বিমল করের বিখ্যাত উপন্যাস ‘যদুবংশ’-এর চিত্ররূপ দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী। তিনি একইসঙ্গে সেই ছবির চিত্রনাট্যকার সংলাপ রচয়িতা এবং পরিচালক ও সংগীত পরিচালকও বটে। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে শুটিং চলছে। একদিনের ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। পরিচালকেরা সাধারণত ‘অল লাইটস’ বলে হাঁক দিলে লাইটসম্যানরা সবাই লাইট জ্বালাবে।
সত্তরের দশকের গোড়ায় কাঠের পাঠাতনের উপর দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতেন লাইটসম্যানরা। পরিচালকের নির্দেশ মতো সুইচ অন অফ করতেন। কালী নামের যে লাইটসম্যান উপর থেকে কাজ করছিলেন তিনি পার্থপ্রতিমের হাঁক শোনার পরেও ভুলে গেলেন লাইট জ্বালাতে। সেটি কিন্তু লক্ষ্য করলেন অভিনেতা উত্তম কুমার। শটটা খুব ভালো মতনই টেক করা হয়ে গেল। তিনি কালীকে ডেকে পাঠালেন তাঁর মেকআপ রুমে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কালী এসেছেন। সাধারণত কালীর কাছ থেকে বিড়ি নিয়েও খেতেন উত্তম কুমার। সেই কালীকে হঠাৎ মেকআপ রুমে কেন ডাকলেন?
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৭: গাড়ি থেকে নেমেই ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘তোদের ছবির নামই তো পথে হল দেরি’
স্মরণে-বরণে উত্তম: নিঃসঙ্গ মহানায়ক
কালী মেকআপ রুমে ঢোকার পর উত্তমকুমার জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছে রে কালী তুই একটু অন্যমনস্ক ছিলিস”। কালী ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, “মেয়ের বিয়ে। কিন্তু পণের টাকা এখনও জোগাড় করে উঠতে পারিনি”। উত্তমকুমার বললেন, “কত টাকা?” কালী জবাব দিলেন, “৫০০০ টাকা”। আজকের দিনে হয়তো কিছু নয়, কিন্তু তখনকার দিনে (৭০ দশকের গোড়ায়) পাঁচ হাজার টাকা অনেক টাকাই বটে। তিনি পার্থপ্রতিম চৌধুরীর সহকারী বিমল দে’কে নির্দেশ দিলেন পরের দিন কালীকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসতে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়
তার আগে কালীর হাতে ৫০০০ টাকা ভরা একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। সেই টাকা পেয়ে কালী কৃতজ্ঞতায় আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। এমনই মহানুভব ছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু কালীকে তিনি বলেছিলেন এ কথাটা কাউকে না বলতে।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৪: টলস্টয় ও সোফিয়া—‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’/৪
এমন নীরবে উত্তমকুমার কত মানুষের কত লোকের যে উপকার করে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। “শিল্পী সংসদ” প্রতিষ্ঠা তো দুঃস্থ শিল্পীদের জন্যই উত্তমকুমার করে গিয়েছেন। সেই উত্তম কুমারের প্রয়াণ দিবস আমরা পার হয়ে এলাম গত ২৪ জুলাই। কিন্তু এখনও যেন মনে হচ্ছে তিনি তেমনি জীবন্ত তেমনি সজীব হয়ে আছেন আমাদের মধ্যে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
‘যদুবংশ’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালের ২৯ শে মার্চ শ্রী, প্রাচী, ইন্দিরা প্রেক্ষাগৃহে। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার, অপর্ণা সেন, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সন্তোষ দত্ত, রবি ঘোষ সহ বহু বিশিষ্ট শিল্পীরা। উত্তম কুমারের অসাধারণ অভিনয় ধন্য এই ছবি। আজকের এই লেখার মধ্য দিয়ে প্রয়াত অভিনেতার উদ্দেশে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম। —চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।