উত্তমকুমারের প্রযোজনায় ‘আলোছায়া’ প্রোডাকশনের ব্যানারে নির্মিত হতে চলেছিল ‘সপ্তপদী’। কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল কাহিনিতে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভালোবাসার পুরুষ নারীর মধ্যে মিলন লেখক রাখেননি। পুরুষটি হলেন কৃষ্ণেন্দু। যে চরিত্রের শিল্পী হলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। আর নারী রিনা ব্রাউন। যে চরিত্রের শিল্পী হলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।
রিনা’র বিয়ে হয়ে যাবে তাঁর প্রেমিক ক্লিটনের সঙ্গে। কৃষ্ণেন্দু খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে কৃষ্ণস্বামী হয়ে আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার ফল হিসেবে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত এমন গল্প দর্শকদের ভালোলাগার কথা নয়। ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার মিল নেই। অথবা উত্তম কুমারের কুষ্ঠ রোগ হয়েছে তা দর্শকেরা কখনওই ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারবেন না। তাহলে উপায় কী?
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৭: উত্তমের প্রশ্নে মজাদার জবাব ভানুর, হাসির বন্যা বয়ে গেল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো ফ্লোরে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’
পরিচালক অজয় করের পরামর্শ মতো চিত্রনাট্যকার বিনয় চট্টোপাধ্যায় রোজ চিত্রনাট্য নিয়ে ঘষামাজার কাজ করতে শুরু করে দিলেন। তাঁকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন অজয় করেন প্রধান সহকারী হীরের নাগ। যিনি পরবর্তীকালে নিজেও খুব বিখ্যাত পরিচালক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। যাঁর হাতে আমরা পেয়েছি ‘থানা থেকে আসছি’, ‘সাবরমতী’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘প্রিয় বান্ধবী’র মতো সব স্মরণীয় ছবি। বিনয় চট্টোপাধ্যায় ও হীরেন নাগের সম্মিলিত প্রয়াসে যে চিত্রনাট্য লেখা চলত, সন্ধ্যায় অজয় করের কাছে তা পেশ করা হতো। তিনি সম্মতি দিলে আবার পরের দিনে কাজ এগোত।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার
চিত্রনাট্য এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল যে ছবি হিসেবে ‘সপ্তপদী’ যখন মুক্তি পেল, দর্শকের ঢল নামলো প্রেক্ষাগৃহগুলিতে। চিত্রনাট্য অনুসারে ছবির শেষে দেখা যাচ্ছে যে, কৃষ্ণেন্দু এবং রিনা ব্রাউন দু’জনেই মিলিত হতে পেরেছেন। তাঁদের প্রেম সেখানে সার্থক হয়েছে। বোঝা গেল যে ধর্ম নয়, প্রেমই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।
ছবিটি পুজোর সময় মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬১ সালে রূপবাণী, অরুণা, ভারতী প্রেক্ষাগৃহগুলিতে। নির্মাণ পর্বে এই যে ঘটনার কথা আপনাদের পেশ করলাম, সে কথা আমাকে জানিয়েছিলেন পরিচালক হীরেন নাগ। কলকাতা দূরদর্শনে ‘ক্লোজআপ’ অনুষ্ঠানে যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তখন। এই ছবিতে সুচিত্রা উত্তম তো রয়েছেন মুখ্য ভূমিকায়। এছাড়াও ছিলেন ছবি বিশ্বাস, পদ্মা দেবী, ছায়া দেবী, তরুণ কুমার, মিন্টু দাশগুপ্ত, সীতা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা। ছবি সুরকার হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো” তা চিরদিনের গান হয়ে রয়েছে বাঙালির অন্তরে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।