বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


দুই মূল চরিত্র হোচি ও অনুশ্রী। ছবি: সংগৃহীত।

 

ভাষা: বাংলা

 

কাহিনি চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অর্কদীপ মল্লিকা নাথ

 

অভিনয়: অনসূয়া মজুমদার, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, ঊষসী রায়, ঋষভ বসু, অরুণিমা হালদার প্রমুখ

 

পর্ব: ৭টি

 

রেটিং: ৬.৭৫/১০

উচ্চশিক্ষায় বিগ ডেটার মতো ‘হরর কমেডি’ বা ‘ক্রাইম কমেডি’-এর আজকাল খুব কাটতি। হইচই-এর নতুন ওয়েব সিরিজ ‘কুমুদিনী ভবন’ জাতে ক্রাইম কমেডি। কিন্তু তালে মাতাল নয়। বরং বেশ সুস্থ স্বাভাবিক বুদ্ধিদীপ্ত। দর্শক মনোরঞ্জনের নামে কোনওরকম অকারণ এবং অসহ্য আঁতলামো বা পাগলামি করা হয়নি। বরং মজার সঙ্গে খুব যত্ন করে পর্ব থেকে পর্বান্তরে টানটান রহস্যকাহিনি বোনা হয়েছে। পরিচালক অর্কদীপ মল্লিকা নাথ পরিচালক হিসেবে এই সিরিজে আত্মপ্রকাশ করলেন। এর আগে দু’-দুটি ওয়েব সিরিজের রচয়িতা তিনি। ‘শুভারম্ভ’ এবং ‘টুরু লাভ’। ‘কুমুদিনী ভবন’ দেখার পর আগের দুটি ওয়েব সিরিজ দেখার আগ্রহ বোধ করছি।
বর্ষীয়ান অভিনেত্রী অনুসূয়া মজুমদারের অসাধারণ অভিনয় প্রতিভার পরিচয় আমরা বহু ছবিতে এবং টেলিভিশনে পেয়েছি। তিনি এই সিরিজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে এই সিরিজের প্রাণকেন্দ্র হলেন অম্বরীশ ভট্টাচার্য আর ঊষসী রায়। অম্বরীশে অম্বর আছে আর ঊষসীতে ঊষা বলেই-এই দু’ জনের সঙ্গে আকাশ কিংবা প্রাতঃকালের কোনও সম্পর্ক নেই।

অম্বরিষ শব্দের অর্থ পুরোনো অভিযানে লেখা আছে সূর্য। বিষ্ণু বা শিবও বলা হয়েছে। আর ঊষসী মানে দিবসের অন্ত। সায়ংকাল। সন্ধ্যা। বাংলা বানান লেখার আগে আজকাল অভিধানটা বারবার খুলে দেখতে হয়। কৃষি বিপ্লবের মতো এখন বাংলা বানানে বিপ্লব এসেছে তো।

জানি না অম্বরীশ নিজে কোন বাংলা বানান লেখেন, তবে বাংলার একটি বহুল প্রচলিত সংবাদপত্র “অম্বরীশ” লিখছেন। “অম্বরিশও” লিখছেন কেউ কেউ। তবে অম্বরিষ বানানের ব্যবহার আমার চোখে পড়েনি। হয়তো অর্থ মিলিয়ে কেউ ব্যবহার করেছেন। তবে সঠিক বানান লিখে ভুল প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে আমি আর সে বানান লিখছি না।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: ‘ঘুমর’ আসলে জীবনকে ফিরে পাওয়ার গল্প

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

বাংলা নাটকে সে প্রায় ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকেই তাঁর সংগ্রাম চলছে। নয় নয় করে তেইশটা বছর কেটে গেল। এতদিন বাদে তাঁর মতো করে চরিত্র তৈরি করার কথা ভাবছেন লেখক পরিচালকেরা। টেলিভিশনের পর্দায় ২০০৭ এ রাজা-গজা সিরিয়ালে গজা হিসেবে যতটা খ্যাতি পেয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী অম্বরীশের কেরিয়ার কিন্তু দ্রুতগতিতে এগোয়নি। তার একটা মূল কারণ সম্ভবত অম্বরীশ কোনওদিনই শরীর আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে চোখমুখ পেঁচিয়ে গলায় বলায় অকারণ বদল এনে কাতুকুতু ভাঁড়ামো করেননি। সচেতনভাবেই করতে চাননি।

অম্বরীশ সর্বদাই একজন মজার মানুষের ‘চরিত্রে’ সফলভাবে অভিনয় করেছেন। তাই খড়কুটোর ‘পটকা’ চরিত্রের মতই অম্বরীশ খুব সহজে কমেডি থেকে সিরিয়াস নোটে যেতে পারেন। আবার অক্লেশে ফিরে আসতে পারেন। যে অস্ত্র অতীতে তরুণকুমার বা অনুপকুমার সফলভাবে ব্যবহার করতেন। পূর্বসূরীদের মতোই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে গিয়ে বহু সিরিয়াল বা সিনেমাতে গতানুগতিক চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। ছোটবড় নানান চরিত্রে ত্রিশটা ছবি এবং ১৫টি সিরিয়াল করা হয়ে গিয়েছে। আমি যেগুলি দেখেছি তার মধ্যে আগেই উল্লেখ করা গজা, পটকা বা গোয়েন্দা গিন্নির হাবলু, মহানায়ক টিভি (সিরিজে) তরুণকুমার বা বুড়োর চরিত্রে অম্বরীশ অনবদ্য।

সিরিজের অন্যতম চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত।

দিকে দিকে ধ্বজা উড়িয়ে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর অভিনেতা হওয়ার কোনও দায় বা তড়বড় করা তাগিদ নেই অম্বরীশ ভটাচার্যের। স্লো বাট স্টেডি উইন্স দ্য রেস—এর চিরসত্য বজায় রেখেই আগের মতো হালে রিলিজ হওয়া ছবি ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য’তে অজিত আর কুমুদিনী ভবনের হোচি সরকার অম্বরীশের অভিনয় জীবনের পেজ মার্ক দেওয়া চরিত্র হয়ে থাকবে।

২০১৫ সালে মিলন তিথি সিরিয়ালের অহনা বা ২০১৭ সালের বকুলকথার বকুল চরিত্রের জনপ্রিয়তায় ঊষসী রায় বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাদম্বিনী সিরিয়ালে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং যে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন তা হল বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক চরিত্র। শুধু নির্মাতা বা কলাকুশলীদের নয় আমাদের মতো দর্শকদের দুর্ভাগ্য যে এই গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়ালটি অধিকাংশ দর্শককে টিআরপি নামক নেশায় আচ্ছন্ন করতে পারেনি এবং মাত্র তিন মাসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

তবে এই সব চরিত্রে ঊষসীর কমেডি অভিনয়ের দারুন ক্ষমতার পরিচয় পাইনি। হইচইয়ের গোরা-২ ওয়েব সিরিজে কমেডি করেছেন। সেই চরিত্রে কমেডি অভিনয়ের এক্সটেনশনটাই কুমুদিনী ভবনে অনুশ্রীতে মিশিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অনুশ্রীর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে রহস্যভেদের অদম্য ইচ্ছে। অনুশ্রী আবার হাতের লেখা দেখে মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারে।

১৬ শতক থেকে ১৮ শতকে গ্রাফোলজিকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও ১৯ শতকে এসে এই হাতের লেখা দেখে চরিত্র বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বলা হয়েছে। তাই অনুশ্রী বারবার বলে এটা একদম ঠিক ঠিক নয়, কিছুটা আন্দাজ করা যায়। হোচি সরকারের মতো পুলিশ অফিসার এই বাংলার কোন থানায় আছেন ঠিক জানি না। তবে এমন মানুষ থাকলে বড্ড ভালো হয়। ঊষসীর গতি কমিয়ে কথা বলার ধরন এবং দুর্দান্ত কমেডি টাইমিং-এর সঙ্গে অম্বরীশের নিশ্চিন্ত আয়েশ করে গড়ে তোলা হোচি সরকার গোটা সিরিজকে অন্যরকম মজা দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

এক লেডিস হোস্টেলে একের পর এক খুন আর পর্বে পর্বে সূত্র ধরে তার সমাধানের দিকে এগোনো। দুটো বিষয়ে কাহিনি চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালককে একসঙ্গে ধন্যবাদ দিতে হয়। এক নম্বর লেডিজ হোস্টেলের গল্প। যথেষ্ঠ এবং স্বাভাবিক প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও অর্কদীপ একবারের জন্যেও কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্কের পাতা ওল্টানোর চেষ্টা করেননি। দ্বিতীয়ত অকারণ বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ না করে সিরিজ সর্বদাই কাহিনির ফোকাসের দিকে একমুখী থেকেছে।

এখানে বলা প্রয়োজন কুমুদিনী ভবনের উঠোনের দেয়ালে প্রজেকশন করে টাইটেল দেখানোর প্রচেষ্টা খুব সুন্দর। মৃন্ময় সান্যাল-এর আবহ, শুভদীপ দে’র ক্যামেরা এবং প্রণয় দাশগুপ্তের সম্পাদনা ‘কুমুদিনী ভবন’কে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সেই সঙ্গে রহস্যকাহিনীর প্রাথমিক শর্ত মেনে প্রায় নিখুঁতভাবেই দর্শকদের অনেক সন্দেহভাজনের ধন্দে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

বিশেষ দৃশ্যে ঋষভ বসু। ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম চার পর্ব ভীষণ টানটান। পঞ্চম পর্বে এসে ডাক্তারবাবুর মুখে অতীত কাহিনির ফ্ল্যাশব্যাক বড় সাদামাটা। রাস্তার মধ্যে তর্ক করতে করতে গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু এসব যেন ওয়ার্নিং বেল পড়ার পর তাড়াহুড়ো করে লেখা রচনার মত মনে হয়েছে। পঞ্চম পর্বের শেষ থেকে ষষ্ঠ এবং সপ্তম পর্বে আবার এই সিরিজ তার স্বাভাবিক গতি ছন্দ ফিরে পায়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

দূর্বা, জাহ্নবী হোস্টেলের বাকি মেয়েরা যে যার চরিত্রে খুব সুন্দর অভিনয় করেছেন। ঋষভ বসু যথাযথ। সবচেয়ে আনন্দের কথা কমেডি সিরিজের ধারার উল্টো রাস্তায় হেঁটে ভাগ্যিস কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল এবং ইন্সপেক্টররা কেউ মনোরঞ্জনের সস্তা ভাঁড়ামোর রাস্তা নেননি।
অপেক্ষায় আছি কবে কোন সাহসী পরিচালক অম্বরীশকে কোন জটিল মানবিক চরিত্রের জন্য বেছে নেন। আর ঊষসীর জন্যে স্বাভাবিকভাবেই আরও কমেডির চরিত্র আসবে, সে ক্ষেত্রে অভিনেত্রীকে নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content