সেই বিখ্যাত মুহূর্ত।
অগ্রদূত গোষ্ঠীর হাতেই সুচিত্রা-উত্তম রোম্যান্টিক জুটির সার্থক প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে। এই গোষ্ঠী এই জুটিকে নিয়ে অনেক ছবি করেছে। তার মধ্যে একটি ছবি হল ‘পথে হল দেরি’। একেই প্রথম বাংলা রঙিন ছবি বলা যেতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রঙিন বাংলা ছবি। ‘পথে হল দেরি’ ছবির আউটডোর শুটিং হয়েছিল দার্জিলিংয়ে।
সুচিত্রা সেন এবং উত্তম কুমার উঠেছেন মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে। আর ইউনিটের বাকি সকলে উঠেছেন স্নো ভিউ হোটেল। অগ্রদূত গোষ্ঠীর বিভূতি লাহা ও যতীন দত্ত ছিলেন। এছাড়া ছিলেন বিভূতি লাহার দুই সহকারী অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এবং সলিল দত্ত। যাঁরা পরবর্তীকালে বিখ্যাত পরিচালক হয়ে উঠেছিলেন। আউটডোর লোকেশনে যাওয়ার পর বৃষ্টির জন্য প্রথম দু’দিন কোনও কাজই করা যায়নি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামী দিবানাথ সেন এবং কন্যা মুনমুন সেন। দিবানাথ সেন একটি ৮ মিলিমিটারের মুভি ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে সকলের ছবি তুলে রাখছিলেন।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য
একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু গিয়েছিলেন। বিকেলে এভারেস্ট হোটেলের নিচের রাস্তায় যেখানে শুটিং হবে, সেখানে সুচিত্রা সেনকে আসতে দেখে বন্ধুটি হঠাৎ ‘ওয়েট প্লিজ’ বলে স্টিল ক্যামেরায় ফটাফট সুচিত্রা সেনের ছবি তুলতে লাগলেন। সুচিত্রা সেন তো হতবাক। বললেন, “এ কি আমাকে না জানিয়ে এ ভাবে ছবি তুললেন কেন? একবার অন্তত বলা উচিত ছিল। আর এরকম করবেন না”। সেই বন্ধুটি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। তিনি ক্যামেরা খুলে নেগেটিভ রোলটাকে ফর ফর করে টেনে বার করে গটগট করে হোটেলের দিকে ঢুকে গেলেন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই
ওই ঘটনার কথাটা যথারীতি উত্তম কুমারের কানে গিয়েছিল। পরের দিন শুটিংয়ে উত্তম কুমারের কিছু সোলো শট নেওয়া হচ্ছে। দিবানাথ সেন যথারীতি তাঁর মুভি ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। হঠাৎ উত্তমকুমার বিভূতি লাহাকে বললেন, “দাদা আপনার শুটিংয়ের সময় অন্য কেউ যেন মুভিতে ছবি না তোলেন”। কথাটা শুনতে পেলেন দিবানাথ সেন। তিনি তখনই ক্যামেরাটা নিয়ে শুটিং জোনের বাইরে চলে গেলেন। অনেকেই আশঙ্কা করতে লাগলেন পরিস্থিতি আবার জটিল হয়ে উঠবে না তো।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৭: সাধারণের প্রতি পাণ্ডবদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ কোন মহাভারতীয় শিক্ষা?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি
পরের দিন ভাইফোঁটা। এই উপলক্ষে নির্দিষ্ট কয়েকজনকে সুচিত্রা সেন নেমন্তন্ন করলেন। বিভূতি লাহা ও যতীন দত্ত আলোচনা করে বললেন, “ইউনিটের অনেকেই যখন এই নেমন্তন্ন পাননি তখন আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে না।” যতীন দত্ত সুচিত্রা সেনকে বললেন, “এটা উচিত কাজ হবে না”। এ বার পরের দিন দেখা গেল আরেক নাটক। সকালে এভারেস্ট হোটেল থেকে স্নো ভিউতে খবর এলো উত্তম কুমার করবেন ‘ভগিনী দ্বিতীয়া’। ইউনিটের সকলের নেমন্তন্ন তাঁর হোটেলে। বেশ মজার ব্যাপার। অবশ্য সুচিত্রা সেন এবং উত্তম কুমারের মধ্যে এই যে ঝামেলাটা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে আবার ভাব হল কিন্তু ছোট্ট মুনমুন সেনকে কেন্দ্র করেই।
যথারীতি সুচিত্রা-উত্তমের জনপ্রিয় ছবিগুলির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ‘পথে হল দেরি’। এই ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানগুলি যা রয়েছে সুচিত্রা সেনের লিপে, তা আজও শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে চলেছে। সেই তালিকায় রয়েছে, “এ শুধু গানের দিন”, “তুমি না হয় রহিলে কাছে” প্রভৃতি গান। আজ ৬ এপ্রিল মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মদিন। জন্মদিনে মহানায়িকার উদ্দেশে রইল শ্রদ্ধা।—চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।