ছবির (টুয়েলভ্থ ফেল) গল্প শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। গল্পের কথক মনোজ কুমার শর্মার বন্ধু প্রীতম পান্ডে (অনন্ত যোশী)। মধ্যপ্রদেশের চম্বলের দেহাতি ছেলে মনোজ কুমার শর্মা (বিক্রান্ত মাসে) তাঁর অদম্য জেদকে সহায় করে যখন দিল্লির মুখার্জি নগরে পড়তে আসে তখন সে ইউপিএসসি (UPSC) পরীক্ষার ‘ইউ’ পর্যন্ত জানতো না। ঘটনাক্রমে মনোজের মাথায় সবসময় ছিল তাঁদেরই গ্রামে একসময় পোস্টেড ডিএসপি দুষ্যন্ত সিংয়ের (প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়) তাঁকে বলা সাবধান বাণী, ‘চিটিং ছোড়নী পড়েগী’ অর্থাৎ পরীক্ষার খাতায় অন্যের নকল করে লেখা ছাড়তে হবে। এই এক কথার জেরে মনোজ প্রথমবার ১২ ক্লাসে ফেল আর পরের বার কোনও মতে থার্ড ডিভিশন পেয়ে পাশ করে। বুঝতে শুরু করে পড়াশোনার গুরুত্ব। ক্রমশ ইতিহাসের স্নাতক মনোজের পেছনে পড়ে থাকে তাঁদের গ্রাম, ভিটেমাটি, মা-ঠাকুমা, ভাই-বোনেরা কারণ মনোজ জানতো তাঁদের এই হতদরিদ্র অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটবে এবং পরিপার্শ্ব বদলাবে শুধুমাত্র সে জীবনে কিছু করতে পারলে।
তাঁর সত্যকামী, সরকারি চাকরি করা বাবা আগেই দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সব ছেড়ে হাইকোর্ট অভিমুখী হয়, মনোজও গোয়ালিয়রে এসে সদ্য পরিচিত ও ক্রমে বন্ধু হওয়া প্রীতম পান্ডেকে পাকড়াও করে প্রতিযোগিতার সমুদ্র দিল্লির মুখার্জি নগরে এসে পড়ে। কিছুদিন থাকার পর এবং নানা ধাক্কা খেতে খেতে সে বুঝে যায় ইউপিএসসির মতো পৃথিবীর অন্যতম কঠিন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা আর পড়াশোনার কোনও বিকল্প হয় না। পরীক্ষার প্রস্তুতি ও বাড়িতে টাকা পাঠাতে কখনও লাইব্রেরির মেঝেতে, কখনও খুব ছোট আটা পেশাইয়ের কলের পাশে বাল্ব জ্বেলে, কখনও রাস্তার আলোয়, কখনও হিতাকাঙ্খীর (গৌরী ভাইয়া) দয়ায় ঠিকঠাক একটা ঘর পেয়ে মনোজের অন্তহীন লড়াই চলতে থাকে। চলতে থাকে প্রিলিমসে পাশ করে দিনের পর দিন মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে শুধুমাত্র ইউপিএসসি মেন্স ক্লিয়ার করার লড়াই কারণ অগণিত হারিয়ে যাওয়া মুখ, মেঠো মুখ, দেহাতি মুখ, এগিয়ে আসতে না পারা মুখ তখন শুধুই তাঁর দিকে তাকিয়ে।
আরও পড়ুন:
সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’
সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা মানুষের কাছ থেকে হঠাৎ পাওয়া ভালবাসায় এমনিতেই ভয়, উৎকণ্ঠা থাকে, তার উপর যদি এমন কঠিন পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বে হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। সম্পর্ক ভাঙলে ভালোবাসাও মূল্যহীন হয়। এক্ষেত্রে সেসব হয়নি কারণ শ্রদ্ধা জোশী (মেধা শঙ্কর) ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। যে মেয়ে নিজে মেডিকেলের ছাত্রী হয়ে পণের দায়ে দগ্ধ, মৃত মহিলাকে দেখে পেশা পরিবর্তনের সংকল্প নেয় এবং ক্রমশ আইআরএস (IRS) হয় সে মনোজের মূল ইন্টারভিউয়ের দিনেই জানিয়ে দেয় “আইপিএস হও কিংবা আটা ভাঙো, আমার ভালোবাসা তোমার জন্য সব সময় একই থাকবে”। এই মেয়ের বিশ্বাস মনোজকে আরও প্রত্যয়ী করে তোলে। তারপর শুধুই ‘হার নহি মানুঙ্গা, রার নহি ঠানুঙ্গা’
বিক্রান্ত মাসে, বিকাশ দিব্যকীর্তি এবং বিধু বিনোদ চোপড়া।
পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া হিন্দি ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে ৪৮ বছর পার করেছেন। তাঁর পরিচালিত সাসপেন্স থ্রিলার ‘খামোশ’ (১৯৮৫) হোক, মুম্বইয়ের অন্ধগলির গল্প ‘পরিন্দা’ (১৯৮৯) হোক কিংবা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ভিটেমাটি ছাড়ার গল্প ‘শিকারা’ (২০২০) হোক, তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবি টুয়েলভ্থ ফেল (12th Fail) সবকিছুর বিপরীতে যায় কারণ এই ছবি অগণিত অন্ধকারে থাকা ভারতবাসীর আলোয় আসার গল্প বলতে পেরেছে। কারও মনের অন্ধকার, কারও সমাজ-সংসারের অন্ধকার, কারও অনেক অপমানের অন্ধকার তো কারও দুবেলা ঠিক করে খেতে না পাওয়ার অন্ধকার। ৮০ শতাংশ ভারতীয়ের গল্পই এই অন্ধকার থেকে আলোয় আসার গল্প, না থামার গল্প। সেখানে শুধুই রিস্টার্ট আর রিস্টার্ট।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর
প্রথম থেকেই এই ছবির দুর্দান্ত রিভিউ, মন ছুঁয়ে যাওয়া কথোপকথন, সেট না বানিয়ে মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, আগ্রা, মুসৌরিতে শুটিং, নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শুটিং এবং অভিনেতা বিক্রম মাসে, অনন্ত জোশী, প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়, অংশুমান পুষ্কর, মেধা শঙ্কর, গীতা আগরওয়াল, হরিশ খান্না প্রমুখের অসাধারণ অভিনয় এই ছবিকে ২০২৩ সালের অন্যতম সেরা ছবিতে পরিণত করেছে। অভিনেতারা সকলে চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ছবির গল্প অনুরাগ পাঠকের অন্যতম সেরা বিক্রিত বই ‘টুয়েল্ভ ফেল: হারা বহি জো লড়া নহী’, যেখানে আইপিএস অফিসার মনোজ কুমার শর্মা এবং আইআরএস অফিসার শ্রদ্ধা যোশীর বাস্তব জীবন থেকে উঠে এসেছে। দুজন ভিন্ন মেরুর এবং ভিন্ন সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা মানুষের গল্প বলায় যোগ্য সঙ্গত করেছেন সুরকার শান্তনু মৈত্র তাঁর আরোপিত অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৫: বলবয় থেকে বিশ্বসেরা
এই ছবির অভিনেতা, অভিনেত্রীরা শুটিংয়ের সময় বয়স ও প্রয়োজন অনুযায়ী ওজন বাড়িয়েছেন, কমিয়েছেন। চম্বলে মনোজের যে গ্রামের বাড়ি দেখানো হয়েছে সেই বাড়ির রাস্তাও শুটিং শুরুর সাতদিন আগে থেকে অভিনেতারা নিজেরাই তৈরি করেছিলেন ফলে রোদে পোড়া, মেঠো চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওঁরা অভিনেতা অভিনেত্রী। ছবিটি নিয়ে আরও নানান গল্প এখন উঠে আসছে। অক্টোবর মাসের শেষে এই ছবি হলে মুক্তি পাওয়ার পর ‘স্লিপার হিট’ হয়।
বিক্রান্ত মাসে, মনোজ কুমার শর্মা, বিধু বিনোদ চোপড়া, শ্রদ্ধা যোশী এবং মেধা শঙ্কর।
সমালোচকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা একে সবার নজরে আনে আর এখন এই ছবি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ডিজনি হটস্টারে সবচেয়ে সার্চড ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম। এ বছর অস্কারে ‘স্বাধীন এন্ট্রি’ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে এই ছবিকে তবে মানুষের মনের অস্কার এই ছবি এতদিনে পেয়ে গিয়েছে।
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত চৌদ্দ বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।