সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


ভারতের মতো জাপানেও একটি দীর্ঘ সমৃদ্ধশালী ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জাতিসত্তা রয়েছে। সে দেশের জনগণের শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং আবেগ রয়েছে। তাই তাঁরা তাদের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় উত্সবগুলি অনেক আড়ম্বর এবং জাঁকজমক সহকারে উদযাপন করতে পারে। তাঁরা অন্য দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জাতিগত বৈচিত্র্যকেও পছন্দ করেন। আবার মন খুলে প্রশংসাও করে। সে কারণে জাপানে গ্যালারি এবং থিয়েটারগুলিতে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা একটি সাধারণ ঘটনা মাত্র।

বৌদ্ধধর্ম প্রথম চিন থেকে জাপানের উপকূলে পৌঁছনোর সময় থেকেই ভারত ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যায়। জাপানের বৌদ্ধধর্মের শিকড় রয়েছে চিনে, যা ভারতের ঐতিহ্যবাহী সীমানা ছাড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের সক্রিয় প্রসারে তিব্বত ও ভারতে ফিরে আসে। এই দৃঢ় সম্পর্ক নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল তাঁর জাপান সফরের সময় ১৯১৬, ১৯২৪ এবং ১৯২৯ সালে।
ভারতীয় পলিম্যাথের প্রতিভা শুধু জাপানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি একাধিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতাও দিয়েছেন। পাশাপাশি পূর্ববর্তী জাপানি সমাজের অভিজাত, সাধারণ এবং বুদ্ধিজীবী—সবার মধ্যেই যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। তদুপরি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাসবিহারী বসু এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বৈপ্লবিক অবদান, এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর প্রতি জাপানের সমর্থন কয়েক দশক ধরে উভয় দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। জাপান ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং একটি প্রধান বিনিয়োগকারী ও কাঁচামাল এবং পণ্যের ক্রেতা।
আরও পড়ুন:

শম্ভু, শম্ভু, শিব মহাদেব শম্ভু, খুদার ইবাদত যাঁর গলায় তাঁর আর কাকে ভয়?

সম্প্রতি ইয়োকোহামায় কানাগাওয়া প্রিফেকচার, জাপানের বিখ্যাত ওকুরায়মা মেমোরিয়াল অডিটোরিয়ামে বেশ আড়ম্বর ও জাঁকজমকের মধ্যে ইন্দো-জাপানিজ সাংস্কৃতিক উৎসব উদযাপিত হয়ে গেল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অংশ ছিল সঙ্গীত ভবনের একজন প্রাক্তন ছাত্রী (বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনেকেতন), মিসেস ওকুদা দ্বারা উপস্থাপিত রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে মিসেস সুকৃষ্ণ ইশির অসামান্য নৃত্য পরিবেশন। সেতার ও তবলার মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘দ্য সাউন্ডস অফ বেঙ্গল’। এটি ছিল সব মিলিয়ে এক নজরকাড়া পরিবেশনা। মনোজ্ঞ এই অনুষ্ঠান দর্শকদের যে বিপুল প্রশংসা পেয়েছে, তা অডিটোরিয়ামের ভিতর প্রতিধ্বনিত হওয়া হাততালির গর্জন থেকে অনুমান করা যেতে পারে।
এর পাশাপাশি অসামান্য শিল্প প্রদর্শনীও প্রদর্শিত হয়েছে। প্রদর্শনীটি কলা ভবন (কলা অনুষদ), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্ররা প্রদর্শন করেন৷ শিল্পকর্ম ক্যালিগ্রাফি, প্রতিকৃতি, ল্যান্ডস্কেপ, মানুষের অভিব্যক্তি, ভারতীয় এবং জাপানি পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা এবং প্রকৃতি এ সবই প্রদর্শনীতে সাজানো ছিল। গ্যালারিতে ঐতিহ্যগত কাজগুলির পাশাপাশি বিমূর্ত শিল্প এবং চিন্তাভাবনা উভয়কেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

স্থানীয় এবং বিদেশী পর্যটক— উভয়ই এখানে অংশ নিয়েছিলেন। এখানে শিল্প সমালোচক, উত্সাহী মানুষজন এবং শিল্পপ্রেমীদের ভিড় নজর কেড়েছিল। বেশ গর্বের বিষয় যে, আজও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরাধিকার এবং প্রভাব ভারত-জাপান সাংস্কৃতিক সম্পর্কে একটি শক্তিশালী ভূমিকা নিয়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসামান্য সাহিত্যকর্ম জাপানে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তদুপরি, একজন শক্তিশালী প্রাচ্যবিদ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত প্রথম ভারতীয় যিনি সমৃদ্ধ জাপানি সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের বৈচিত্র্য এবং জটিল বিবরণ অন্বেষণ করেছিলেন। তাঁর বিশ্বভারতী সম্ভবত ভারতে স্কুল অফ জাপানিজ স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শকদের একজন। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় এবং জাপানের নাগরিকদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সেতু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ একজন স্বপ্নদর্শী হিসেবে প্রথম ভারতীয় ছিলেন, যিনি ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদী স্বাধীন ভারত-জাপান সম্পর্কের সম্ভাবনা বুঝতে সফল হয়েছিলেন। এ ভাবে, ইন্দো-জাপান সাংস্কৃতিক উৎসব রবি ঠাকুরের উত্তরাধিকার বহন করে এবং উভয়কে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একে অপরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ইয়োকোহামা, কানাগাওয়া প্রিফেকচারের ওকুরায়ামা মেমোরিয়াল অডিটোরিয়াম বন্দর শহর এবং জাপানের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী ভবনও। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি ও উত্তরাধিকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। কথিত, রবি ঠাকুরের চিন্তাশীল মূল্যবান পরামর্শ, অন্তর্দৃষ্টি মঞ্চের নকশা, স্থাপত্যও জাপান জুড়ে পরিচিত।

১৯৩২ সালে এই ভবন নকশা করেছিলেন উহেইজি নাগোনা। এই অডিটোরিয়াম সরকারি এবং বেসরকারি আলোচনাসভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কথোপকথন এবং কর্মশালার মতো অনুষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত। পাশাপাশি সঙ্গীত ও নৃত্য, নাটক, শিল্প প্রদর্শনী-সহ সাংস্কৃতিক উৎসবও এখানে হয়ে থাকে।
ছবি: সুকৃষ্ণা ইশি

Skip to content