শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন সিবিএসসি-র দশম শ্রেণি ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে। দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়ল কবি ফৈজের কবিতার দুটি উদ্ধৃতাংশ। দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনীতি’ নামক অধ্যায়ে ফৈজ়ের কবিতা দু’টির উদ্ধৃতি দিয়ে রাজনৈতিক পোস্টার বিষয়ে পড়ানো হতো। বাদ দেওয়া হয়েছে সেই উদ্ধৃতিগুলি। পাশাপাশি বাদ দেওয়া হয়েছে একটি রাজনৈতিক কার্টুনও। ২০২২ যে নতুন বই ছাপা হয়েছে, তাতে এই পোস্টার দু’টি বা কার্টুনটি নেই। সিবিএসই-র তরফ থেকে নোটিস জারি করে জানানো হয়েছে, যাঁরা বইয়ের পুরনো সংস্করণ পড়বেন, তাঁরা যেন এই বিষয়ে সচেতন থাকেন যে, পুরনো সংস্করণের ৪৬, ৪৮ ও ৪৯ নম্বর পাতা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত থাকছে না। শুধু তাই নয়, বাদ পড়েছে ‘ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ডাইভার্সিটি’ নামের একটি বিশেষ অধ্যায়ও, যে অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করার মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন করার জন্য পাঠ্যক্রমে রাখা হয়েছিল। নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সামাজিক বৈষম্যের বিরূদ্ধে সচেতন না হয়েই তৃতীয় বিশ্বের ‘শিক্ষিত’ যুবাসম্প্রদায় হয়ে উঠবে আজকের পড়ুয়ারা। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষণীয় একাদশ শ্রেণির ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠক্রমেও কিছু কিছু স্কুলের বক্তব্য অনুযায়ী ছাঁটা হয়েছে অঙ্কের সিলেবাসও। ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে ‘সেন্ট্রাল ইসলামিক ল্যান্ডস’ অধ্যায়টি। আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে কী ভাবে ইসলামি শাসন কায়েম হয়েছিল, সেবিষয়ে বিস্তৃতভাবে ওই আলোচনা করা হতো এই অধ্যায়ে। পাশাপাশি বাদ পড়েছে বেশ কিছু আর্থসামাজিক প্রসঙ্গও। দশ‌ম ও একাদশ শ্রেণি ছাড়া দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাস থেকেও একটি অধ্যায় বাদ গিয়েছে— ‘কোল্ড ওয়ার এরা অ্যান্ড নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট’, যে অধ্যায়ে মূলত দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুর শাসনকাল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক হরি বাসুদেবনের তৈরি করা এই পাঠক্রম প্রায় দেড় দশক ধরে সিবিএসসি বোর্ডের পড়ুয়ারা পড়ে আসছে। সিবিএসই-র দশম শ্রেণির বইয়ে ফৈজ়ের কবিতা দু’টির কিছুটা অংশও এতদিন ধরে ইংরেজি অনুবাদে পড়িয়ে আসা হয়েছে । লাহোর জেলে বন্দি থাকার সময়ে কবির ব্যক্তিজীবনের দুর্দশাময় আকুতির আক্ষরিক দলিল এই কবিতাগুলি। কথিত আছে বন্দিদশায় তাঁকে একবার চিকিৎসকের কাছে শিকলে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, আর তারপরেই ফৈজ় লিখেছিলেন— ‘আজ, প্রকাশ্যে স্বাধীন চলাটুকুও শিকলবন্দি।’ আচমকা এত বছরের পাঠক্রমে কেন এমন বিস্ময়কর পরিবর্তন? কেবলই কী সিলেবাসের ‘অতিরিক্ত’ মেদ বর্জনের প্রচেষ্টা? তাও যদি হয় তাহলে তো বাদ পড়া বিষয়গুলির গুরুত্ব নিয়ে বৈশ্বিকগতভাবে আর্থ -সামাজিক পরিকাঠামোর নিরিখে এক বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের উদয় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। না সিবিএসই বোর্ডের তরফ থেকে এই দন্দ্ব নিরসন হওয়ার মতো কোনও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বোর্ডের এক কর্তা জানিয়েছেন, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-এর নির্দেশিকা মেনেই পাঠ্যক্রমে এই পরিবর্তন করা হয়েছে। শিক্ষাবিদদের একাংশের মত, কিন্তু অন্যকথা বলছে। তাঁদের মতে এই উদ্যোগ সম্পূর্ণরূপে শিক্ষায় গৈরিকীকরণের এক প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে আর কিছুই না। আর কেন্দ্রীয় সরকারের সেই উদ্যোগকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্যই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা এনসিইআরটি এবং তাদের সুপারিশ অনুযায়ী পাঠ্যক্রমে বদল আনছে সিবিএসই। শিক্ষাবিদদের মতে, ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস ‘নতুন করে’ লিখতে চান রাষ্ট্রে শীর্ষে আসন দক্ষিণপন্থী এই হিন্দুত্ববাদী সরকার। আর সেই ‘নতুন বিশ্ব ইতিহাস’-এ কোনও জায়গা থাকবে না বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক ক্ষেত্রগুলিতে ইসলাম ধর্মের অবদান সংক্রান্ত আলোচনা। তেমনই থাকবে কম্যুনিজম তথা সমাজ বিপ্লবের সুস্পষ্ট কোনো ধারণা। ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ পাঠক্রম থেকে বাদ দিয়ে আসলে নতুন প্রজন্মের চেতনাকে গৈরিকিকরণের একমুখী ও ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা আচ্ছন্ন করতে চাওয়াই এই উদ্যোগের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই শিক্ষাবিদদের একাংশের।

Skip to content