রবিবার ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

স্নেহের ছাত্রছাত্রীরা আজ আমি তোমাদের চিনের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করব৷ এই অতিমারির আবহে সহজেই যাতে তোমরা সিলেবাস সম্পূর্ণ করতে পারো তাই উচ্চ মাধ্যমিকের ইতিহাসের সিলেবাস কমিয়ে ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত রাখা হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে তোমরা চিনের ইতিহাস পড়েছ। আজ আমি তৃতীয় অধ্যায়ের চিনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব৷

তোমরা জানো যে সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি চিন। চিনারা নিজেদের দেশকে অতীতে ‘স্বর্গীয় দেশ’ বা Celestial Empire বলে মনে করত, এবং চিন সম্রাটকে তারা ‘স্বর্গের সন্তান’ বলত। ঊনবিংশ শতকের সূচনায় কিং বা মাঞ্চু রাজবংশের আমলে চিন ছিল সবথেকে পিছিয়ে পড়া একটি দেশ। সরকারি রাজকর্মচারীদের দুর্নীতির শিকার হয়ে এবং করভারে জর্জরিত হয়ে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সম্রাটের রক্ষণশীল মানসিকতা। চিন ছিল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের আকর, তাই বিদেশিরা চিনে গিয়ে বাণিজ্য করতে অত্যন্ত উৎসাহী হলেও চিনারা বিদেশিদের বর্বর বলে মনে করত। বিদেশি বিলাসবহুল পণ্যের প্রতিও তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। চিন সরকার ও বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে অনিচ্ছুক ছিল। কোনও বিদেশি দূত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চিন সম্রাটের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তাকে প্রথমেই সম্রাটকে নজরানা দিতে হত এবং ‘কাও তাও’ প্রথা অনুসারে তাকে সম্রাটের সামনে আভূমিপ্রণত হয়ে সম্রাটের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করতে হত। চিনের মূল্যবান সাদা রেশম, সবুজ চা এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের আকর্ষণে বিদেশি বণিকরা চিনে বাণিজ্য করতে অত্যন্ত উৎসাহী হলেও তারা চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারত না।
চিনের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যের সূত্রপাত শুরু হয় তাং যুগ থেকে। ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে সমুদ্রের সঙ্গে অল্প সময়ে এবং সহজে যোগাযোগ গড়ে তোলা যেত, তাই এর আগে ব্যবহৃত বন্দর যেমন অ্যাময়, নিংপো, সাংহাই, ম্যাকাও প্রভৃতির থেকেও ক্যান্টন বন্দরের গুরুত্ব প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পর্তুগিজরা প্রথম ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু করে। ব্রিটিশ বাণিজ্য প্রথম ক্যাপ্টেন ওয়েড্ডেলের উদ্যোগে ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলেও নিয়মিত বাণিজ্য শুরু হতে অনেকটা দেরি হয়। ক্যান্টন বাণিজ্যে চিনা বণিক গোষ্ঠী কো-হং-এর মাধ্যমে বিদেশি বণিকদের বাণিজ্য করতে হত, চিনা সরকারের সব শর্ত মেনে। এইভাবে ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চিনে বিদেশি বণিকদের যে বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল তাই ক্যান্টন বাণিজ্য নামে পরিচিত।

ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য : ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে চিনে বিদেশি বণিকদের জন্য এক বন্দর কেন্দ্রিক ক্যান্টন বাণিজ্যের সূত্রপাত হওয়ার পর এখানকার বাণিজ্যে শীঘ্রই ব্রিটিশ বণিকদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কো-হং নামক বণিক গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত এই বাণিজ্য ছিল শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক বাণিজ্য। ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যরত ইউরোপিয়ানদের মূলত শহরের মূল ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে থেকে বাণিজ্য করতে হত এবং তাঁদের পরিবারবর্গকে রেখে আসতে হত ম্যাকাও বন্দরে। ক্যান্টনে রুদ্ধদ্বার নীতি চালু ছিল, কারণ এখানে আসা বিদেশি বণিকরা সর্বদা চিনা সৈনিকদের নজরদারিতে থাকতে বাধ্য ছিল। খুব শীঘ্রই ব্রিটিশ বণিকরা পর্তুগিজ বণিকদের হটিয়ে দিয়ে ক্যান্টন বাণিজ্যে প্রধান স্থান দখল করে নেয়। পরবর্তীকালে আমেরিকা এই বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।

ক্যান্টন বাণিজ্যের বিভিন্ন শর্ত ও বিধিনিষেধ বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানারকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। চিনের সরকার কোনওভাবেই বিদেশি কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার সঙ্গে কোনওরকম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি। তাই ইংল্যান্ড থেকে যতবার চিনে দূত প্রেরিত হয়েছে, প্রতিবারেই তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে ব্রিটিশ বণিকরা চোরাপথে ভারত থেকে চিনে আফিম পাঠাতে শুরু করলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। আফিমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চিন ও ইংল্যান্ডের মধ্যে বিরোধ বাধে এবং প্রথম অহিফেন যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮৩৯-১৮৪২ সালের মধ্যে। এই যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের ফলে চিনের ক্যান্টন বাণিজ্য ভেঙে পড়ে এবং চিন ক্যান্টন সহ আরও বেশ কয়েকটি বন্দর ব্রিটিশদের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়। এইভাবেই ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান ঘটে।

প্রথম অহিফেন যুদ্ধে চিন পরাজিত হয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে নানকিং-এর অসম সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় ১৮৪২ সালে। এই সন্ধির শর্ত হিসাবে ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও, নিংগপো এই পাঁচটি বন্দর ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। হংকং বন্দর চিরকালের জন্য ব্রিটিশদের দিয়ে দেওয়া হয় ও কো-হং প্রথা বাতিল হয় এবং চিনের সর্বত্র ব্রিটিশ বণিকদের পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের অধিকার স্বীকৃত হয়, এর সঙ্গে চিনের রাজবংশকে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এইভাবেই চিনের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর অসম চুক্তি সম্পাদনের ভিত প্রস্তুত হয়। এরপর দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলি চিনের সঙ্গে একের পর এক অসম চুক্তি সম্পাদন করে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের সঙ্গে ওয়াংঘিয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে, ফ্রান্স স্বাক্ষর করে হোয়ামপোয়ার চুক্তি, রাশিয়া চিনের ওপর চাপিয়ে দেয় আইগুনের সন্ধি, চিন-জাপান যুদ্ধের পর জাপান পরাজিত চিনের সঙ্গে স্বাক্ষর করে শিমোনোসেকির সন্ধি, দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধের পর চিন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে বাধ্য হয়ে তিয়েনসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করে যা আরও অনেক বেশি পরিণত হয় পিকিং সন্ধির মাধ্যমে। এই কারণেই চিনের ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিনাক চিনকে বিদেশিদের এইভাবে আত্মসাৎ করার প্রক্রিয়াটিকে ‘Cutting of Chinese melon’ বলে অভিহিত করেছেন। বিদেশি শক্তিগুলির অর্থনৈতিক শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে চিনে ১৮৯৯-১৯০১ সালে বক্সার বিদ্রোহ সম্পাদিত হয়। অবশেষে বক্সার প্রোটোকল নামক চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি রাষ্ট্রগুলি চিনের ওপর বিভিন্ন কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
এইভাবেই দেখা যায় সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে ধীরে ধীরে চিনের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল একটি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে বিদেশি শক্তিগুলির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।

ছেলেমেয়েরা তোমরা সবাই চিনের এই অংশটা খুব মন দিয়ে পড়বে, এই বছরের জন্য এই অংশ থেকে ক্যান্টন বাণিজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ টপিক, তা ছাড়াও অসম চুক্তিগুলি নিয়েও বড় প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা আছে। মূল বিষয়টা খুব ভালো করে পড়ে আগে বুঝে নেবে কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটেছে, তবেই এই আলোচ্য অংশের যে কোনও বিষয় থেকেই উত্তর দিতে পারবে সহজেই। এই অতিমারির আবহে নিজের এবং পরিবারের সবাই সুস্থ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নাও কেমন।

লেখক: বিধাননগর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা।

 


Skip to content