মধুমেহ বা ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোনও বয়স নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধুমেহ হল এমন একটা অসুখ যেটা একবার দেখা দিলে তা প্রায় চিরস্থায়ী একটা রোগ হিসেবে থেকেই যায়। ছোট বা বড় যে কোনও বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ডায়াবিটিস ধরা পড়লে তাকে প্রাথমিক পর্যায়ে হিসেবেই দেখা হয়। সেক্ষেত্রে মধুমেহ বা ডায়াবিটিস সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে বয়স যদি ছয় মাসের বেশি হয় তাহলে তা সাধারণত চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পরিবারে বাবা-মা দু’ জনেই ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের ছোট সদস্য ডায়াবিটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই পরিবারের ছোট সদস্যের দিকে বাড়তি সর্তকতা বা বাড়তি নজর রাখা প্রয়োজন। শিশুদের মধ্যে প্রধানত টাইপ-১ ডায়াবেটিসই বেশি দেখা যায়।
একজন শিশুর খাদ্য তালিকায় সাধারণত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে থাকে। একজন শিশু প্যানকেক, কর্ণফ্লেক্স, ম্যাগি, মোমো, চিপস, বার্গার, চকোলেট এই সমস্ত খাবার খেতেই বেশি পছন্দ করে। আর প্রতিটা খাবারই রক্তে শর্করার পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। ফলস্বরূপ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়।
এখনকার জীবনযাত্রায় শিশু থেকে কিশোর-কিশোরী কেউই সে ভাবে বাইরে গিয়ে খেলাধুলা বা শরীরচর্চা করে না। হয় তারা পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে অথবা ফোনের মধ্যে ডুবে থাকে। আর এই অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়।
কী কী উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হবেন?
● ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া। বার বার প্রস্রাব করাও কিন্তু ডায়াবিটিসের লক্ষণ। সন্তান যদি বার বার বাথরুমে যায়, তা হলে বুঝতে হবে তার রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়েছে।
● বার বার জল খেয়েও পিপাসা মিটছে না। এটি কিন্তু ডায়াবিটিসের লক্ষণ। ডায়াবিটিসের কারণে জিভে লালার পরিমাণ কমে যায়। তাই গলা শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যাও হয়। ডায়াবিটিসের মাত্রা অনেক বাড়লে তা থেকে গলায় জ্বালা, আলসার, সংক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে।
● শরীর দুর্বল লাগতে পারে।
● সব সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকা।
● শিশুর শরীরে মাঝেমধ্যেই র্যাাশ বেরোচ্ছে? গা-হাত-পায়ে কালো ছোপ পড়ছে? তা হলে কিন্তু সতর্ক হতে হবে।
● খিদে বেড়ে যাওয়া।
● সময় মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা মাত্রা কমে যাওয়া।
● মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া।
● কোনও কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া।
● দ্রুত ক্ষত শুকতে না চাওয়া।
● দাঁত মাজার সময় মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ। ডায়াবিটিস থাকলেও মাড়িতে প্রদাহ হয়। তার ফলে মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। শিশুর মুখের ভিতরের অংশ, জিভে মাঝেমাঝেই ঘা হলে বা জ্বালা করলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
● ত্বক শুষ্ক ও খসখসে ভাব, চুলকানি ইত্যাদি।
● বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা।
● চোখে কম দেখতে শুরু করা। শিশুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে? এর কারণ কিন্তু কেবল টিভি দেখার বা মোবাইল ঘাঁটা না-ও হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদেরও চোখের সমস্যা হতে পারে।
তাহলে কী করণীয়?
শিশুদের মধুমেহর রোগ প্রতিরোধ করতে কিছু উপায় অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন—
● এই আধুনিক জীবনে ছোটদের খেলার মাঠের পরিবর্তে ভিডিও গেমের রিমোট হাতে বেশি দেখা যায়। এর ফলে শিশুর সঠিক বিকাশ হয় না। কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা শরীরচর্চা করতে হবে। প্রতি দিন অন্তত ঘণ্টাখানেক দৌঁড়ঝাপ করা উচিত।
● বয়সের তুলনায় শিশুর ওজন যদি বেশি থাকে তা হলে সর্বপ্রথম নিয়ন্ত্রণে আনুন ওজন। শুধু ডায়াবেটিস নয়, অন্য আরও অনেক ধরনের রোগের ক্ষেত্রেও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। তেমন দরকার হলে চিকিৎসক পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিশুর উপযুক্ত একটি ডায়েট চার্ট বানিয়ে নিতে পারেন।
● সব সময় খেয়াল রাখতে হবে নিত্যদিনের ডায়েটে এমন খাওয়ার রাখতে হবে তাতে যেন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
● শিশুর স্বাস্থ্যের যত্নে রোজদিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। সময় মতো খাবার খেলে হজমজনিত সমস্যাও কমবে।
● খাদ্য তালিকায় বেশি বেশি ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার রাখতে হবে। যেমন: ফলমূল, শাক-সব্জি ইত্যাদি। তবে বেশি মিষ্টি জাতীয় ফল যেমন আম, কাঁঠাল বেশি না খাওয়াই ভালো।
● গম, ভুট্টা, বার্লি ইত্যাদি থেকে তৈরি খাবার যেমন ব্রেড বা পাস্তাজাতীয় খাবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে এই সব খাবার পাতে রাখা যায়।
● সকালের প্রাতরাশে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে বেশি করে ফলও রাখুন।
● খাদ্য তালিকা থেকে শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার খুবই অল্প পরিমাণে রাখতে হবে।
● চকোলেট হোক বা কেক, বাচ্চারা মিষ্টি জাতীয় খাবাব খেতে সব সময়ই ভালোবাসে। বাড়ির বড়দের খেয়াল রাখতে হবে যাতে শিশু অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার না খেয়ে ফেলে।
● চাল থেকে তৈরি খাবারা অল্প পরিমাণে খেতে হবে। তবে দুধ খেতে বাধা নেই।
যোগাযোগ: ৯৮৩০৭৬৮১৫২
* হেলদি ডায়েট (Healthy Diet): সুতনুকা পাল (Sutanuka Paul), পুষ্টিবিদ, ডায়েট-টু-ফাইট।