মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


 

সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: ক্রাইম থ্রিলার (২০২২)
ভাষা: মালয়ালম ও হিন্দি
প্রযোজনা: স্বর্গচিত্র আপ্পাচান
রচনা: এসএন স্বামী
নির্দেশনা: কে মধু
অভিনয়ে: মামুটি মুকেশ, শ্রীকুমার, সাই কুমার প্রমুখ
সময়সীমা: ১৬৪ মিনিট
রেটিং: ৫/১০
ওটিটি: নেটফ্লিক্স

‘সিবিআই 5: দ্য ব্রেন’ মালায়লাম ভাষার ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এক রহস্য থ্রিলার। এসএন স্বামীর লেখা এবং কে মধুপরিচালিত এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র সিবিআই অফিসার সেতুরামা আইয়ারের ভূমিকা রয়েছেন মালয়ালাম ছবির অবিসংবাদিত সুপারস্টার মামুটি।

এ ছবির মূল গল্পে পৌঁছনোর আগে আরও একটি গল্প বলা হয়েছে। আইপিএস ট্রেনিংয়ে একজন সিবিআই অফিসার তার কর্মজীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে এক দুঁদে সিবিআই অফিসারের স্মরণীয় কেসস্টাডি উল্লেখ করেন। সেখান থেকে আমরা ছবির মূলগল্পে যাই। প্রাথমিকভাবে ছবির শুরু দেখে মনে হতে পারে এ ছবি একজন সফল সিবিআই অফিসার হবার পথ এবং পদ্ধতি স্পর্শ করবে, কিন্তু তা ঘটেনি।

দিল্লি থেকে কেরল ফেরার পথে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। কিন্তু কোনও অস্বাভাবিকতার প্রমাণ না থাকায় অনেকেই তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মনে করেছিলেন। ক্রমশ দেখা যায় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বেশ কয়েকজনের পরপর অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু ঘটছে। এই গল্পে রাজ্য পুলিশ বনাম কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই-এর তদন্তে অংশগ্রহণ করার পরিচিত টানাপড়েন রয়েছে। পরপর এই অস্বাভাবিক মৃত্যু বা পরিকল্পিত খুনের পুলিশি নামকরণ করা হয় বাস্কেট কিলিং।
রহস্য কাহিনির শর্ত মেনে নানান চরিত্র এবং তাদের উপকাহিনি মূলগল্পের সঙ্গে সঙ্গে উপসংহারের দিকে এগিয়েছে। সন্দেহের তীর যত একদিক থেকে অন্যদিকে, এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে ঘোরাফেরা করেছে ততই দর্শকের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিশেষে খুনের যে পদ্ধতিগ্রহণ করা হয়েছিল সেটির কোন ক্লু থাকা বড়ই শক্ত, যার জন্য সিবিআইয়ের দুঁদে অফিসারদেরও বাস্কেট কিলিংয়ের হত্যা রহস্য সমাধান করতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে।

কোনও সংগঠিত গোদা অপরাধের ক্ষেত্রেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিয়ম মেনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তথ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করা গেলে প্রকৃত অপরাধী বা অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং আমাদের দেশের আইনানুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। তাই ঘৃণ্যতম অপরাধীও অপরাধ প্রমাণ না হওয়ার ছুতোয় খোশমেজাজে সরকারী অন্ন ধ্বংস করে প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস হয়ে যান এবং পরবর্তীকালে কেউ কেউ হয়ত আরও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অপরাধ সংগঠন করায় মনোনিবেশ করেন।

অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নন! হক কথা! অপরাধ প্রমাণ না হলে তিনি নিস্কলুষ! সঙ্গে সেই সাংঘাতিক আপ্তবাক্য, অপরাধী ছাড়া পাক কিন্তু কোনওভাবেই যেন নিরাপরাধের শাস্তি না হয়। আর তার সঙ্গে আমাদের দয়ালু দেশে কোনওভাবেই অপরাধীর মানবাধিকার লঙ্ঘণ করা যাবে না, সেও যেন বিচারসভায় তার পক্ষ এবং যুক্তি প্রমাণ করার যথেষ্ঠ সুযোগ পায়। কাসভ মানুষ খুন করার আগে মানবিকতা দেখিয়েছিল কি? না দেখাক। কিন্তু আমরা ভাই ন্যায় সত্যের দেশ একবছর ধরে বিরিয়ানি খাইয়ে হাজার হাজার পাতার নথি তৈরি করেছি, লক্ষ লক্ষ সরকারী অর্থ খরচ করেছি এবং এখনও মাঝেমধ্যে আলাপ আলোচনায় সচেতন আত্মসমালোচনায় প্রশ্ন ওঠে ফাঁসির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা?
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

আর এই ছিদ্র দিয়েই আইনব্যবস্থার লৌহবাসরে অনবরত কালনাগিনী ঢুকছে এবং সামাজিক ন্যায়ের শরীরে ক্রমাগত বিষাক্ত দংশন করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। প্রবাদ ছিল বাঘের ছুঁলে ১৮ ঘা আর পুলিশের ছুঁলে…। কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যখন তদন্ত করেন তাঁরা সম্ভবত জবানবন্দি আদায়ের ক্ষেত্রে আইনগত বাধায় পুলিশের পরিচিত পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। জবানবন্দি আদায়ের ক্ষেত্রে থার্ড ডিগ্রির ব্যবহার খাতা-কলমে বিলোপ হলেও পুলিশের আস্তিনের মধ্যে এখনও তা থেকে গিয়েছে।

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ক্ষেত্রে বোধহয় সেটা প্রশ্নোত্তর পর্যায়েই রয়ে গিয়েছে। অভিযুক্ত যদি নার্ভ শক্ত রেখে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান বা তদন্তকে ভুল পথে পরিচালনা করতে সক্ষম হন তাহলে সোনায় সোহাগা। এই যে আজকাল পলিগ্রাফ টেস্ট বা নারকো টেস্ট নিয়ে এত কথা হচ্ছে, এগুলো কি আমাদের দেশে আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ? নারকো টেস্টের ক্ষেত্রে আবার যার নারকো টেস্ট করা হবে তার অনুমতি নিতে হবে। মানে অভিযুক্ত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেই বলবেন হ্যাঁ, আমার নারকো টেস্ট করুন আমি সব দোষ স্বীকার করব। আমরা প্রায়ই খবরে দেখি বা শুনি অমুক অভিযুক্ত অসহযোগিতা করছেন। আচ্ছা তার সহযোগিতা করার, সব দোষ আলোচনার টেবিলে চা-সিঙ্গাড়া সহযোগে স্বীকার করে নিয়ে হাজতবাস করার কোনও দায় পড়েছে কি?
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

মুভি রিভিউ: ‘বাবলি’ স্বর্ণযুগের বাংলা ছবির মতো রোম্যান্সে ভরপুর

আসলে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শিক্ষিত সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো বেশ কঠিন কাজ। এটাও ঠিক যে, সম্মিলিত প্রতিবাদ ছাড়া সেই মানুষের হাতে আর কোনও ক্ষমতা নেই। কিন্তু অতীতে যেভাবে খুব সহজেই সকলকে মিথ্যে বোঝানো যেত এখন সেটা যায় না। কুচক্রী রাজনীতিবিদ, লোভী ডাক্তার, ঘুষখোর ইঞ্জিনিয়ার, মুনাফাবাজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ধূর্ত ব্যবসায়ী অসৎ দোকানদার অফিসের বজ্জাত বস ঠগ টেলিফোন কোম্পানি জোচ্চোর বিমা সংস্থা বাটপাড় ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি বা পাড়ার ন’পয়সার মদ গাঁজা খাওয়া মস্তান — কেউই খুব সহজে আগের মতো চমকাতে ধমকাতে পারেন না।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

তবু আজও সব জেনে বুঝেও সাধারণ মানুষকে মুখবুজে সব অন্যায় সহ্য করতে হয়, খুব কমক্ষেত্রেই নিজেদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের কঠিন বৃত্ত থেকে ছিটকে এসে সততার সঙ্গে হয়ত প্রতিবাদী হয়ে ওঠা যায়।কিন্তু প্রতিবাদের গাছে সময়ে ফল আসে না, কালের নিয়মেই সময়ের পলি পড়ে পড়ে প্রতিবাদের নাব্যতা কমে আসে। শেষমেশ সম্মিলিত মানুষেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। প্রতিবাদের মৃত্যু ঘটে।কিন্তু এটা জেনেও যখন জনজাগরণ ঘটে তখন অপরাধীদের জন্য সেটা আতঙ্কের।আমদের যে সামাজিক ন্যায়ের জন্যে বারবার বিক্ষিপ্ত বা সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নিরুপায় হয়েই প্রতিবাদী হতে হয় তার আরেক কারণ আমাদের মতো উন্নতিকামী দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার ও সম্মান উন্নতিশীল দেশে প্রাপ্য অধিকার ও সম্মানের তুলনায় অনেকটাই কম। হয়ত আর্থিক দৈন্যতা এর একটা বড় কারণ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

অপরাধ সারা পৃথিবীতেই ঘটে কারণ অপরাধমনস্কতা মানবমস্তিষ্কের অন্যতম উপাদান। কিন্তু সে দেশে সেই অপরাধের দায়ে সাধারণ মানুষকে আমাদের মতো জর্জরিত হতে হয় না। কম সংখ্যার কারণেই বিচারব্যবস্থাও আমাদের মতো প্রলম্বিত নয়। এখনও উন্নতিশীল দেশে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আইনের শাসনের প্রতি আপামর জনসাধারণ অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ, সজাগ এবং সতর্ক। প্রশাসনিক ভিভিআইপি কালচার আমাদের দেশের মতো এতো তীব্র ও প্রকট নয়।

‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ ছবিতে এই সমস্ত ভয়ংকর প্রশ্ন নিয়ে পর্যালোচনার বা দিকনির্দেশ করার অনেক সুযোগ ছিল, কেন কোন কারণে তদন্তকারী সংস্থা লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় তার অন্তত কিছুটা ইঙ্গিত আসতে পারতো, কিন্তু বিতর্ক এড়াতে বক্স-অফিসের তাগিদে ছবিতে সেই সুযোগ সচেতন ভাবেই রাখা হয়নি। তার বদলে ছবিতে দীর্ঘসময় ধরে অসংখ্য ফিকশনাল উপকাহিনী নিয়ে আসা হয়েছে, যা এই প্রয়াসকে একটি সাধারণ মানের দীর্ঘায়িত রহস্য ছবিতেই আটকে রেখেছে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content