মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে রাত্রিবাস করলেন ভরত। মহর্ষির অগ্নিহোত্র যাগ সবেমাত্র সম্পন্ন হয়েছে। ভরতের সম্মুখে স্বয়ং ভরদ্বাজ ঋষি। অতিথি ভরতের সুখনিদ্রা হয়েছে কি না। অতিথি সৎকার মনোমত হয়েছে তো? মহর্ষি ভরদ্বাজের এমন সব উদগ্রীব প্রশ্ন।

মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে রাত্রিবাস করলেন ভরত। মহর্ষির অগ্নিহোত্র যাগ সবেমাত্র সম্পন্ন হয়েছে। ভরতের সম্মুখে স্বয়ং ভরদ্বাজ ঋষি। অতিথি ভরতের সুখনিদ্রা হয়েছে কি না। অতিথি সৎকার মনোমত হয়েছে তো? মহর্ষি ভরদ্বাজের এমন সব উদগ্রীব প্রশ্ন।
পঞ্চ পাণ্ডবের দাম্পত্যজীবনে একমাত্র ধর্মপত্নী দ্রৌপদী। পত্নীকে কেন্দ্র করে ভাইদের মধ্যে যাতে বিরোধ না হয় তাই, মহর্ষি নারদের নির্দেশে, তাঁরা স্থির করলেন, দ্রৌপদী এক বৎসর কাল এক একজন ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করবেন। সেই সময়ে অন্য কোন ভাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। এ নিয়মের অন্যথা হলে, শাস্তি, বার বৎসরের ব্রহ্মচর্য ও বনবাস।
মহর্ষি ভরদ্বাজ, তাঁকে আতিথ্যগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। দরিদ্র আশ্রমবাসী মহর্ষির আতিথিসৎকারের সামর্থ্য আছে কি না, এ বিষয়ে হয়তো ভরতের সন্দেহ আছে, সেই দ্বিধা দূর করলেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। তিনি জানেন, প্রীতিময় ভরত, যে কোন অল্প বস্তুতেই সন্তুষ্ট। ঋষি ভরদ্বাজ ভরতের সৈন্যবাহিনীকে ভোজনদানে আপ্যায়িত করতে ইচ্ছুক। ভরত যেন সেই ইচ্ছা পূরণ করেন।
একদিন পঞ্চ পাণ্ডবভাইদের উপস্থিতিতে হাজির হলেন দেবর্ষি নারদ। সশ্রদ্ধ যুধিষ্ঠির দেবর্ষিকে নিজের সুন্দর আসনটি দিলেন, তার ওপরে নিজের কৃষ্ণমৃগচর্মটি বিছিয়ে উপবেশন করলেন নারদ। যুধিষ্ঠির তাঁকে যথোচিত অর্ঘ্যাদি সম্মান প্রদর্শন করে,নিজের রাজ্য উপহার দিতে চাইলেন। তৃপ্ত মহর্ষি সন্তুষ্টচিত্তে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে যুধিষ্ঠিরকে কাছে বসালেন এবং দ্রৌপদীকে ডেকে পাঠালেন সেখানে।
বনবাসী জ্যেষ্ঠ রামকে ফিরিয়ে আনতে চলেছেন কুমার ভরত। পথে রামের সখা নিষাদরাজ গুহর সঙ্গে সাক্ষাৎ। নিষাদপতির মনে সন্দেহের জটিলতা। এই সশস্ত্র ভরত, হয়তো রামের কারণে, নিষাদরাজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবেন। নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে, তিনি ভরতের সাক্ষাতে নিজের আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। গুহর সমস্ত আশঙ্কা দূর করলেন ভরত।
আলিঙ্গনাবদ্ধা, কমলনয়না দ্রৌপদীর স্পর্শে যেন এক অশুভ ইঙ্গিত। গান্ধারীর মনে হল, এই পাঞ্চালীই হবেন আমার পুত্রদের মৃত্যুর কারণ। পরিষ্বজ্যৈব গান্ধারী কৃষ্ণাং কমললোচনাম্। পুত্রাণাং মম পাঞ্চালী মৃত্যুরেবেত্যমন্যত।। সুবলকন্যা গান্ধারী, সুচিন্তিত, যুক্তিসঙ্গত, সিদ্ধান্ত জানালেন বিদুরকে। আপনার যদি রুচিকর মনে হয় তবে, অন্যতম, লগ্ন, নক্ষত্র এগুলির যোগে শুভ তিথিতে সমস্ত উপকরণ সহযোগে, দেবী কুন্তীকে, বধূমাতা রাজপুত্রীসহ, পাণ্ডুর আলয়ে সত্বর নিয়ে যান।
বনবাসী রামের সন্ধানে ভরতের যাত্রাপ্রস্তুতি সম্পূর্ণ হল। ভোরবেলায় শয্যা ত্যাগ করেই ভরত, উত্তম রথে আরোহণ করে, রামের দর্শনলাভের ইচ্ছায় যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সম্মুখবর্তী অশ্বযুক্ত সূর্যতুল্য রথে, চললেন মন্ত্রী ও পুরোহিতগণ। নয় সহস্র সুসজ্জিত হাতি ইক্ষ্বাকুকুলনন্দন ভরতের অনুগমন করল। ষাট সহস্র রথে,ধনুক ও নানা অস্ত্রধারী যোদ্ধারা যশস্বী সত্যসন্ধ ভরতের সহযাত্রী হলেন। শত সহস্র অশ্বারোহী সেনা, সত্যপ্রতিজ্ঞ জিতেন্দ্রিয় ভরতকে অনুসরণ করলেন।
দুর্যোধনের পরিকল্পিত চক্রান্ত ও বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে পাণ্ডবদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে তাঁদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার পন্থায় কর্ণের মোটেই আস্থা নেই। কর্ণের প্রস্তাব ছিল—চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে সোজাসুজি দ্রুপদরাজ্য আক্রমণ এবং পাণ্ডবদের দ্রুত নিজেদের রাজ্যে এনে তাঁদের বশে আনা। সন্তুষ্ট প্রৌঢ় রাজা ধৃতরাষ্ট্র প্রাজ্ঞ,বিজ্ঞ স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শগ্রহণে আগ্রহী।
রাজা দশরথের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। চতুর্দশ দিবসে রাজার কর্মসহায়ক মন্ত্রীরা সকলে মিলিত হয়ে ভরতকে বললেন, মন্ত্রীদের মাননীয় রাজা দশরথ। তাঁর গুরুত্ব গুরুর থেকেও বেশি। জ্যেষ্ঠ রাম ও মহাবীর লক্ষ্মণকে নির্বাসিত করে, রাজা আজ প্রয়াত হয়েছেন। নেতৃত্বহীন রাজ্যে কোন অপরাধমূলক কাজ এ পর্যন্ত ঘটেনি। হে মহাযশস্বি রাজনন্দন, আপনি আমাদের রাজা হন।
পঞ্চপাণ্ডব এখন বিবাহিত। বৈবাহিক সম্পর্কে তাঁরা দ্রুপদরাজের জামাতা। এ খবর অপরাপর রাজবৃন্দের কানে গেল, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুর্যোধন, তাঁর ভায়েরা, বন্ধু কর্ণ এবং তাঁর সমর্থকরা সকলে শুনলেন। শৈশব থেকেই যাঁরা পাণ্ডবদের প্রতি ঈর্ষাকাতর তাঁরা পাণ্ডবদের এই সৌভাগ্যের বৃত্তান্ত জেনে, যথারীতি বিষণ্ণ হলেন।
পিতার মৃত্যু ও জ্যেষ্ঠ রাম ও সীতা, লক্ষ্মণের বনবাস এবং তার কারণ জেনে, কৈকেয়ীপুত্র ভরত, শোকে বিধ্বস্ত ও উত্তেজিত হলেন। বাগ্বিশারদ, ঋষি বশিষ্ঠ ভরতকে সান্ত্বনা দিলেন। হে রাজপুত্র মহাযশস্বি ভরত, শোকার্ত হয়ো না। সময় হয়েছে। নৃপতি দশরথের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন কর। অলং শোকেন ভদ্রং তে রাজপুত্র মহাযশঃ। প্রাপ্তকালং নরপতে কুরু সংযানমুত্তমম্।।
পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর বিবাহ, মহাসমারোহে, সম্পন্ন হল। মহর্ষি ব্যাসদেব ছিলেন পাণ্ডবদের বল ও ভরসা। এই কারণে, দেবতাদের থেকেও তাঁদের ভয় ছিল না। প্রাসাদে, দ্রুপদরাজের মহিষীরা পর্যন্ত নিজেদের নামোল্লেখ করে, প্রত্যেকে, পাণ্ডবমাতা কুন্তীর পদবন্দনা করতেন। কৃষ্ণা পাঞ্চালী, ক্ষৌম বসন পরিধান করে, মাঙ্গলিক কাজ সম্পন্ন করলেন।
মা, রানি কৈকেয়ীর প্রতি, কুমার ভরতের, ভর্ৎসনা ও অভিযোগের যেন শেষ নেই। তিনি, জননীকে তিরস্কারের পর তিরস্কার করে চললেন। ক্রোধান্বিত ভরত, তিক্ত ভাষায় বললেন, এ রাজ্য থেকে দূর হও রে, নির্মম, দুরাচারিণী কৈকেয়ি, ধর্ম তোমার সাহচর্য ত্যাগ করেছে, ওই মিথ্যে চোখের জল আর ফেল না।
যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্ত—দ্রৌপদী পঞ্চ পাণ্ডবের ধর্মপত্নী হবেন। যুধিষ্ঠিরের স্থির প্রত্যয়, ন মে বাগনৃতং প্রাহ নাধর্ম্মে ধীয়তে মতিঃ। তাঁর কথা মিথ্যা হবার নয়, তার বুদ্ধিও ধর্মবিরুদ্ধ নয়। যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মা কুন্তী সম্পূর্ণভাবে একমত। জননীর নির্দেশ—অর্জিত সামগ্রী পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে নাও। দ্রুপদরাজ পড়েছেন ধর্মসঙ্কটে।
মাতামহের রাজ্য থেকে ভরত অযোধ্যায় এসেছেন, পিতার ভবনে। সেখানে পিতার দর্শন না পেয়ে গেলেন মাতার আলয়ে। প্রবাসী পুত্রকে দেখে আনন্দে আত্মহারা কৈকেয়ী তাঁর স্বর্ণময় আসন ত্যাগ করলেন। ধার্মিক ভরত, দেখলেন তাঁর নিজভবন শ্রীহীন। সেখানে প্রবেশ করে, তিনি মায়ের শ্রীচরণ স্পর্শ করলেন। রানি কৈকেয়ী ভরতকে স্নেহভরে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর মাথার ঘ্রাণ নিয়ে ঠাঁই দিলেন নিজের কোলে।