রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


পুনরায় রুবি রায় নাটকের একটি দৃশ্য (বাঁ দিকে)। তেরি বাতো মেঁ অ্যায়সা উলঝা জিয়া ছবিতে শাহিদ-কৃতি (ডান দিকে)।

যখন সবেমাত্র ট্রেলার প্রকাশ পেয়েছিল সন্দেহের কাঁটাটা তখন থেকেই খচখচ করছিল। গতকাল মুক্তি পেল শাহিদ কাপুর-কৃতি শ্যাননের নতুন ছবি ‘তেরি বাতো মেঁ অ্যায়সা উলঝা জিয়া’। কিন্তু শুধু ট্রেলার দেখেই মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। ছবি দেখে আরও অনেক কিছু মনে হল। ছবির মূল কাঠামোর ঘটনা অনুষঙ্গে লোককৃষ্টি প্রযোজিত মঞ্চসফল কমেডি ‘পুনরায় রুবি রায়’-এর এত মিল কেন? সবটাই কি কাকতালীয়? নিছক ভাবনার মিল?

উত্তর আসতে পারে দক্ষিণের সুপারস্টার রজনীকান্তের সুপারহিট ছবি রোবট-এও তো মানবী ঐশ্বর্যের সঙ্গে রোবটমানবের প্রেম হয়েছিল। শাহিদ-কৃতির নতুন হিন্দি ছবিতে নায়কের সঙ্গে রোবটমানবীর প্রেম। অসুবিধার কি আছে?

অসুবিধে সেখানে নয়, অসুবিধে কাহিনির গঠনরীতি এবং দৃশ্যের অনুষঙ্গে। লোককৃষ্টি’র ‘পুনরায় রুবি রায়’ ২০১৮-র ডিসেম্বর থেকে এই ২০২৩-এর মাঝপর্যন্ত একনাগাড়ে অভিনীত হয়েছে। দর্শকের শুভেচ্ছা অভিনন্দন আনুকূল্য লাভ করেছে। প্রচারিত হয়েছে কলকাতা দূরদর্শনে। দূরদর্শন তাদের ফেসবুক-এ এবং দূরদর্শনের পর্দায় এই নাটকের ট্রেলার বারবার দেখিয়েছেন। একটি রোবটমানবী কোনও পরিবারের মধ্যে ঢুকে পড়লে ঠিক কী ঘটতে পারে, তার অস্তিত্ব নিয়ে পারিবারিক টানাপড়েন সেই নিয়েই নাটক পুনরায় রুবি রায়। আলোচ্য হিন্দি ছবিটির বিষয়বস্তু ঠিক একই। শুধু তাই নয়, দূরদর্শন ক্লিপ দেখার পর এই ছবির ট্রেলার দেখলে মিশে থাকা মিল সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু একটি বাংলা আপ্তবাক্য বড্ডবেশি করে মনে আসছে “..বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা।”
বিদেশে মূল ভাবনায় কোনও কপিরাইট হয় কিনা জানা নেই, তবে আমাদের দেশে এমন নেই। তাই নায়কের বদলে সাইন্টিস্ট হয়েছেন মাসি। তিনি রোবটমানবী বানিয়েছেন, সেই রোবটমানবী গেরস্থালীতে ঢুকে পড়ে কী কী করল, নায়কের সঙ্গে কীভাবে নাচল গাইল প্রেম করল সেই নিয়ে মহাবাজেটের হিন্দি ছবির প্রযোজক ‘কাহিনি’ এবং চিত্রনাট্যকার বা নির্মাতারা নতুন কিছু ভাবতে পারলেন না কেন? আক্ষেপ সেখানে। ম্যাসাচুসেটসকে গোটা আমেরিকা বলে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউকে-র ব্রিস্টল রোবোটিক ল্যাবেও প্রচুর হিউম্যানয়েড রোবটের কাজ হয়। গল্প সেখানে নয় কেন? নানান মিল তবে আমাদের দেশের আইন মেনে করা অন্যায়। সেটাতো শেষমেষ ন্যায়ই হল নাকি!!
আরও পড়ুন:

নাট্যকথা: অতিমারির বদ্ধতায় একঝলক অক্সিজেন, বৃহস্পতিবার ১০ ফেব্রুয়ারি অ্যাকাডেমিতে লোককৃষ্টি’র নতুন হাসির নাটক ‘পুনরায় রুবি রায়’

মুভি রিভিউ: সুধীর মিশ্রের ‘আফওয়া’ নতুন প্রজন্মকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস জোগাবে

এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, লোককৃষ্টির ‘ছুমন্তর’ বা ‘পুনরায় রুবি রায়’ নাটকের নাট্যকার সাহিত্যিক জিৎ সত্রাগ্নি-র সঙ্গে। তিনি জানালেন, “এ বিষয়টি গত ডিসেম্বর মাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই আমি প্রথম জানতে পারি লোককৃষ্টির কর্ণধার পরিচালক অভিনেতা ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তখনও ছবিটির কোন ট্রেলার প্রকাশিত হয়নি। তবে এ সম্পর্কিত খবর পড়ার পর মনে হয়েছিল আমার লেখা নাটকের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই ছবিটির হয়ত মিল রয়েছে। আমার নাটকটি পাঁচ বছর আগে রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইটে রেজিস্ট্রিকৃত। ট্রেলার দেখলাম। গল্পের বিষয় এবং দৃশ্য ভাবনায় যথেষ্ট মিল আছে। জানি না আমাদের দেশের রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইট কীভাবে সাহায্য করবেন যাতে একজন সাধারণ লেখক সুবিচার পেতে পারেন। বিষয় চুরি ভাবনা চুরি এগুলিকে ইংরেজি ভাষায় খুব একটা সুন্দর শব্দে ব্যবহার করা হয়, প্লেগারিসম। যেটা অতীতেও ছিল।”
লেখকের কথায়, “যাঁরা নাটক দেখেছেন তাঁরা মিল স্পষ্ট অনুভব করবেন। আইন মেনে করা চুরি দোষ হিসেবে প্রমাণ করতে যুগ কেটে যাবে। এটা তো ১৯৭৫-র শোলে বা তারও ১৫ বছর আগে ১৯৬০-র মুগলে আজমের মতো মাইলস্টোন ছবি নয়, যে ছবিগুলো আজও মানুষ মনে রেখেছেন। বড় প্রযোজক সারা ভারতে ছবির পয়সা ওঠানোর চেষ্টা করবেন কয়েক মাস বাদে ওটিটি-র তাকে পড়ে থাকবে।

নিজের গল্প বঙ্কুবাবুর বন্ধু থেকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় তাঁর এলিয়েন ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, কলম্বিয়া পিকচারসের সেই ছবি করার কথা ছিল। ছবি হয়নি। বহুবছর পর সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল স্টিভেন স্পিলবার্গের ই-টি। বিশ্বখ্যাত পরিচালক স্বয়ং প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, এলিয়েন থেকেই ই-টি বানানো। স্টিভেন স্পিলবার্গ অস্বীকার করেছিলেন। ব্যাস, ওইটুকুই।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

জিৎ সত্রাগ্নি এও জানালেন, “আমি কেন যাঁরা আমার এ নাটকের একাধিক মঞ্চাভিনয় দেখেছেন দূরদর্শনে এ নাটক দেখেছেন তাঁরাও একটু খেয়াল করলেই এই হিন্দি ছবিটির মধ্যেই নাটকের বহু দৃশ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। যাঁরা পুনরায় রুবি রায় দেখেননি তাঁরাও দূরদর্শনের ক্লিপের সঙ্গে ট্রেলার মিলিয়ে দেখলে বেশ কয়েকটি মিল স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। ‘সময় আপডেটসে’ এই নাটকের প্রতিবেদনে সেই ক্লিপটি ছিল। তবে দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ বাংলাভাষা জানেন না। আর দূরদর্শনের ক্লিপে ইংরিজি সাবটাইটেল নেই। সেটা ইউটিউবেও নেই। নির্মাতারা এসব বিষয়ে খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিয়েছেন। এটা ভেবে ভালো লাগছে। তবে যাঁরা পুনরায় রুবি রায়-এর কথা জানেন না, তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবে এই হিন্দি ছবির বিষয়ের নতুনত্বে আকৃষ্ট হবেন বাহবা দেবেন কিন্তু নির্মাতারা কি এককভাবে সেই সম্মানের প্রকৃত প্রাপক?’’

পুনরায় রুবি রায় নাটকের রেজিস্ট্রেশন।

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার

লেখকের পরিষ্কার বক্তব্য, দেশের কপিরাইট আইনের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল হলেও এ ধরণের জাগ্লারি ধরা মুশকিল। এটাও রূঢ় বাস্তব যে এ ধরনের নামী ক্ষমতাবান অর্থসমৃদ্ধ প্রযোজকের সঙ্গে একজন সাধারণ মানুষের লড়াইটা সবসময় অসম। প্রচুর সময় ও অর্থব্যয় হয়তো বা অনেক বিরুদ্ধাচারণের মুখোমুখি হবার পরেও সত্যি সুবিচার পাওয়া যাবে কিনা সেখানে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ত আছে। ‘তারিখ পে তারিখ তারিখ পে তারিখ’ —এতো কারও অজানা নয়। হ্যাঁ, কথায় কথায় আপনি রোবট সিনেমার প্রসঙ্গে বললেন, এস শঙ্কর পরিচালিত জনপ্রিয় ছবিটি ২০১০-এ রিলিজ করে। হয়তো ২০০৮ সালে কাজ শুরু হয়েছিল। সকলের অবগতির জন্য জানাই ২০০২ সালে এবিপি টিভির প্রযোজনায় ইটিভি-তে প্রচারিত হত আমারই লেখা রোবটমহিলা রুবি রায়কে নিয়ে প্রথম সিরিয়াল ‘কলকাতায় রুবি রায়’। আমি লিখেছিলাম ২০০০ সালে। মানে ২৪ বছর আগে। তাই শাহিদের ছবির জন্য শহিদ হবার ইচ্ছে বা সময় আমার কোনওটাই নেই। তবে আগামীতে বাংলার দর্শক বিচার করবেন। আমি নিশ্চিত। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য ‘সময় আপডেটসকে ধন্যবাদ’। হলিউডে নাকি মূলকাহিনি ও তার বিন্যাসকে বাইবেল বলা হয়। তবে সৎভাবে বাইবেল যাঁরা গড়েন তাঁরা পরিচালক না হলে সাধারণত পাদপ্রদীপের অনেক দূরে জায়গা পান। সেখানে আলো পৌঁছয় না।

Skip to content