সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


অভিরূপ পাল।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি—এই দু’ বছর ধরে যে ছেলেটি বোর্ডভিত্তিক পড়াশোনাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার (JEE বা NEET-এর) জন্য পড়েছে, তার পক্ষে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশে থাকা অতটাও সহজ নয়। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে দুই বছর ছাত্রদের এই সব পরীক্ষার জন্য আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু বোর্ডকে প্রাধান্য দেওয়ার সময় না পেলেও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল এবং রাজ্যে প্রথম স্থান দুটিই ছাত্ররা করে এসেছে বছরের পর বছর।

২০২১ সালে করোনা অতিমারির কারণে আমি মাধ্যমিক দিতে পারিনি। এরপর একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হয় অনলাইনে। আমি একাদশে ভর্তি হই বাংলা, ইংরেজি, অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং জীববিদ্যা এই বিষয়গুলি নিয়ে। প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম সর্বভারতীয় মেডিকেল এন্ট্রান্স পরীক্ষা ( নিট) এর জন্য।
নরেন্দ্রপুরের শিক্ষকেরা আমাদের আলাদা করে কোচিং দিতেন। মূলত নিট-এর জন্য পড়াশোনা করতাম। প্রথমে অসুবিধা হতো, ভাবতাম কীভাবে দুটো একসঙ্গে সামলাবো। তারপর ধীরে ধীরে বুঝলাম কীভাবে সামলাতে হয়। সিলেবাস একই হলেও বোর্ডের পরীক্ষায় জিনিসগুলি বিশ্লেষণ করতে হয়—এই ছিল পার্থক্য। তাই সারা বছর নিয়মিত বোর্ডভিত্তিক না পড়লেও পরীক্ষার দু’ মাস আগে সে-রকম পড়া শুরু করতাম।
<>একাদশ শ্রেণির স্কুল ফাইনালে স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়ে ‌৯৪ শতাংশ নিয়ে দ্বাদশে উঠি। এরপরে সামনে ছিল আমার জীবনে প্রথম বোর্ড পরীক্ষা উচ্চমাধ্যমিক। টেস্টের পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক অবধি এই সময়টায় পুরো বিষয়টা রপ্ত করেছিলাম—কীভাবে লিখলে ফুল মার্কস পাওয়া যায়, ল্যাঙ্গুয়েজ সাবজেক্টে কীভাবে লিখতে হয় এগুলো। টেস্টের পর থেকে শিক্ষকরা আলাদাভাবে আমাদের এগুলো নিয়ে বলতেন। টেস্ট পেপার করতে হয়েছিল পুরোটা। প্রশ্নের বিশ্লেষণধর্মী উত্তর, সূত্রের প্রমাণ—এই সমস্ত লিখে অনুশীলন করে রপ্ত করতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

ক্লাসরুম: উচ্চ মাধ্যমিকে দশের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না, তবে মন বলছিল—আমি পারব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

যত মত, তত পথ, পর্ব-২: গুরুমশায় শ্রীরামকৃষ্ণ

কিছু বোর্ড ভিত্তিক মক টেস্ট নেওয়া হয়েছিল স্কুল থেকে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে মোট ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে রাজ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করি। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে নম্বর প্রথমে কম এলেও শিক্ষকদের পরামর্শ ও নিয়মিত চর্চার কারণে সেগুলিতে ভালো নম্বর আসে (রসায়ন ৯৮, পদার্থবিদ্যা ৯৯)।
<>পরীক্ষা আশানুরূপ দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু প্রথম দশে আসবো ভাবিনি। প্রথমবার যখন নিজের নামটা শুনি তখনই আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার এই সাফল্যের পিছনে আমার মায়ের ভূমিকাকে সত্যিই ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। দশ বছর আগে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। সেই থেকে মা-ই আমার মা-বাবা উভয়ই। নিজের সমস্ত কিছু দিয়ে তিনি আমাকে এই জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর এই ঋণ কোনওদিন পরিশোধ করা যাবে না।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১২: বিষম কালা ধুইলে ছাড়ে না

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ

রেজাল্ট শুনে মায়ের মুখের হাসি আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয় আমার জীবনে একটা খুব বড় জায়গা অধিকার করে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে সুদীর্ঘ আটটি বছর কাটিয়েছি এখানে। এখানের হেডমাস্টার মহারাজ, শিক্ষক, ভবন শিক্ষকরা—সবাই সাহায্য করেছেন আমাকে। আর আমার বন্ধুরা যারা আমার অনুপ্রেরণা, আমার সুখ-দুঃখ, আমার বাড়ির বাইরে আরেকটি পরিবার, তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা আমাকে বেশি আকৃষ্ট করতো। সব খেলেই আমার ভালো লাগে, তবে ক্রিকেটই সব থেকে বেশি পছন্দ করি।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৩: কানে ব্যথা? তেল দেবেন কি?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

এরপরে সর্বভারতীয় মেডিকেল পরীক্ষা ৭ মে অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মোট ৬৭৩ নম্বর পেয়ে সর্বভারতীয় ২৪০১ র্যা ঙ্ক করি, যা ছিল স্বপ্ন পূরণের আরেক ধাপ। সবশেষে, মূলত প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার উপরে জোর দিয়েও উচ্চমাধ্যমিকে বছরের পর বছর ভালো ফল করা নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি বড় সাফল্য, যার জন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবার থেকে আলাদা, সর্বশ্রেষ্ঠ। আর আমি সেই স্কুলের একজন ছাত্র হয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করি।
* অভিরূপ পাল, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭তম স্থান অধিকারী।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content