বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


পঞ্চায়েত ছবির একটি দৃশ্য।

 

সিজন: ১,২ ও ৩

ভাষা: হিন্দি
কাহিনি চিত্রনাট্য: চন্দন রায়
পরিচালনা: দীপক মিশ্র
অভিনয়: জিতেন্দ্র কুমার, রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তা, সানভিকা, চন্দন রায়, দুর্গেশ কুমার, অশোক পাঠক, ফয়সাল মালিক, সুনীতা রাজোয়ার প্রমুখ
ওটিটি রিলিজ: আমাজন প্রাইম
সিজন প্রতি পর্ব: ৮
রেটিং: ৭.০/১০

ক্রিকেটে ‘ল অফ অ্যাভারেজ’ শব্দটা খুব ব্যবহার হয়—দুটো ইনিংস ভালো গেলে একটা ইনিংস একটু খাটো যেতে পারে। আজকাল ওটিটিতে আসা ওয়েবসিরিজেও সেই শব্দবন্ধের ছোঁয়া লেগেছে। এটা বলা হয় একজন চিত্রপরিচালকের প্রথম ছবি, একজন গায়কের প্রথম রেকর্ড বা হালের সিডির আবেগ বা উদ্যম পরে সেভাবে দেখা যায় না। এটা একেবারে স্বতঃসিদ্ধ কোনও তথ্য প্রমাণ নয় তবে অনেকাংশে সত্যি। পরে শিল্পী বা কলাকুশলীর নামডাক হয় অভিজ্ঞতা বাড়ে কিন্তু প্রথম সৃষ্টির সেই উন্মাদনা বা সেই সারল্য কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা বা সাফল্যের আড়ালে চলে যায়। সত্যজিতের পথের পাঁচালী বা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তোমাকে চাই’, নচিকেতার ‘এই বেশ ভাল আছি’—একথা প্রমাণ করে।
লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের মতো পঞ্চায়েত বা মহারানি দেখে ওটিটির দর্শক প্রাথমিক মুগ্ধতায় ভরে ওঠেছিলেন। ‘সিজন -১’ এর সাফল্যের পর স্বাভাবিকভাবে ‘সিজন-২’ এ নির্মাতাদের দায় নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার আরও জনপ্রিয়তা পাবার ফলে ‘সিজন ২’ আরও চমকিত করে বা এক্ষেত্রে করেছে।

কিন্তু এরপর সে সোনার হাঁসের পেট কেটে ডিম বের করা বা ডিম জমিয়ে রাখার খেলা। ব্যবসা জমে গিয়েছে সুতরাং ‘সিজন ৩’ তো হবেই আরও পরপর সিজনের সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে মহারানি বা পঞ্চায়েত ব্র্যান্ড বেচে। ফলে রং জৌলুস ফিকে হয়ে গেলো গল্পের গরুকে ঘাড় ধরে ঘোড়া বানানোর চেষ্টা হল। ‘পঞ্চায়েত সিজন ৩’-এ যেন এমনটাই মনে হচ্ছে। সেই একই অভিনেতা-অভিনেত্রী যাদের অনবদ্য অভিনয়ে ‘সিজন ১’ এবং ‘সিজন ২’ মানুষের মনে ছাপ রেখে গিয়েছে। লিখেছেন সেই একই লোক পরিচালনাও একই মানুষের। তবুও কেমন যেন জমল না।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: ‘ক্রু’ মজাদার কমেডির মোড়কে ক্রাইমের চকোলেট

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

বাড়িতে শুনেছি দুধ বেশি গরম হয়ে গেলে কিম্বা দই পাতার পুরনো দইয়ের অংশ কমবেশি হলে বা না মিশলে বাড়িতে পাতা দইটা ঠিকঠাক জমে না। সেই একই বাটি, একই দইয়ের অংশ, একই দুধ। একইভাবে গরম করা একইভাবে মেশানো কিন্তু শেষমেষ কাঙ্খিত জায়গাটায় পৌঁছনো যায় না।

আজকাল একটা কথা খুব শোনা যায় ‘কনটেন্ট ইজ দ্য কিং’! এতাবৎকাল কনটেন্ট রাইটার বা রচয়িতাদের খুব একটা পাত্তা দেওয়া হতো না। হালে তাঁদের ভাগ্য ফিরেছে। লোকে আপনি আঁজ্ঞে করে কথা বলছে—মিডিয়ার লোকজন যাদের দিকে কোনদিন ক্যামেরার লেন্স ঘোরানো বা বুম এগিয়ে দেবার কথা ভাবেননি, তাঁরাও এঁদের কথা বলছেন-টলছেন। এমনকি তাঁদের নাম ছবি বা সিরিজের ক্রেডিট টাইটেলে উপযুক্ত মর্যাদায় দেওয়া হচ্ছে। অর্থকরীভাবে এতদিন শোষিত-উপেক্ষিত লেখককুল এখন পুরোপুরি না হলেও প্রাপ্যের কিছুটা পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

এতদিন বাবার অপারেশন স্ত্রীর অসুখ মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসার প্রমাণ ছাড়া চোখে মোটা লেন্স কাঁধে ব্যাগ ময়লা জামা কাশতে থাকা ক্ষয়িষ্ণু লেখক পারিশ্রমিকই পেতেন না। কারণ লিখতে না সময় লাগে না বুদ্ধি না পরিশ্রম। লিখতে ক্যামেরা লাগে না, লাইট লাগে না, মেকআপ লাগে না। ১২/১৪ ঘণ্টার শিফটে রক্ত-ঘাম জল করা খাটনি নেই। আলোর সামনে সংলাপ বলা অভিব্যক্তি ফোটানোর অসামান্য কৃতিত্ব নেই সর্বোপরি এই পুরো ব্যাপারটা ফ্রেমবন্দি করার কৃতিত্বের একফোঁটাও নেই! তবু যা হোক মা সরস্বতীর কৃপায় শ্লেট পেন্সিলে ওই অপ্রয়োজনীয় অ-আ-ক-খ লেখাটুকু ছাড়া জগৎ অন্ধকার। লেখার আগে পর্যন্ত ভাবনা-চিন্তা-কল্পনা সবই বায়বীয়। সেই হাওয়া থেকে প্রাথমিক ভিত্তি বা আকার গড়ার কারিগর একজন লেখক। তাঁর গড়া আকার দেখার পর নানারকম চোখে-আঙ্গুল দাদা/দিদিরা কপালে চশমা তুলে পেটটা মাথায় কানটা পায়ে চোখদুটোকে হাঁটুতে লাগাবার নানান ফন্দিফিকির বাতলান। কিন্তু হাওয়ায় পাঁচিল গাঁথা বড্ড কঠিন কাজ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

তাই পঞ্চায়েতের লেখক চন্দন রায় যদি ‘সিজন-৩’ এ হাত খুলে না খেলে স্লগ ওভারে খেলার কথা ভাবেন। যদি চার এবং পাঁচ নং সিজনের জন্যে গপ্পো সঞ্চিত রাখেন তাতে খুব একটা দোষের কিছু করেননি। পঞ্চায়েত নামটা যে আজ এত পরিচিত তাঁর সিংহভাগ কৃতিত্ব টিম পঞ্চায়েতের সঙ্গে আলাদা করে লেখকের। কিন্তু প্রথম দুই সিজনে অভিনয় না করলে চন্দন রায়কে আমরা জানতেই পারতাম না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেমন সৃষ্টি নিয়ে নানান আলোচনা হয়, কিন্তু স্রষ্টাকে প্রয়োজন না হলে প্রায় আড়ালেই রাখা হয়। তাই চন্দন নিজের হাতে রাশ আগলে রেখে যথার্থ কাজ করেছেন।

উত্তরপ্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম ফুলেরা তাকে ঘিরেই অতি সাধারণ ভাবে বলা এক অসাধারণ কাহিনী হল ‘পঞ্চায়েত সিজন ১’ এবং ‘সিজন ২’। শহরে পড়াশোনা করা এক যুবক অভিষেক ত্রিপাঠির (জিতেন্দ্র কুমার) চোখে দেখা ভারতের এক গ্রাম। সারল্য ছিল এই সিরিজের মূলচালিকা শক্তি। আর অক্লেশে এইসব গ্রাম্য সহজ চরিত্রে প্রবেশ করেছিলেন রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তা, সানভিকা, চন্দন রায়, দুর্গেশ কুমার, অশোক পাঠক ফয়সাল মালিক ও সুনীতা রাজোয়ার প্রমুখ
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

সিরিজ পরিচালক দীপক কুমার মিশ্রের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি এই সিরিজের লোকেশন দৃশ্যায়ণ চরিত্রদের অভিনয়, সম্পাদনা, চিত্রগ্রহণ এমনকি, আবহও সৃষ্টিতেও এক অসাধারণ সারল্য বজায় রেখেছেন। যা ক্রমাগত খুনোখুনি রক্তারক্তি অকথ্য গালিগালাজ এবং উত্তেজক দৃশ্য সম্বলিত শহর ও গ্রামের পটভূমিকায় তৈরি করা একঘেয়ে সিরিজের থেকে এক লহমায় মানুষকে আকর্ষণ করে নিয়েছিল।

কিন্তু মহারানি সিরিজের মতোই’পঞ্চায়েতের সিজন ৩’ কিছুটা হলেও আমাদের হতাশ করে। প্রথম দুই সিজনে সহজাত নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘সিজন ৩’-এ জোর করে নাটকীয়তাকে গল্পের মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা হয়েছে। যার ফলে পঞ্চায়েতের নিজস্ব ঘরানা থেকে সেই সব উপকাহিনি আলাদা মনে হয়েছে। ভাড়াটে গুণ্ডা, গুলিগোলা সবকিছু এসেছে এই নতুন সিজনে। গ্রামের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের উপরে শহুরে মেকআপ চাপালে যেমন হয় ঠিক তাই হয়েছে। তবু না দেখা হলে সিজন ১, ২, ৩ এললপ্তে দেখে নিন। পঞ্চায়েতের কলাকুশলীরা অবশ্য সামাজিক মাধ্যমে এবারে অনেক বেশি সক্রিয়।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content