বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


 

মহারাজা

ভাষা: তামিল, তেলেগু, হিন্দি
পরিচালনা: নিথিলন স্বামীনাথন
অভিনয়: বিজয় সেতুপতি, অনুরাগ কাশ্যপ, সচনা নমিদাস, অভিরামা, নটরাজন, সিঙ্গমপুলি।
ওটিটি রিলিজ: নেটফ্লিক্স
রেটিং: ৯/১০

পিতৃত্ব কি শুধুই রক্তের সম্পর্ককে বিশেষিত করে? যদি সেই সম্পর্ক রক্তের না হয়ে শুধুই হয় বিশ্বাস, ভালোবাসার? তাহলেও কি দিনের পর দিন সুবিচারের আশায় গলা ধাক্কা খাওয়া যায়? যেমন মহারাজা (বিজয় সেতুপতি) দিনের পর দিন খেয়েছে। কথায় কথায় চড়, থাপ্পড়, ফাই-ফরমাশ খাটা কিছুই বাদ যায়নি স্থানীয় থানায়। এমনকি নিজের নামটাও বদলে যেতে দেখেছে সে ‘কচড়ে কা ডব্বা’তে অর্থাৎ ময়লা ফেলার বাক্সে, তবু অনড়, অচল থেকেছে নিজের অবস্থানে! ভয় একটাই, নিজের বউ, মেয়েকে তো সে কবেই চোখের সামনে চলে যেতে দেখেছিল, নিজের বলতে ওই অন্যের একরত্তি মেয়েটাই ছিল। অন্যের বাড়ির ‘কচড়ে কা ডব্বা’ই মেয়েটাকে যেন দৈবক্রমে বাঁচিয়েছিল।

মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ডব্বাও অতিরিক্ত খাতির, যত্ন পাচ্ছিল বাবা-মেয়ের সংসারে। ডব্বার নামকরণ হয় লক্ষ্মী। মেয়ে জ্যোতির (সচনা নমিদাস) যাপনই তখন বাবার যাপন। ছোট সেলুনে কাজ করা আর মেয়ের সব আবদার মেটাতে ব্যস্ত বাবা সেদিনও ক্যাম্প থেকে ফেরা মেয়ের কথায় তার জুতো জোড়া কিনে বাড়ি ফিরতে দেরি করে ফেলে। লোকাচার জ্ঞানহীন বাবা, কারও সঙ্গে মিশতে না পারা বাবা, স্বধর্মে চলা বাবা, বুঝে যায় তার অনুপস্থিতিতে মেয়ের ওপর পরিকল্পিত, সংঘটিত অপরাধের কথা থানায় বললে মেয়ের আরও বহুবার বাচিক ধর্ষণ হবে।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

ত্রাতার ভূমিকায় আবার অবতীর্ণ হয় ‘লক্ষ্মী’ নামের ‘কচড়ে কা ডব্বা’। থানায় গিয়ে সেই ‘কচড়ে কা ডব্বা’ খুঁজে দেওয়ার জন্য প্রথমে কাকুতি মিনতি, তারপর বলপ্রয়োগ আর তাতেও কাজ না হলে বিশাল অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুলিশকে দিয়ে কাজ শুরু করায় সে। ক্রমশ থানার বড়বাবু থেকে ছোটবাবু বুঝতে শুরু করে এ গল্প সে গল্প নয় যা মহারাজা তাদের দেখাচ্ছে। নিজেদের মতো করে, অবশ্যই মহারাজাকে এড়িয়ে ঘটনার জট ছাড়াতে গিয়ে তাঁরা দেখে, তাঁদেরই এক ‘খবরি’ (নল্লাশিবম) এই ভয়ঙ্কর অপরাধে সামিল। নিজেদের মতো করে জাল গোটাতে থাকে থানার বড়বাবু (নটরাজন) আর তাঁর সহযোগীরা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

এই ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রায় বারো-তেরো বছর আগে পর পর সংঘটিত অপরাধের কিনারা করতে গিয়ে পুলিশের নজর ঘোরে সেলভামের দিকে। বাড়িতে স্ত্রী, শিশু কন্যার প্রিয় মানুষটিই অপরাধ সংঘটিত করার ক্ষেত্রে দানব হতে বেশি সময় নেয় না। উগ্র পৌরুষ প্রতিফলিত হয় প্রত্যেকটি ঘটনায়। উদগ্র যৌনতা, বিকার ছুঁয়ে যায় প্রত্যেকটি ঘটনাকে। কর্মফল স্বরূপ অবধারিত কারাবাস শেষে পুরোনো ভুল বোঝাবুঝির বলি হয় তাঁর নিজের মেয়ে। অপরাধের বহর পুলিশেরও বিবমিষা জাগায়, মাথায় রক্ত চড়ে, তাঁরা ধারালো অস্ত্র তুলে দেয় পালক পিতা মহারাজার হাতে। ছবির দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে এই একটি মাত্র খামতি ছাড়া ছবিটির বিষয়বস্তু, চিত্রনাট্য ও উপস্থাপনার নিরিখে এটি দেশে নির্মিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিজয় সেতুপতির এটি পঞ্চাশতম ছবি। তাঁর অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ তিনি এই ছবিতে করে দেখিয়েছেন। তাঁর ঈর্ষণীয় অভিনয় দেশের সিনেমা শিল্পকে নিশ্চয় এগিয়ে দিয়েছে। অসাধারণ, অসামান্য, অপূর্ব সব বিশেষণই সেতুপতির অভিনয়ের ক্ষেত্রে কম পড়বে। আর অনুরাগ কাশ্যপ? আপনাকে তো আমরা ছবির পরিচালক হিসেবে জানি। আপনি বুঝি এমন অভিনয় আপনার কুশীলবদের প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রে করে দেখান? তাঁরা তো সেই অভিনয়ের ষাট শতাংশও দিতে পারেন না। আপনি যদি পরিচালনা ছেড়ে শুধু অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন তাহলে বোধহয় আরও বেশি সফল হবেন। যা আপনি করে দেখিয়েছেন, যে সমতা ও আশ্চর্যজনকতা আপনি আপনার চরিত্রকে দিয়েছেন সেটা অন্য কেউ দিতে পারত বলে মনে হয় না। অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেমন নটরাজন, অভিরামা, সচনা নমিদাস, সিঙ্গমপুলি সমান স্বচ্ছন্দ তাঁদের নিজস্ব পরিসরে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

পরিচালক নিথিলন স্বামীনাথন আপনার কাজ পৃথক উল্লেখের দাবি রাখে। আপনি জিনিয়াস। রূপকের পর রূপক ব্যবহার করে পরিচালক নিথিলন আসলকে আড়ালে রাখেন ছবির সিংহভাগ জুড়ে। সময়ের বেড়াজাল এমনভাবে বুনেছেন যে ক্রম বজায় না থেকেও শুধুমাত্র অসামান্য প্লট দর্শককে পর্দা থেকে চোখ সরাতে দেয় না। তিনি এই ছবির চিত্রনাট্যকার এবং সংলাপ রচয়িতা ও। তাঁর কলম উগ্র পৌরুষকে প্রতিহত করেছে।
সমস্ত চরিত্রগুলোকে তিনি এমন ঘেরাটোপে রেখেছেন যে তাঁরা কথায় কথায় দর্শকের সহানুভূতি আদায় করে না, কিন্তু ঠিক সময়ে তাঁদের প্রতিবাদ, হাহাকার কানে পৌঁছয় প্রেক্ষককুলের, গল্পের বুনট তাঁদের ভাবায়। না বাড়াবাড়ি রকমের ভিএফএক্সের ব্যবহার, না কল্পকথার আশ্রয়, না চড়া দাগের অভিনয়, না অকারণ গানের ব্যবহার অথচ এই কুড়ি কোটিতে নির্মিত ছবি গত এক মাসে একশো কুড়ি কোটি আয় করে ফেলেছে। ক্যামেরায় দীনেশ পুরুষোত্তম এবং সম্পাদনায় ফিলোমিন রাজ নিজের নিজের কাজ সমান দক্ষতায় করে গিয়েছেন।

তবে এতকিছুর পরেও এই ছবি যা সবচেয়ে বেশি ভাবতে বাধ্য করে সেটি হল শুধু হাহাকার আর মৃত্যুবরণ কী মুক্তি দেয় একমুখী পিতৃত্বের?
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত পনেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাস। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যাল শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content