শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

শিরোনামটি দেখেই যে প্রশ্নটা অনেকের মনে আসতে পারে তা হল: পালি কী? এর জবাব দিতে গেলে অনেক কথা লিখতে হবে। কিন্তু এই পরিসরে তা সম্ভব নয়। অতএব অলমতি বিস্তরেণ।

প্রাচীন উত্তর ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত একটি ভাষা হল পালি। ভগবান গৌতম বুদ্ধ (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক) খুব সম্ভবত এই ভাষার মাধ্যমে তাঁর উপদেশ তথা বাণী সকলের উদ্দেশ্যে প্রচার করেছিলেন। পরবর্তীকালে থেরবাদ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের (মতান্তরে হীনযান) ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক রচনাগুলিও এই ভাষায় রচিত হয়েছিল। এই সূত্রে বর্তমানে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার গোষ্ঠীভুক্ত এই ভাষাটির চর্চা বা প্রচলন ভারতবর্ষে সীমিত হয়ে গেলেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তত ১৮টি দেশে থেরবাদ বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এই ভাষার বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়াও একাডেমিক পরিসরে এশিয়ার বাইরে ইউরোপ-আমেরিকার প্রচুর দেশে এই ভাষার চর্চা (গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে) ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।

পালি নিয়ে গৌরচন্দ্রিকার পরে মূল প্রসঙ্গে আসার আগে একটু জেনে নিই কেরিয়ার বলতে আমরা সাধারণত কী বুঝি। কেরিয়ার কথাটির প্রতিশব্দ হল কর্মজীবন। মানে যার দ্বারা আমরা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করি। আমাদের কেরিয়ার মূলত তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। যথা: শিক্ষণ (Education) প্রশিক্ষণ (Training) এবং কর্ম-অভিজ্ঞতা (work experience)। আপাতত আমরা আমাদের আলোচনাটিকেও এই পরিপ্রেক্ষিতেই বেঁধে রাখার চেষ্টা করব।

শিক্ষণ
পশ্চিমবঙ্গে পালি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধুনা প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে (পূর্বতন সংস্কৃত কলেজ) স্নাতক স্তরে পালি পড়ানো হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তর সহ উচ্চতর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগের সঙ্গে পালি ও প্রাকৃতও যুক্ত রয়েছে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে interdisciplinary studies-এর সুবাদে পালি নিয়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে সারা ভারতে পালি চর্চা বিশেষ গুরুত্ব ও উৎসাহ পাচ্ছে। তবে সেই সুযোগ কাজে লাগানোর মতো উপযুক্ত মানবসম্পদ আমাদের দেশে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি হয়নি।

পালি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষণের জন্য যে প্রক্রিয়া তা বহুমুখী বিষয়ের সমন্বয়ে হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা (বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা) এবং নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার (বাংলা, হিন্দি প্রভৃতি) মধ্যবর্তী অবস্থানের ফলে পালি চর্চার দ্বারা বাকি দুটি স্তরের ভাষার (সংস্কৃত ও বাংলা) উপর স্বাভাবিক ব্যুৎপত্তি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও যেকোনও ভাষা চর্চার জন্যই ভাষাতত্ত্ব বুঝতে হয়। পালিতে যেহেতু প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষিতে লেখা বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন সংক্রান্ত সাহিত্যই বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় তাই প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন আমরা এর মধ্যে পাই। এছাড়াও পরবর্তী পালি রচনাগুলির মধ্যে ‘বংশ সাহিত্য’ বলে খ্যাত গ্রন্থগুলির মাধ্যমে আমরা শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড-সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের জ্ঞান লাভ করতে পারি। পালি ভাষায় বর্ণিত অভিধর্ম পিটক ও সূত্র পিটক আমাদের বৌদ্ধ দর্শনের থেকেও বেশি করে পরিচয় করায় মনস্তত্ত্ববিদ্যা সঙ্গে যেহেতু বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন মনের ভাব থেকেই কর্মের সূচনা হয় এবং তার ফল ভোগ করতে হয় প্রধানত মানসিকভাবে। কর্মের ফল সুখ-দুঃখ যা-ই হোক না কেন তা আমরা মনের দ্বারাই উপলব্ধি করতে পারি। এইজন্য পালিতে মনস্তত্ত্বের বিশদ আলোচনা আছে যা সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মনস্তত্ত্ববিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এছাড়াও পালি সাহিত্যে বর্ণিত ধ্যানের প্রক্রিয়াও বর্তমান মানসিক চাপে জীর্ণ সমাজকে শান্তির আলো দেখাচ্ছে। এই প্রসঙ্গেই বলা যায় Conflict resolution ও Peace studies-এর পরিপ্রেক্ষিতে পালি বিষয় নিয়ে অধ্যয়নের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই শিক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরের সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়।

প্রশিক্ষণ
কেবলমাত্র পুঁথিগতবিদ্যা আমাদেরকে কেরিয়ার-উপযুক্ত করে তুলতে পারে না। তাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করতে করতেই নিজের নিজের পছন্দ ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই সমস্ত বহুধাবিভক্ত বিষয়সমূহের মধ্য থেকে বেছে নিতে হবে নিজেকে প্রশিক্ষিত করার উপযুক্ত বিষয়।
ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থাকলে ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক হিসেবে নিজেকে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
আবার এরই সূত্র ধরে বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্রগুলির ইতিহাস ও ধর্মীয় গুরুত্বের অধ্যয়ন করে ট্যুরিজম সংগঠনের পেশাদারি পড়াশোনা করা যায়। এমনকী গাইড হিসেবেও নিজেকে প্রশিক্ষিত করা যেতে পারে।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এবং সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম হিসেবেও পালি বিশারদদের বিশেষ ভূমিকা থাকে। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের খুঁটিনাটি নিয়েও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে।
ভাষা ও ভাষাতত্ত্বগত ব্যুৎপত্তির ফলে অনুবাদক ও কপি এডিটরের প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়।

দর্শন ও মনস্তত্ত্বের বিশেষ অধ্যয়নের দ্বারা মানসিক কাউন্সেলরের প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও মেডিটেশনের (বিদর্শন ধ্যান) কোর্স করেও আত্মোন্নতি করার সঙ্গে সঙ্গেই পেশাদারি দক্ষতাও অর্জন করা যায়। বর্তমানে গবেষণা ও অধ্যাপনার জন্য নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এর জন্যও প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন।

কর্ম অভিজ্ঞতা
শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে এখনকার দিনে কর্ম অভিজ্ঞতাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা ও অধ্যাপনার ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা স্নাতকোত্তর ও তার পরবর্তী পিএইচডি গবেষণার মাধ্যমে কিছুটা সঞ্চিত হতে পারে।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের দুই বছরের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুরাতাত্ত্বিক হিসেবে হাতে কলমে কাজের অভিজ্ঞতার সুযোগ থাকে।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত শিক্ষামূলক ভ্রমণগুলি সংগঠনের মধ্যে দিয়েও ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টের অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধ্যান, stress management ও counselling-এর প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের চারপাশের লোকেদের মধ্যেও তা প্রয়োগ করতে পারা যায়।

শেষ হইয়াও না হইল শেষ
অন্যান্য যে কোনও বিষয়ে স্নাতকদের মতো পালি স্নাতকরাও বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হতে পারে। এমনকী সর্বভারতীয় স্তরে ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিস বা পশ্চিমবঙ্গ পিএসসি পরিচালিত ডব্লুবিসিএস পরীক্ষায় পালি বিষয় চয়ন করা যায় সফলতার সঙ্গে। এগুলো ছাড়াও মিউজিয়োলজি, লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম-এর মতো কোর্সগুলি পড়েও পরবর্তী সময়ে পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করা যায়।

যাওয়ার আগে শেষ কথাটি যাই বলে
পালি ভাষা ও সাহিত্য পঠন-পাঠনের সঙ্গে একটা মহৎ দর্শন ও চিন্তাধারার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। ইতিহাস অভিজ্ঞতা দিয়ে দিকদর্শন করায়, দর্শন উদারতা ও চিন্তাশীলতা বাড়ায়, সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমে আমাদের বিশ্লেষণাত্মক মন তৈরি করতে সাহায্য করে আর ভাষা সেই ভাবনাকে প্রকৃষ্টরূপে প্রকাশ করতে শেখায়। এই সব আঙ্গিকের সমন্বয়ে আমরা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারি। পালি আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়। ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’-এর এই আধুনিক চরমপন্থী বাইনারি থেকে বেরিয়ে সৃষ্টিশীল সহানুভূতিপ্রবণ মানসিকতা গড়তে সাহায্য করে। হাজার হোক আমাদের সকলের উদ্দেশ্য হল এমন একটি কেরিয়ার গড়ে তোলা যার দ্বারা আমরা আনন্দের সঙ্গে সৎভাবে কারওর কোনওরকম ক্ষতি না করে আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারি। পালি শিক্ষার মাধ্যমেই হয়তো আমরা সেই সম্যক জীবিকার সন্ধান পেতে পারি।
আমার কথাটি ফুরাল…

Skip to content