাড়া কস্টিউম ডিজাইন। একটা সেরিব্রাল গল্প বলার সময় ক্যামেরায় অত্যন্ত সংযত কিন্তু তীক্ষ্ণ তুহিন তামিজুল। আনিস মাসুদের চিত্রসম্পাদনা তারিফ করার মতো। তিনু রশিদের আবহের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এই সিরিজের এক সম্পদ। আর যেটা সবথেকে উল্লেখযোগ্য তা হল আলি আফজাল উজ্জল-এর অসামান্য প্রোডাকশন ডিজাইন।

এই সিরিজে কিছু মিষ্টি রোমান্টিক মুহূর্তের কোলাজ রয়েছে। তার একটির উল্লেখ না করে পারছি না। ভালোলাগা-ভালোবাসা প্রকাশ করতে ছবিতে চরিত্ররা গোলাপের ব্যোকে নিয়ে দাঁড়ায়। বিদেশি ছবিতে নানান জানা-অজানা ফুলের তোড়া নিয়েও দাঁড়াতে দেখেছি। পাতা সমেত কদমের তোড়া নিয়ে দাঁড়াতে কখনও দেখিনি। ভালোলাগা ভালোবাসার এই আদ্যন্ত বাঙালিয়ানা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

এই সিরিজের আরেকটি অসাধারণ অনুষঙ্গ হল, প্রতি পর্বের শেষে যাঁদের নিয়ে এই মামলা হবে সেই শ্রমিকদের কঠিন জীবনের সাদাকালো ডকুমেন্টেশন। এটা একেবারেই অন্য রকমেরএকটা ভাবনা। ২৭ বা ২৮ মিনিটের রঙিন পর্বে গড়ে ওঠা ঝকঝকে ষড়যন্ত্রকে প্রতিবার পর্ব শেষের এই টুকরো সাদাকালো ক্লিপ যেন আরও স্পষ্ট আরও নগ্ন করে তোলে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

পরিযায়ী মন: বর্ণময় ইংল্যান্ড: লন্ডনের অন্যতম আকর্ষণ বাকিংহাম প্রাসাদের রক্ষী বদল অনুষ্ঠান

চারটি মূল চরিত্র যেখানে মেয়েটির মৃত্যুর দায় নিতে অস্বীকার করছে এবং প্রত্যেকেরই নিজস্ব আত্মপক্ষ সমর্থনের গল্প সামনে আসছে। ঠিক এই অংশটির সঙ্গে জাপানের বিশ্বখ্যাত পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া’র ইতিহাস সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র রশোমন-এর সঙ্গে হালকা একটা মিল পাওয়া যায়।

শুধু একটা খটকা দু’বার গুলি চলার শব্দ হল একবারও হোটেলে তরফে কেউ এলেন না কেন? হ্যাঁ, মানছি হোটেল ভেলভেট ইন-এর সাড়ে ১৬ তলায় নজিরবিহীন প্রাইভেসি। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, একজন সেই ফ্লোরেই ডিউটি করছেন। অনেক অনেক পরে ঠিক গল্পের মোচড়ে যখন প্রয়োজন তখন তিনি এসে বেল দিলেন কিছু লাগবে কিনা সেটা জানতে। তাঁকে গুলির শব্দ শুনেই একবার আগে আনা যেত নাকি?

তবে হ্যাঁ, আরফান নিশোর যে ভক্তরা তাঁদের সুপারস্টারকে এই সিরিজে খুঁজতে যাবেন তারা হয়তো একটু নিরাশ হবেন। কারণ, নিশো খুব সচেতনভাবেই এই সিরিজে প্রমাণ করেছেন যে তিনি সুপারস্টার নন এখানে সুপার সিনেমা অ্যাক্টর হতে চান।
ওটিটি ছাড়া নিয়মিত বাংলাদেশের ছবি বা ওয়েব সিরিজ দেখার সুযোগ ঘটে না। হয়তো অনেক ভালো ছবি তৈরি হয়েছে যা এখনও আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এর মধ্যে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকি নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ডুব-নো বেড অফ রোজেস’, ওয়েব সিরিজ ‘লেডিস এন্ড জেন্টলমেন’, মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ বা ইয়াসির আল হকের অনবদ্য ওয়েব সিরিজ ‘১৬.৫০’ দেখার পর এই মুহূর্তে তৈরি হওয়া বাংলাদেশের সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ নিয়ে আমার উৎসাহ অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। একজন বাঙালি হিসেবে আমি সবিশেষ আনন্দিত ও গর্বিত। সৃষ্টি বা কৃষ্টি কাঁটাতার দিয়ে ভাগ করা যায় না। সেই কবে ১৯৪৯-এ কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখে গিয়েছিলেন—
“ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।”
*বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content