রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

সিনেমাতে ‘কন্টিনিউটি’ নিয়ে সহকারী পরিচালকদের একটা বিরাট টেনশন থাকে। সেটা কস্টিউম বা মেকআপ বা সেট প্রপস যা-ই হোক। ভুল হলেই রি-শ্যুট ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। যে ভয় মেগাসিরিয়ালে থাকে না। কারণ সিনেমাটা হলে বসে দর্শকরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা দেখে। ফলে সময় বিচার করে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে যাওয়ার সময় যুক্তিগ্রাহ্য সবকিছুর সাদৃশ্য রাখতে হয়। কিন্তু মেগাসিরিয়ালে এসবের কোনও বালাই নেই। তা সে যত বড় কন্টিনিউটি ব্রেক হোক না কেন! কারণ মেগা নির্মাতারা জানেন, তাঁরা যা দেখাবেন দর্শকরা তা দেখতে বাধ্য। ভুল হলে দর্শকরা তৎক্ষণাৎ দু-চার কথা বলবে, তারপর বিজ্ঞাপন বিরতিতে উনুনে বসানো তরকারিটা নেড়ে বা নামিয়ে ফিরে এসে আবার বড়বউ, ছোটবউ-এর ঝগড়া দেখবে।

নির্মাতারা এটাও জানেন, ভুল হয়েছে বলে কোনও দর্শক রাগ করে সিরিয়াল দেখবে না, এমন সচেতন দর্শক এ বঙ্গে নেই। তাই আগের দিন শ্যুটিংয়ে নায়িকা যখন স্কুলে যাবার সিনে নিজের সাদা শাড়ি পরে অভিনয় করে এবং পরের দিন সেই শাড়ি আনতে ভুলে যায়, তখন স্কুল থেকে ফেরার সিনে ড্রেসারের দেওয়া হলদে চুড়িদার পরাতে পরিচালক বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। ভুলটা দেখে কপাল চাপড়ে দর্শকরা নিজের মনে অনেক কিছুই বলেন, কিন্তু কিছুই করার থাকে না। অর্থাৎ দর্শকরা দেখে দিদিমণি সাদা শাড়ি পরে স্কুলে যাচ্ছে, ফিরছে হলদে চুড়িদার পরে। এরকম কন্টিনিউটি ব্রেক আর্ট ডিপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে মারাত্মক ভাবে ঘটে। আর সেটা ‘ব্রেক’ না বলে বলা ভালো, ভেঙে একেবারে চুরমার। গতকাল ১০০ এপিসোড পর্যন্ত দর্শকরা প্রধান চরিত্রদের যে বাড়িতে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে, ১০১ থেকে দেখলেন তারা অন্য বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে স্টুডিওতে বিশাল সেট বানিয়ে শ্যুটিং শুরুর পর হিসেব কষে প্রোডিউসার দেখলেন, তাঁর লাভ হচ্ছে না। তাই চ্যানেলের সঙ্গে রফা করে কম টাকায় একটা রেডিমেড বাড়িতে শ্যুটিং শুরু করলেন। আরেকটা কন্টিনিউটি ব্রেক দর্শকরা প্রায়ই দেখে থাকেন শিল্পীদের ক্ষেত্রে। প্রোডিউসার বা চ্যানেলের সঙ্গে বনিবনা না হলেই বাদ। দর্শকরা আজ অবধি একজনকে ‘বাবা’ হিসেবে দেখলেন, কালকে দেখলেন অন্য ‘বাবা’।

একবার এক মেগাতে নানা কারণে হিরোর বাবার চরিত্রে চারজন অভিনেতা চেঞ্জ হয়েছিল। তাই নিয়ে সেই হিরো পরিচালককে ঠাট্টা করে বলেছিল, স্যার, আমার মা কি চরিত্রহীন? মানে আর কতজনকে ‘বাবা’ বলে ডাকব? তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যে লাভ নেই, আমরা টেকনিশিয়ানরা সেদিনই এটা ফিল করেছিলাম, যেদিন এই ঘটনাটা ঘটেছিল। ঘটনাটা কী? শনিবার রাত বারোটায় শ্যুটিং শেষে বাড়ি ফিরে রাত একটায় নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ডিরেক্টর অভিজিৎদার ফোন, জানো, একটা সর্বনাশ হয়েছে! আঁতকে উঠে বললাম, কী? আজ লাঞ্চের পর অরুণবাবুর (অভিনেতা) সিন যখন শুরু হল, তখন তার মেকআপ চেক করেছিলে? —মেকআপ চেক! কেন সমস্যা হয়েছে?—হ্যাঁ, লাঞ্চের আগে যে দুটো সিন করেছেন তাতে দাঁত ছিল, পরে দুটোতে দাঁত নেই। ওঁর সামনের তিন পাটি দাঁত যে ফলস, সেটা কী করে বুঝব? মানে লাঞ্চ ব্রেকে খাওয়াদাওয়ার পর ফলস দাঁত-পাটিটা খুলে ছোট পাত্রে ভিজিয়ে রেখেছিলেন, লাঞ্চের পর সেটা পরতে ভুলে গেছেন। আমরা কেউ খেয়াল করিনি যে লাঞ্চের পর উনি দাঁত ছাড়া পার্ট করেছেন। মেকাপম্যান মন্টু বলল, এইজন্য ফোকলা দাঁতের বুড়োদের পার্ট দিতে নেই। অভিজিৎদা বললেন, সেটা কোনও যুক্তি নয়। ভালো অভিনেতা ভেবেই পার্টটা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উনিই বা কেমন? উনি যখন খুলেছেন, তখন ওঁরই মনে রাখা উচিত। মেকাপম্যান মন্টু বলে, দাদা আপনার কিন্তু ওঁকে দু’এক কথা শোনানো উচিত, বলেছিলাম। বললেন, সব দোষ নাকি আমাদের। আমরা কেন খেয়াল করিনি। তিনি বেশি দোষ দিচ্ছেন তোমাকে। বলছেন, মেকআপ রুমে তিন পাটি দাঁত পড়ে রইল, আমি পার্ট করতে চলে এলাম, মন্টুর খেয়াল হল না? মন্টু খেপে গিয়ে বলল, তাই নাকি? উনি কি আমাকে আলাদা পয়সা দেন নাকি যে, ওঁর দাঁতের খেয়াল রাখব? মেকআপম্যান কি ফলস দাঁতও পরিয়ে দেবে? এডিটর মানস বলল, যাক গে এখন কী হবে? রি-শ্যুট? —না, অরুণবাবু তো আজই আউটডোরে চলে যাচ্ছেন। এদিকে কালই টেলিকাস্ট। উনি বলছেন, ও যা হয়েছে হয়েছে ওইভাবেই টিভিতে দেখিয়ে দিতে বলো। কেউ ধরতে পারবে না। মানস খেপে গিয়ে বলল, এটা উনি কী করে বললেন? একটা লোক ডিনার করল দাঁত ছাড়া, ঘুমোতে গেল দাঁত পরে? হওয়া তো উচিত উলটোটা। কথার মাঝে ক্যামেরাম্যান গৌতমদা এসে হাজির হন। তিনিও বিভ্রাটের কথা শুনে বললেন, ছিঃ ছিঃ! এত বড় ভুল আমরা সবাই করলাম! যাক গে, অরুণদাকে যেভাবেই হোক রাজি করাও। যদি উনি আবার পারিশ্রমিক চান, আমরা না হয় চাঁদা তুলে সেটা দিয়ে দেব। যেহেতু ভুলটা আমাদের, মাশুল দেব আমরা। ধরে নাও ‘দাঁত-মাশুল’। ফোনে এক্সট্রা পারিশ্রমিকের কথা শুনে অরুণদা আউটডোর (হয়তো ওটা ছিল বাহানা) ক্যানসেল করে শ্যুটিংয়ে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সিনটা রিটেক হচ্ছে কেন, এর জবাব প্রোডিউসারকে বা চ্যানেলকে দেবে কে? পুরো ডিরেক্টরিয়াল টিমের ঘাড়ে এসে পড়বে দোষটা। এডিটর মানস বলল, প্রোডিউসারকে কিছু বলার দরকার নেই, আর চ্যানেলকে যা বলার আমি বলছি। এরপর উনি চ্যানেলের ইপি ইন্দ্রাণীদিকে ফোনে পুরোটা ‘ব্রিফ’ করলেন। তারপর মানস একতরফা ওপার থেকে পাঁচ মিনিট ধরে অনেক কিছু শুনলেন। তারপর ফোনটা ছেড়ে হাসিমুখে বললেন, নো টেনশন, বিপদ কেটে গেছে। সবাই অবাক চোখে জানতে চাইলাম, মানে? মানস ইন্দ্রাণীদির বক্তব্যটা জানালেন, যেভাবে টেক হয়েছে সেভাবেই টেলিকাস্ট হবে। দর্শকরা ধরতে পারলে ধরবে, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। মেগাসিরিয়াল দেখতে বসে যুক্তি খুঁজলে হবে? শুনে সীমাহীন আনন্দ পেলাম সবাই। মাথার ওপর দায় নেওয়ার এরকম কেউ থাকলে ‘কন্টিনিউটি’ নিয়ে আমরা এত মাথা ঘামাই কেন? বেঁচে থাক মেগা সিরিয়াল।

Skip to content