ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
বৌদ্ধ দর্শনের একটি সিদ্ধান্ত হল ‘সর্বম অনিত্যম্’। অর্থাৎ সব কিছু অনিত্য, পরিবর্তনশীল বা অস্থায়ী, কোনও কিছু স্থায়ী নয়। এই সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ ও অনিত্যতাবাদ বৌদ্ধদের প্রতীত্যসমুৎপাদ থেকে নিঃসৃত হয়েছে। প্রতীত্যসমুৎপাদের অর্থ হল—কার্য মাত্রই কারণের উপর নির্ভরশীল। কারণ থাকলে কার্য হয়, কারণের অভাবে কার্যের অভাব ঘটে। তাই কার্য মাত্রই অনিত্য। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দর্শনের এই সর্বজনীন পরিবর্তনবাদকে তাত্ত্বিকেরা ক্ষণিকবাদে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁদের মতে ‘সর্বম্ ক্ষণিকং ক্ষণিকম্’। সব কিছু ক্ষণিক, অর্থাৎ একটিমাত্র ক্ষণের জন্য স্থায়ী। বৌদ্ধ মতে, একটি বস্তুর মধ্যেই তার ধ্বংসের বীজ নিহিত থাকে। তাই প্রথম ক্ষণের বস্তু দ্বিতীয় ক্ষণে থাকে না। দ্বিতীয় ক্ষণে উৎপন্ন বস্তু তৃতীয় ক্ষণে বিনষ্ট হয়। এইভাবে পরিবর্তনের ধারা চলছে। বাহ্য ও আন্তরসত্তা সবই পরিবর্তনশীল, সবই ক্ষণিক।
বৌদ্ধ ক্ষণভঙ্গবাদ তাঁদের সত্তার লক্ষণ থেকে নিঃসৃত হয়েছে। বৌদ্ধ মতে, অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা কার্য উৎপাদন করার ক্ষমতাই বস্তুর সত্তা। যা কার্য উৎপাদন করতে পারে বা অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ। বৌদ্ধ মতে এমন কোনও সৎ বস্তু নেই যা কার্য উৎপাদন করতে পারে না। যা কার্য উৎপাদন করতে পারে না তা অসৎ—যেমন শশশৃঙ্গ। বীজ সৎ বস্তু, তাই বীজ অঙ্কুর উৎপাদন করতে পারে। তাই বৌদ্ধরা বলেন, ‘যা অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ। সৎ বস্তুমাত্রই কোনও কারণ থেকে উৎপন্ন হয় এবং নিজের কার্যটি উৎপন্ন করে। যদি সৎ বস্তু পরক্ষণেই তার কার্যকে উৎপন্ন করে, তবে সেই ক্ষণে তা আর থাকতে পারে না। কেন না, বস্তুর সত্তা তার কার্য উৎপাদন করার ক্ষমতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এই ক্ষমতা নিঃশেষিত হওয়ার অর্থ হল বস্তুর সত্তার বিলুপ্তি। অতএব, সৎ বস্তু মাত্রই ক্ষণিক। এই তাৎপর্যেই বৌদ্ধ দার্শনিক জ্ঞানশ্রী মিশ্র বলেছেন—‘যৎ সৎ তৎ ক্ষণিকম্ অর্থক্রিয়াকারিত্বাৎ’।
বৌদ্ধ দার্শনিকরা অনুমান প্রমাণের দ্বারা ক্ষণিকবাদকে সিদ্ধ করেন। তাঁরা বলেন—‘বীজাদিকং সর্বং ক্ষণিকং সত্ত্বাৎ’। বীজ প্রভৃতি সববস্তুই সৎ বা সত্তাবান, অতএব বীজাদি সব বস্তুই ক্ষণিক। এই অনুমানে বীজাদি সব বস্তু হল পক্ষ, ক্ষণিকত্ব সাধ্য এবং সত্তা হল হেতু। রত্নকীর্তি অন্বয়ব্যাপ্তি ও ব্যতিরেকব্যাপ্তির দ্বারা সব বস্তুর ক্ষণিকত্ব প্রমাণ করেন। ‘যা অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ, যা অর্থক্রিয়াকারী বা সৎ তাই ক্ষণিক, যেহেতু তার সত্তা আছে, যেমন—’ঘট’। এটি অন্বয় ব্যাপ্তি। যা ক্ষণিক নয় অর্থাৎ স্থায়ী বস্তু তা অর্থক্রিয়াকারী বা সৎ নয়। এটি ব্যতিরেক ব্যাপ্তি। সুতরাং সব বস্তুই ক্ষণিক।
প্রশ্ন হল—প্রথম ক্ষণের বীজটি দ্বিতীয় ক্ষণে থাকে কি না? ধরা যাক, বীজটি দুটি ক্ষণ স্থায়ী অর্থাৎ দুটি ক্ষণে বীজটি একই রয়েছে। বীজটি দুটি ক্ষণে স্থায়ী হলে তা দুটি ক্ষণেই কার্য উৎপাদন করবে। কিন্তু যেহেতু দুটি ক্ষণে একই কার্য উৎপন্ন হতে পারে না, তাই বলতে হবে দুটি ক্ষণে তা দুটি পৃথক কার্য উৎপন্ন করে। তাহলে দুটি ক্ষণে দুটি আলাদা কারণ আছে এবং বলতে হবে দুটি ক্ষণে দুটি আলাদা বীজ আছে। রত্নকীর্তি বলেন, প্রথম ক্ষণের বীজ ও দ্বিতীয় ক্ষণের বীজ ভিন্ন। প্রথম ক্ষণে যে বীজ থাকে দ্বিতীয় ক্ষণে তা বিনষ্ট হয়। দ্বিতীয় ক্ষণে, প্রথম ক্ষণের সদৃশ উৎপন্ন বীজ আবার তৃতীয় ক্ষণে বিনষ্ট হয়। আপাতদৃষ্টিতে, আমরা একটি বীজ দেখছি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীজটি হল বীজ সন্তান বা বীজ প্রবাহ। সুতরাং বীজটি একটি ক্ষণের জন্য স্থায়ী।
বৌদ্ধ মতে, কোনও অক্ষণিক স্থায়ী বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিতা নেই। যদি কোনও স্থায়ী বস্তু কার্য উৎপাদন করে তবে তা দুভাবে করতে পারে—
১. ক্রমে বা ধারাবাহিকভাবে
২. অক্রমে অর্থাৎ যুগপৎভাবে
বৌদ্ধ তাত্ত্বিকেরা নানা যুক্তি প্রয়োগ করে দেখান যে, এ দুটি বিকল্পের কোনওটিই গ্রহণযোগ্য নয়। তৃতীয় কোনও বিকল্প না থাকায় বৌদ্ধরা সিদ্ধান্ত করেন যে, স্থায়ী বস্তুর কার্য উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। বীজ প্রভৃতি যাদের সত্তা আছে তারা অর্থক্রিয়াকারী বলে ক্ষণিক।
১. প্রথম বিকল্প অনুসারে ধরা যাক, স্থায়ী বস্তু ক্রমে কার্য উৎপাদন করে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে বস্তুটির কার্য উৎপাদনের ক্ষমতা আছে কি না?
● যদি থাকে তাহলে তা যুগপৎ বা একসঙ্গে সমস্ত কার্য উৎপাদন করবে না কেন? সামর্থ্য বা শক্তি থাকলে এবং যুগপৎ কার্য উৎপাদনে বাধা না থাকলে তার যুগপৎ কার্য উৎপাদন করা উচিত।
● আর যদি বস্তুটির কার্য উৎপাদনের ক্ষমতা না থাকে তাহলে কার্য কখনওই উৎপন্ন হবে না। ফলে অর্থক্রিয়াকারিত্ব না থাকায় কার্যটি অসৎ হয়ে পড়বে।
নৈয়ায়িক প্রমুখ পূর্বপক্ষীরা দাবি করেন যে, স্থায়ী বস্তুর কার্য উৎপাদনের শক্তি আছে, কিন্তু সহকারিকারণ না থাকায় তা কার্য উৎপাদন করতে পারে না। বৌদ্ধরা বলেন, শক্তিবিশিষ্ট কোনও বস্তুকে সহকারিকারণের সাহায্যে কার্য উৎপাদন করতে দেখা যায় না। আর কার্য উৎপাদনের শক্তি না থাকলে সহকারিকারণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
স্থায়ী বস্তু সহকারিকারণের দ্বারা কার্য উৎপাদন করে—এমন বিকল্প খণ্ডনে বৌদ্ধরা বলেন কার্য উৎপাদন কার দ্বারা হচ্ছে?
● স্থায়ী বস্তুর দ্বারা, অথবা
● সহকারী কারণের দ্বারা
যদি স্থায়ী বস্তু কার্য উৎপাদন করে তাহলে সহকারিকারণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। যদি বলা হয় যে, স্থির বীজই অঙ্কুর উৎপাদন করে তাহলে গৃহস্থ বীজও ক্ষেত্রস্থ বীজের মতো অঙ্কুর নামক কার্য করতে পারে তা বলা উচিত। কারণ বীজ স্থির হলে গৃহস্থ বীজ ও ক্ষেত্রস্থ বীজের মধ্যে কোনও তফাত থাকে না। বৌদ্ধরা বলেন বাস্তব অনুভব স্থির দ্রব্যবাদীদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে। বস্তুত ক্ষেত্রস্থ বীজই অঙ্কুরের জনক হয়, গৃহস্থ বীজ তা হয় না। নৈয়ায়িকরা দাবি করেন যে, বীজ নিজেই অঙ্কুরের জনক নয়, তা মাটি, বাতাস, জল, প্রভৃতি সহকারিকারণের দ্বারাই অঙ্কুর উৎপাদনে সমর্থ হয়। এর উত্তরে বৌদ্ধরা বলেন—প্রথমত, সহকারিকারণের দ্বারা অঙ্কুর উৎপন্ন করা বীজের স্বভাব হলে তা বীজে সর্বদাই থাকবে, কেননা স্বভাব বস্তুকে কখনও ত্যাগ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সহকারিকারণ কার্য উৎপাদনে অসমর্থ বস্তুকে কখনও সমর্থ করতে পারে না, যা কার্য উৎপাদনে অসমর্থ তা সহস্র সহকারিকারণ লাভ করলেও কার্য উৎপাদন করতে পারে না। যেমন—শিলাখণ্ড থেকে কখনও অঙ্কুর জন্মায় না।
তাই বৌদ্ধরা বলেন, সহকারিকারণ বলে কোনও কারণই হতে পারে না। বীজই অঙ্কুরের কারণ। তবে বীজ বীজত্ব রূপে অঙ্কুরের কারণ হতে পারে না। কেন না, সেক্ষেত্রে ঘরের বীজে বীজত্ব থাকায় তা থেকে অঙ্কুরের উৎপত্তির আপত্তি হবে। তাই যে বীজ অঙ্কুর উৎপন্ন করে সেই বীজে জাতিবিশেষ স্বীকার করতে হবে। ওই বিশেষের নাম ‘কুর্বদ্রূপত্ব’। বীজ এরূপেই অঙ্কুরের কারণ। যে ক্ষণে বীজ অঙ্কুর উৎপন্ন করে অব্যবহিত পূর্বক্ষণেই বীজে ‘কুর্বদ্রূপত্ব’ থাকে, তার পূর্বপূর্বকালবর্তী বীজে তা থাকে না বলে সে সব ক্ষণের বীজ অঙ্কুরের জনক হয় না। তাহলে একথা স্বীকার করতে হবে যে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার অব্যবহিত পূর্বক্ষণের বীজ তার পূর্বক্ষণবর্তী বীজ থেকে ভিন্ন। সুতরাং, বীজ দুই ক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। বীজ মাত্রই ক্ষণিক অর্থাৎ এক ক্ষণ মাত্র স্থায়ী। অঙ্কুরের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বক্ষণের বীজ তার পূর্বক্ষণে ছিল না। তা তার অব্যবহিত পূর্বক্ষণের বীজ হতে উৎপন্ন হয়েছে এবং তার পরক্ষণেই অঙ্কুর উৎপন্ন করে বিনষ্ট হয়েছে। সুতরাং ক্ষণিকবাদই সমর্থিত হয়। স্থায়ী বস্তু ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না, যা ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী তাকে ক্ষণিকই বলতে হবে।
২. বৌদ্ধরা বলেন স্থায়ী বস্তু যুগপৎ কার্য উৎপাদন করে একথাও বলা যায় না। স্থায়ী বস্তুর উৎপাদিকাশক্তি থাকলে তার দ্বারা একই সঙ্গে যুগপৎ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কার্য উৎপন্ন হবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কোনও স্থায়ী বস্তুকেই সমস্ত কার্য একসঙ্গে উৎপন্ন করতে দেখা যায় না। তাছাড়া স্থায়ী বস্তু যুগপৎ সমস্ত বস্তু উৎপন্ন করলে পরমুহূর্তে উৎপন্ন করার আর কিছু থাকে না। ফলে বস্তুটি অসৎ হয়ে পড়বে। আর যদি বলা হয় যে, পরমুহূর্তে স্থায়ী বস্তুটি ভিন্ন কার্য উৎপন্ন করবে এবং তার পরমুহূর্তে আবার অন্য কার্য উৎপন্ন করবে, তাহলে দ্বিতীয় বিকল্প প্রথম বিকল্পের অনুরূপ হয়ে পড়ে।
—এই সব যুক্তির সাহায্যে বৌদ্ধরা সিদ্ধান্ত করেন যে, স্থির দ্রব্যের পক্ষে কার্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। স্থির দ্রব্য বা স্থায়ী বস্তু অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না। ‘যা অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক, যা সৎ তাই অর্থক্রিয়াকারী; সুতরাং যা সৎ তাই ক্ষণিক।’
বৌদ্ধ ক্ষণভঙ্গবাদ তাঁদের সত্তার লক্ষণ থেকে নিঃসৃত হয়েছে। বৌদ্ধ মতে, অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা কার্য উৎপাদন করার ক্ষমতাই বস্তুর সত্তা। যা কার্য উৎপাদন করতে পারে বা অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ। বৌদ্ধ মতে এমন কোনও সৎ বস্তু নেই যা কার্য উৎপাদন করতে পারে না। যা কার্য উৎপাদন করতে পারে না তা অসৎ—যেমন শশশৃঙ্গ। বীজ সৎ বস্তু, তাই বীজ অঙ্কুর উৎপাদন করতে পারে। তাই বৌদ্ধরা বলেন, ‘যা অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ। সৎ বস্তুমাত্রই কোনও কারণ থেকে উৎপন্ন হয় এবং নিজের কার্যটি উৎপন্ন করে। যদি সৎ বস্তু পরক্ষণেই তার কার্যকে উৎপন্ন করে, তবে সেই ক্ষণে তা আর থাকতে পারে না। কেন না, বস্তুর সত্তা তার কার্য উৎপাদন করার ক্ষমতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এই ক্ষমতা নিঃশেষিত হওয়ার অর্থ হল বস্তুর সত্তার বিলুপ্তি। অতএব, সৎ বস্তু মাত্রই ক্ষণিক। এই তাৎপর্যেই বৌদ্ধ দার্শনিক জ্ঞানশ্রী মিশ্র বলেছেন—‘যৎ সৎ তৎ ক্ষণিকম্ অর্থক্রিয়াকারিত্বাৎ’।
বৌদ্ধ দার্শনিকরা অনুমান প্রমাণের দ্বারা ক্ষণিকবাদকে সিদ্ধ করেন। তাঁরা বলেন—‘বীজাদিকং সর্বং ক্ষণিকং সত্ত্বাৎ’। বীজ প্রভৃতি সববস্তুই সৎ বা সত্তাবান, অতএব বীজাদি সব বস্তুই ক্ষণিক। এই অনুমানে বীজাদি সব বস্তু হল পক্ষ, ক্ষণিকত্ব সাধ্য এবং সত্তা হল হেতু। রত্নকীর্তি অন্বয়ব্যাপ্তি ও ব্যতিরেকব্যাপ্তির দ্বারা সব বস্তুর ক্ষণিকত্ব প্রমাণ করেন। ‘যা অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ, যা অর্থক্রিয়াকারী বা সৎ তাই ক্ষণিক, যেহেতু তার সত্তা আছে, যেমন—’ঘট’। এটি অন্বয় ব্যাপ্তি। যা ক্ষণিক নয় অর্থাৎ স্থায়ী বস্তু তা অর্থক্রিয়াকারী বা সৎ নয়। এটি ব্যতিরেক ব্যাপ্তি। সুতরাং সব বস্তুই ক্ষণিক।
প্রশ্ন হল—প্রথম ক্ষণের বীজটি দ্বিতীয় ক্ষণে থাকে কি না? ধরা যাক, বীজটি দুটি ক্ষণ স্থায়ী অর্থাৎ দুটি ক্ষণে বীজটি একই রয়েছে। বীজটি দুটি ক্ষণে স্থায়ী হলে তা দুটি ক্ষণেই কার্য উৎপাদন করবে। কিন্তু যেহেতু দুটি ক্ষণে একই কার্য উৎপন্ন হতে পারে না, তাই বলতে হবে দুটি ক্ষণে তা দুটি পৃথক কার্য উৎপন্ন করে। তাহলে দুটি ক্ষণে দুটি আলাদা কারণ আছে এবং বলতে হবে দুটি ক্ষণে দুটি আলাদা বীজ আছে। রত্নকীর্তি বলেন, প্রথম ক্ষণের বীজ ও দ্বিতীয় ক্ষণের বীজ ভিন্ন। প্রথম ক্ষণে যে বীজ থাকে দ্বিতীয় ক্ষণে তা বিনষ্ট হয়। দ্বিতীয় ক্ষণে, প্রথম ক্ষণের সদৃশ উৎপন্ন বীজ আবার তৃতীয় ক্ষণে বিনষ্ট হয়। আপাতদৃষ্টিতে, আমরা একটি বীজ দেখছি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীজটি হল বীজ সন্তান বা বীজ প্রবাহ। সুতরাং বীজটি একটি ক্ষণের জন্য স্থায়ী।
বৌদ্ধ মতে, কোনও অক্ষণিক স্থায়ী বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিতা নেই। যদি কোনও স্থায়ী বস্তু কার্য উৎপাদন করে তবে তা দুভাবে করতে পারে—
বৌদ্ধ তাত্ত্বিকেরা নানা যুক্তি প্রয়োগ করে দেখান যে, এ দুটি বিকল্পের কোনওটিই গ্রহণযোগ্য নয়। তৃতীয় কোনও বিকল্প না থাকায় বৌদ্ধরা সিদ্ধান্ত করেন যে, স্থায়ী বস্তুর কার্য উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। বীজ প্রভৃতি যাদের সত্তা আছে তারা অর্থক্রিয়াকারী বলে ক্ষণিক।
নৈয়ায়িক প্রমুখ পূর্বপক্ষীরা দাবি করেন যে, স্থায়ী বস্তুর কার্য উৎপাদনের শক্তি আছে, কিন্তু সহকারিকারণ না থাকায় তা কার্য উৎপাদন করতে পারে না। বৌদ্ধরা বলেন, শক্তিবিশিষ্ট কোনও বস্তুকে সহকারিকারণের সাহায্যে কার্য উৎপাদন করতে দেখা যায় না। আর কার্য উৎপাদনের শক্তি না থাকলে সহকারিকারণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
স্থায়ী বস্তু সহকারিকারণের দ্বারা কার্য উৎপাদন করে—এমন বিকল্প খণ্ডনে বৌদ্ধরা বলেন কার্য উৎপাদন কার দ্বারা হচ্ছে?
যদি স্থায়ী বস্তু কার্য উৎপাদন করে তাহলে সহকারিকারণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। যদি বলা হয় যে, স্থির বীজই অঙ্কুর উৎপাদন করে তাহলে গৃহস্থ বীজও ক্ষেত্রস্থ বীজের মতো অঙ্কুর নামক কার্য করতে পারে তা বলা উচিত। কারণ বীজ স্থির হলে গৃহস্থ বীজ ও ক্ষেত্রস্থ বীজের মধ্যে কোনও তফাত থাকে না। বৌদ্ধরা বলেন বাস্তব অনুভব স্থির দ্রব্যবাদীদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে। বস্তুত ক্ষেত্রস্থ বীজই অঙ্কুরের জনক হয়, গৃহস্থ বীজ তা হয় না। নৈয়ায়িকরা দাবি করেন যে, বীজ নিজেই অঙ্কুরের জনক নয়, তা মাটি, বাতাস, জল, প্রভৃতি সহকারিকারণের দ্বারাই অঙ্কুর উৎপাদনে সমর্থ হয়। এর উত্তরে বৌদ্ধরা বলেন—প্রথমত, সহকারিকারণের দ্বারা অঙ্কুর উৎপন্ন করা বীজের স্বভাব হলে তা বীজে সর্বদাই থাকবে, কেননা স্বভাব বস্তুকে কখনও ত্যাগ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সহকারিকারণ কার্য উৎপাদনে অসমর্থ বস্তুকে কখনও সমর্থ করতে পারে না, যা কার্য উৎপাদনে অসমর্থ তা সহস্র সহকারিকারণ লাভ করলেও কার্য উৎপাদন করতে পারে না। যেমন—শিলাখণ্ড থেকে কখনও অঙ্কুর জন্মায় না।
তাই বৌদ্ধরা বলেন, সহকারিকারণ বলে কোনও কারণই হতে পারে না। বীজই অঙ্কুরের কারণ। তবে বীজ বীজত্ব রূপে অঙ্কুরের কারণ হতে পারে না। কেন না, সেক্ষেত্রে ঘরের বীজে বীজত্ব থাকায় তা থেকে অঙ্কুরের উৎপত্তির আপত্তি হবে। তাই যে বীজ অঙ্কুর উৎপন্ন করে সেই বীজে জাতিবিশেষ স্বীকার করতে হবে। ওই বিশেষের নাম ‘কুর্বদ্রূপত্ব’। বীজ এরূপেই অঙ্কুরের কারণ। যে ক্ষণে বীজ অঙ্কুর উৎপন্ন করে অব্যবহিত পূর্বক্ষণেই বীজে ‘কুর্বদ্রূপত্ব’ থাকে, তার পূর্বপূর্বকালবর্তী বীজে তা থাকে না বলে সে সব ক্ষণের বীজ অঙ্কুরের জনক হয় না। তাহলে একথা স্বীকার করতে হবে যে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার অব্যবহিত পূর্বক্ষণের বীজ তার পূর্বক্ষণবর্তী বীজ থেকে ভিন্ন। সুতরাং, বীজ দুই ক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। বীজ মাত্রই ক্ষণিক অর্থাৎ এক ক্ষণ মাত্র স্থায়ী। অঙ্কুরের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বক্ষণের বীজ তার পূর্বক্ষণে ছিল না। তা তার অব্যবহিত পূর্বক্ষণের বীজ হতে উৎপন্ন হয়েছে এবং তার পরক্ষণেই অঙ্কুর উৎপন্ন করে বিনষ্ট হয়েছে। সুতরাং ক্ষণিকবাদই সমর্থিত হয়। স্থায়ী বস্তু ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না, যা ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী তাকে ক্ষণিকই বলতে হবে।
—এই সব যুক্তির সাহায্যে বৌদ্ধরা সিদ্ধান্ত করেন যে, স্থির দ্রব্যের পক্ষে কার্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। স্থির দ্রব্য বা স্থায়ী বস্তু অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না। ‘যা অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক, যা সৎ তাই অর্থক্রিয়াকারী; সুতরাং যা সৎ তাই ক্ষণিক।’