সূর্যশিখা ছবির একটি দৃশ্য
লেখা শুরুতে নিজের ঢাকটা একটু পিটিয়ে নিই। তবে সেটা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না। বছর সাতেক আগে প্রভাত রায়ের একটি সিনেমাতে প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সিনেমাটির নাম ছিল ‘বিরাট ২২’। একটু অদ্ভুত নাম! আসলে মহাভারতের বিরাট পর্বের কথা মাথায় রেখেই এমন নামকরণ হয়েছিল। বলাই বাহুল্য চরিত্রটি ডাক্তারের এবং সেজন্যই আমাকে নির্বাচন। জোকায় নারায়ণী স্টুডিওতে পৌঁছে প্রভাত রায়ের মুখোমুখি বসলাম। নায়িকা ধর্ষিতা হয়েছেন। সারা দেহে মাল্টিপল ইনজুরি, কোমরের চোট, প্যারালাইসড, কোমা স্টেজে। সিনটা পড়ে দেখলাম, চলবে না। ডাক্তাররা এভাবে কথা বলেন না জুনিয়রদের সঙ্গে। ব্যাপারটাকে এস্টাবলিসড করার জন্য আমাকে সিনটা রি-রাইট করতে বললেন প্রভাতদা। করলাম। কিন্তু সেটে গিয়ে দেখলাম কোমরের এক্সরে বা এমআরআই প্লেটের বদলে মাথার সিটি স্ক্যান আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। প্রোডাকশনের স্টকে নাকি আর কিছু নেই। অগত্যা দু’চারটে সংলাপ পাল্টে দিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে সিনটাকে উতরে দেওয়া গেল। এটা সম্ভব হল আমার মতো ডাক্তার কাম অ্যাক্টরকে দিয়ে অভিনয়টা করানোর জন্য। তা না হলে ডাক্তারবাবু দর্শকদের মাথার স্ক্যান দেখিয়ে কোমর ভাঙার গল্প শোনাতেন।
আবার বহু পরিচালক-চিত্রনাট্যকার আগেভাগেই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে চিত্রনাট্য-সংলাপ সাজান। নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। ‘ডেফ অ্যান্ড ডামব’ নিয়ে জি বাংলায় একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক বছর পাঁচেক আগে দেখানো হতো। নাম ছিল ‘তুমি রবে নীরবে’। পরিচালক স্নেহাশিস চক্রবর্তী আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। যোগাযোগ করে বললাম, রোল দাও, তবে ডাক্তারের চরিত্র করব না প্লিজ। কয়েকদিন বাদে হোয়াটসঅ্যাপে স্নেহাশিস জানালো, ‘তোমাকে ডাক্তারের রোলই করতে হবে। তুমি ইএনটি স্পেশালিস্ট ডাক্তার অমিতাভ ভট্টাচার্য করছো, অর্থাৎ স্বনামে, স্বভূমিকায়। ডেফ অ্যান্ড ডামব হিরোকে কানে শোনাতে হবে। কথাও বলাতে হবে। এই যে তোমরা কি একটা অপারেশন করো না, সেটাও করে দেখাতে হবে।’
আমি তো পড়লাম অথৈ জলে। ফোন করলাম আমার প্রিয় মাস্টারমশাই মুশকিল আসান ডাঃ শান্তনু বন্দোপাধ্যায়কে। স্যার সব শুনে বললেন, ‘হিরোর খুব ছোটবেলায় ভাইরাল ল্যাবিরিনথাইটিস হয়েছিল। তারপর থেকেই কানে শুনছে না। পরবর্তীকালে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করে স্পিচ থেরাপি করে দেখা যেতে পারে।’ সেভাবেই সিনটার একটা সিনোপসিস লিখে ডিরেক্টরকে পাঠালাম। তাঁর পছন্দ হল। চিত্রনাট্যকার সেভাবেই চিত্রনাট্য সাজালেন। আমি যথারীতি আমার ভূমিকায় অভিনয় করে গেলাম। এমনকি স্টুডিওতে ওটি সাজিয়ে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করা হচ্ছে, এমন একটা দৃশ্য গ্রহণেরও ব্যবস্থা করলাম। মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু কোনও সিনেমার দৃশ্য নয় যে চিরকালের জন্য থেকে যাবে। এটা একটা সিরিয়ালের দৃশ্য মাত্র। আজ দেখলে কালকেই দর্শক ভুলে যাবে। তবু পরিচালক স্নেহাশিস খুব ডিটেলিং-এ যত্ন নিয়ে কাজটি করেছিলেন।
আর এখন তো সব, ধর তক্তা মার পেরেকের যুগ। সিনেমায় তবু কিছুটা ভেবেচিন্তে গুছিয়ে করার চেষ্টা হয়। অধিকাংশ বাংলা সিরিয়ালে সেই বালাই নেই। আর্টিস্ট মেকআপ নিয়ে বসে আছেন। অথচ সিন-ই আসেনি। এমন ঘটনা ইদানিং কালের বাংলা সিরিয়ালে আকছারই হচ্ছে। কাজেই ডাক্তার বা ডাক্তারি বিষয় নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময় নেই চিত্রনাট্যকার -পরিচালকদের। তাছাড়া সিরিয়ালের জগতে সর্বনিয়ন্ত্রক সংস্থা হলে এখন চ্যানেল। যাদের চোখে দেখা যায় না, অথচ ভয়ংকর ভাবে তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যায় প্রতিটি পদে। তাদের কথাই এখন শেষ কথা। ডিরেক্টর কিংবা প্রডিউসার তাদেরই মুখ চেয়ে চলেন, বলা ভালো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলতে বাধ্য হন।
একটা ঘটনা বলি। এক নিউরোলজিস্টের চেম্বারে এসেছেন এক ভদ্রলোক ছেলেকে দেখাতে। স্কুটার এক্সিডেন্টে ছেলেটির হেড ইনজুরি হয় মাস ছয়েক আগে, তারপর থেকে ধীরে ধীরে স্মৃতি লোপ পেতে শুরু করে। ডাক্তার ছেলেটিকে ভালো করে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখতে বসেন। উদ্বিগ্ন বাবা এই ফাঁকে সবিনয়ে ডাক্তারবাবুকে বললেন, আচ্ছা স্যার ওকে কোনও শক দিয়ে ঠিক করা যায় না! মানে ওই রকম আবার একটা স্কুটার এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে। মানে ওতেই যদি স্মৃতি ফিরে আসে। শুনে তো ডাক্তারের চোখ কপালে। ধাতস্থ হয়ে উনি সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, এমন সাজেশন আপনাকে কে দিল! চিকিৎসা শাস্ত্রে তো এইরকম কোনও থেরাপির উল্লেখ নেই। আজ্ঞে না স্যার কেউ দেয়নি। ভদ্রলোক শান্ত কণ্ঠে বললেন, সেদিন ওই লেট নাইটে একটা ফিল্মে দেখলাম কি না, এক গাড়ির গুঁতোই নায়কের স্মৃতি ভ্রম হল, আবার সিনেমার শেষে আরেক গাড়ির গুঁতোয় সেই স্মৃতি ফিরে এল, তাই ভাবছিলাম আর কী..!
আবার বহু পরিচালক-চিত্রনাট্যকার আগেভাগেই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে চিত্রনাট্য-সংলাপ সাজান। নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। ‘ডেফ অ্যান্ড ডামব’ নিয়ে জি বাংলায় একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক বছর পাঁচেক আগে দেখানো হতো। নাম ছিল ‘তুমি রবে নীরবে’। পরিচালক স্নেহাশিস চক্রবর্তী আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। যোগাযোগ করে বললাম, রোল দাও, তবে ডাক্তারের চরিত্র করব না প্লিজ। কয়েকদিন বাদে হোয়াটসঅ্যাপে স্নেহাশিস জানালো, ‘তোমাকে ডাক্তারের রোলই করতে হবে। তুমি ইএনটি স্পেশালিস্ট ডাক্তার অমিতাভ ভট্টাচার্য করছো, অর্থাৎ স্বনামে, স্বভূমিকায়। ডেফ অ্যান্ড ডামব হিরোকে কানে শোনাতে হবে। কথাও বলাতে হবে। এই যে তোমরা কি একটা অপারেশন করো না, সেটাও করে দেখাতে হবে।’
আমি তো পড়লাম অথৈ জলে। ফোন করলাম আমার প্রিয় মাস্টারমশাই মুশকিল আসান ডাঃ শান্তনু বন্দোপাধ্যায়কে। স্যার সব শুনে বললেন, ‘হিরোর খুব ছোটবেলায় ভাইরাল ল্যাবিরিনথাইটিস হয়েছিল। তারপর থেকেই কানে শুনছে না। পরবর্তীকালে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করে স্পিচ থেরাপি করে দেখা যেতে পারে।’ সেভাবেই সিনটার একটা সিনোপসিস লিখে ডিরেক্টরকে পাঠালাম। তাঁর পছন্দ হল। চিত্রনাট্যকার সেভাবেই চিত্রনাট্য সাজালেন। আমি যথারীতি আমার ভূমিকায় অভিনয় করে গেলাম। এমনকি স্টুডিওতে ওটি সাজিয়ে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করা হচ্ছে, এমন একটা দৃশ্য গ্রহণেরও ব্যবস্থা করলাম। মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু কোনও সিনেমার দৃশ্য নয় যে চিরকালের জন্য থেকে যাবে। এটা একটা সিরিয়ালের দৃশ্য মাত্র। আজ দেখলে কালকেই দর্শক ভুলে যাবে। তবু পরিচালক স্নেহাশিস খুব ডিটেলিং-এ যত্ন নিয়ে কাজটি করেছিলেন।
আর এখন তো সব, ধর তক্তা মার পেরেকের যুগ। সিনেমায় তবু কিছুটা ভেবেচিন্তে গুছিয়ে করার চেষ্টা হয়। অধিকাংশ বাংলা সিরিয়ালে সেই বালাই নেই। আর্টিস্ট মেকআপ নিয়ে বসে আছেন। অথচ সিন-ই আসেনি। এমন ঘটনা ইদানিং কালের বাংলা সিরিয়ালে আকছারই হচ্ছে। কাজেই ডাক্তার বা ডাক্তারি বিষয় নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময় নেই চিত্রনাট্যকার -পরিচালকদের। তাছাড়া সিরিয়ালের জগতে সর্বনিয়ন্ত্রক সংস্থা হলে এখন চ্যানেল। যাদের চোখে দেখা যায় না, অথচ ভয়ংকর ভাবে তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যায় প্রতিটি পদে। তাদের কথাই এখন শেষ কথা। ডিরেক্টর কিংবা প্রডিউসার তাদেরই মুখ চেয়ে চলেন, বলা ভালো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলতে বাধ্য হন।
একটা ঘটনা বলি। এক নিউরোলজিস্টের চেম্বারে এসেছেন এক ভদ্রলোক ছেলেকে দেখাতে। স্কুটার এক্সিডেন্টে ছেলেটির হেড ইনজুরি হয় মাস ছয়েক আগে, তারপর থেকে ধীরে ধীরে স্মৃতি লোপ পেতে শুরু করে। ডাক্তার ছেলেটিকে ভালো করে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখতে বসেন। উদ্বিগ্ন বাবা এই ফাঁকে সবিনয়ে ডাক্তারবাবুকে বললেন, আচ্ছা স্যার ওকে কোনও শক দিয়ে ঠিক করা যায় না! মানে ওই রকম আবার একটা স্কুটার এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে। মানে ওতেই যদি স্মৃতি ফিরে আসে। শুনে তো ডাক্তারের চোখ কপালে। ধাতস্থ হয়ে উনি সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, এমন সাজেশন আপনাকে কে দিল! চিকিৎসা শাস্ত্রে তো এইরকম কোনও থেরাপির উল্লেখ নেই। আজ্ঞে না স্যার কেউ দেয়নি। ভদ্রলোক শান্ত কণ্ঠে বললেন, সেদিন ওই লেট নাইটে একটা ফিল্মে দেখলাম কি না, এক গাড়ির গুঁতোই নায়কের স্মৃতি ভ্রম হল, আবার সিনেমার শেষে আরেক গাড়ির গুঁতোয় সেই স্মৃতি ফিরে এল, তাই ভাবছিলাম আর কী..!
পাঠকদের একটি বিখ্যাত বাংলা ছবির কথা মনে করিয়ে দিই। ‘হারানো সুর’। ছবিটিতে নায়ক উত্তম কুমারের ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটেছিল। গল্প এবং অভিনয়ের গুণে ছবিটি তখন খুব চলে ছিল, এখনও চলে এবং সাধারণ দর্শক ধরেই নেন, ঘটনাটি খুব স্বাভাবিক এবং সর্বাংশে সত্যি। আরেকটি অ্যাক্সিডেন্ট না হওয়া পর্যন্ত ১৪ রিলের ছবিটি আগ্রহের সঙ্গেই দেখেন এবং একবারও এই আজগুবি ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। সিনেমা-সিরিয়ালে কোনও অপারেশন থাকলেই দেখবেন, বাইরে লাল আলোর বোর্ড জ্বলে, ভিতরে অ্যানাস্থেটিসটের এয়ার ব্যাগ একবার ফোলে, একবার চুপসে যায়। মনিটরের পর্দায় রেখাগুলো ওঠানামা করে। খুবই রিয়ালিস্টিক অ্যান্ড টেন্সড সিচুয়েশন! দর্শকদের হৃদয়ের ধুকপুকানি বাড়ে। অপারেশন শেষে লাল আলোর বোর্ড নিভে যায়। ডাক্তার বাবু অপারেশনের পোশাক পরেই বাইরে বেরিয়ে এসে উদ্বিগ্ন আত্মীয় পরিজনকে বলেন, ৭২ ঘণ্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না। তবে অপারেশন সাকসেসফুল।
সিনেমার ডাক্তারবাবুরা মনে হয় অন্য গ্রহের জীব। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে তারা আবির্ভূত হন ঠিকই, কিন্তু বড় অস্বাভাবিক আচরণ করেন পর্দা জুড়ে। সিনেমা বাস্তবের ট্রু কপি হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। সিনেমার ডাক্তারবাবুরা পুরোপুরি বাস্তবের মতো হবেন, এমনটাও কেউ আশাও করেন না। কিন্তু একটা বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় তো ব্যাপারগুলোকে আনতে হবে। যদি কেউ স্টেথোস্কোপ উল্টো করে বুকে বসায়, হার্ট দেখায় বুকের উপরের দিকে, গ্লাভস ছাড়া ছুরি উল্টো করে ধরে অপারেশন করেন, তবে কেমন লাগে সেসব দেখতে! আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু তো ডাক্তারের হাতেই। জীবনে অসংখ্য বার তাদের মুখোমুখি হই আমরা। তাদের আচার-আচরণ, রোগী দেখার কায়দা, সবই তো মুখস্ত আমাদের। যে পেশার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি খুব কম, সেই পেশাকে ভুল ভাবে দেখালেও সাধারণ দর্শক সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু ডাক্তারি পেশার ব্যাপারে এই কথা খাটে কি!
যৌবনে দেখা দুটি ছবিতে ডাক্তারি ব্যাপারগুলো নিয়ে একটু বলি। প্রথম ছবিটি ছিল ‘অনুরাগের ছোঁয়া।’ নায়কের মাঝে মধ্যেই মাথায় যন্ত্রণা হতো, তার থেকে স্মৃতিলোপ। বাড়ি ছেড়ে পালালেন। পথে ট্রেনে এক গ্রামের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে ব্রেন সার্জারি করে নায়কের স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন। কার উর্বর মস্তিষ্কের পরিকল্পনা এটি কে জানে! আবার সুখেন দাসের সুপারহিট ‘মিলন তিথি’ ছবিতে এক গাঁয়ের ডাক্তার ক্যানসারের স্টেজিং পর্যন্ত বলে দিয়েছিলেন নায়িকার বায়োপসি বা কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই।
সিনেমার ডাক্তারবাবুদের দেখে ডাক্তার সমাজ সম্বন্ধে আমাদের কতগুলো অবাস্তব ধারণা গড়ে ওঠে মনের ভেতর। তাঁরা হয় খুব মহান হন, তা না হলে অর্থ পিশাচ। মহান ডাক্তারবাবুরা নিজের ঘর সংসার, স্ত্রী সন্তানকে ফেলে গ্রামেগঞ্জে গরিব মানুষের সেবায় জীবন দান করেন। গত শতাব্দীর তিরিশ দশকের ছবি শৈলজানন্দর ‘ডাক্তার’ ছবির নায়ক পঙ্কজ মল্লিক, ‘গৃহদাহ’-র প্রদীপ কুমার, ‘হাটে বাজারে’-র অশোক কুমার, ‘অগ্নীশ্বর’-র উত্তম কুমার, ‘ক্ষণিকের অতিথি’-র নির্মল কুমার.. এঁরা প্রত্যেকেই আদর্শবাদী মানব সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ ডাক্তার। বাস্তবের ডাক্তারদের সঙ্গে এঁদের মেলাতে গেলে হোঁচট খেতে হবে। আবার এমনও দেখি হিরো নার্সিংহোমে ভর্তি হল। অপারেশনের জন্য সার্জেন ফি হাঁকিয়ে বসলেন তিন লক্ষ টাকা! ব্যস, হিরো নার্সিংহোমের বেড ছেড়ে সরাসরি রাজপথে নেমে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করতে শুরু করলেন।
মেলোড্রামা তৈরির জন্য বা কোনও চরিত্রকে মেরে ফেলার জন্য এক সময় আকছার টিবি রোগের ব্যবহার হতো। স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কৃত হওয়ার বহু বছর বাদেও এইসব চরিত্ররা দাপটে বাংলা সিনেমায় রাজত্ব করে গিয়েছেন। নায়কের মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বেহালার প্যাথোজ, তারপর একসময় নায়ক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন… এমন দৃশ্য বহু ছবিতে দেখে আমাদের দু’চোখে জলের বান ডেকেছে। প্রয়াত সুখেন দাসের বহু ছবির কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। টিবি-র যুগ শেষ। নায়ক- নায়িকাকে মারতে এখন ঘন ঘন ডাক পড়ছে ক্যানসার রোগটির। ছুটি, আনন্দ, মিলি, জীবন মরণ, মিলন তিথি-সহ বহু সিনেমায় ক্যানসারের ছড়াছড়ি। নানা ধরনের ক্যানসারের মধ্যে আবার ব্লাড ক্যানসার লিউকিমিয়ার কদর বেশি চিত্রনাট্যকারদের কাছে। এক সময় প্লেগ নিয়েও ‘গৃহদাহ’-র মতো হিট ছবি হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে ডেঙ্গিও নিয়ে হবে, করোনা নিয়ে তো হবেই। তবে ক্যানসারের মতো পপুলারিটি কোনও রোগই পাবে বলে মনে হয় না! ক্যানসার মানেই মৃত্যু, এর কোনও চিকিৎসাই নেই, এমন একটা ভুল মেসেজ এই ধরনের সিনেমাগুলো আমাদের ধারাবাহিক ভাবে দিয়েই যাচ্ছে।
সিনেমার ডাক্তারবাবুরা মনে হয় অন্য গ্রহের জীব। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে তারা আবির্ভূত হন ঠিকই, কিন্তু বড় অস্বাভাবিক আচরণ করেন পর্দা জুড়ে। সিনেমা বাস্তবের ট্রু কপি হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। সিনেমার ডাক্তারবাবুরা পুরোপুরি বাস্তবের মতো হবেন, এমনটাও কেউ আশাও করেন না। কিন্তু একটা বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় তো ব্যাপারগুলোকে আনতে হবে। যদি কেউ স্টেথোস্কোপ উল্টো করে বুকে বসায়, হার্ট দেখায় বুকের উপরের দিকে, গ্লাভস ছাড়া ছুরি উল্টো করে ধরে অপারেশন করেন, তবে কেমন লাগে সেসব দেখতে! আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু তো ডাক্তারের হাতেই। জীবনে অসংখ্য বার তাদের মুখোমুখি হই আমরা। তাদের আচার-আচরণ, রোগী দেখার কায়দা, সবই তো মুখস্ত আমাদের। যে পেশার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি খুব কম, সেই পেশাকে ভুল ভাবে দেখালেও সাধারণ দর্শক সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু ডাক্তারি পেশার ব্যাপারে এই কথা খাটে কি!
যৌবনে দেখা দুটি ছবিতে ডাক্তারি ব্যাপারগুলো নিয়ে একটু বলি। প্রথম ছবিটি ছিল ‘অনুরাগের ছোঁয়া।’ নায়কের মাঝে মধ্যেই মাথায় যন্ত্রণা হতো, তার থেকে স্মৃতিলোপ। বাড়ি ছেড়ে পালালেন। পথে ট্রেনে এক গ্রামের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে ব্রেন সার্জারি করে নায়কের স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন। কার উর্বর মস্তিষ্কের পরিকল্পনা এটি কে জানে! আবার সুখেন দাসের সুপারহিট ‘মিলন তিথি’ ছবিতে এক গাঁয়ের ডাক্তার ক্যানসারের স্টেজিং পর্যন্ত বলে দিয়েছিলেন নায়িকার বায়োপসি বা কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই।
সিনেমার ডাক্তারবাবুদের দেখে ডাক্তার সমাজ সম্বন্ধে আমাদের কতগুলো অবাস্তব ধারণা গড়ে ওঠে মনের ভেতর। তাঁরা হয় খুব মহান হন, তা না হলে অর্থ পিশাচ। মহান ডাক্তারবাবুরা নিজের ঘর সংসার, স্ত্রী সন্তানকে ফেলে গ্রামেগঞ্জে গরিব মানুষের সেবায় জীবন দান করেন। গত শতাব্দীর তিরিশ দশকের ছবি শৈলজানন্দর ‘ডাক্তার’ ছবির নায়ক পঙ্কজ মল্লিক, ‘গৃহদাহ’-র প্রদীপ কুমার, ‘হাটে বাজারে’-র অশোক কুমার, ‘অগ্নীশ্বর’-র উত্তম কুমার, ‘ক্ষণিকের অতিথি’-র নির্মল কুমার.. এঁরা প্রত্যেকেই আদর্শবাদী মানব সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ ডাক্তার। বাস্তবের ডাক্তারদের সঙ্গে এঁদের মেলাতে গেলে হোঁচট খেতে হবে। আবার এমনও দেখি হিরো নার্সিংহোমে ভর্তি হল। অপারেশনের জন্য সার্জেন ফি হাঁকিয়ে বসলেন তিন লক্ষ টাকা! ব্যস, হিরো নার্সিংহোমের বেড ছেড়ে সরাসরি রাজপথে নেমে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করতে শুরু করলেন।
মেলোড্রামা তৈরির জন্য বা কোনও চরিত্রকে মেরে ফেলার জন্য এক সময় আকছার টিবি রোগের ব্যবহার হতো। স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কৃত হওয়ার বহু বছর বাদেও এইসব চরিত্ররা দাপটে বাংলা সিনেমায় রাজত্ব করে গিয়েছেন। নায়কের মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বেহালার প্যাথোজ, তারপর একসময় নায়ক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন… এমন দৃশ্য বহু ছবিতে দেখে আমাদের দু’চোখে জলের বান ডেকেছে। প্রয়াত সুখেন দাসের বহু ছবির কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। টিবি-র যুগ শেষ। নায়ক- নায়িকাকে মারতে এখন ঘন ঘন ডাক পড়ছে ক্যানসার রোগটির। ছুটি, আনন্দ, মিলি, জীবন মরণ, মিলন তিথি-সহ বহু সিনেমায় ক্যানসারের ছড়াছড়ি। নানা ধরনের ক্যানসারের মধ্যে আবার ব্লাড ক্যানসার লিউকিমিয়ার কদর বেশি চিত্রনাট্যকারদের কাছে। এক সময় প্লেগ নিয়েও ‘গৃহদাহ’-র মতো হিট ছবি হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে ডেঙ্গিও নিয়ে হবে, করোনা নিয়ে তো হবেই। তবে ক্যানসারের মতো পপুলারিটি কোনও রোগই পাবে বলে মনে হয় না! ক্যানসার মানেই মৃত্যু, এর কোনও চিকিৎসাই নেই, এমন একটা ভুল মেসেজ এই ধরনের সিনেমাগুলো আমাদের ধারাবাহিক ভাবে দিয়েই যাচ্ছে।
বালিগঞ্জ কোর্ট
তাই বলে ডাক্তারি ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ভালো ছবি তৈরি হয়নি, তা কিন্তু নয়। অনেক ছবি হয়েছে। আমার বিচার চারটি শ্রেষ্ঠ ছবি হল ‘প্রভাতের রং’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘হাটে বাজারে’ ও ‘অগ্নীশ্বর’। হিন্দিতে ‘আনন্দ’ ও ‘মিলি’। ‘প্রভাতের রং’ ছবিটিতে এক ডাক্তারি ছাত্রের ছাত্র জীবনের নানা সমস্যা-সংঘাত, উত্থান-পতন, প্রেম ইত্যাদি ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। অপারেশনের দৃশ্যগুলো তোলা হয়েছিল আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ডাঃ অজিত অধিকারী ও ডাঃ মনীশ প্রধানের তত্ত্বাবধানে। তবে এই ছবির সাফল্যের নেপথ্যের দুই কান্ডারি হলেন কাহিনীকার ডাঃ বিশ্বনাথ রায় এবং সুযোগ্য পরিচালক অজয় কর। এই অজয়বাবুরই আরেকটি ছবি তারাশঙ্করের ‘সপ্তপদী’কে যুগোত্তীর্ণ বললে অত্যুক্তি বলা হয় না। এছাড়া অজয় করের ‘মাল্যদান’ এবং ‘দত্তা’ ছবিতেও ডাক্তারি ব্যাপারগুলো খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই দেখানো হয়েছে।
তারাশঙ্করের অমর সৃষ্টি ‘আরোগ্য নিকেতন’। বিজয় বসু পরিচালিত এই সিনেমায় আয়ুরবেদাচার্য জীবন মশায়ের ভূমিকায় বিকাশ রায় এবং তরুণ এলোপ্যাথ ডাক্তারের ভূমিকায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। একটি গ্রামীণ হাসপাতালের দৃশ্যায়নও স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ‘হাটে বাজারে’ এবং ‘হসপিটাল’ ছবিতে অশোক কুমার ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ডাক্তারি বিষয়ক কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি সহজেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সুদক্ষ পরিচালকের পরিচালনার গুনে। মোবাইল ভ্যানে চিকিৎসার পরিকল্পনা প্রায় ৬০ বছর আগে বনফুলের মাথায় কীভাবে এসেছিল, তা কে জানে! তবে আজ কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে অগ্নীশ্বর মুখার্জির চরিত্রটি কাহিনীকার বনফুল অর্থাৎ ডাঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় দেখা একটি বাস্তব রক্তমাংসের চরিত্র। যদিও এমন সর্বত্যাগী, অতি নিয়ম-নিষ্ঠ, মানব সেবায় উৎসর্গিকৃত প্রাণ ডাক্তারকে বাস্তবের ডাক্তার বলে মেনে নিতে মন চায় না, বরং সুপারম্যান বলেই মনে হয়। তবে এমন ডাক্তারের সন্ধান মাঝেমধ্যে কিন্তু এখনও মেলে। এই ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় অসাধারণ বললে কম বলা হয়।
এছাড়া শৈলজানন্দর ‘শহর থেকে দূরে’, যেটি তরুণ মজুমদার পরবর্তীকালে রিমেক করেছিলেন, অসিত সেনের ‘চলাচল’ এবং ‘দীপ জ্বেলে যাই’, তপন সিংহের ‘ক্ষণিকের অতিথি’, অরুন্ধতী দেবীর ‘ছুটি’, যাত্রিকের ‘কাঁচের স্বর্গ’, সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘শাখা প্রশাখা’, নিউ থিয়েটার্সের ‘ডাক্তার’ যেখানে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজকুমার মল্লিক অভিনয় করেছিলেন… সেই সব ছবিতে ডাক্তারের চরিত্রায়ন এবং ডাক্তারি বিষয়গুলো বাস্তবসম্মতভাবেই পরিবেশিত হয়েছে। এইসব ছবির অধিকাংশর নেপথ্যেই উপদেশক হিসাবে কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম পর্দায় দেখানো হয়েছে। এই উপদেশকের কাজটি আমাকেও করতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ছবিতে, যে কথা আমি আগেই বলেছি, তরুণ মজুমদারের ‘সজনী গো সজনী’, ‘অঙ্গার’, জি বাংলার সিরিয়াল ‘তুমি রবে নীরবে’ ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্টকে নিয়ে রোগীর বাড়িতেই যে টেনসড আ্যটমোস্ফিয়ার তৈরি করা হয়েছিল, সেটি আমার কাছে খুব কনভিনসিং লেগেছে। সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট, তার জুনিয়র, নার্স, অক্সিজেন, কন্টিনুয়াস মনিটরিং-ভেরি মাচ রিয়েলিস্টিক।
এত বছর বড় পর্দা এবং ছোট পর্দায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলব্ধি হয়েছে, পরিচালক যদি ভালো হন, নায়ক-নায়িকা যদি চরিত্রের পিছনে সেরাটুকু দিতে চান, ডাক্তার চরিত্রে যদি কোনও ডাক্তার কাম অভিনেতা অভিনয় করেন, ডাক্তারি ব্যাপারগুলো চিত্রায়িত করার জন্য যদি কোনও ডাক্তারের পরামর্শ মতো পরিচালক এগোন, তাহলে সেই সিনেমার ডাক্তারি বিষয়গুলো শিল্প-সম্মত হয়েও বাস্তব অনুসারী হয়।
আমার খুব কাছের মানুষ প্রয়াত শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় এক ঘরোয়া আড্ডায় এই বিষয়ে আমায় যা বলেছিলেন তা শুভেন্দুদার কথাতেই তুলে ধরছি। ছবির নাম ছিল ‘সূর্যশিখা’।’ আমি তখন মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এক বন্ধুর সঙ্গে স্টুডিওতে গিয়েছি শ্যুটিং দেখতে। আমি ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারে পড়ি শুনে ছবির নায়ক ডাক্তারি বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি আমার কাছে জানতে চাইলেন। যেমন অপারেশনের সময় ছুরিটা কীভাবে ধরতে হয়, স্টিচ দিতে গেলে সুচটা কীভাবে নিডল হোল্ডারে লাগাতে হয়, কতটা রেজিস্ট্যান্স দিতে হয়… এমন সব ডিটেলিংস। নায়কের এই নিষ্ঠা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, এই নায়কটি আর কেউ নন, বাঙালির নয়নের মণি মহানায়ক উত্তম কুমার।
তারাশঙ্করের অমর সৃষ্টি ‘আরোগ্য নিকেতন’। বিজয় বসু পরিচালিত এই সিনেমায় আয়ুরবেদাচার্য জীবন মশায়ের ভূমিকায় বিকাশ রায় এবং তরুণ এলোপ্যাথ ডাক্তারের ভূমিকায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। একটি গ্রামীণ হাসপাতালের দৃশ্যায়নও স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ‘হাটে বাজারে’ এবং ‘হসপিটাল’ ছবিতে অশোক কুমার ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ডাক্তারি বিষয়ক কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি সহজেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সুদক্ষ পরিচালকের পরিচালনার গুনে। মোবাইল ভ্যানে চিকিৎসার পরিকল্পনা প্রায় ৬০ বছর আগে বনফুলের মাথায় কীভাবে এসেছিল, তা কে জানে! তবে আজ কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে অগ্নীশ্বর মুখার্জির চরিত্রটি কাহিনীকার বনফুল অর্থাৎ ডাঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় দেখা একটি বাস্তব রক্তমাংসের চরিত্র। যদিও এমন সর্বত্যাগী, অতি নিয়ম-নিষ্ঠ, মানব সেবায় উৎসর্গিকৃত প্রাণ ডাক্তারকে বাস্তবের ডাক্তার বলে মেনে নিতে মন চায় না, বরং সুপারম্যান বলেই মনে হয়। তবে এমন ডাক্তারের সন্ধান মাঝেমধ্যে কিন্তু এখনও মেলে। এই ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় অসাধারণ বললে কম বলা হয়।
এছাড়া শৈলজানন্দর ‘শহর থেকে দূরে’, যেটি তরুণ মজুমদার পরবর্তীকালে রিমেক করেছিলেন, অসিত সেনের ‘চলাচল’ এবং ‘দীপ জ্বেলে যাই’, তপন সিংহের ‘ক্ষণিকের অতিথি’, অরুন্ধতী দেবীর ‘ছুটি’, যাত্রিকের ‘কাঁচের স্বর্গ’, সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘শাখা প্রশাখা’, নিউ থিয়েটার্সের ‘ডাক্তার’ যেখানে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজকুমার মল্লিক অভিনয় করেছিলেন… সেই সব ছবিতে ডাক্তারের চরিত্রায়ন এবং ডাক্তারি বিষয়গুলো বাস্তবসম্মতভাবেই পরিবেশিত হয়েছে। এইসব ছবির অধিকাংশর নেপথ্যেই উপদেশক হিসাবে কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম পর্দায় দেখানো হয়েছে। এই উপদেশকের কাজটি আমাকেও করতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ছবিতে, যে কথা আমি আগেই বলেছি, তরুণ মজুমদারের ‘সজনী গো সজনী’, ‘অঙ্গার’, জি বাংলার সিরিয়াল ‘তুমি রবে নীরবে’ ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্টকে নিয়ে রোগীর বাড়িতেই যে টেনসড আ্যটমোস্ফিয়ার তৈরি করা হয়েছিল, সেটি আমার কাছে খুব কনভিনসিং লেগেছে। সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট, তার জুনিয়র, নার্স, অক্সিজেন, কন্টিনুয়াস মনিটরিং-ভেরি মাচ রিয়েলিস্টিক।
এত বছর বড় পর্দা এবং ছোট পর্দায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলব্ধি হয়েছে, পরিচালক যদি ভালো হন, নায়ক-নায়িকা যদি চরিত্রের পিছনে সেরাটুকু দিতে চান, ডাক্তার চরিত্রে যদি কোনও ডাক্তার কাম অভিনেতা অভিনয় করেন, ডাক্তারি ব্যাপারগুলো চিত্রায়িত করার জন্য যদি কোনও ডাক্তারের পরামর্শ মতো পরিচালক এগোন, তাহলে সেই সিনেমার ডাক্তারি বিষয়গুলো শিল্প-সম্মত হয়েও বাস্তব অনুসারী হয়।
আমার খুব কাছের মানুষ প্রয়াত শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় এক ঘরোয়া আড্ডায় এই বিষয়ে আমায় যা বলেছিলেন তা শুভেন্দুদার কথাতেই তুলে ধরছি। ছবির নাম ছিল ‘সূর্যশিখা’।’ আমি তখন মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এক বন্ধুর সঙ্গে স্টুডিওতে গিয়েছি শ্যুটিং দেখতে। আমি ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারে পড়ি শুনে ছবির নায়ক ডাক্তারি বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি আমার কাছে জানতে চাইলেন। যেমন অপারেশনের সময় ছুরিটা কীভাবে ধরতে হয়, স্টিচ দিতে গেলে সুচটা কীভাবে নিডল হোল্ডারে লাগাতে হয়, কতটা রেজিস্ট্যান্স দিতে হয়… এমন সব ডিটেলিংস। নায়কের এই নিষ্ঠা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, এই নায়কটি আর কেউ নন, বাঙালির নয়নের মণি মহানায়ক উত্তম কুমার।