রবিবার ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ কার্যালয়ে পৌঁছে দেখেন তাঁর ছাত্ররা তাঁর জন্মদিন পালনের আয়োজন করেছেন। তিনি বলেন, এই দিনটি অন্যভাবে উদযাপন করতে। এই মহান শিক্ষকের জন্মদিনটিকে তাই ‘জাতীয় শিক্ষক দিবসে’র মর্যাদা দেওয়া হয়। রাধাকৃষ্ণাণ ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। তিনি একজন বিশ্বমানের শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও গবেষক। তাই সারা পৃথিবী ৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করলেও ভারতে ৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয় জাতীয় শিক্ষক দিবস।

এটি জাতীয় ছুটির দিন নয়। জাতীয় শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের দিন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে যে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা প্রাচীন ভারতের গুরু-শিষ্য পরম্পরা থেকে আজকের ‘দেওয়া-নেওয়ার’ যুগেও টিকে আছে, তা উদযাপনের জন্যই এই দিনটির পালন। রামকৃষ্ণ মিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে আমার জীবনের আটটি বছর কেটেছে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের সুমধুর এক আবহে। তাই অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এই দিনটি সম্পর্কে লিখতে বসে স্মৃতির পাতাগুলো উলটে চলেছি মনে মনে।
২০১৫-১৬ সালে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে তখন পড়ি রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রহড়াতে। ৫ সেপ্টেম্বর স্কুলের সবচেয়ে উঁচু ক্লাসের দাদারা ক্লাস নিতে আসত। স্যারেদের সেদিনের মতো ছুটি দেওয়া হতো, শিক্ষার আলো বিস্তারের যে ব্যাটন তাঁরা অবিরাম বয়ে চলেছেন তা অন্তত একদিনের জন্য তুলে দিতেন ছাত্রদের হাতে। এইটের দাদারাও যথেষ্ট পড়াশোনা করে আসত ছোটোদের পড়ানোর জন্য। তবে শুধু পড়াশুনার নয়, আমরা ছোটরা অনেক সময়ই চাইতাম ওইদিনে একটু কুইজ, কিংবা মজার কিছু হোক। এবং তেমন তেমন দাদা এলে সে আশাও পূর্ণ হতো।
আরও পড়ুন:

উচ্চ মাধ্যমিকে দশের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না, তবে মন বলছিল—আমি পারব

শিক্ষক দিবসে উজ্জ্বল হোক ছাত্রছাত্রীরা

২০১৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম। সেবারের ব্যাটন এল আমাদের হাতে। ক্লাসও ঠিক করে দিলেন স্যার। আমরা নিজের নিজের পছন্দের বিষয় পড়ে এলাম। আমি ঠিক করলাম বাংলা পড়াব। কারণ অঙ্ক করতে ভালো লাগলেও ওতে পড়ানোর মতো কী আছে তখন বুঝতাম না, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পড়ানোর পাণ্ডিত্য তখনও আসেনি। আর বাংলা তো চিরকালের ভালো লাগার বিষয়।

পঞ্চম শ্রেণিতে ছিল প্রথম ক্লাস। মনে আছে শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘একলা’ কবিতাটা পড়িয়েছিলাম, ওরা কতটা শুনেছিল জানি না, আমার মনে ভালোলাগার একটা ফোয়ারা জেগে উঠেছিল। তারপর সেভেনে ক্লাস নিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-বিদ্যাসাগরের রচনা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলেছিলাম। একটু কবিতাও হয়তো লিখেছিলাম। চমৎকার অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

নবম শ্রেণিতে উঠে জুনিয়র হাই স্কুল ছেড়ে চলে এলাম রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রহড়াতে। সেবার শিক্ষক দিবসে (২০১৯ সালে) আমাদের অঙ্ক করালো দাদারা। বিশেষ ভালো লাগেনি। কিন্তু অনেকে বলল ওদের দর্শন পড়িয়েছে, নাটক করার পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছে। নিজের ভাগ্যের জন্য একটু আফশোস হয়েছিল।

২০২০ এল। মার্চে এল কোভিড। সেবারের শিক্ষক দিবস মাঠে মারা পড়ল। স্কুল খোলা-না-খোলার দোলাচলে ২০২০ সাল কেটে গেল। মাধ্যমিক হওয়া-না-হওয়ার দোলাচলে কেটে গেল ২০২১ এর প্রথম কটা মাস। নতুন জীবন শুরু হলো নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৩: মালিকা পরিলে গলে/ প্রতি ফুলে কে-বা মনে রাখে?…

কিন্তু কোভিডের জন্য প্রথম স্কুল শুরু হল নভেম্বর মাসে। শিক্ষক দিবস ততদিনে পেরিয়ে গেছে। তাই ওখানে দাদাদের ছাত্র হওয়া হলো না। নিজেরাই শিক্ষক হয়ে গেলাম পরের বছর ২০২২ সালে। নরেন্দ্রপুরে শিক্ষক দিবসে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ক্লাস নিতে হয়। সেদিন আমাদেরও ক্লাস ছিল। জয়েন্টের কোচিং ক্লাস। প্রার্থনার পর আমরাও আমাদের মতো পড়ানোর জন্য চলে গেলাম। ভেবেই রেখেছিলাম একটু মজা করব।

অষ্টম শ্রেণিতে ঢুকেই বললাম—ধর এটা ওরিয়েন্টাল সেমিনারি (সালটাও বলেছিলাম, বলেছিলাম শিক্ষকের নামটাও)। একজন স্যার এক ছাত্রকে বললেন, তুমি নাকি কবিতা লেখো। এই লাইন দুটো মিল করে দাও তো।

রবি করে জ্বালাতন আছিল সবাই
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।


তারপর আমার ছাত্রদের তার মিল করতে বললাম। তারাও চেষ্টা করল। শেষে বললাম সেই বিশেষ ছাত্রটির দেওয়া উত্তরটা।

মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে
এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।
ছাত্রটি বালক রবীন্দ্রনাথ।
এমন আরও কথায় কথায় শেষ হয়ে গেল ক্লাসের সময়। শেষ হয়ে গেল রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল জীবনের আটটা শিক্ষক দিবস, চলে গেল আটটা বসন্ত। এই চলে যাওয়া, এগিয়ে চলার নামই জীবন। সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাওয়া কিছু স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের ভার। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তেমনই এক মধুর সম্পর্ক, যা গড়ে ওঠে পবিত্র জ্ঞান, মধুর স্নেহ আদান-প্রদানের মাধ্যমে।

ভবিষ্যতে যারা শিক্ষক হবে, তাদের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ার আগে তাদের তৈরি করে নেওয়া বর্তমানে এআই( আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এর যুগেও প্রয়োজন। চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) এর দৌলতে প্রোগ্রামিং করা যায়, পাওয়া যায় বহু প্রশ্নের উত্তর, তবু কোথায় যেন শোনা যায় না নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দাম’ গল্পের সেই ‘সুকুমার’ ডাকটা।

বয়ে চলা জীবনের তরীকে থমকে দিয়ে যে ডাক একবার ভাবিয়ে তোলে—যা পেয়েছি তা গ্রহণ করেছি, কিন্তু প্রতিদানে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্বও বর্তায় আমাদের উপর। শিক্ষক দিবস তেমনই একটা দিন। ভাবার দিন, ভাবতে শেখানোর দিন।
* অর্ক ঘোষ, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭তম স্থান অধিকারী। আইআইটি খড়্গপুরে ইন্সট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইলেকট্রিক্যাল) প্রথম বর্ষের ছাত্র।

Skip to content