রবিবার ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মনোজিতের তুলির টানে অ্যাবস্ট্রাক্টের জাদু।

মাইকেল এঞ্জেলো থেকে আরম্ভ করে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিই বলুন কিংবা আমাদের অবন ঠাকুর বা নন্দলাল বসু—সমস্ত শিল্পীরই শিল্পী হয়ে ওঠার একটা বিশেষ যাত্রা থাকে, একটা নিভৃতযাপন থাকে, ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনস্মৃতি’তে দক্ষিণের বারান্দায় তাঁর নিভৃতযাপনের বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন, ঠিক তেমনই এক নিভৃতযাপনের কাহিনি লুকিয়ে আছে সমস্ত শিল্পীর আত্মকাহিনিতেই। এমন কতশত শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠার যাত্রার কাহিনিই তো আমাদের অগোচরে থেকে যায়। সেই রকমই কিছু অগোচরে থেকে যাওয়ার কাহিনির সন্ধান করতে গিয়েই আমরা আমাদের মাঝে পেয়ে গিয়েছি মালদার মনোজিৎকে। মনোজিৎ, মনোজিৎ মাইতি, না এখনও পর্যন্ত কোনও চেনা সারির বিশেষ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে হয়তো তার নাম পাওয়া যাবে না কিন্তু এই শিশুশিল্পীর অন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা যে তাকে একদিন পরিচিত মহলের অনন্য এক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। তাই আগামীর বিশিষ্টজনের ‘বিশিষ্ট’ হয়ে ওঠার যাত্রাপথের এক ছোট্ট শরিক হয়ে ওঠার অভিপ্রায়ে ‘সময় আপডেটস’ উঁকি দিয়েছিল মনোজিতের অন্তরমহলে।

শিশুশিল্পীর ক্যানভাসে জীবন্ত পার্থিব জীবন।

মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মনোজিৎ। তার তুলির টানে যেকোনও পার্থিব দৃশ্যই ক্যানভাসের পরিধিতে হয়ে ওঠে যেন জীবন্ত। প্রাকৃতিক পটভূমি হোক বা কোনও অ্যাবসট্রাক্ট চিত্রকল্প সমস্ত কিছুতেই তার অনায়াস দক্ষতা। যদিও মনোজিৎ নিজেই আমাদের জানিয়েছে যে ও পোর্ট্রেট আঁকতেই বেশি ভালোবাসে। মানুষটি সামনে বসে থাকার চেয়ে ছবি দেখে পোর্ট্রেট আঁকতেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ। ক্লাস ওয়ান থেকে ছবি আঁকার এই যাত্রায় প্রথাগতভাবে আঁকা শিখেছে সে মাত্র দু’বছর। আশ্চর্য কাণ্ড, এই যে প্রথাগত শিক্ষাও হয়তো তাকে একটা শৈল্পিক বোধের অধিকারী করে তুলতে পারত না যতটা তার জন্মগতভাবে আছে। শান্ত শিষ্ট লাজুক এই শিশুশিল্পীকে ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘কতকিছুই তো ইচ্ছে করে, কিন্তু কী করব সেকথা তো ভাবিনি কখনও। ছবি আঁকতে ভালোবাসি তবে ভবিষ্যতে ছবি আঁকাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করব কি না সে বিষয়ে এখনও কিছু ভাবিনি।’ শুনে অবাক লাগল, একবিংশ শতকে ইঁদুরকলের এক শরিক, যে বিশ্বায়ন পরবর্তী এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কোনওরকম প্রতিযোগিতায় শামিল না হয়ে কেবল ভালোবাসার তাগিদেই ছবি এঁকে চলেছে ! জানি না মনোজিৎ-এর এই সারল্য কতদিন এরকম থাকবে কিন্তু শিল্পীর হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথে ওকে যেন কখনও কোনও প্রতিযোগিতার মালিন্য স্পর্শ করতে না পারে এই প্রার্থনাই করি।
মনোজিতের বাবা বিশ্বজিৎ মাইতি এবং মা মনোমিতা মাইতি উভয়ই শিক্ষক। মনোজিতের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রায়ই তার মাকে দেখছিলাম ছেলেকে সাহস জোগাতে, বোঝাই যাচ্ছিল সন্তানের সামান্যতম সাফল্য-অসাফল্য সমস্ত কিছুতেই মা ঠিক কতটা তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকেন। মনোজিৎ অবসর সময়ে ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসে, প্রিয় ক্রিকেটার কে এল রাহুল। প্রিয় বিষয় গণিত, প্রিয় খাবার চিকেন এবং প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা শুনে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘লালু’ পড়া আছে কি না? উত্তরে খানিকটা অপ্রতিভ হয়ে হাসে কেবল সে। পাশ থেকে মা মনোমিতা মাইতিই বলে দেন—’হ্যাঁ, ও ‘লালু’ পড়েছে, একটু লাজুক তো তাই…’
আজ থেকে আরও দশ বছর পরে পৃথিবী কী অবস্থায় থাকবে আমরা জানি না, কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনোজিতের সারল্য ও প্রতিভার নিরিখে সে আগামী দিনের বিশ্ব প্রতিনিধি হয়ে উঠুক এইটুকুই কাম্য। আগামীদিনের পৃথিবী যেমনই হোক না কেন, আজকের শিশুশিল্পী তার নিজের প্রতিভার জোরে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলবে তার শিল্পচেতনার আলোকে, এই আমাদের বিশ্বাস এবং আগামীর প্রতি আমাদের অঙ্গীকার৷

Skip to content